আয়বণ্টন

আয়বণ্টন  দেশের সকল ব্যক্তি ও পরিবারের মধ্যে মোট  জাতীয় আয় বিভাজনের ধরন। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত আয়ের মধ্যে পার্থক্যের ফলে সৃষ্ট আয়বৈষম্য ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনাই সরকারের আয়বণ্টন নীতিমালার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হওয়া কাম্য। বাজার অর্থনীতিতে আয় সাধারণত ৩ প্রকার হয়ে থাকে। প্রথমত, আত্ম-কর্মসংস্থান থেকে অর্জিত আয়ের অংশবিশেষসহ শ্রমজীবী মানুষের আয়; দ্বিতীয়ত, ঋণ ও বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত সুদ, ভূমি ও যন্ত্রপাতি থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ও ভাড়াসহ মালিকানাধীন পরিসম্পদসমূহ থেকে প্রাপ্ত আয়; এবং তৃতীয়ত, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অর্জিত আকস্মিক মুনাফা এবং বিবিধ আয়। চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে নির্ধারিত মূল্যস্তর, মজুরি, ভাড়া, সুদ, মুনাফা এবং সম্পদের বণ্টন পদ্ধতির ওপর জাতীয় আয়ের বণ্টন নির্ভর করে। আয়বণ্টনকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও চূড়ান্ত এ তিন পর্যায়ে পরিগণনা করা হয়। উৎপাদনশীল কার্যাবলি থেকে অর্জিত আয়ের বণ্টনই হচ্ছে প্রাথমিক আয়বণ্টন। কর পরিশোধ এবং সরকার কর্তৃক সামাজিক নিরাপত্তা-সংক্রান্ত ভাতা বা সুবিধাদি বিতরণের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় দ্বিতীয় পর্যায়ের আয়বণ্টন। তৃতীয় পর্যায়ের আয়বণ্টন ব্যবস্থা দ্বিতীয় পর্যায়ের আয়বণ্টনের পরিবর্তিত ও উন্নীত রূপ। এ পর্যায়ের আয়বণ্টন বাজারদর নিয়ন্ত্রণ, সরকারি দ্রব্য ও সেবাদির জন্য সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি জাতীয় সরকারি খাতের কার্য দ্বারা সম্পন্ন হয়।

আয়বণ্টন ব্যবস্থাকে আবার আয়ের উৎস এবং আয়ের মালিক এ দু বিবেচনায়ও ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। উৎপাদনের উপকরণ তথা ভূমি, শ্রম, মূলধন ও সংগঠনের উৎপাদনশীলতার ভিত্তিতে আয় বণ্টিত হলে তাকে আয়ের উৎসভিত্তিক আয়বণ্টন হিসেবে গণ্য করা হয়। অপরপক্ষে, আয়ের মালিককে মানদন্ড হিসেবে নিলে, আয় ব্যক্তিবিশেষ এবং পরিবার এ দু শ্রেণির সামাজিক এককের মধ্যে বণ্টিত হয় বলে ধরা যায়।

বিশ্বের অনেক দেশের অনুরূপ পারিবারিক আয় এবং ভোক্তা ব্যয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত গিনি সূচকের মাধ্যমে বাংলাদেশেও আয়বণ্টন পরিমাপের একটি পরোক্ষ পদ্ধতি প্রচলিত আছে। এ উদ্দেশ্যে  পরিবার অর্থ একটি আবাসিক ইউনিট, যেখানে এক বা একাধিক ব্যক্তি একত্রে বসবাস করে এবং সাধারণত একই খানায় বা চুলায় একত্রে আহারাদি গ্রহণ করে। অপরদিকে, কিছুসংখ্যক ব্যক্তি একই বাসস্থানে বসবাস করলেও খানা পৃথক হলে প্রত্যেক খানার সদস্যদের এক-একটি পৃথক পরিবার বলে গণ্য করা হয়। হাউজহোল্ড বা পরিবারের আয়ের উপাদানগুলি হচ্ছে, ক. মজুরি ও বেতনাদি থেকে আয়, পেনশন এবং পরিবারের সদস্যগণ কর্তৃক অর্জিত ও প্রাপ্ত অনুদান, পেশাগত ফি-সমূহ; খ. দ্রব্য বা সেবাদির বিনিময়ে পরিবারের সদস্য বা সদস্যগণ কর্তৃক প্রাপ্ত ও অর্জিত নগদ অর্থ বা পরিসম্পদ; গ. পরিবারের সদস্যগণ কর্তৃক প্রাপ্ত বা অর্জিত সুদ-আয় ও লভ্যাংশ এবং কৃষি, বাণিজ্য, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য অর্জিত আয়, ভাড়া, উপহার, আর্থিক সাহায্য, বীমাসুবিধা এবং বীমাদাবির অর্থ; ঘ. অন্যান্য প্রাপ্তিসমূহ। হাউজহোল্ড বা পারিবারিক ব্যয়ের মধ্যে ভোগজনিত ব্যয় ও অন্যান্য খরচাদি অন্তর্ভুক্ত হয়। ভোগ-ব্যয় দ্বারা একটি পরিবারের প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও সেবাদির মূল্য বোঝায়। অন্যান্য ব্যয়ের মধ্যে থাকে  আয়কর ও অন্যান্য কর, ফি, পেনশন, সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত অবদান, ইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম, উপহার এবং অন্যান্য হস্তান্তর ব্যয়।

১৯৬৩-৬৪ এবং ১৯৮১-৮২ সালে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্য পরিমাপকৃত পারিবারিক আয়ের গিনি সূচক ছিল যথাক্রমে ০.৩৩ ও ০.৩৭। সময়ের ব্যবধানে পৌর ও পল্লী এলাকার গিনি সূচকে পার্থক্য আরও বৃদ্ধি পায়। পারিবারিক আয়ের হিসেবে ১৯৬৬-৬৭ সালে পৌর ও পল্লী এলাকার গিনি সূচক ছিল যথাক্রমে ০.৩৯৯ ও ০.৩৩৪। ১৯৯৫-৯৬ সালে পৌর ও পল্লী এলাকার গিনি সূচক ছিল যথাক্রমে ০.৪৪৪ ও ০.৩৮৪। ১৯৮০-র দশকের শেষ অবধি বাংলাদেশে আয়ের গিনি সূচক এবং ভোগ-ব্যয়ের পার্থক্য অনেক কমে আসে। মূলত সঞ্চয়ের নিম্নহার, অংশত আয়ের ঊনপ্রাক্কলন এবং ভোগ-ব্যয়ের অধিপ্রাক্কলনের ফলেই এ পার্থক্যের মাত্রা এমন ন্যূনতম পর্যায়ে চলে আসে।

১৯৯০-এর দশকে বাংলাদেশে আয়বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৫-৯৬ সালে দেশের সর্বোচ্চ আয়ের ৫% পরিবার ছিল দেশের মোট আয়ের ২৩.৬২%-এর মালিক। ১৯৯১-৯২ সালে দেশের মোট আয়ে তাদের অংশ ছিল ১৮.৮৫% এবং ১৯৮৩-৮৪ সালে তা ছিল ১৮.৩০%। একই সময়ে মোট আয়ে দেশের সর্বনিম্ন আয়ের ৫% পরিবারের অংশ ১৯৯৫-৯৬ সালে ছিল ০.৮৮%, ১৯৯১-৯২ সালে ১.০৩% এবং ১৯৮৩-৮৪ সালে ১.১৭%। ১৯৯৫-৯৬ সালে মোট আয়ে সর্বনিম্ন আয়ের ১০% পরিবারের আয়ের অংশ ছিল ২.২৪% এবং সর্বোচ্চ আয়ের ১০% পরিবারের অংশ ছিল ৩৪.৬৮%।

কাজের সীমিত সুযোগ, লৈঙ্গিক বৈষম্য, জ্ঞান ও দক্ষতাবৃদ্ধির সুযোগের অভাব, শিক্ষার বৈষম্যপূর্ণ সুযোগ ও নীতি এবং বিশেষত ভূমির অসম বণ্টনের ফলে বাংলাদেশে আয়বণ্টনে বৈষম্য এবং চরম  দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আয়বণ্টনের বৈষম্য ক্রমবর্ধমান হলেও বিভিন্ন প্রকারের উচ্চ ফলনশীল শস্যের উৎপাদন এবং সরকার ও  এনজিওদের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির ফলে ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশের দারিদ্র্যাবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। জনপ্রতি দৈনিক ক্যালরি গ্রহণের ভিত্তিতে দরিদ্র ও চরম দরিদ্র জনসংখ্যার যে হিসাব করা হয় তদনুযায়ী ১৯৯৫-৯৬ সালে দরিদ্র ও চরম দরিদ্র লোকসংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪৭.৫% ও ২৫.১% এবং ১৯৮৩-৮৪ সালে তা ছিল যথাক্রমে ৬২.৬% এবং ৩৬.৮%।

১৯৭০-৮১ সময়ে বাংলাদেশে জিডিপি এবং আয়বৈষম্য বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৪.১% ও ০.৩৭%। আর্জেন্টিনায় এ হার ছিল যথাক্রমে ১.৯% ও ০.৪৩%, ফিলিপাইনে ৬.২% ও ০.৪৫%, থাইল্যান্ডে ৭.২% ও ০.৩৯%, ইন্দোনেশিয়ায় ৭.৮% ও ০.৪২%, মালয়েশিয়ায় ৭.৮% ও ০.৪৯%, ব্রাজিলে ৮.৪% ও ০.৬০% এবং মেক্সিকোতে ৬.৫% ও ০.৫২%। এ থেকে দেখা যায়, উক্ত দেশসমূহের মাথাপিছু আয় বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হারের সঙ্গে তাদের আয়বৈষম্য বৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই।

১৯৭৩-২০০০ সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি ৪০ গুণ বৃদ্ধি পেলেও দেশের আয়বণ্টনের বৈষম্য এবং দারিদ্র্য-স্তর সমানুপাতিক হারে হ্রাস পায় নি। এরপরও কিছু উন্নত ও অনুন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশের আয়বণ্টন অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভাল বলেই প্রতীয়মান হয়। ২০০০ সাল থেকে অধ্যবধি (২০১০ অর্থবছর) বাংলাদেশের প্রকৃত দেশজ উৎপাদন গড়ে বাৎসরিক শতকরা ৬ ভাগের মত বৃদ্ধি পায়। যা এর আগের দশকে অনেক কম ছিল। এ অগ্রগতি সুনির্দিষ্টভাবেই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে এবং আয় বণ্টনের মাধ্যমে জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বর্তমান দশকে উচ্চ ও নিম্নবিত্তের মানুষের মধ্যে আয় ব্যবধান বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর থানা জরিপ থেকে প্রতিভাত হয় যে বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্বাধিক আয় বৈষম্যের সম্বলিত অন্যতম একটি দেশ, যার দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও আয়বণ্টন পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে অবনতি ঘটছে। এর প্রতিফল হিসেবে আয় বৈষম্যর পরিমাণ জিনি-সূচক ১৯৯৫ সালের ০.৪৫১-এর তুলনায় বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৫ সালে ০.৪৬৭-এ দাঁড়িয়েছে। এটা ধনীদের পক্ষে অসমভাবে আয় বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। এরাই মূলত নতুন উৎপাদন ও নতুন উৎপাদন প্রক্রিয়ার সুবিধাভোগী। ২০০৫ সালের পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানাভিত্তিক জরিপের ভিত্তিতে বাংলাদেশের আয় বৈষম্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে সর্বনিম্ন শতকরা ৫ ভাগ জনগণের মোট আয়ের ২০০০ সালের শতকরা ০.৯৩ ভাগ অংশীদারিত্ব হ্রাস পেয়ে ২০০৫ সালে ০.৭৭ ভাগে দাঁড়িয়েছে। পক্ষান্তরে সর্বোচ্চ শতকরা ৫ ভাগ জনগণের মোট আয়ের অংশ হিসেবে ২০০০ সালের শতকরা ২৮.৩৪ ভাগ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০০৫ সালে শতকরা ২৬.৯৩ ভাগ নেমে আসলেও হ্রা্সের হার সর্বনিম্ন আয়ের জনগণের তুলনায় অনেক কম। শহর ও গ্রামভিত্তিক আয় বণ্টনেও এরূপ গতিধারা লক্ষণীয়। দেখা যায় সর্বোচ্চ ২০ ভাগ জনগণের মোট আয়ে অংশীদারিত্ব ২০০০ সালে ছিল শতকরা ৫২ ভাগ যা ২০০৫ সালে এসেও একই রয়ে গেছে। তবে সর্বনিম্ন আয়ের শতকরা ২০ ভাগের মোট আয়ের অংশীদারিত্ব ২০০০ সালের শতকরা ৬.১৭ ভাগ থেকে আরো হ্রাস পেয়ে ২০০৫ সালে শতকরা ৫.২৬ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য যে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বিভিন্ন এনজিওগুলো দীর্ঘদিন ধরে দারিদ্র্য বিমোচন কাজ করে আসলেও এক্ষেত্রে অগ্রগতি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। বর্তমান দশকে দেশের আয় বণ্টন প্রক্রিয়া মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের পক্ষে গেলেও দুর্ভাগ্যবশত তা নিম্নবিত্তের প্রতিকূলে যায়। সরকারি প্রচেষ্টা এবং বাজার প্রক্রিয়ার অব্যহতভাবে মধ্য ও নিম্নবিত্তের জন্য প্রান্তিক লভ্যাংশজনিত মুনাফা সৃষ্টি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে দরিদ্রদের বঞ্চিত করার ফলে এ অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। [আবুল কালাম আজাদ এবং আব্দুস সামাদ সরকার]