ধর্মপাল

ধর্মপাল  বাংলার পাল বংশের দ্বিতীয় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা। পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের পুত্র ও উত্তরাধিকারী ধর্মপাল পালদের উদীয়মান প্রতিপত্তির যুগের সূচনা করেন।

পাল আমলের তাম্রশাসন

ধর্মপালের সুদীর্ঘ রাজত্বকালের (আনু. ৭৮১-৮২১ খ্রি.) সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধ। উত্তর ভারতের মধ্যদেশে আধিপত্য বিস্তারের জন্য দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট এবং মালব ও রাজস্থানের গুর্জর-প্রতীহারদের সঙ্গে বাংলার পালগণ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ললিতাদিত্য ও যশোবর্মণের বিজয়াভিযানের পর উত্তর ভারতের মধ্যমণি কনৌজে শূণ্যস্থান পূরণের জন্য উল্লিখিত তিন শক্তির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ধর্মপাল উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করার মতো যথেষ্ট শক্তির অধিকারী বলে নিজেকে মনে করেন এবং এক্ষেত্রে তিনি কিছু সাফল্যও অর্জন করেন। এর যথার্থতা পাল তাম্রশাসনে উৎকীর্ণ প্রশংসাত্মক উক্তিসমূহে দেখা যায়। কালানুক্রমিকভাবে এ যুদ্ধের প্রকৃত গতিধারা নিরূপণ করা কষ্টসাধ্য। প্রাপ্ত তথ্যাদির আলোকে ঘটনার সম্ভাব্য গতিধারার রূপরেখা নিরূপণ করা যায়।

পাল রাজা ধর্মপাল এবং প্রতীহার রাজা বৎসরাজের মধ্যে সংঘর্ষের মাধ্যমে ৭৯০ খ্রিস্টাব্দের দিকে ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধের প্রথম পর্ব শুরু হয়। এতে প্রথমোক্তজনের পরাজয় ঘটে এবং পরে উভয়েরই অভিন্ন শত্রু দাক্ষিণাত্য থেকে আগত রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুবধারাবর্ষের হাতে দুজনেই পরাজিত হন। ধ্রুব অবশ্য তাঁর সাফল্যকে ধরে রাখতে পারেন নি। কারণ দাক্ষিণাত্যে নিজ রাজ্য রক্ষার্থে তাঁকে ফিরে যেতে হয়। এভাবে, উত্তর ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য ধর্মপালের উদ্যোগ সাফল্য লাভ করে নি।

বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে প্রতীহারদের কিছু সময় লাগে। বিভিন্ন কারণে রাষ্ট্রকূটগণ তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন নি এবং সে কারণগুলির জন্যই তাদেরকে ফিরে যেতে হয়। এ অবস্থায় মধ্যদেশে প্রভাব বৃদ্ধির জন্য শুধু ধর্মপালই রয়ে যান। সম্ভবত তিনি কিছুদিনের জন্য কনৌজের সিংহাসনে তাঁর মনোনীত প্রতিনিধি চক্রায়ুধকে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।

তার এ সাফল্যের কথা সভাকবিদের কলমে অলঙ্কৃত রীতিতে পালদের দলিলপত্রে উল্লিখিত হয়েছে। তাদের প্রশংসাত্মক উক্তিসমূহ ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসনের ১২নং শ্লোকে দেখা যায়। এতে বলা হয়েছে- তিনি মনোহর ভ্রূভঙ্গী বিকাশে (অর্থাৎ চোখের ইঙ্গিত দ্বারা) কান্যকুব্জের রাজ অভিষেক সম্পন্ন করেছিলেন; ভোজ, মৎস্য, মদ্র, কুরু, যদু, যবন, অবন্তি, গন্ধার, কীর প্রভৃতির নরপালগণ প্রণতিপরায়ণ চঞ্চলাবনত মস্তকে ’সাধু সাধু’ বলে এর সমর্থন করেছিলেন এবং হূষ্টচিত্ত পাঞ্চালবৃন্দ কর্তৃক স্বঅভিষেকের স্বর্ণকলস উদ্ধৃত করিয়েছিলেন। পন্ডিতগণ সভাকবি রচিত শ্লোকটিকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে শ্লোকে উল্লিখিত সকল স্থান জয় এবং উত্তরাপথস্বামী হিসেবে পরিগণিত হওয়ার কৃতিত্ব ধর্মপালকে প্রদান করেন।

উপরিল্লিখিত দেশসমূহের উপর ধর্মপালের আধিপত্য বিস্তারের কথা অন্যান্য উপাদানে সমর্থিত হয় নি। ধর্মপালের কিছু সাফল্য হয়ত ছিল এবং তার প্রভাব বলয় বড় জোর কনৌজ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছিল এবং তিনি সেখানে তাঁর মনোনীত প্রতিনিধিকে সিংহাসনে বসাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সভাকবিগণ তাদের রাজপৃষ্ঠপোষকের এ সফলতার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে স্বভাবতই কিছুটা অতিরঞ্জনে লিপ্ত হয়েছেন এবং পশ্চিমাঞ্চলে যে কয়টি দেশের নাম কবিতার ছন্দে মিল খায় সেগুলির নাম উল্লেখ করেছেন। উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত এক বিশাল উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্যের কল্পনাই কবির কাব্যময়তায় বাস্তবতার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। ধর্মপাল উত্তর ভারতের অবিসংবাদিত শাসকে পরিণত হয়েছিলেন এ বক্তব্য সর্বাংশে গ্রহণ করা চলে না।

ধর্মপালের সকল আক্রমণাত্মক অভিযান এবং সাফল্য মোটামুটিভাবে ৭৯০ এবং ৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অর্থাৎ ধ্রুবের প্রত্যাবর্তন এবং তৃতীয় গোবিন্দের আবির্ভাবের মধ্যবর্তী সময়ে সংঘটিত হয়েছিল। প্রতীহার রাজা বৎসরাজের পুত্র ও উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় নাগভট্টের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় সূচিত হয়। নাগভট্ট চক্রায়ুধকে পরাজিত করেন। চক্রায়ুধ ধর্মপালের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে নাগভট্ট মুঙ্গের-এর কাছে এক যুদ্ধে ধর্মপালকেও পরাজিত করেন। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারতে আসেন এবং নাগভট্টকে ভীষণভাবে পরাজিত করেন। নাগভট্টের পরাজয়ের পর ধর্মপাল ও চক্রায়ুধ উভয়েই স্বেচ্ছায় গোবিন্দের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু গোবিন্দকেও তাঁর পিতার ন্যায় দাক্ষিণাত্যে (৮০১ খ্রি.) ফিরে যেতে হয়েছিল। তারপর থেকে ধর্মপালকে সম্ভবত আর কোন বিপদের সম্মুখীন হতে হয় নি। এটি অসম্ভব নয় যে, ধর্মপাল উত্তর ভারতের কিছু অংশের উপর হয়ত তাঁর আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন যদিও তা সুনির্দিষ্ট করে জানা যায় না।

তাই বলা যায় যে, ধর্মপাল বাংলার ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূত্রপাত করেছিলেন। তিনি স্বল্প সময়ের জন্য কনৌজ পর্যন্ত তাঁর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। প্রতীহার এবং রাষ্ট্রকূট রাজাদের কাছে পরাজিত হলেও ধর্মপাল তার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে বাংলা সমৃদ্ধি ও সফলতা অর্জন করেছিল যা পাল সভাকবিদেরকে প্রশস্তি রচনায় কিছুটা অতিরঞ্জনে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

ধর্মপাল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। বিক্রমশীল বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের কৃতিত্ব তাঁর। নয় শতক থেকে বারো শতক পর্যন্ত সমগ্র ভারতে এটি ছিল বৌদ্ধদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র। পাহাড়পুরের সোমপুর বিহারও ধর্মপালের আরেক কীর্তি। ধর্মপাল সমান উৎসাহে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও মন্দিরেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। বলা হয় যে, তিনি শাস্ত্রানুশাসন সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন এবং প্রতি বর্ণের লোক যাতে স্ব স্ব নীতি মেনে চলতে পারে সেজন্য তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির প্রবর্তক হিসেবে তাঁকে গণ্য করা যেতে পারে। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা বাংলায় পাল শাসনের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

আরব ভৌগোলিক ও বণিকদের বিবরণে ধর্মপালের অধীনে বাংলা সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যায়। সুলায়মান (মৃত্যু ৮৫১ খ্রি.), ইবনে খুরদাদবিহ (মৃত্যু ৯১২ খ্রি.), ইদ্রিসী (জন্ম-এগারো শতকের শেষপাদে), মাসুদী (মৃত্যু ৯৫৬ খ্রি.) প্রমুখ উল্লেখ করেন যে, বাংলার রাজা রাষ্ট্রকূট (বলহার) এবং গুর্জর (জুর্জ)দের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন। এরা সকলেই উল্লেখ করেন যে, নয় থেকে দশ শতকে বাংলা সামুদ্রিক বাণিজ্যে সমৃদ্ধ ছিল এবং এ বাণিজ্যে আরবদের বেশ প্রাধান্য ছিল। ফারসি ভাষায় লেখা হুদুদ-উল-আলম (৯৮২-৮৩ খ্রি.)-এ লিপিবদ্ধ আছে যে, ধর্মপাল (দহুম) নিজের চাইতে অপর কাউকে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন না এবং তাঁর ৩ লক্ষ সদস্যের একটি সেনাবাহিনী ছিল।  [আবদুল মমিন চৌধুরী]