পরিবার

পরিবার পিতামাতা ও তাদের সন্তান-সন্ততিদের কেন্দ্র করে হতে পারে, দ্বিতীয়ত একসঙ্গে বসবাসরত আত্মীয়-স্বজন সমবায়ে একটি প্রসারিত পরিবারও হতে পারে। তৃতীয় ধরনের পরিবার হলো একটি বৃহৎ সংসার, যেখানে অন্যান্য আত্মীয় ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কিংবা তাদের ছাড়া অনাত্মীয়রাও যুক্ত হয়।

পরিবার প্রায়শ সন্তানসহ বা সন্তানবিহীন এক বা একাধিক দম্পতির ছোট সংসার নিয়ে গঠিত। এর আর্থিক ভিত্তি রয়েছে। এই ভিত্তিকে কেন্দ্র করে আত্মীয়, সামাজিক সম্পর্ক ও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে এবং ঐক্যবদ্ধ কাজের মাধ্যমে তা রূপায়িত হয়। পরিবারের বিকাশে সন্ধানযোগ্য বংশগত সম্পর্ক সাধারণত জ্ঞাতি সম্পর্কের চেয়ে অগ্রাধিকার পায়। এই শৃঙ্খলার মধ্যে সদস্যরা সমাজের আর্থিক ও সামাজিক উপপ্রথাগুলি গড়ে তোলে।

বাংলাদেশের পরিবারও রক্তসম্পর্ককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে যেকোন পরিবারের অধিকাংশই স্বামী-স্ত্রী ও তাদের অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের নিয়ে গঠিত। স্বামী ও স্ত্রী, অথবা বিবাহিত জীবনের এই দুই অংশীদারের যে-কেউ একজন সংসারের নিত্যনৈমিত্তিক কাজকর্মের চালক। পরিবার প্রধানের দিক থেকে বংশানুক্রমিক সদস্যদের মধ্যে দাদা, দাদি, বাবা, মা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ছেলের বউ, নাতি, নাত-বউ এবং নাতনি অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপভাবে, জ্ঞাতি সদস্যদের মধ্যে রয়েছে চাচা ও চাচি, চাচার ছেলে ও মেয়ে, ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী, ভাইয়ের ছেলেমেয়ে এবং এই ধারাবাহিকতায় অন্যান্যরা। বংশীয় ও জ্ঞাতিগত উভয় শ্রেণিতে পরিবার প্রধানের সকল সন্ধানযোগ্য পূর্বপুরুষ ও উত্তরপুরুষ বিগত দিনের অব্যাহত সদস্যতা এবং ঘনিষ্ঠতার পারস্পরিক অনুভবের ভিত্তিতে পরিবারের সদস্য হওয়ার স্বীকৃতি লাভ করতে পারে।

বাংলাদেশে বেশিরভাগ সমাজ পিতৃতান্ত্রিক হওয়ার ফলে বংশের পরিজনরা পিতা থেকে পুত্র ক্রমিকতায় অর্থাৎ পুরষ পরম্পরার নিম্নগামী ধারায় সংজ্ঞায়িত ও পরিচিত। পিতৃতান্ত্রিক সূত্র নববিবাহিত দম্পতিকে স্বামীর ঘরে ও সংসারে বসবাসের প্রথার সঙ্গে যুক্ত করে। এই উপপ্রথাসমূহ অনেকগুলি খন্ড রূপে প্রতিফলিত, যেমন বাড়ি (একটি উঠানকে কেন্দ্র করে বহু লোকজন নিয়ে গঠিত), পাড়া (চারদিকে অনেকগুলি বাড়ি নিয়ে গঠিত প্রতিবেশ), এবং সমাজ (ক্ষুদ্র মানবগোষ্ঠী যেখানে সাধারণভাবে সামাজিক, আর্থিক ও ধর্মীয় সুবিধাদি লভ্য)। সম্ভবত সমাজ সদস্যদের খুঁজে নেওয়া যায় কয়েকটি সাধারণ পূর্বপুরুষের বংশ-পরম্পরায়। বাংলাদেশের মানুষেরা এই বিভাজিত সংগঠনকে এক সূত্রীয় বংশগতির নিয়ম অবলম্বন করতে হয়েছিল। ব্যাপক অর্থে তারা এক একটি মুক্ত দল। বিবাহিত দম্পতির বন্ধন আত্মীয়বর্গের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত। স্বামী-স্ত্রী দুজনের যেকোন একজন আত্মীয়দের দায়দায়িত্ব বহন করে।

বাংলাদেশে পরিবারের লোকজনদের চেনা যায় একই খানা বা চুলার অংশীদার হিসেবে। একজন বিবাহিত পুরুষ ও নারী মিলিয়ে একটি সমাজ একক। তাদের সংহতি, অভিন্ন স্বার্থ ও কর্তব্য তাদের যেকোন একজনের অন্যবিধ সম্পর্কজাত দায় ও স্বার্থ থেকে অধিক পূর্বাধিকার পায়। তাদের বংশধররা পারস্পরিক স্বার্থে যুক্ত এবং বিবাদরত। পরিবারের সদস্যরা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং সম্পদ, শ্রম ও আবেগে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা জীবনের সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক দিকগুলি পরিচালনা করে।

পরিবার-প্রতিষ্ঠান দ্বারা একজনের গার্হস্থ্য জীবন গঠিত হয় সংসারের জন্য যথাযোগ্য আচরণ, স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে, অন্যান্য পোষ্য, প্রত্যেকের দায়িত্ব, সম্পত্তির উত্তরাধিকার এবং এইরকম আরও কিছু নিয়মসূত্রে। পরিবারের মধ্যে বিরাজমান পারস্পরিক ভূমিকা ও সম্পর্ক, সহযোগিতা ও বিবাদ মুসলিম এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত জ্ঞাতিবর্গের একের সঙ্গে অন্যের আত্মীয়তার প্রতিফলন ঘটায়। জ্ঞাতিত্ব বন্ধন ও অবস্থান এখন আর বাংলাদেশি পরিবারকে কোন বিশেষ ভৌগোলিক ও সামাজিক আয়তনে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখে না। পরিবার-স্থানান্তর ভৌত, সামাজিক ও আর্থিকভাবে স্থাপিত আদি পারিবারিক অধিষ্ঠান থেকে মূল পরিবারগুলিকে বিচ্ছিন্ন করতে সাহায্য করছে। স্থানত্যাগ করে একটি মূল পরিবারের নাগরিক সমাজে গমনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় আদি পরিবারে পড়ে থাকা পিতা-মাতা বা আত্মীয়স্বজনের প্রয়োজনের চেয়ে পরিবারের সঙ্গী প্রধান সদস্যদের প্রয়োজন মেটানোর অধিক প্রবণতা। যখন কোন বিবাহিত পুরুষ চাকরির প্রয়োজনে স্ত্রী ও সন্তানদের রেখে শহর বা অন্যত্র গমন করে তখন তাদের দেখাশোনার দায়িত্ব কখনও কখনও বিদেশগামীর পিতা-মাতা, ভাইয়ের বা পরিবারের অন্য সদস্যরা বহন করে। সেরকম অবস্থায় টাকা পাঠানো তাদের জন্য লাভ। যখন কোন স্থানান্তর-প্রয়াসী লোক উপার্জন করতে কিছুদিনের জন্য বেরিয়ে যায়, তখন পিতামাতা, ভাইবোন ও অন্য আত্মীয়রা সাধারণত তাকে সমর্থন করে। এই সমর্থনের প্রতিদানে স্থানান্তরকারী ব্যক্তি টাকা প্রেরণের দায় অনুভব করে।

পরিবার অপরাধ ও হিংস্রতা কমানোর শক্তিশালী মাধ্যম রূপে সামাজিকীকরণে বাস্তব ভূমিকা পালন করে। পিতৃতান্ত্রিক প্রথায় সম্পত্তির উত্তরাধিকার মূলত পুরুষ ধারায় থাকে, এবং পরিবার পিতৃশাসিত হয়। এর বাইরে মাতৃসূত্রীয় পরিবারও আছে। বাংলাদেশের গারো এবং খাসি আদিবাসীরা মাতৃসূত্রীয়।

বাংলাদেশে পরিবার একটি মৌলিক অর্থনৈতিক একক। সকল সদস্য কাজে অংশ নেয়। প্রায় অবশ্যম্ভাবী রূপে পরিবারের পুরুষ প্রধানরা ও অন্যান্য বয়স্ক পুরুষ সদস্য ফসল তুলে থাকে এবং ঘরের বাইরে আর্থিক কাজে যুক্ত হয়। সাধারণত পরিবারের মেয়েরা রান্নাবাড়া, ঘরসজ্জা, সন্তান পালন, বাড়ির বাগান পরিচর্যা, বীজ ও শস্যাদি সংরক্ষণ এবং গবাদি পশুর পরিচর্যায় অংশগ্রহণ করে থাকে। খাদ্য উৎপাদন হয় পরিবারকে ভিত্তি করে। বেশ কয়েক জোড়া স্বামী-স্ত্রী ও অল্পবয়সী সন্তানাকীর্ণ বিশাল সংসার ক্রমে এক দম্পতি ও অপরিণত ছেলেমেয়েসহ সরল, ছোট, একক পরিবারে রূপান্তরিত হচ্ছে।

সমাজ ও সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও হিতকর বলে বিবেচিত অনেক নিষিদ্ধ ব্যাপার ও বিধান পরিবারভুক্ত জ্ঞাতি সদস্যদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে। মুসলিমদের মধ্যে পাত্রপাত্রীর বিবাহ বন্ধনের ক্ষেত্রে রক্তসম্বন্ধীয়, জ্ঞাতি ও পালিত ভাই-বোন নিষিদ্ধ। হিন্দু বিয়েতে নিষেধের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে পূর্ণজ্ঞাতি সম্পর্ক, অর্ধজ্ঞাতি ও বৈপিত্রেয় সম্বন্ধ এবং পালিত সম্পর্কও। বাংলাদেশে বিয়ে প্রথাগতভাবে পরিবার কর্তৃক আয়োজিত, তবে অনেক ক্ষেত্রে বর বা কনে পছন্দ করার ক্ষেত্রে পিতামাতার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত নয়। দেশে অধিকাংশ বিয়ে একগামী এবং এটি গুরুত্ব আরোপ করে একক মূল পরিবার গঠনের ওপর।  [কে.এম.এ আজিজ]