মুন্নী বেগম

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৪৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

মুন্নী বেগম (?-১৮১৩)  সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক নিযুক্ত বাংলার নওয়াব  মীরজাফর এর অন্যতম স্ত্রী। আকবরের সমাধিস্থল সিকান্দ্রার নিকটবর্তী বলকুন্দা গ্রামে তাঁর জন্ম। দরিদ্র মা তাঁকে দিল্লির এক মহিলা নৃত্যশিল্পি বিষুর নিকট বিক্রি করে দেন। বিষু তাঁকে নৃত্যশিল্পি হিসেবে গড়ে তোলেন। বিষুর নৃত্যদলের সদস্যরূপে মুন্নী ভারতের বিভিন্ন রাজদরবার ভ্রমণ করেন। অপরূপ সৌন্দর্য এবং নৃত্যপ্রতিভার জন্য তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

ঘসেটি বেগম ও নওয়াজিশ মুহম্মদ খানের দত্তক পুত্র ইকরামউদ্দৌলার বিবাহ উপলক্ষে বিষুর নাচের দল আমন্ত্রিত হয়। সেখানে মুন্নী বেগম তাঁর সৌন্দর্য, সংগীত এবং নৃত্যশৈলীতে অভিজাতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মুর্শিদাবাদে নৃত্যশিল্পিদের অধিকতর কদর পরিলক্ষিত হওয়ায় নৃত্যদল অনুষ্ঠান শেষে সেখানেই থেকে যায়।

নৃত্যশিল্পিদের মধ্যে সবচাইতে আকর্ষণীয় ও রূপবতী মুন্নী বেগম শীঘ্রই আলীবর্দী খানএর প্রধান সেনাপতির হারেমে স্থানলাভ করেন। তাঁর তারুণ্যদীপ্ত সৌন্দর্য মীরজাফরের হূদয় জয় করে। বুদ্ধিদীপ্ত মুন্নী বেগম অচিরেই মীরজাফরের হারেমে কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে মীরজাফরের প্রথম স্ত্রী শাহ খানম ও অপর স্ত্রী বাববু বেগম ম্লান হয়ে যান।

১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৫ ফেব্রুয়ারি মীরজাফরের মৃত্যু হয়। মীরজাফরের অবর্তমানে তাঁর বিপুল সম্পদের অধিকারী হন মুন্নী বেগম। লর্ড ক্লাইভের সঙ্গে তাঁর বিশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। লর্ড ক্লাইভ মুন্নী বেগমকে সান্ত্বনা প্রদান করে বলেছিলেন যে, তিনি নিজে এবং কোম্পানির অন্যান্য কর্মকর্তারা মুন্নীকে ‘তাদের মাতা’ হিসেবে সম্মান দেবেন। মুন্নী বেগম ক্লাইভকে পাঁচ লাখ রূপি প্রদানের বিনিময়ে তাঁর পুত্র নাজমুদ্দৌলাকে মসনদে বসাতে সক্ষম হন। মুন্নী বেগম অন্দরমহলের প্রধান হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি প্রাসাদের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব পালন করতেন। প্রাসাদের কর্মচারীদের বেতন, জেনানামহলের ভরণ-পোষণ, অতিথি আপ্যায়ন এবং ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের জন্য প্রতি মাসে তাঁর মাধ্যমে প্রায় তেইশ হাজার রূপি ব্যয়িত হতো। তরুণ নওয়াবকে রাজকার্যে সহায়তা করার জন্য কোম্পানি রেজা খানকে ‘নায়েব নাজিম’ পদে নিযুক্ত করে। ধীরে ধীরে রেজা খানই প্রশাসনের সকল বিভাগের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হন। ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে নাজমুদ্দৌলার মৃত্যু হয়। এরপর মুন্নী বেগমের দ্বিতীয় পুত্র সাইফুদ্দৌলা নওয়াব হন। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের মার্চে নওয়াবের মৃত্যুর পর বাববু বেগমের পুত্র মুবারকউদ্দৌলা মসনদে আরোহণ করেন। ধীরে ধীরে মুন্নী বেগমের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাস পেতে থাকে এবং বাববু বেগম পরিপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হন।

মুন্নী বেগম কিন্তু নিজের এ অবস্থা মেনে নেননি। ইতোমধ্যে কোম্পানির সঙ্গে রেজা খানেরও সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কোম্পানি তাঁর দুর্নীতির তদন্তের জন্য কমিশন গঠন করে। তদন্তে রেজা খান দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাঁকে পদচ্যুত করা হয়।

ওয়ারেন হেস্টিংস একজন ইংরেজ কর্মচারীকে প্রশাসনিক দায়িত্বে নিয়োজিত করেন। মুন্নী বেগম পুনরায় হারেমের প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। নন্দকুমারের পুত্র রাজা গুরুদাসকে মুন্নী বেগমের ডেপুটি নিযুক্ত করা হয়। নাটোরের জমিদার রাণী ভবানী মুন্নী বেগমের জন্য ত্রিশ জন বেহারাসহ একটি পালকি প্রেরণ করেন। রাণী এ সকল বেহারার ভরণ-পোষণের জন্য মুন্নী বেগমকে ভূমি উপহার দেন।

উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের কথোপকথন হতো একটি রেশমী পর্দার অন্তরালে অবস্থানরত মুন্নী বেগমের সাথে। লর্ড ভেলেনসিয়া নামে একজন ইংরেজ কর্মকর্তার বর্ণনা হতে এ তথ্য পাওয়া যায়। তাঁর বর্ণনানুসারে, সত্তর বছর বয়স্ক মুন্নী বেগম ছিলেন খাটো ও স্থূল, গলার স্বর ছিল উচ্চ ও কর্কশ এবং কখনও কখনও তিনি ভীষণভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। তিনি হুক্কা খেতে অভ্যস্ত ছিলেন। বিত্ত ও যশের প্রতি মুন্নী বেগমের আকর্ষণ ছিল। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত কর্মচারীদেরকে কর ফাঁকি দিয়ে চোরাচালানী ও মাদক ব্যবসায় উদ্বুদ্ধ করতেন। সমসাময়িক উৎসে তাঁর উদারতার প্রমাণও পাওয়া যায়। তিনি এতিম মেয়ে এবং বিধবাদেরকে সাহায্য করতেন। কোন বন্ধুর সঙ্গে মুন্নী বেগম কখনোই প্রতারণা করেননি। গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিলে হেস্টিংস-এর কতিপয় শত্রু ছিল। তারা লন্ডনে কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স এর কাছে অভিযোগ করে যে, হেস্টিংসকে উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে মুন্নী বেগম বাববু বেগমের প্রকৃত দাবি উপেক্ষা করে তরুণ নওয়াবের অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছেন। এরপর কোর্ট অব ডাইরেক্টর্স মুন্নী বেগমকে অভিভাবকত্ব থেকে সরিয়ে দেয়।

১৮১৩ সালের ১০ জানুয়ারি সাতানববই বছর বয়সে মুন্নী বেগমের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় তিনি বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, স্বর্ণ ও মণিমুক্তা রেখে যান। তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ফোর্ট উইলিয়মে ব্রিটিশ পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং নববইবার তোপধ্বনি করা হয়। মীরজাফরের পারিবারিক সমাধিস্থলে তাঁকে সমাহিত করা হয়। [শাহরিয়ার জেড. আর ইকবাল]