আর্কাইভস

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৫:৪৬, ১৭ জুন ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

আর্কাইভস ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন সরকারি ও বেসরকারি নথিপত্র, দলিলাদি, পুরনো বিরল পুস্তকাদি, পান্ডুলিপি ইত্যাদির সংগ্রহশালা। গ্রিক ‘আর্কিয়ন’ শব্দ থেকে এর উদ্ভব, যা দ্বারা বোঝায় কোনো দফতরের আয়ত্তাধীন বস্ত্তনিচয়কে। আর্কিয়ন এসেছে ‘আর্ক’ শব্দ থেকে যা দ্বারা আবার প্রারম্ভ, উদ্ভব, সর্বময় কর্তৃত্ব, সাম্রাজ্য, ম্যাজিস্ট্রেসি, দফতর ইত্যাদি বোঝায়। ল্যাতিন ‘আর্কিভিয়াম’ এসেছে গ্রিক আর্কিয়ন শব্দ থেকে, আর ল্যাতিন থেকে এসেছে ফরাসি ল্যা-আর্কাইভ। বিভিন্ন বস্ত্তর সন্নিবেশ বোঝাতে ফরাসি থেকে ইংরেজি ‘আর্কাইভ’ শব্দটির উৎপত্তি। অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধান আর্কাইভসকে সজ্ঞায়িত করেছে এমন একটা স্থান হিসেবে যেখানে সংরক্ষণের নিমিত্ত সরকারি নথিপত্র বা ঐতিহাসিক দলিলাদি সংগৃহীত হয়। টি.আর. শ্যালেনবার্গ আর্কাইভস-এর আধুনিক সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে যে কোনো সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সেই সকল নথিপত্র যেগুলি কোনো গবেষণায় তথ্য-উপাত্ত হিসেবে প্রয়োগের উদ্দেশ্যে স্থায়ী সংরক্ষণের উপযুক্ত বলে বিবেচনা করে সেভাবে কোনো সংগ্রহশালায় রক্ষিত হয়েছে বা রক্ষণের জন্য বাছাই করা হয়েছে।

বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস, আগারগাঁও

সম্ভবত প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় আর্কাইভ জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের উদ্ভব হয় এবং মধ্যযুগেও এগুলির অস্তিত্ব বজায় থাকে। তবে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয় আধুনিক যুগে এসে, আর তখনই এগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রূপ পরিগ্রহ করে। আর্কাইভ এখন একটা দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণাগার; একটা জাতির স্মৃতিময় তথ্যের ভান্ডার। জার্মানি, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে এ প্রতিষ্ঠানের বিশেষ বিকাশ পরিলক্ষিত হয়।

ভারতীয় উপমহাদেশে সুলতানি ও মুগল আমলে মহাফেজখানা নামে অভিহিত সংরক্ষণাগারে প্রশাসনিক দলিল দস্তাবেজ ও নথিপত্র রক্ষিত হতো। তবে উপমহাদেশে ধারাবাহিকভাবে কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় ভিত্তিতে দলিল দস্তাবেজ সংরক্ষণের কাজ শুরু হয় ব্রিটিশ আমল থেকে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকার ছিল লেখনি ও রেকর্ড নির্ভর সরকার। এ সরকার প্রশাসনে বিভিন্ন বিভাগ ও শাখা সম্বলিত সচিবালয় (Secretariat) কাঠামো গঠন করে। এ বিভাগ ও অফিসসমূহে বিভিন্ন প্রকৃতির প্রচুর দলিলপত্র জমে ওঠে। ১৮৫৪ সালে ‘রেকর্ড আইন’ (Record Rules) প্রণীত হয় এবং ১৮৮৮ সালে স্বতন্ত্রভাবে ‘রেকর্ড ম্যানুয়াল’ (Record Manual) প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন সময়ে রেকর্ড ম্যানুয়ালের সংস্কার সাধন করে প্রকাশ করা হয়। সচিবালয়ের নথি ও রেকর্ডপত্র কালক্রমে বেড়ে গেলে জরুরি নথিপত্র কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগারে পাঠানোর এবং অপেক্ষাকৃত কম দরকারিগুলি বিনষ্ট করে ফেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। জরুরি দলিলপত্র সংরক্ষণের প্রয়োজনে ১৮৯১ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইম্পেরিয়াল রেকর্ড ডিপার্টমেন্ট’। ১৯১১ সালে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হওয়ায় সরকারি রেকর্ডপত্র নতুন রাজধানীতে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর ইম্পেরিয়াল রেকর্ড ডিপার্টমেন্টের নাম পাল্টে ‘ন্যাশনাল আর্কাইভস অব ইন্ডিয়া’ রাখা হয়।

১৯৪৩ সালে বেঙ্গল রেকর্ডস ম্যানুয়াল পুনর্মুদ্রণ করা হয়। এ ম্যানুয়ালে যে সকল নথিপত্র স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের জন্য বাছাইকৃত সেগুলিকে ‘A’ শ্রেণীভুক্ত করা হয়; যেগুলি ১২ বছর পর নষ্ট করে ফেলতে হবে সেগুলি ‘B’ শ্রেণীর ও যেগুলি ২ বছরের বেশি সংরক্ষণের প্রয়োজন নেই সেগুলি ‘C’ শ্রেণীর এবং যেগুলি সাথে সাথে বিনষ্ট করতে হবে সেগুলিকে ‘D’ শ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত করা হয়। তখন থেকে বাংলা প্রেসিডেন্সির নথিপত্র কলকাতায় অবস্থিত বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েটে সংরক্ষিত হতে থাকে।

বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস (NAB)  ১৯৪৭ পরবর্তীকালে আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অধীনে ন্যাশনাল আর্কাইভস অব পাকিস্তান (NAP) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫১ সালে করাচিতে। তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে এর কোনো শাখা ছিল না। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে জাতীয় আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীনে বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস (NAB) প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর কাছে এলিফ্যান্ট রোডস্থ একটা ভাড়া বাড়িতে জাতীয় আর্কাইভস-এর কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে NAB-এর অফিস এবং এর সংগ্রহরাজি ঢাকার শেরে বাংলা নগরের আগারগাঁওতে নবনির্মিত জাতীয় গ্রন্থাগার ভবনে সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত হয়। তারপর থেকে জাতীয় আর্কাইভস সেখানেই রয়েছে। ৩ এপ্রিল ২০০৬, শেরে বাংলা নগরে জাতীয় গ্রন্থাগার ভবনের নিকটবর্তী জাতীয় আর্কাইভস এর নিজস্ব ভবন উদ্বোধন করা হয়। এই নবনির্মিত অত্যন্ত আধুনিক ভবনে বর্তমানে আর্কাইভস এর সকল সংগ্রহ সংরক্ষিত আছে।

সূচনাতে বিদ্যমান আইনের আওতায় একজন সরকারি পরিচালক কর্তৃক NAB-এর প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালিত হতো। যে সকল নির্দেশনামা এবং বিধিবিধান মোতাবেক রেকর্ড সংরক্ষণের কাজ চলতো তার মধ্যে ছিল ১৯৭৬-এর সচিবালয় আদেশ; ১৯৭৫-এর রুলস অব বিজনেস (১৯৭৬-এর ২০ অক্টোবর পর্যন্ত পরিবর্তিত); ১৯৪৩-এর বেঙ্গল রেকর্ডস ম্যানুয়াল; ১৯৩৮-এর বেসামরিক নিরীক্ষাবিধি, ট্রেজারি ম্যানুয়াল, ভূমি রেজিস্ট্রেশন ম্যানুয়াল; আইন ম্যানুয়াল, আয়কর ম্যানুয়াল, সাধারণ অর্থআইন ভল্যুম ১; হাইকোর্ট আইন ইত্যাদি। সংরক্ষণের জন্য রেকর্ডগুলিকে A (স্থায়ী), B (অর্ধস্থায়ী), C (সাধারণ) এবং D (মাত্র ১ বছর সংরক্ষণ করা হবে এমন) শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা হয়।

একটি জাতীয় এবং কয়েকটি আঞ্চলিক আর্কাইভ স্থাপনের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৮৩ সালে ‘জাতীয় আর্কাইভস অধ্যাদেশ’ জারি করে। আর্কাইভস সামগ্রী চিহ্নিতকরণ, সংরক্ষণ ও ব্যবহারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে সরকারকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৮৩ সালের আর্কাইভস অধ্যাদেশ রেকর্ডপত্র সংগ্রহ সম্পর্কিত বিধিবিধান নির্ধারণ করে, কিন্তু সংগৃহীত কিংবা সংগ্রহের অপেক্ষায় রয়েছে এমন রেকর্ডসমূহের তত্ত্বাবধান সম্পর্কিত কোনো স্থায়ী আইনের নিশ্চয়তা বিধান এ অধ্যাদেশ করতে পারে নি। ফলে, স্থায়ীভাবে সংগৃহীত হওয়ার মানসম্পন্ন রেকর্ডও এখন পর্যন্ত সেগুলির উৎপত্তিস্থলেই পড়ে রয়েছে। কোনো রেকর্ডের গুরুত্ব অনুধাবন এবং সংরক্ষণ নির্ভর করে যারা এসব রেকর্ডের স্রষ্টা তাদেরই ওপর। সুতরাং ঔপনিবেশিক শাসনামলের ন্যায় কোনো রেকর্ডের চূড়ান্ত ভাগ্য এখনও তাদের একক বিচার- বিবেচনার ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস-এর প্রধান প্রধান দায়িত্ব ও কর্মকান্ড:

১.   ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন সরকারি ও বেসরকারি দলিলপত্র সংগ্রহ ও তত্ত্বাবধান;

২.   ব্যক্তিগত সংগ্রহ জোগাড় ও সংরক্ষণ;

৩.   সংবাদপত্র ও সাময়িকীসহ সরকারি প্রশাসন সংক্রান্ত  মুদ্রিত দলিল ও প্রকাশনা সামগ্রী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ;

৪.   গবেষক ও পন্ডিতবর্গের ব্যবহারের জন্য বিশেষ লাইব্রেরি গঠন;

৫.   আর্কাইভস এ সংগৃহীত সামগ্রীর নির্দেশিকা প্রকাশ;

৬.  ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব আর্কাইভস এর সদস্য হিসেবে আই সি এ-এর বিভিন্ন সদস্য ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ;

৭. ঐতিহাসিক মূল্যবান দলিলাদি উদ্ধার ও সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকে পরামর্শমূলক সেবা প্রদান; এবং

৮. দেশ-বিদেশের পন্ডিতদের গবেষণা কর্মে ন্যাব কর্তৃক বিশ্বের অন্যান্য আর্কাইভস এর নথিপত্র ব্যবহারে সহায়তা প্রদান।

সংগ্রহ জুলাই ২০০০ অব্দি জাতীয় আর্কাইভস-এ সংরক্ষিত মোট নথিপত্র ও দলিলাদির সংখ্যা ৭ লক্ষের উপর। এ সকল ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র সংগৃহীত হয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয় রেকর্ডরুম, দেশের বিভিন্ন জেলার সরকারি রেকর্ডরুম এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা থেকে। এগুলির অধিকাংশ ব্রিটিশ আমলের  বাংলা ও আসাম, পাকিস্তান আমলের পূর্ব পাকিস্তান (১৯৪৭-৭১) ও বাংলাদেশ আমলের সরকারি নথিপত্র। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহ হচ্ছে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের নথিপত্র, বিভিন্ন জেলার ডেপুটি কমিশনারদের নথিপত্র এবং জয়দেবপুরের ভাওয়ালরাজ ও ঢাকার নওয়াব পরিবারের রেকর্ডপত্র। ন্যাব সংগ্রহশালায় আরও আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ এর পুরনো বহু নথিপত্র এবং ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত বিলুপ্ত দৈনিক বাংলা এর সকল প্রকাশনা, যার মধ্যে রয়েছে সংবাদপত্র, জার্নাল ও বিভিন্ন ক্রোড়পত্র। ন্যাবে বিশেষ উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ হলো ব্রিটিশ ভারতের বাংলা সরকারের কার্যবিবরণী ও নথির ভল্যুমসমূহ, এবং এগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক লেনদেন ও পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও কার্যাবলি বিষয়ক নথিপত্রাদি। ঐগুলি ব্যতীত প্রাদেশিক গভর্নরের নেতৃত্বাধীনে নির্বাহি কাউন্সিলের পত্রাদি, আদেশাবলি, সিদ্ধান্তসমূহও রয়েছে। ওই ভল্যুমগুলিকে আদিতে Body sheets, পরবর্তীকালে Consultation Books এবং সবশেষে Proceeding Volumes বলা হতো। ওই ভল্যুমসমূহ ‘A’ ও ‘B’ এ দু’শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল।

সাধারণত নীতি নির্ধারণের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি মুদ্রিত আকারে স্থায়ী সংরক্ষণের জন্য ‘A’ প্রসিডিংস-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল, অন্য দিকে নীতি নির্ধারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হস্তলিখিত আকারে ‘B’ প্রসিডিংস-এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পরে পূর্ব-বাংলা সরকার এবং পরবর্তীকালে পূর্ব-পাকিস্তান সরকার অনুরূপভাবে দলিলপত্র সৃষ্টি এবং সংরক্ষণ করে। তবে এ সময়কালের বেশির ভাগ রেকর্ডপত্র এখনও জাতীয় আর্কাইভসে এসে পৌঁছায় নি।

বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসে দেশবিভাগের সময় পূর্ববঙ্গ সরকারের নিকট হস্তান্তরিত আসাম সরকারের (১৮৭৫-১৯৪৭) বেশ কিছু দলিলপত্র সংরক্ষিত আছে। এগুলি মূলত সিলেট জেলা ও কাছাড় অঞ্চলের দলিলপত্র। বৃহত্তর সিলেট জেলা ১৮৭৪ সালে চীফ কমিশনার শাসিত আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তখন থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত (১৯০৫ হতে ১৯১১ পর্যন্ত সময়কাল ব্যতীত) আসামের অংশ হিসেবে থাকে। সিলেটকে আসামের সঙ্গে অন্তর্ভুক্তির ফলে সিলেটবাসীর ক্ষোভ, সিলেট ও কাছাড় অঞ্চলে ব্রিটিশ আমলের উন্নয়ন কর্মকান্ড, বিশেষ করে  চা উৎপাদন ইত্যাদি বিষয়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এ দলিলপত্রে বিবৃত রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কৃষি, বিচার, রাজস্ব, স্থানীয় সরকার, গণপূর্ত, শুমারি ও সাধারণ বিভাগীয় ও নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়াদি।

ন্যাবের পুরোনো সংগ্রহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রায় বিশ হাজার ঐতিহাসিক সরকারি নথিপত্র। ঐসব নথিপত্রে রয়েছে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের অফিস থেকে প্রেরিত নথিসমূহ, কমিশনারের মাধ্যমে সরকারের সাথে জেলা পর্যায়ের অফিসসমূহের যোগাযোগ এবং সরকারের নিকট থেকে কমিশনারদের অফিস হয়ে জেলা পর্যায়ে প্রেরিত নিদের্শাবলি।

বিভিন্ন ধরনের এ সকল নথি দেশের প্রশাসনিক উন্নয়ন, সরকারের প্রধান প্রধান সিদ্ধান্তসমূহের বাস্তবায়ন এবং বিভিন্ন অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরে। এ সকল নথির কোনো কোনটা ১৮৯০-এর দশকে তৈরি এবং রাজস্ব নথি, বিচার বিভাগীয় নথি, স্থানীয় সরকার নথি ইত্যাদি শ্রেণীতে বিন্যস্ত। ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের অফিস থেকে প্রায় ৩০০০ দুর্লভ গ্রন্থও সংগ্রহ করা হয়েছে। এ সকল গ্রন্থে উনিশ এবং বিশ শতকের বাংলার প্রশাসন ও জীবনধারা বর্ণিত।

জেলা রেকর্ডগুলি বর্তমানে জাতীয় আর্কাইভস-এর সংরক্ষিত সংগ্রহশালার সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও বিরল উৎস। ব্রিটিশ আমলের ১৩টি পুরাতন জেলার, যেগুলি বর্তমানে বাংলাদেশের অংশ, প্রায় ৫০০০ ভল্যুম নথিপত্র ন্যাবে সংগৃহীত রয়েছে। এ সকল নথির কোনো কোনটি ১৭৬০ সালে সূচিত হয়ে ১৯০০ সাল পর্যন্ত পরিব্যপ্ত। বস্ত্তত, এ সকল রেকর্ডকে অষ্টাদশ, উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের বাংলার জেলাসমূহের জীবনযাত্রা প্রণালী ও অবস্থা সম্পর্কে তথ্য প্রদানকারী একমাত্র সূত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এখনও বর্তমান এ সকল রেকর্ড-এ তৎকালীন বাংলার প্রশাসনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়। বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভসে যেসব জেলা বা ডিস্ট্রিক্ট রেকর্ডস রয়েছে সেগুলি হচ্ছে: চট্টগ্রাম (১৭৬০-১৯০০), রংপুর (১৭৭৭-১৮৭৯), কুমিল্লা (১৭৮২-১৮৬৮), ঢাকা (১৭৮৩-১৮৫৯), দিনাজপুর (১৭৮৬-১৯৫১), রাজশাহী (১৭৮২-১৮৭৮), ময়মনসিংহ (১৭৮৭-১৮৬৯), বরিশাল (১৭৯০-১৮৮৭), ফরিদপুর (১৭৯৯-১৮৬৮), সিলেট (১৭৭৭-১৮৭৮), পাবনা (১৮২০-১৮৮৬), নোয়াখালী (১৮৪০-১৮৭৯) এবং যশোর (১৭৯০-১৮৬২)।

পূর্ববাংলার জমিদারদের দলিলাদি ও তৈলচিত্র সংগ্রহের প্রচেষ্টা হিসেবে NAB ঢাকার নওয়াব পরিবার ও ভাওয়াল রাজ পরিবারের প্রচুর নথিপত্র; বইপত্র, ম্যাপ ও তৈলচিত্র সংগ্রহে সমর্থ হয়েছে। ঐসব সংগ্রহকে ঊনিশ ও বিশ শতকের পূর্ব বাংলার ইতিহাসসহ জমিদারি ব্যবস্থার মূল্যবান তথ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গত ২ এপ্রিল ২০০৮ তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২৫ বছরের উর্দ্ধের মূল্যবান দলিলপত্র সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী এর মাধ্যমে জাতীয় আরকাইভসে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী অধিদপ্তরের পরিচালক জনাব ম. লতিফুর রহমান-এর নিকট ওই দিনই হস্তান্তর করেন। হস্তান্তরিত দলিলপত্রের মধ্যে রয়েছে ১৯৭১-১৯৮২ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীগণের নিয়োগ ও শপথ গ্রহণ সংক্রান্ত ৩ ভলিউম, মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক/উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকের কার্যবিবরণী (১৯৭১-১৯৮০) ১০ ভলিউম, মন্ত্রিপরিষদ বৈঠক/উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকের বিজ্ঞপ্তি ৪ ভলিউম এবং মন্ত্রিসভা বৈঠক/উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকের সার-সংক্ষেপ (১৯৭৬-১৯৮০) ৩৭ ভলিউম।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় হেড অফিস চট্টগ্রাম সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং বা সিআরবি থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু নথিপত্র সংগ্রহের জন্য সেখান থেকে বাছাই করে নথিগুলো পরে জাতীয় আরকাইভস-এ সংরক্ষণ করা হয়। ২৩ জুলাই ২০০৭ জাতীয় আরকাইভসের পরিদর্শকদল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ-এর রেকর্ডরুম থেকে পুরাতন নথিপত্র সংগ্রহ করে তা আর্কাইভস এ সংরক্ষণ করেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশ রেলওয়ে পাকশী ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজার-এর অফিসের বিভিন্ন শাখা থেকে ২ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে জাতীয় আরকাইভসের ৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ২৫ বছরের উর্দ্ধের বেশ কিছু মূল্যবান নথিপত্র সংগ্রহ করে জাতীয় আরকাইভস-এ স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করেন। উল্লেখযোগ্য সংরক্ষণের মধ্যে রয়েছে, হেলিকপ্টার থেকে তোলা পদ্মা নদীর গতি প্রবাহের ছবি, Year Book 1912 ইত্যাদি।

লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার (ডি আর এম) এর অফিসের রেকর্ডরুম থেকে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের অল্প কিছু রেকর্ড সংগ্রহ করা হয়েছে। সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঢাকা জিলা পরিষদ থেকে ব্রিটিশ আমল ও পাকিস্তান আমলের ৪২০১টি নথি, ৪৬৮ ভলিউম গেজেট (১৮৯০-২০০৬) ও প্রায় ৫ (পাঁচ) শতাধিক দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ গত ২৪ এপ্রিল ২০০৮ তারিখে সংগ্রহ করে জাতীয় আরকাইভসে সংরক্ষণ করা হয়েছে। জাতীয় সংসদের অধিবেশনসমূহের কার্যবিবরণী (কার্যবাহ) ২৯৩ ভলিউম সংগ্রহ করা হয়েছে। ইনকামট্যাক্স আপীলাত ট্রাইবুনালের ৪৩৩০টি নথিও সংগ্রহ করে আর্কাইভস এ সংরক্ষণ করা হয়েছে। সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রের কেটে রাখা অংশ তথা প্রেস ক্লিপিং সমূহ বাংলাদেশ জাতীয় আর্কাইভস সংগ্রহ করেছে। এ সংগ্রহের মধ্যে রয়েছে ১৯৫৪-১৯৮৮ পর্যন্ত জাতীয় দৈনিকগুলিতে প্রকাশিত প্রধান প্রধান ঘটনাবলি এবং বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সম্পর্ক সংক্রান্ত তথ্যের সমাবেশ। সচিবালয়ের রেকর্ড রুম, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ও অন্যান্য জেলা অফিসের রেকর্ড রুমগুলিসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বিখ্যাত মানচিত্রকর জৈমস  রেনেল ও সরকার পরিচালিত জরিপের সময় করা অন্যান্য মানচিত্রকরের পুরানো ম্যাপ সংগৃহীত হয়েছে। এ সকল ম্যাপকে দেশের ভৌগোলিক পরিবেশ ও আবহাওয়াগত পরিবর্তন সম্পর্কে গবেষণার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে গণ্য করা হয়।

ন্যাব ১৯৭৩ সাল থেকে ‘দি বাংলাদেশ গেজেট’ এবং ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতার এর প্রতি দিনের রেডিও মনিটরিং সংরক্ষণ করে যাচ্ছে। এগুলি সাম্প্রতিক কালের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইতিহাসের মূল্যবান উৎস। আরেকটি উৎকৃষ্ট সংগ্রহ হলো দেশ-বিদেশের খবরের কাগজ, জার্নাল ও সাময়িকীর পূর্বের প্রকাশনা।

অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলির মধ্যে ন্যাব দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক সেমিনার নিয়মিতভাবে আয়োজন করে থাকে। এছাড়াও ন্যাব কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে অটোমেশন সেবা এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে এর তথ্যাদি ও সংগ্রহ প্রচারের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। [শরীফ উদ্দিন আহমেদ এবং কে.এম করিম]