পাল চিত্রকলা

পাল চিত্রকলা পাল রাজা প্রথম মহীপালের (খ্রিস্টীয় ৯৮৩) ষষ্ঠ রাজ্যাঙ্কে তালপাতার উপরে চিত্রসম্বলিত বৌদ্ধ গ্রন্থ অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা পান্ডুলিপির বারোটি রঙ্গিন চিত্র বঙ্গীয় চিত্রকলার প্রাচীনতম নিদর্শন। বর্তমানে দুর্লভ এই পান্ডুলিপি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া প্রথম মহীপাল এর রাজত্বের আরও দুটি চিত্রায়িত পান্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে, তবে এগুলি পরবর্তী সময়ের। পরবর্তী দুশ বছরে চিত্রসম্বলিত আরও বেশ কিছু পান্ডুলিপি পাওয়া যায়। যেহেতু পালবংশীয় রাজাদের রাজত্বকালে এ সমস্ত পান্ডুলিপি চিত্রালঙ্কৃত হয়েছে, তাই এগুলিকে ‘পাল মিনিয়েচার’ বলে অভিহিত করা হয়। এ চিত্রকলার অঙ্কন-নৈপুণ্য এতই উন্নত যে, এগুলিকে বঙ্গীয় চিত্রকলার প্রাথমিক নিদর্শন বলে মনে হয় না। চিত্রকর্মগুলির উন্নত শিল্পরীতি দেখে মনে হয় এর পিছনে অনেক দিনের অভিজ্ঞতা কাজ করেছে। চিত্রকলা অতি সহজে বিনষ্ট হয় বিধায় পাল-পূর্ব যুগের কোন চিত্রালঙ্কৃত পান্ডুলিপি পূর্ব ভারতে পাওয়া যায় নি।

বুদ্ধের জন্ম, অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা, আনু. ৯৮৩ খ্রি.

বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থ দিব্যাবদান-এর ‘বীতাশোকাবদান’ অংশে এক কাহিনী থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে বাংলায় চিত্রকলার প্রচলন ছিল। এ গ্রন্থ অনুযায়ী উত্তরবঙ্গের একটি প্রাচীন শহর পুন্ড্রবর্ধন এর নির্গ্রন্থী উপাসকদের অঙ্কিত চিত্রে দেখা যায়, বুদ্ধদেব নিগ্রন্থ (গোসাল)-কে প্রণতি জানাচ্ছেন। এ ঔদ্ধত্যে মহারাজা  অশোক ক্রুদ্ধ হয়ে শহরের আজীবিকদের সমূলে বিনাশ করেন। এ কাহিনীর ঐতিহাসিক গুরুত্ব যাই হোক না কেন, এ থেকে মনে হয় খ্রিস্টপূর্বকালে বাংলার এ অঞ্চলে চিত্রকলার প্রচলন ছিল।

চারশত বছর ব্যাপী পূর্ব-ভারতে পাল শাসনের ফলে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং এ অঞ্চলে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার ক্ষেত্রে এক অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হয়। যেহেতু পাল আমলের পূর্বের কোন চিত্রকলা এ অঞ্চলে আবিষ্কৃত হয় নি, এবং ক্ষুদ্রাকৃতির চিত্রকলারীতি সমগ্র পাল যুগেই অব্যাহত ছিল, পাল শাসনের অবসানের পরও এ রীতি নিষ্প্রভভাবে চলতে থাকে, তাই বলা যায় পাল চিত্রকলাই বাংলার প্রাচীন চিত্রকলা। পাল শাসকগণ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতি সহিষ্ণু ছিলেন। তাদের সময়ে মহাযান ধর্মমত ধীরে ধীরে তন্ত্রযান-বজ্রযান-কালচক্রযানে বিবর্তিত হয়। পাল মিনিয়েচারগুলি এক অর্থে এ সমস্ত ধর্মীয় বিশ্বাসেরই ঐক্ষিক প্রকাশ।

আশ্চর্যের বিষয় হলো যে, পাল আমলের বিপুল সংখ্যক চিত্রালঙ্কৃত পান্ডুলিপি হাজার বছর পরেও কালের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেয়েছে। এ বিষয় থেকে পাল আমলে শিল্পের ব্যাপক প্রসার সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। পাথর ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন মূর্তি সেই সময়ের শিল্পকলার প্রসারের কথাই ইঙ্গিত করে। পাল আমলের পান্ডুলিপিসমূহে যে বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্রাকৃতির চিত্র অংকিত হয়েছিল তা অনুমান করা যায় তারিখযুক্ত পান্ডুলিপি থেকে। এ সময়ের তিনশতেরও অধিক চিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া এর সাথে সেই সময়ের তৈরি তারিখ বিহীন পান্ডুলিপির চিত্র সংখ্যা যোগ করলে এ সংখ্যা আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে।

নলগিরি বশীকরন, অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা, আনু. ৯৮৩ খ্রি.

পান্ডুলিপিসমূহ তালপাতায় লেখা ও চিত্রায়িত করা হয়েছে। তালপাতা ভঙ্গুর, এ কারণে অনেক পুথিচিত্র বর্তমানে জীর্ণ হয়ে পড়েছে। তুলনামূলক বিচারে দেখা যায় যে, পাল যুগের চিত্রালঙ্কৃত পান্ডুলিপিসমূহ উন্নতমানের তালপাতার (শ্রীতাড়) উপর অনুলিখিত ও চিত্রালঙ্কৃত করা হতো। বিভিন্ন ধরনের তালপাতা বেশ পাতলা ও স্থিতিস্থাপক, তাই লেখার জন্য উপযুক্ত ও কম ভঙ্গুর। শ্রীতাড় পাতা দৈর্ঘ্যে ৯০ সেমি ও প্রস্থে ৭.৫ সেমি পর্যন্ত হতে পারে। পুঁথি লেখার পূর্বে এ পাতা গোছা বেঁধে একমাস পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো এবং পরবর্তীকালে তা রোদে শুকিয়ে শঙ্খ দিয়ে ঘষে মসৃণ করে নেওয়া হতো।

এরপর আকার অনুযায়ী কেটে এবং বাঁধার জন্য ছিদ্র করার পর এ গুলিতে লেখা ও চিত্র অঙ্কন করা হতো। লিপিকর দৈর্ঘ্যের সমান্তরালে প্রতিটি পাতায় পাঁচ বা ছয় পংতি লিখতেন এবং প্রয়োজনীয় চিত্র অঙ্কনের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতেন। প্রতিটি পাতায় সাধারণত ৬ সেমি  ৭ সেমি আয়তনের তিনটি চিত্র অঙ্কিত হতো এবং এগুলির মধ্যে একটি মাঝখানে ও অপর দুটি দুপাশে অঙ্কন করা হতো। তবে কোন কোন পুঁথিতে অঙ্কন করা হতো দুটি চিত্র।

চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি বেশ জটিল। তবে প্রাচীর চিত্রের তুলনায় পান্ডুলিপি চিত্রের অঙ্কনকৌশল অনেক সহজ ও সরল। চিত্র অংকনের জন্য সাধারণত পটভূমিটি একটি রং দিয়ে ভরে নেওয়া হতো, তবে কোন কোন ক্ষেত্রে পাতার উপর সরাসরি তুলির অাঁচরে চিত্রাঙ্কন করা হতো। এরপর প্রতিকৃতিটি প্রয়োজনীয় রং দিয়ে ভরা হতো, রূপ ও গঠন অনুসারে রঙের ঘনত্বের তারতম্য করা হতো এবং উজ্জ্বল বর্ণের ছোয়ায় সম্পূর্ণ করা হতো রঙের কাজ। এরপর ভারতীয় চিত্রকলার রীতি অনুসারে একটি মাঝারি তুলি দিয়ে প্রথমে ভেতরকার রঙ এবং সর্বশেষে সরু তুলি দিয়ে লাল বা কালো রঙে প্রতিকৃতির গড়নের রেখা টানা হতো।

বৌদ্ধ দেবী, পঞ্চরক্ষা, আনু. ১০৪০ খ্রি.

চিত্রগুলিতে যে সমস্ত রঙ ব্যবহার করা হতো তা হলো হলুদ, চক সাদা, ইন্ডিগো নীল, প্রদীপের শিষের কালি, সিন্দুর এবং হলুদ ও নীলের মিশ্রণে সৃষ্ট সবুজ। বেশিরভাগ রঙই প্রয়োজনানুসারে সাদা মিশিয়ে হালকা করে নেয়া যেত। যেহেতু বৌদ্ধ দেব-দেবীই ছিল চিত্রাঙ্কনের প্রধান বিষয়বস্ত্ত তাই চিত্রকর ‘সাধনমালা’ ও অন্যান্য গ্রন্থে নির্দেশিত মূর্তিলক্ষণের নিয়মকানুন মেনে চলতেন। তবে দেবদেবীর চিত্রের চারপাশে খালি জায়গায় শিল্পিরা তাদের নান্দনিক অভিব্যক্তি ঘটাতেন গাছপালা, স্থাপত্য এবং অন্যান্য চিত্রের মধ্যে। বেশির ভাগ দেবদেবীর চিত্রেই প্রাধান্য পেয়েছে হলুদ বা গাঢ় লাল রং। এছাড়া পটভূমির রং হিসেবেও হলুদ ও লাল ব্যবহার করা হয়েছে।

পাল চিত্রকলার রীতি চরিত্র নির্ধারণ করতে গিয়ে তিববতি ঐতিহাসিক লামা তারনাথএর বিবরণী উল্লেখযোগ্য। তাঁর মতে, পাল শাসক ধর্মপাল (খ্রিস্টীয় ৭৮১-৮২১) ও দেবপাল এর (খ্রিস্টীয় ৮২১-৮৬১) রাজত্বকালে শিল্পকলা উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে। উপরোক্ত শাসকদ্বয়ের রাজত্বকালে বরেন্দ্র বা উত্তরবঙ্গের দুজন শিল্পি, ধীমান ও তাঁর পুত্র বিটপাল, খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পাথর ও ধাতুর ভাস্কর্য গড়ায় এবং চিত্রাঙ্কনে তাঁরা ছিলেন খুবই খ্যাতিমান শিল্পি। কিন্তু শিল্পরীতির ক্ষেত্রে পিতা ও পুত্রের মধ্যে পার্থক্য ছিল।

তারা, পঞ্চরক্ষা, আনু. ১০৮০ খ্রি.

চিত্রকলার ক্ষেত্রে পিতা ‘পূর্ব দেশিয় রীতি’ এবং পুত্র ‘মধ্যদেশীয় রীতি’ (বৌদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মধ্যদেশ হলো মগধ বা দক্ষিণ বিহার) অনুসরণ করেন। তারনাথের এ উক্তি থেকে বোঝা যায় যে, পাল যুগে পূর্ব-ভারতীয় চিত্রকলায় ছিল বরেন্দ্র ও মগধ অঞ্চলের দুটি পৃথক রীতি। তবে এ চিত্রকলার চরিত্র সঠিকভাবে বোঝার জন্য পাঁচ ও ছয় শতকে ধ্রুপদী চিত্রকলার উল্লেখ প্রয়োজন।

ভারতীয় শিল্পকলার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে গুপ্ত সম্রাট (খ্রি. ৩২০-৬৭৫) এবং তাঁদের নিকটবর্তী সময়ে। এ সময়ে ভারতীয় প্রাচীরচিত্র কৌশলগত উৎকর্ষ ও নান্দনিক শ্রেষ্ঠত্বে যে কতখানি এগিয়ে গিয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় অজন্তা, বাগ ও বাদামি গুহাচিত্রে। এ ধ্রুপদী চিত্রকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তার প্রবহমান নিরবচ্ছিন্ন ছন্দময় রেখা ও পরিপূর্ণভাবে বিকশিত সাবলীল শারীরিক গঠন। শেষোক্ত বৈশিষ্ট্যটি অর্জিত হয়েছে রঙের আলো-ছায়া ও রেখার সুনিপুণ ব্যবহারের মাধ্যমে। ধ্রুপদী যুগের ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় উপরোক্ত শিল্পাদর্শ অনুসরণ করা হয় এবং উভয় শিল্পই রেখার বিন্যাস ও নমনীয়তার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। পাল যুগে শিল্পকলায় ধীমান ও বিটপাল ধ্রুপদী শিল্পকলাকেই পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন, একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তারনাথ উল্লেখ করেছেন যে, ধীমান ছিলেন ‘নাগ’ রীতির অনুসারী। উত্তর ভারতের মথুরা ছিল নাগ উপাধিধারী রাজাদের একটি অন্যতম কেন্দ্র এবং এ মথুরা নগর ছিল ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্পরীতির উৎসস্থল। পাল যুগে তৈরি মিনিয়েচারের ফিগারগুলিতে ছন্দময় রেখা ও পরিপূর্ণ শারীরিক গঠনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এই মিনিয়েচারগুলি আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও এগুলিতে ধ্রুপদী শিল্পরীতির সকল বৈশিষ্ট্যই ফুটে উঠেছে। এছাড়াও ইউরোপীয় মিনিয়েচারের সাথে এর পার্থক্য লক্ষ করা যায়। পাল যুগের মিনিয়েচারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে যে, সমসাময়িক পাথর ও ধাতুর তৈরি মূর্তির শিল্পরীতির অনুকরণে এগুলি অাঁকা হয়েছিল।

কয়েক শতক ধরে পাল মিনিয়েচারগুলি তৈরি হলেও এর শিল্পরীতি সব সময় এক ছিল না। পাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন শতকের বিভিন্ন শিল্পকর্মশালায় নির্মিত চিত্রকর্মের শিল্পশৈলীগত তুলনায় দেখা যায়, চিত্র রচনায় ও গঠন ভঙ্গিমায় এক একটি চিত্রকর্ম এক এক রূপ লাভ করেছে। পালযুগের চিত্রকর্মগুলিতে দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। দশ শতকের শেষ ও এগারো শতকের শুরুতে প্রথম মহীপাল (খ্রি. ৯৯৫-১০৪৫) ও নয়পালের (খ্রি. ১০৪৫-১০৫৮) রাজত্বকালে প্রস্ত্ততকৃত চিত্রাঙ্কিত পান্ডুলিপিগুলিতে একটি ধারা বা রীতি লক্ষণীয়। আর অন্য ধারাটি দেখা যায় এগারো শতকের শেষ থেকে বারো শতকের সমাপ্তি পর্যন্ত পাল শাসক রামপাল (খ্রি ১০৮২-১১২৪) ও তাঁর উত্তরাধিকারীদের সময়ে চিত্রিত পান্ডুলিপিসমূহে। প্রথম ধারাটি অজন্তার প্রাচীরচিত্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। এ ধারায় নির্মিত পাল মিনিয়েচারসমূহে রঙের ব্যবহার, মূর্তির শারীরিক গঠন বা ছন্দোময় প্রবহমান রেখার ব্যবহার অজন্তার দেয়াল চিত্রের অঙ্কন নকশাকে ছাড়িয়ে গেছে। নালন্দায় একটি বৌদ্ধ মন্দিরে উৎখননের ফলে আবিষ্কৃত পাল যুগের প্রাচীর চিত্রের কিছু নিদর্শন থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, পুঁথিচিত্রের পাশাপাশি দেয়ালচিত্রও এ সময়ে অঙ্কিত হতো।

দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা যায় একই সঙ্গে দুটি পৃথক চিত্র মাধ্যমের নন্দনতাত্ত্বিক বিকাশ। এ দুটির মধ্যে রামপাল ও তাঁর একজন উত্তরাধিকারী গোবিন্দপালের সময়ে প্রস্ত্ততকৃত মিনিয়েচারসমূহ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ চিত্র কর্ম গুলিতে সমসাময়িককালে প্রস্ত্ততকৃত ভাস্কর্য, বিশেষ করে নারী মূর্তিগুলির ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপকেই যেন তুলির অাঁচরে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর এ সংরক্ষিত এবং দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার বর্মণ বংশীয় রাজা হরিবর্মণের উনিশ রাজ্যাঙ্কে লিখিত ও চিত্রিত অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা পান্ডুলিপির চিত্রগুলিতে উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ দেখা যায়।

অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা

তবে একই রাজার অষ্টম রাজ্যাঙ্কে রচিত পঞ্চবিংশতি-সাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা পান্ডুলিপির চিত্রাঙ্কনে কিছুটা ভিন্ন রীতি পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে ভারতের বরদা জাদুঘরের চিত্রশালায় পান্ডুলিপিটি সংরক্ষিত আছে। একটি দ্বিমাত্রিক মূর্তি সুন্দরভাবে একরঙের পটভূমির উপর অঙ্কন করা হয়েছে। ছবিতে মূর্তিটি সুখাসনে উপবিষ্ট। উপরোক্ত চিত্রসমূহে দেখা যায় সূক্ষম আঙ্গুল, কৌণিক দেহাবয়ব, এবং চোখের অস্বাভাবিক চাহনি ইত্যাদি লক্ষণসমূহ ‘মধ্যযুগীয় চিত্ররীতি’র, যার প্রথম প্রকাশ লক্ষ করা যায় ইলোরা গুহার দেওয়ালচিত্রে এবং এর পূর্ণাঙ্গরূপ দেখা যায় বারো শতকে জৈন চিত্রায়িত পান্ডুলিপিতে। পূর্ব ভারতে বারো শতক ও তেরো শতকে তৈরি কিছু তাম্রপট্টে উৎকীর্ণ চিত্রে এই মধ্যযুগীয় চিত্ররীতির ছাপ লক্ষ করা যায়। যদিও পাল যুগের কিছু কিছু মিনিয়েচারে মধ্যযুগীয় চিত্ররীতির ছাপ লক্ষণীয়, তবে পুঁথিচিত্রে ব্যাপকভাবে এর প্রভাব পড়ে নি, যেরূপ পড়েছিল পশ্চিম ভারতের পুঁথিচিত্রে। তবে পনেরো শতকের শেষের দিকে বিহারে অনুলিখিত ও চিত্রায়িত দুটি বৌদ্ধ পান্ডুলিপিতে মধ্যযুগীয় চিত্ররীতির ভঙ্গুর প্রকাশ লক্ষ করা যায়।

পালযুগে অনুলিখিত ও চিত্রালঙ্কৃত বেশিরভাগ পান্ডুলিপিই মহাযান বৌদ্ধ গ্রন্থ অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা অনুসরণে রচিত। এছাড়া অন্যান্য চিত্রিত পান্ডুলিপি হলো বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মীয় যেমন, পঞ্চরক্ষা, করন্ডব্যূহ, কালচক্রযানতন্ত্র। কিন্তু বিস্ময়কর বিষয় এই যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পান্ডুলিপির বিষয়ের সঙ্গে চিত্রগুলির বিশেষ কোন যোগ নাই। বিষয়বস্ত্তকে ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে চিত্র সংযোজিত হয়নি, হয়েছে কেবল শোভা বর্ধন করার জন্যই। চিত্রগুলি গ্রন্থের চিত্ররূপায়ণ নয় বরঞ্চ স্ব-মহিমায় স্বতন্ত্র সত্তায় বিরাজমান। সকল পান্ডুলিপিতেই চিত্রের বিষয়বস্ত্ত ছিল গৌতম বুদ্ধ ও তাঁর জীবনের বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা। তাঁর জীবনের আটটি অলৌকিক ঘটনা যথা: (১) লুম্বিনী উদ্যানে জন্ম; (২) বুদ্ধগয়ায় দিব্যজ্ঞান লাভ; (৩) সারনাথে ধর্মচক্র প্রবর্তন; (৪) কুশিনগরে মহাপরিনির্বাণ; (৫) সঙ্কিষ্যে স্বর্গাবতরণ; (৬) শ্রাবস্তীতে অলৌকিক ক্রিয়া প্রদর্শন; (৭) রাজগৃহে নলগিরি হস্তি বশীকরণ এবং (৮) বৈশালীর আম্রবনে বানরের মধুদান গ্রহণ। এদের মধ্যে প্রথম চারটি ঘটনাকে বুদ্ধের জীবনের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেহেতু সে সময় বৌদ্ধ ধর্মের বজ্রযান ও তন্ত্রযান মতবাদ ব্যাপকভাবে পূর্বভারতে বিকাশ লাভ করেছিল, তাই তান্ত্রিক বৌদ্ধ দেবদেবীর চিত্র এ সময় নির্মিত মিনিয়েচারগুলিতে প্রাধান্য পেয়েছে। পুথিতে চিত্রায়িত উল্লেখযোগ্য বৌদ্ধ দেবদেবীর মধ্যে ছিল প্রজ্ঞাপারমিতা, তারা, লোকনাথ, মৈত্রেয়, বজ্রপাণি, পদ্মপাণি, বসুধরা, মহাকাল, কুরুকুল্ল, চুন্ডা, বজ্রসত্ত্ব এবং মঞ্জুশ্রী।

একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো, কারা এবং কোন উদ্দেশ্যে এ চিত্রালঙ্কৃত পান্ডুলিপি প্রস্ত্ততে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছিলেন? প্রথম প্রশ্নের প্রথম উত্তর বের করা খুব কঠিন নয়। কারণ পান্ডুলিপিসমূহের দান-পুষ্পিকা নামক উৎসর্গ শ্লোক থেকেই এর উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়। এই সমস্ত পান্ডুলিপি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় ও তত্ত্বাবধানে তৈরি হতো- যাঁদের উল্লেখ করা হয়েছে স্থবির, উপাসক বা ভিক্ষু বলে। এছাড়া কোন কোন পান্ডুলিপিতে বৌদ্ধ অনুসারী সামন্ত নৃপতি বা রাজকর্মচারীর নামও উল্লেখ করা হয়েছে দাতা হিসেবে। পৃষ্ঠপোষকতার উদ্দেশ্য ছিল কেবল নিজের জন্য পুণ্যার্জন নয়, মাতা-পিতা, শিক্ষক ও গুরু সকলের জন্য।

দেবাবতরন, অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা, আনু. ১১৮০ খ্রি.

উপরোক্ত কারণ ছাড়াও এ চিত্রায়িত পান্ডুলিপি তৈরির মতো পুণ্য কাজের পেছনে কিছু গভীরতর প্রেরণা অবশ্যই কাজ করেছে, যার ইঙ্গিত পাওয়া যায় প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থেই। গ্রন্থগুলিতে প্রচারিত ধর্মতত্ত্বে সম্যক জ্ঞান সকল মানুষ ও প্রাণীর জন্য তার যথাযথ প্রয়োগকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। এ উদার মানবতাবাদী চিন্তাধারার কারণেই বাংলায় বসবাসকারী সকল বৌদ্ধদের ধর্মানুষ্ঠানে এ গ্রন্থের পাঠ ও আবৃতি পুণ্যার্জনের অপরিহার্য অঙ্গ রূপে পরিগণিত হয়েছে। এ গ্রন্থের মাহাত্ম্য এত বেশি ছিল যে, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এর পান্ডুলিপিকে পূজা করত। অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা গ্রন্থে চন্দন প্রলেপ ও ধূপকাঠি দিয়ে অর্চনার চিহ্ন পাওয়া যায়।

অধিকন্তু এ গ্রন্থে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে যে, গ্রন্থের অনুলিপি প্রস্ত্তত করা মহাপুণ্যের কাজ। মালদা জেলার জগজ্জীবনপুরের বৌদ্ধ বিহারে সাম্প্রতিককালে একটি পোড়ামাটির ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। এতে দেখা যায়, একটি পান্ডুলিপি, সম্ভবত প্রজ্ঞাপারমিতা, পদ্মের উপর রাখা আছে। এ থেকে মনে হয় এটি পূজনীয়। এ গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে তান্ত্রিক বৌদ্ধ দেবদেবীর ক্ষুদ্রাকৃতি রূপ। তাই মনে হয় যে, এ গ্রন্থ অত্যন্ত সম্মানিত স্থান অধিকার করেছিল।

আট থেকে বারো শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মমতের একটি অন্যতম প্রধান ও শক্তিশালী কেন্দ্র ছিল বাংলা এবং এখান থেকেই এ মতবাদ বিভিন্ন দেশে, যেমন উত্তরে নেপাল ও তিববত এবং পূর্বে বার্মা ও থাইল্যান্ডে, বিস্তার লাভ করে। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তাদের সঙ্গে চিত্রালঙ্কৃত পান্ডুলিপিসমূহ এ সমস্ত দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন, যার ফলে পাল রীতির চিত্রকলার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। বারো শতকের শেষের দিকে এবং তেরো শতকের শুরুতে অনেক বৌদ্ধ ভিক্ষু ব্রোঞ্জের ছোট বুদ্ধমূর্তি ও চিত্রসম্বলিত পান্ডুলিপিসহ এ সমস্ত পার্শতবর্তী অঞ্চলে চলে গিয়েছিলেন। এর ফলে পরবর্তী শতকগুলিতে পাল শিল্পরীতি বিদেশের মাটিতে আরও পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়। তবে পাল মিনিয়েচারগুলির শিল্পরীতিকে পরিপূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে হলে নেপালে তৈরি চিত্রালঙ্কৃত পান্ডুলিপিসমূহের শিল্পরীতিকে বিবেচনায় রাখতে হবে।  [অশোক ভট্টাচার্য]

আরও দেখুন বৌদ্ধ চিত্রালঙ্কৃত পান্ডুলিপি

গ্রন্থপঞ্জি  Sarasikumar Saraswati, Palyuger Chitrakala, Calcutta, 1978; Jeremiah P Losty, The Art of the Book in India, London, 1982; অশোক ভট্টাচার্য, বাংলার চিত্রকলা, কলকাতা, ১৯৯৪; Claudine Bautze-Picron, ‘Buddhist Painting during the reign of Harivarmadeva in Southeast Bangladesh’, Journal of Bengal Art, 4, 1999.