সেন বংশ

সেন বংশ  একশ বছরের কিঞ্চিদধিক (আনু. ১০৯৭-১২২৫ খ্রি) সময় বাংলা শাসন করে। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে এগারো শতকের অন্তিমলগ্নে পাল বংশের অবসান ঘটিয়ে সেনদের উত্থান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে  বরেন্দ্র-এ ‘সামন্তচক্রের’ বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা  বিজয়সেন পশ্চিমবঙ্গে ক্রমশ স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করেন এবং অবশেষে মদনপালের রাজত্বকালে স্বাধীন সত্ত্বার বিকাশ ঘটান। বাংলায় সেন শাসনের বিশেষ তাৎপর্য এই যে, সেনগণই সর্বপ্রথম সমগ্র বাংলার ওপর তাদের নিরঙ্কুশ শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

সেনদের আদিনিবাস ছিল দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট অঞ্চলে (কর্ণাটদেশাতাগত)। আধুনিক মহীশূর, কর্ণাটক এবং অন্ধ্রপ্রদেশের কানাড়ী ভাষাভাষি অঞ্চলকে তাঁদের আদি নিবাস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তাঁরা ছিলেন ব্রহ্মক্ষত্রিয় অর্থাৎ তাঁরা প্রথমে ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং পরে ব্রাহ্মণ বৃত্তি ত্যাগ করে ক্ষত্রিয় বৃত্তি গ্রহণ করেন।

বিজয়সেনের  দেওপাড়া প্রশস্তিতে বলা হয়েছে যে, চন্দ্রবংশীয় বীরসেন এবং অন্যান্যগণ কর্ণাট অঞ্চলে শাসন করতেন। এই বংশোদ্ভূত সামন্ত সেনের বংশধরগণই বাংলায় শাসন করেন। সেনগণ কখন বাংলায় এসে শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করেন তার সঠিক তথ্য নির্দেশ করা খুবই দুরূহ। দেওপাড়া লিপিতে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মক্ষত্রিয় কুলতিলক সামন্তসেন রামেশ্বর সেতুবন্ধ পর্যন্ত যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করে কর্ণাটলক্ষ্মী লুণ্ঠনকারী দুর্বৃত্তদেরকে দমন করেন। কিন্তু জীবনসায়াহ্নে তিনি গঙ্গাতটে বসতি স্থাপন করেন। এই উক্তি থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সামন্তসেন তাঁর প্রথম জীবন কর্ণাট অঞ্চলে অতিবাহিত করেন এবং সেখানে তিনি কিছুটা প্রতিপত্তির অধিকারীও ছিলেন। তবে তিনি শেষ জীবনে বাংলায় আসেন এবং গঙ্গার তীরে কোথাও বসবাস করেন। বল্লালসেনের নৈহাটি তাম্রশাসনে বলা হয়েছে যে, সামন্তসেনের জন্মের পূর্বেই সেন বংশের কোন এক পূর্বপুরুষ পশ্চিম বঙ্গে বসতি গড়ে তুলেছিলেন। সামন্তসেনের বংশধরগণ পরবর্তীকালে বাংলায় এই বংশের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

সেনগণ কিভাবে বাংলায় আসেন তার সদুত্তর দেওয়া অসম্ভব। এ ব্যাপারে সেন লিপিমালায় কোন তথ্য নেই। অনুমান করা হয় যে, সেনগণ কর্ণাট থেকে বাংলায় আসেন এবং পাল বংশীয় রাজাদের অধীনে উচ্চ রাজকার্যে নিয়োজিত হন। পাল বংশ দুর্বল হয়ে পড়লে তাঁরা বাংলার শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করেন। পাল তাম্রশাসনে নিয়মিতভাবে ‘গৌড়-মালব-খষ-হূণ-কুলিক-কর্ণাট-লাট-চাট-ভাট’ বাক্যাংশের উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে সংগৃহীত লোকজনের আবাসভূমির একটা পরিচিতি এ থেকে অনুমান করা যায়। এমন হতে পারে যে, পাল প্রশাসনের একজন কর্ণাটদেশীয় কর্মকর্তা কালক্রমে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন এবং নিজস্ব স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। কোন কোন পন্ডিত এমনও অনুমান করেন যে, সেনদের পূর্বপুরুষগণ দাক্ষিণাত্যের কোন আক্রমণকারী দলের সাথে বাংলায় এসে প্রথমে সামন্তরাজা হিসেবে এবং পড়ে পশ্চিমবঙ্গে একটা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

সেন বংশের প্রথম ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব সামন্তসেন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। জীবনের শেষদিকে তিনি গঙ্গাতীরে রাঢ়ের কোথাও বসতি স্থাপন করেন। তাঁর নামের সাথে কোন রাজকীয় উপাধি সংযুক্ত হয় নি। তাঁর পুত্র ও উত্তরাধিকারী হেমন্তসেন একজন সামন্ত নৃপতি ছিলেন বলে মনে হয়। সামন্ত বিদ্রোহে পাল সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ার সুযোগে তিনি রাঢ়ে একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। হেমন্তসেনের কোন লিপি প্রমাণ আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নি। তবে একটি সেন লিপিতে তাঁকে ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রলিপিতে তাঁকে ‘রাজরক্ষাসুদক্ষ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। উপরোক্ত উপাধিদৃষ্টে সিদ্ধান্ত করা যায় যে, হেমন্তসেন ছিলেন পাল রাজের একজন সামন্ত নৃপতি এবং তিনি তাঁর অধিরাজকে রক্ষাকল্পে সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছিলেন। সামন্তসেন এবং হেমন্তসেন সম্পর্কিত সঠিক তারিখ নির্ধারেণের জন্য কোন তথ্যপ্রমাণ নেই। তবে অনুমান করা যায় যে, তাঁরা এগারো শতকের শেষার্ধে তাঁদের স্ব স্ব ভূমিকা পালন করেন।

হেমন্তসেনের পুত্র বিজয়সেন নিজ বংশের স্বাধীন শাসনের সূচনা করেন। তাঁর লিপিমালা থেকে অনুমিত হয় যে, তিনি  রাঢ় অঞ্চলে পাল বংশের একজন অধীন নৃপতি ছিলেন। যে চৌদ্দজন সামন্ত নৃপতি  রামপালকে বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন নিদ্রাবলীর বিজয়রাজ। মনে হয় এই বিজয়রাজ ও সেন বংশীয় বিজয়সেন অভিন্ন।

বাংলায় পাল শাসনের দুর্বলতার পরিপূর্ণ সুযোগ নেন বিজয়সেন। কৈবর্তদের সাথে যুদ্ধের মাধ্যমে বরেন্দ্র পুনরুদ্ধারে রামপালকে সহায়তা করার প্রতিদান হিসেবে তিনি রাঢ়ে স্বাধীন শাসকের মর্যাদা লাভ করেন। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি পালদের পরাজিত করে গৌড়ের সিংহাসন দখল করেন। তাঁর রানী বিলাসদেবী ছিলেন শূর বংশের রাজকন্যা। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম্ সাক্ষ্য দেয় যে, এগারো শতকের গোড়ার দিকে দক্ষিণ রাঢ়ে শূর বংশের অস্তিত্ব ছিল। একই সূত্রে রামপালের সামন্তদের তালিকায় অপর-মন্দারের লক্ষ্মীশূরের নাম পাওয়া যায়। অপর-মন্দারের সাথে হুগলি জেলার মন্দারনকে অভিন্ন মনে করা হয়। শূর বংশের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে বিজয়সেন রাঢ়ের ওপর স্বীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। তিনি সম্ভবত উড়িষ্যারাজ অনন্তবর্মন চোড়গঙ্গের সাথেও মৈত্রী স্থাপন করেন। এই মৈত্রী অবশ্যই তাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়ায়। আনন্দভট্টের বল্লালচরিতে তাঁকে ‘চোড়গঙ্গসখ’ বলা হয়েছে।

এ ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই যে, রামপালের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই বিজয়সেন বাংলায় তাঁর স্বাধীন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। বিজয়সেন যে গৌড়েশ্বরকে দ্রুত পলায়নে বাধ্য করেন তিনি ছিলেন অবশ্যই শেষ পাল রাজা মদনপাল। মদনপালের ক্ষমতা তখন শুধু উত্তর বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। মনহলি তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, মদনপালের ক্ষমতা উত্তর বাংলায় অব্যাহত ছিল তাঁর অষ্টম রাজ্যাঙ্ক অর্থাৎ ১১৫২-৫৩ খিস্টাব্দ পর্যন্ত। খুব সম্ভব ১১৫২-৫৩ খিস্টাব্দের পরে কোন এক সময় বিজয়সেন উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলায় তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। বিজয়সেন পশ্চিমে বিহার এবং পূর্বে ‘বঙ্গ’ (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) পর্যন্ত রাজ্যসীমা সম্প্রসারিত করেন বলে উল্লেখ আছে। বর্মনদের রাজধানী  বিক্রমপুর থেকে বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রশাসন প্রকাশিত হয়েছিল। বর্মনগণ এগারো শতকের শেষভাগ থেকে বারো শতকের মাঝামাঝিকাল পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় শাসন করেন। সুতরাং বিজয়সেন বারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে বর্মন রাজবংশকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা থেকে উৎখাত করেন বলে মনে হয়।

এভাবে বারো শতকের মধ্যভাগের মধ্যে বিজয়সেন পাল ও বর্মনদের পরাভূত করে সমগ্র বাংলায় নিজ বংশের শাসন প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। তিনি প্রায় দীর্ঘ ৬২ বছর (আনু. ১০৯৮-১১৬০ খ্রি) রাজত্ব করেন। শৈব মতাবলম্বী বিজয়সেন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ পন্ডিত ও দরিদ্রদের উদারভাবে দান করতেন। তিনি ‘পরমমাহেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ’ ইত্যাদি রাজকীয় উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি গৌরব সূচক ‘অরিরাজ বৃষভশঙ্কর’ উপাধিও গ্রহণ করেছিলেন। সংগত কারণেই মনে করা হয় যে, বিজয়সেনের গৌরবে উদ্বুদ্ধ হয়েই বিখ্যাত কবি শ্রীহর্ষ তাঁর গৌড়ৌবীশ-কুল-প্রশস্তি ও বিজয়-প্রশস্তি রচনা করেন।

বিজয়সেনের পর তাঁর পুত্র বল্লালসেন রাজা হন। এ যাবৎ বল্লালসেনের আমলের দুটি লিপি (নৈহাটি তাম্রশাসন ও সনোখার মূর্তি লিপি) আবিষ্কৃত হয়েছে। লিপিদ্বয়ে বল্লালসেনের কোন রাজ্য জয়ের উল্লেখ নেই। তবে তাঁর কিছু সামরিক কৃতিত্ব ছিল। অদ্ভুতসাগর-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি গৌড়রাজের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। পাল বংশের রাজা গোবিন্দপালকে এই গৌড়রাজ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত আনন্দভট্টের বল্লালচরিত-এও এই তথ্যের অনুমোদন মেলে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, পাল বংশীয় শেষ রাজা গোবিন্দপাল ১১৬০ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যহারা হন। এই সময়ে বল্লালসেন যে সিংহাসনে উপবিষ্ট তা লিপি প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত। সুতরাং মগধে পালদের শেষ আঘাত হানার কৃতিত্ব বল্লালসেনের। অদ্ভুতসাগর-এ উল্লেখ আছে যে, তাঁর পিতার জীবদ্দশায় বল্লালসেন মিথিলা জয় করেন।

বাংলায় কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তনের সাথে বল্লূালসেনের নাম জড়িত আছে। সাধারণ বিশ্বাস এই যে, সামাজিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রয়োজনে বল্লালসেন কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় লোককে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা হয়, তারা অভিজাত ও কুলীন হিসেবে পরিগণিত হন। কুলগ্রন্থ বা কুলজীশাস্ত্র হচ্ছে কৌলিন্য প্রথার আদি ইতিহাস জানার উৎস। বস্ত্তত, বল্লা লসেনের রাজত্বকালের পাঁচ ছয়শ বছর পর প্রণীত এই সকল গ্রন্থ প্রমাদ-আকীর্ণ ও স্ববিরোধিতাপূর্ণ। সুতরাং কৌলিন্য প্রথা সম্পর্কিত এ সকল তথ্য প্রশ্নাতীত নয়। তদুপরি সেন আমলের কোন লিপিসূত্রে কৌলিন্য প্রথা সম্পর্কিত কোন তথ্য নেই। আঠারো ও ঊনিশ শতকের বাংলার ব্রাহ্মণদের মধ্যে কৌলিন্য প্রথার গভীর প্রভাব সুবিদিত। সুতরাং খুবই স্বাভাবিক যে, কৌলিন্য প্রথার প্রবক্তাগণ এর একটা ঐতিহাসিক ভিত্তি দেওয়ার প্রয়াস চালাবেন এবং সে প্রয়াস থেকেই তারা হিন্দু রাজা বল্লালসেনের আমলে এই প্রথার উদ্ভব হয়েছে বলে প্রচারণা চালান।

সেন লেখমালা ও কাহিনী-কিংবদন্তী থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, বল্লালসেন সুপন্ডিত হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ১১৬৮ খ্রিস্টাব্দে দানসাগর লেখা সম্পন্ন করেন এবং ১১৬৯ খ্রিস্টাব্দে অদ্ভুতসাগর লেখায় হাত দেন। তবে তা তিনি সম্পন্ন করে যেতে পারেন নি। পিতার মতো বল্লালসেনও শৈব মতাবলম্বী ছিলেন। অন্যান্য রাজকীয় উপাধির সাথে তিনি ‘অরিরাজ-নিঃশঙ্কশঙ্কর’ উপাধি ধারণ করেন। অদ্ভুতসাগর সূত্রে জানা যায় যে, বল্লালসেন বৃদ্ধবয়সে পুত্র লক্ষ্মণসেনের ওপর রাজ্যভার অর্পণ করে সস্ত্রীক গঙ্গাতীরে ত্রিবেণীর নিকটবর্তী একটি স্থানে শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি প্রায় ১৮ বছর (আনু. ১১৬০-৭৮ খ্রি) সগৌরবে রাজত্ব করেন।

এতে কোন সন্দেহ নেই যে,  লক্ষ্মণসেন বেশ অধিক বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর রাজত্বকাল প্রশংসনীয় সাহিত্যকর্মের জন্য খ্যাত। তিনি নিজে সংস্কৃত ভাষায় অনেকগুলি শ্লোক রচনা করেন এবং পিতার আরব্ধ অদ্ভুতসাগর সম্পূর্ণ করেন। তাঁর রাজসভা গীতগোবিন্দম্ প্রণেতা জয়দেব, শরণ, পবনদূত রচয়িতা ধোয়ী এবং সম্ভবত গোবর্ধন প্রমুখ প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিকদের দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল। তাঁর রাজত্বকালে বটুদাসের পুত্র শ্রীধরদাস (লক্ষ্মণসেনের সাথে শ্রীধরদাসের বন্ধুত্ব ছিল)  সদুক্তিকর্ণামৃত নামক কাব্যসংগ্রহ সঙ্কলিত করেন। তাঁর প্রধান অমাত্য ও প্রধান বিচারপতি হলায়ুধ মিশ্র ব্রাহ্মণসর্বস্ব রচনা করেন। দেওপাড়া প্রশস্তিকার উমাপতিধর রাজ্যের একজন অমাত্য এবং লক্ষ্মণসেনের অন্যতম সভাকবি ছিলেন।

লক্ষ্মণসেন ছিলেন বৈষ্ণব মতবাদের কঠোর অনুসারী। তিনি ‘পরমবৈষ্ণব’ বা ‘পরমনরসিংহ’ উপাধি ধারণ করেন। তাঁর ধর্মমত পরিবর্তন সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। লক্ষ্মণসেন তাঁর অসামান্য গুণাবলী ও দানশীলতার জন্য খ্যাত ছিলেন। তবকাত-ই-নাসিরীর লেখক মিনহাজ-উস-সিরাজ তাঁর দানশীলতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বাংলার ‘মহান রায়’ হিসেবে অভিহিত এবং সুলতান কুতুবউদ্দীন তুল্য বিবেচনা করেন। তাঁর শাসনামলের শেষ দিকে অবশ্য লক্ষ্মণসেন রাজকার্য পরিচালনায় অশক্ত হয়ে পড়েন। এই সময় সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা ও সংহতির অভাব পরিলক্ষিত হয়। সমসাময়িক লেখসূত্রে সেন রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কতগুলি বিদ্রোহী প্রধানের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আভাস পাওয়া যায়। এই প্রক্রিয়া সেন সাম্রাজ্যের সংহতিতে চিড় ধরায় ও পরিণামে এর পতন ঘটায়। শেষ আঘাত হানেন মুহম্মদ  বখতিয়ার খলজী (১২০৪ খ্রি)। অবশ্য দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় লক্ষ্মণসেন আরও কিছুদিন রাজত্ব করেন।

১২০৬ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্মণসেনের মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন যথাক্রমে সিংহাসনে বসেন। তাঁদের শাসনামলের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না। তবে বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে তাঁদের শাসন যে আরও প্রায় ২৫ বছর স্থায়ী ছিল, লিপি প্রমাণে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তাঁদের পিতার মৃত্যুর পর বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন কর্তৃক বিক্রমপুর ও বঙ্গে ভূমিদান করা থেকে প্রমাণিত হয় যে, এতদঞ্চলে তাঁদের আধিপত্য বজায় ছিল। তবকাত-ই-নাসিরী সাক্ষ্য দেয় যে লক্ষ্মণসেনের বংশধরগণ অন্তত ১২৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। কিন্তু কেশবসেনের পর সেনগণ বাংলায় রাজত্ব করেছিলেন এমন কোন প্রমাণ এখনও পাওয়া যায় নি। পঞ্চরক্ষা নামক একটি বৌদ্ধ গ্রন্থের পান্ডুলিপি থেকে মধুসেন নামক এক গৌড়েশ্বরের নাম পাওয়া যায়। সেন উপাধিধারী তিনিই ছিলেন বাংলার শেষ রাজা। তেরো শতকের শেষভাগে সেনদের নিকট থেকে দেব রাজবংশ বিক্রমপুরের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। তেরো শতকের শেষে এবং চৌদ্দ শতকের শুরুতে সমগ্র বাংলার ওপর মুসলমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

সেনযুগের আগে বাংলায় হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ফলে উভয় ধর্মের মধ্যে একটি চমৎকার মিথস্ক্রিয়া গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সেন শাসনামলে গোড়া হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ঘটে। এই সময় বৌদ্ধধর্মের ওপর আঘাত নেমে আসে বলে মনে করা হয় এবং এর ফলে বৌদ্ধগণ দলে দলে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে আশ্রয় নেয়। সেন আমলে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি হয়। বল্লালসেন ও লক্ষ্মণসেন দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর নামক সংস্কৃত কাব্যগ্রন্থ দুটি প্রণয়ন করেন। জয়দেব, উমাপতিধর, শরণ, ধোয়ী, শ্রীধরদাস, হলায়ুধ মিশ্র এবং গোবর্ধন ছিলেন এই যুগের সাহিত্য পরিমন্ডলে এক একজন জ্যোতিষ্কস্বরূপ। সেন রাজা ও রাজপুরুষদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভাস্কর্য শিল্পও বিকাশলাভ করে।  [আবদুল মমিন চৌধুরী]