আসবাবপত্র

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:১৯, ১৯ জুন ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

আসবাবপত্র গৃহে ব্যবহূত অস্থাবর সামগ্রী যেমন চেয়ার, টেবিল, খাট ইত্যাদি। পর্দা, কম্বল, আয়না, বাতি এবং অন্যান্য যাবতীয় গৃহসজ্জার জিনিস আসবাবপত্রের অন্তর্ভুক্ত। আদিকাল থেকেই সংস্কৃতির বিকাশের সঙ্গে আসবাবপত্রের ক্রমবিবর্তন ঘটছে। আঠারো শতকের শেষ অবধি বাংলার আসবাবপত্রের নকশা ও কারুকার্যের উৎস ছিল দুটি যথা, প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতি এবং মধ্যযুগের মুসলিম সংস্কৃতি। এ ছাড়া কাঠ ও হাতির দাঁতের উপর কাজ করার প্রাচীন প্রাচ্যীয় কৌশলও উৎস হিসেবে কাজ করেছে।

ঐতিহ্যবাহী আসবাবপত্র টেরাকোটা শিল্প, দেবদেবীর প্রতিকৃতি, মন্দিরভিত্তিক চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, কাঠ ও হাতির দাঁতের কাজের নমুনা থেকে প্রাচীন ও মধ্যযুগের আসবাবপত্র সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে। প্রচলিত আসবাবপত্রের মধ্যে কাঠের তক্তপোশ, বেত অথবা  বাঁশ দিয়ে তৈরি মোড়া, মোটা সুতি কাপড়ের তৈরি ডোরাকাটা শতরঞ্জি, সুতি কাপড়ে তৈরি লম্বা ফরাস, বসার জলচৌকি, হাতে বোনা উন্নত ও তুলনামূলক নিম্নমানের পাটি, বিভিন্ন ধরনের মোটা মাদুর, কাঠের তৈরি বসার পিঁড়ি, পাট দিয়ে তৈরি ছালা, কুশা নামক ঘাসের তৈরি কুশন ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। বসা ও শোবার কাজে ব্যবহূত এসব আসবাবপত্রের সঙ্গে ছোটখাট আরও অনেক আনুষঙ্গিক তৈজসপত্র রয়েছে, যেগুলি এখন আর তেমন প্রচলিত নয়।

রন্ধন এবং খাবার কাজে ব্যবহূত তৈজসপত্রের মধ্যে রয়েছে, চিনামাটির বাসন, পিতল অথবা অন্য ধাতব থালা, পিতল অথবা মাটির তৈরি বাটি, পিতল বা মাটির তৈরি পানির ঘট, বদনা ও কলসি, পিতলের পাতিল, লোহার কড়াই, মাটির পাতিল ইত্যাদি। এ ছাড়া, রন্ধন কাজে ব্যবহূত আরও কিছু তৈজসপত্র রয়েছে যেমন, মাটির মালসা, মশলা গুড়া করার জন্য পাথরের শিল-পাটা ও হামানদিস্তা।

গৃহস্থালির জিনিসপত্র কাটা বা খনন কার্যে ব্যবহূত যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে দাও, মাছ কোটার বটি, সুপারি কাটার সরতা, কাঁচি, এবং কোদাল। জিনিসপত্র রাখার তৈজসের মধ্যে রয়েছে বড় কাঠের সিন্দুক, বেতের তৈরি পেটরা বা বাক্স, ধান-চাল ইত্যাদির পাত্র রাখার জন্য বাঁশের মাচা, বাঁশের সরু পাত দিয়ে তৈরি ডোল, মাটির মটকি, বেতের ডালি, আগুন জ্বালানোর জন্য কুলসা, আইলা, ধান-চাল ইত্যাদি রাখা বা বয়ে নেওয়ার ছালা, বাঁশের তৈরি সাজি ইত্যাদি।

প্রত্যেক হিন্দু বাড়িতেই কিছু ধর্মীয় চিত্রকর্ম থাকে। এসবের মধ্যে রয়েছে গণেশের মূর্তি, লক্ষ্মীদেবীর প্রতিকৃতি, বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিকৃতি ও দেবদেবীর বাহন বলে পরিচিত প্রাণীর মূর্তি। মুসলমানদের বাড়িতে দরজায় অথবা অন্য উপযুক্ত স্থানে  আল-কুরআনএর বাণী খচিত করতে দেখা যায়। মুসলমানদের অন্যান্য চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে মসজিদ, দরগাহ ইত্যাদি বিষয়ে ধর্মীয় শিল্পকর্ম।

আধুনিক আসবাবপত্র আধুনিক আসবারপত্রের সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসনের একটা সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ইউরোপের বণিকরা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে স্থাপিত তাদের ব্যবসায় কেন্দ্রগুলিতে সমসাময়িক ইউরোপীয়ান ফ্যাশানের আসবাবপত্র দ্বারা অফিস ও বাসগৃহ সজ্জিত করত। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ইউরোপীয় আসবাবপত্রের ব্যবহার ইউরোপীয়ানদের বাসগৃহ ও অফিসেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাঙালিরা তাদের গৃহে বাংলার ঐতিহ্যবাহী আসবাবপত্র ব্যবহার করেছে, এমনকি অফিসে ব্যবহারের জন্যও স্থানীয় আসবাবপত্র বাঙালিরা বেশি পছন্দ করেছে। তারা টেবিল, চেয়ার খুব কমই ব্যবহার করত। পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান এবং দ্রুত নগরায়ণের ফলে ভদ্রলোক সমাজের লোকেরা তাদের গৃহ ও অফিস সাজ-সজ্জার কাজে পাশ্চাত্যের ধরন অনুকরণ করতে শুরু করে, যদিও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, বিশেষ করে পল্লী এলাকার মানুষ তাদের ঐতিহ্যবাহী আসবাবপত্রকেই অাঁকড়ে থাকে।

সময়ের বিবর্তনে কাঠের আসবাবপত্রের সঙ্গে স্টিল, অন্যান্য ধাতু এবং প্লাস্টিকের তৈরি নানা ধরনের আধুনিক আসবাবপত্র বিস্তার লাভ করে। এগুলি এখন বাসগৃহ, অফিস, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, হাসপাতাল এবং সম্মেলনকেন্দ্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসবাবপত্রের ব্যবহারে নানা কারণে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। গ্রামাঞ্চলে এখনও ঐতিহ্যবাহী আসবাবপত্রের প্রচলন বেশি, তবে দেশিয় কৌশল ও কাঁচামালে তৈরি এসব আসবাবপত্রের সঙ্গে আধুনিক নকশা যুক্ত হচ্ছে। গ্রামীণ স্কুল, রেস্টুরেন্ট ও কমিউনিটি সেন্টারগুলিতে ঐতিহ্যবাহী আসবাবপত্রের পাশাপাশি আধুনিক আসবাবপত্র ব্যবহূত হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে আধুনিক আসবাব ঐতিহ্যবাহী আসবাবপত্রের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে।

শ্রেণিভেদে এখনও গ্রামাঞ্চলের মানুষ ব্যাপকভাবে কাঠের আসবাবপত্র ব্যবহার করে। গ্রামীণ কৃষকের ব্যবহার্য আসবাব সাধারণত মজবুত কিন্তু কারুকাজের দিক থেকে সুচারু ও দ্রুত পরিবর্তনশীল নয়। গ্রামীণ ধনী কৃষকের বাসগৃহ খাট, আলমারি, সিন্দুক, আলনা, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি উন্নততর আসবাবপত্রে সজ্জিত হতে দেখা যায়। অপরদিকে গ্রামীণ দরিদ্র কৃষকের বেঁচে থাকার মতো অন্নসংস্থান করা কষ্টকর, তাই তার গৃহসজ্জায় ব্যবহূত হয় প্রাচীন ধরনের টুল, মই, খাট, তাক ইত্যাদি। অন্যদিকে একজন ভূমিহীন কৃষকের সম্বল হয়ত কেবল একটি মাদুর। বাঁশ ও বেতের তৈরি বাক্স, ডুলা, কাঠের তাক ইত্যাদি আসবাবপত্র গ্রামের প্রায় সব কৃষকের বাড়িতেই ব্যবহূত হয়। শহরের গৃহসজ্জায় একদিকে ব্যবহূত হয় কাঠ, বেত, ইত্যাদি প্রাকৃতিক এবং অন্যদিকে স্টিল কিংবা প্লাস্টিকের মতো কৃত্রিম সামগ্রীতে তৈরি আধুনিক আসবাবপত্র। শহর এলাকার গৃহে ব্যবহূত আধুনিক আসবাবপত্রের মধ্যে রয়েছে খাট, সোফাসেট, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, ওয়ার্ড্রব এবং পাকঘরে ব্যবহূত আলমারি বা কিচেন ক্যাবিনেট। অফিসে ব্যবহূত আসবাবপত্রের মধ্যে রয়েছে নথি সংরক্ষণের আলমারি বা ফাইল ক্যাবিনেট, টেবিল, চেয়ার, তাক ইত্যাদি। সম্মেলনকক্ষে টেবিল, স্থির চেয়ার, বেঞ্চ, টুল ইত্যাদি, হাসপাতালে যান্ত্রিক খাট, হুইল চেয়ার এবং খাদ্য ও ঔষধপত্র নেওয়ার ট্রলি ব্যবহূত হয়।

অফিসে ব্যবহূত আধুনিক আসবাবপত্রের বেশির ভাগই স্টিল অথবা অন্যান্য ধাতুনির্মিত। আশির দশক থেকে শুরু করে এ ধরনের আসবাবপত্র বর্তমানে বাসগৃহ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, হোটেল, রেস্টুরেন্ট,  বিমান বন্দর, রেলস্টেশন ও বন্দরের মতো জনসমাগম স্থানগুলিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। আসবাবপত্রের নকশার উন্নয়ন একটি চলমান বিষয়, যদিও এর একটি ধারার সঙ্গে প্রায়ই অপর কোনো ধারার সংমিশ্রণ ঘটে। একটি বিশেষ ধরন চালু হলে আগের ধরনটি সহসাই বন্ধ হয়ে যায় না। নকশা এবং নকশার ধরন প্রায়ই পরস্পরের সঙ্গে সংমিশ্রণ হয় এবং এভাবেই উন্নয়নের গতি অব্যাহত থাকে।

কাঠের আসবাবপত্র  মজবুত অাঁশ দ্বারা গঠিত গাছের বৃহৎ কান্ড থেকে আহরিত কাঠ থেকেই কাঠের আসবাবপত্র তৈরি হয়। উদ্ভিদ বিদ্যার ভাষায় এ অাঁশের নাম Xylem (জাইলেম)। কাঠের তৈরি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত আসবাবপত্র হচ্ছে চেয়ার, টেবিল, খাট, ওয়ার্ড্রব, জিনিসপত্র রাখার তাক, দেরাজওয়ালা আলমারি, ড্রেসিং টেবিল এবং সোফাসেট। উন্নতমানের আসবাবপত্র তৈরির জন্য যেসব কাঠ ব্যবহূত হয় তার মধ্যে  মেহগনিসেগুন, গর্জন, চাপালিশ, চিকরাশি, শিলকড়ই, গামারি, বাদাম এবং চেরি অন্তর্ভুক্ত। প্রায় সবধরনের আসবাবপত্র তৈরিতে সেগুন এবং চাপালিশকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। চিকরাশি, শিলকড়ই, টিকচম্বল কাঠ খুবই সোজা এবং শক্ত বলে এগুলিতে পেরেক লাগানো সুবিধাজনক। তাই এসব কাঠ আসবাবপত্রের কাঠামো তৈরি এবং সজ্জিতকরণের কাজে বেশি ব্যবহূত হয়। অনেক সময় উন্নতমানের আসবাবপত্র বলে চালিয়ে দেওয়ার জন্য পাতিকড়ই (Raintree), আম এবং অন্যান্য ফলজ গাছের নিম্নমানের কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র তৈরি করা হয়।

সেগুন কাঠের চেয়ারে ভিক্টোরিয়ান নকশা খোদাইকরণ

আসবাবপত্র তৈরির সঙ্গে কাঠ শুকানোর প্রক্রিয়া ছাড়াও প্লাইউড, হার্ডবোর্ড, লেমিনেটেড উড ইত্যাদি কারখানার সম্পৃক্ততা রয়েছে। আসবাবপত্র তৈরির আগে কাঠ ভাল করে সিজনিং করে নিতে হয়। কাঠকে আবহাওয়া-সহনীয় (সিজনিং) করার দেশি পদ্ধতি হচ্ছে কাঠ ২০ থেকে ৩০ দিন পানিতে ভিজিয়ে রেখে তারপর ভাল করে রোদে শুকানো। আজকাল অনেক সংস্থাই শক্ত কাঠ এবং প্লাইউড-এ উচ্চমাত্রায় বিদ্যুতের তাপ প্রয়োগ করে অধিকতর কার্যকর পন্থায় এ কাজটি সমাধা করে। টেবিল ও চেয়ার-এর পায়া তৈরিতে লেমিনেটেড বা বিন্যস্ত কাঠ ব্যবহূত হচ্ছে। কম দামি আসবাবপত্র তৈরি, সিন্দুকের পেছনের দিকের আচ্ছাদন এবং দেরাজের তৈরিতে হার্ডবোর্ড বা ফাইবার বোর্ড ব্যবহার করা হয়।

বিভিন্ন ধরনের ক্রেতাদের সন্তুষ্টির জন্য শহর এলাকার আসবাবপত্র তৈরির কারখানাগুলিতে দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ কাঠমিস্ত্রিগণ কাঠে নকশা তৈরি করে। অনেক সময় দেখা যায়, অভিজ্ঞ মিস্ত্রিগণ কোনো রকম পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই কাঠ নিয়ে কাজ শুরু করে এবং কাজের মধ্য দিয়ে বস্ত্তর একটা সুন্দর রূপদানে সক্ষম হয়।

বাংলাদেশের প্রায় সকল শহরেই কাঠের আসবাবপত্র তৈরির বিশেষ বিশেষ এলাকা রয়েছে।  ঢাকা শহরে এ ধরনের এলাকাগুলি হচ্ছে, গুলশান, মীরপুর, শাহজাহানপুর এবং স্টেডিয়াম মার্কেট।

চট্টগ্রাম, কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, খুলনা এবং সিলেট জেলার বনাঞ্চল থেকেই প্রধানত বিভিন্নমান ও আকার-আকৃতির কাঠ আসে। বার্মার সেগুন এবং অন্যান্য গর্জন ও চিকরাশি কাঠ আসে মায়ানমার, ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, হংকং এবং জাপান থেকে। বাংলাদেশ বছরে সাতশ থেকে এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের তৈরি আসবাবপত্র মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, এবং মায়ানমারসহ অন্যান্য কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করে। এসব আসবাবপত্রের মধ্যে রয়েছে খাট, ড্রেসিংটেবিল, চেয়ার এবং রান্নাঘরে ব্যবহূত আলমারি বা কিচেন ক্যাবিনেট। বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় কিছু কিছু কাঠের আসবাবপত্র রপ্তানিও হয়। এসবের মধ্যে রয়েছে ডাইনিং টেবিল, বই রাখার আলমারি, দেরাজওয়ালা আলমারি, টেলিভিশন রাখার টেবিল, ছোট সাইডবোর্ড ইত্যাদি। আসবাবপত্র রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ বছরে প্রায় ২ কোটি মার্কিন ডলার আয় করে।

বাংলাদেশের পল্লী এলাকায় কাঠের আসবাবপত্রের একটা ভিন্নতর চিত্র পাওয়া যায়। গ্রামে এখনও সহজ এবং পুরাতন পদ্ধতির আসবাবপত্র ব্যবহূত হয়। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে গৃহনির্মাণ ও জ্বালানির কাজে কাঠের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে উন্নতমানের কাঠের দারুণ অভাব দেখা দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে দক্ষ, বিশেষজ্ঞ কাঠমিস্ত্রি এবং নির্মাণসামগ্রীর স্বল্পতার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসবাবপত্র সহজ ও পুরানো ধরনের রয়ে গেছে। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাড়িতে যেসব আসবাবপত্র ব্যবহূত হয় তার মধ্যে রয়েছে চেয়ার, টেবিল, খাট, আলনা, বসার টুল, সিন্দুক, ওয়ার্ড্রব, শোকেস, আলমারি, তাক, মই।

কাঠের আসবাবপত্র দেখতে সুন্দর, তুলনামূলকভাবে দামে কম এবং বেশি টেকসই, আর এর নির্মাণসামগ্রী সহজলভ্য। এ কারণেই কাঠের আসবাবপত্র সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাংলাদেশে অন্যান্য সকল আসবাবপত্রকে প্রতিযোগিতায় দূরে রাখতে পেরেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বনায়নের স্বল্পতা ও কাঠের অভাবের ফলে কাঠের আসবাবপত্র তৈরি ক্রমেই অধিক ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে।

বেতের আসবাবপত্র  সৃজনশীল নকশা এবং চমৎকার শৈল্পিক মান সম্বলিত বেতের আসবাবপত্র হস্তশিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অমূল্য ও গৌরবময় ঐতিহ্যের সাক্ষ্য দেয়। বেতের এসব আসবাবপত্রের মধ্যে ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে, ড্রেসিং টেবিল, আরাম কেদারা, দোলনা চেয়ার, আলনা, জুতা রাখার তাক সবকিছুই রয়েছে। শৈল্পিক গুণের অধিকারী হস্তশিল্পিগণ তাদের কায়িক শ্রম ও মননশীলতার দ্বারা বেতের অত্যন্ত উন্নতমানের চেয়ার, টেবিল, সোফাসেট, বুক শেলফ, খাট, কর্নার টেবিল, হালকা দেয়াল বা পার্টিশন, ওয়ার্ড্রব, আলমারি, শোকেস, চারা গাছের খাঁচা, আয়নার ফ্রেম, ট্রলি, শো পিস ইত্যাদি নিপুণভাবে তৈরি করে। আসবাবপত্রের বহিরাবরণে রজনীগন্ধা, কদম, সূর্যমুখী, শাপলা ইত্যাদি ফুল অথবা, চাঁদ, তারকা,  নৌকা, নদীর ঢেউ ইত্যাদি অঙ্কন করা হয়। সকল শ্রেণির ক্রেতার চাহিদা মোতাবেক প্রস্ত্ততকারীদের নিকট দেশি-বিদেশি আসবাবপত্রের তালিকা (ক্যাটালগ) প্রদর্শনের জন্য সংগৃহীত থাকে।

বেতের আসবাবপত্র

আসবাবপত্রের কাঠামো তৈরির জন্য গোল্লা বা মোটা বেত, প্রধান অংশ বা অঙ্গ তৈরিতে চিকন বেত এবং বাইরের দিক সজ্জিত করার কাজে ফালি, চানি, রজন বেত ব্যবহার করা হয়। মায়ানমার, ভারত ও সিঙ্গাপুর থেকে গোল্লা বেত আমদানি করা হয়। চিকন ও হালকা বেত স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় এবং সিলেট, চট্টগ্রাম,  বান্দরবানফেনীফরিদপুরপাবনাটাঙ্গাইল এবং অন্যান্য স্থানে পাওয়া যায়। বেতের আসবাবপত্রের নির্মাণ কাজ শেষ হলে স্বাভাবিক রঙের দেখাতে পাতলা বার্নিশ প্রদান করা হয়।

বেতের সামগ্রী তৈরির পেশায় নিয়োজিত একজন নবীন মিস্ত্রি প্রাথমিক পর্যায়ে দু বেলা অন্নসংস্থানের মতো রোজগার করতে সক্ষম হয়। তবে দক্ষতা অর্জনের পর তার মাসিক রোজগার ৫ হাজার টাকার কাছাকাছি দাঁড়ায়। অপরদিকে, কাঠামো তৈরি করে তার সিনিয়র সহকর্মী বা ওস্তাদ মাসে ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করতে পারে। বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বেতের চাষ হয় না। এগুলি ঝোপ-জঙ্গলে স্বল্পপরিমাণ জন্মে এবং মানের দিক থেকেও তেমন উন্নত নয়। তাই উন্নতমানের বেত বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, এর ফলে উৎপাদিত সামগ্রীর মূল্য বেশি হয়। সুখের বিষয় যে বেশ কিছুসংখ্যক সুদক্ষ কারিগর দেশে রয়েছে যারা বংশানুক্রমে এ পেশা গ্রহণ করে এবং অন্যদেরকে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দিতে পারে।

সারাবিশ্বে, বিশেষ করে এশিয়া ও ইউরোপে বেতের তৈরি আসবাবপত্রের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশ বেতের তৈরি বিভিন্নধরনের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আসবাবপত্র রাশিয়া, জার্মানি, সিঙ্গাপুর এবং মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করে থাকে। জার্মানি, কানাডা, জাপান ও অন্যান্য দেশে অনুষ্ঠিত বেশ কতগুলি আন্তর্জাতিক হস্তশিল্প মেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বেতশিল্পে বিশ্ব জোড়া খ্যাতি অর্জন করেছে।

প্লাস্টিক আসবাবপত্র   ছাঁচে ফেলে প্রচন্ড চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে প্লাস্টিক থেকে তৈরি আসবাবপত্রের মধ্যে একদিকে রয়েছে শক্ত ও অনমনীয় এবং অন্যদিকে নরম এবং রাবারের মতো নমনীয় আসবাবপত্র। হালকা, সহজে পরিষ্কার করা যায়, মজবুত, টেকসই এসব প্লাস্টিকের আসবাবপত্র প্রকৃতি প্রদত্ত কাঠের আসবাবপত্রের স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে।

তুলনামূলকভাবে নতুন আসবাবসামগ্রীর মধ্যে প্লাস্টিকের আসবাব এখন তালিকায় শীর্ষে। ১৯৮০-র দশক থেকে ব্যাপকভাবে প্লাস্টিকের আসবাবপত্র তৈরি শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাপসংহত এবং স্থায়িভাবে তৈরি প্লাস্টিক সবচেয়ে বেশি কার্যোপযোগী। এগুলি বেশ টেকসই এবং ছোট আলমারি, টেবিল-চেয়ার, দেরাজের হাতল ও নব-এর মতো আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি তৈরির জন্য খুবই উপযোগী। প্লাস্টিক ছাঁচে ফেলে নতুন ধরনের ভাস্কর্য তৈরির এক ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। আসবাবপত্র শিল্পে প্লাস্টিকের সবচেয়ে বড় ব্যবহার হচ্ছে লেমিনেটেড শিট তৈরি করা। এগুলি কার্বলিকের সঙ্গে সুতি, শন, পাটের কাপড় ও অন্যান্য তন্তু এমনকি কাগজ সংমিশ্রণের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। এগুলি প্লাস্টিকের সঙ্গে আঠা জাতীয় জিনিস দিয়ে সহজেই জোড়া লাগানো সম্ভব। এসব শিট কাঠের অনুকরণে টেকসই এবং বিভিন্ন রঙে তৈরি করা হয়, টেবিলের উপরিভাগ, রান্নাঘরের আসবাবপত্র, গোসলখানার আসবাবপত্র তৈরির কাজে এসব ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। এ ছাড়া বুনন অথবা শিট আকারের প্লাস্টিক ব্যবহূত হয় চেয়ার, টেবিল, বিছানা ইত্যাদির আচ্ছাদন বোনার কাজে।

বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে প্লাস্টিকের আসবাবপত্র তৈরির সঙ্গে জার্মানি, মালয়েশিয়া, ভারত এবং অন্যান্য কয়েকটি দেশ থেকে তৈরি প্লাস্টিক সামগ্রী আমদানির একটা সম্পর্ক রয়েছে। গত দু দশকে দেশে এ ধরনের বহুসংখ্যক প্লাস্টিকের কারখানা গড়ে উঠেছে। এগুলির মধ্যে বড় কারখানাগুলি প্রধানত ঢাকা (লালবাগ, জিঞ্জিরা, তাঁতিবাজার, শাঁখারিবাজার, তেজগাঁও ইত্যাদি স্থানে), চট্টগ্রাম এবং সিলেটে অবস্থিত। প্লাস্টিকের আসবাবপত্র তৈরির জন্য বাংলাদেশ মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর থেকে প্লাস্টিকের লেমিনেটেড শিট, তন্তু এবং কাঠের আকারবিশিষ্ট স্তরে স্তরে বিন্যস্ত প্লাস্টিক আমদানি করে।

ইস্পাত বা স্টিল আসবাবপত্র ইস্পাত বা স্টিল এবং অন্যান্য ধাতব খাদ দ্বারা বহু ধরনের আসবাবপত্র তৈরি হয়, এর মধ্যে রয়েছে চেয়ার, টেবিল, যান্ত্রিক খাট এবং ওয়ার্ড্রব। বাংলাদেশে স্টিল অথবা ধাতব আসবাবপত্র তৈরির ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। ব্রিটিশ শাসনামলেই সমাজের উঁচু স্তরের লোকেরা ধাতুনির্মিত আমদানিকৃত আসবাবপত্র যথা, সিন্দুক, আলমারি, ওয়ার্ড্রব ইত্যাদি ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর স্টিলের তৈরি আসবাবপত্রে নতুন নক্সা ও স্থানীয় নির্মাণ-কৌশল সংযোজিত হয় এবং এর ব্যবহারও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। বিহারি কারিগরগণ বংশানুক্রমে স্টিলের সিন্দুক, আলমারি, তাক ইত্যাদি তৈরিতে দক্ষতা অর্জন করে। তবে ১৯৮০-র দশক থেকে স্টিল নির্মিত আসবাবপত্রের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। কয়েক বছরের মধ্যেই এগুলি অফিস ও কর্মস্থলে অন্যান্য আসবাবপত্রের সঙ্গে যুগপৎ ব্যবহূত হতে থাকে।

অফিসে ব্যবহূত পাতলা স্টিলের পাতে তৈরি আসবাবপত্র এখন প্রায় সর্বজনীনভাবে ব্যবহূত হচ্ছে। গৃহস্থালিতে ব্যবহূত অনেক প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও এখন স্টিলের তৈরি। স্টিলের নির্মিত আসবাবপত্রের মধ্যে রয়েছে আলমারি, সোফাসেট, নথি রাখার ক্যাবিনেট, বিভিন্ন ধরনের চেয়ার, তাক, শেলফ ইত্যাদি। গৃহে ব্যবহূত স্টিলের আসবাবপত্রের মধ্যে খাট, সোফাসেট, আলনা, ড্রেসিং টেবিল, শোকেস, রান্নাঘরে ব্যবহূত ক্যাবিনেট অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে হাসপাতালে ব্যবহূত স্টিলের আসবাবপত্রের মধ্যে রয়েছে যান্ত্রিক বিছানা, হুইল চেয়ার, ঔষধ ও খাদ্য বহনের ট্রলি ইত্যাদি। স্টিল ও ধাতব আসবাবপত্রের কভার তৈরির কাজে মোটা কাপড় এবং প্লাস্টিক ব্যবহূত হচ্ছে। লেমিনেটেড প্লাস্টিক প্রায়শই টেবিলের উপরিভাগ তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়।

অ্যালুমিনিয়াম অথবা ম্যাগনেশিয়ামের মিশ্রণে তৈরি হালকা ও শক্ত খাদ থেকে বাড়ির বাগান বা লনে ব্যবহূত আসবাবপত্র তৈরি হয়। স্টিলের আসবাবপত্র তৈরির অন্যান্য উপকরণের মধ্যে রয়েছে জয়েন্ট, স্ক্রু, হাতল, তালা, ফোম, রেক্সিন এবং কাপড়। প্রেস পাউডার, তিসির তেল, শিরিশ কাগজ ইত্যাদি ব্যবহূত হয় বার্নিশ করার কাজে।

স্টিলের আসবাবপত্র তৈরির কারখানা কতকগুলি বিশেষ স্থানে, যেখানে নির্মাণ সামগ্রী সহজলভ্য, সেখানেই গড়ে উঠেছে। এসব স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঢাকা (বংশাল, ধোলাই খাল, যাত্রাবাড়ী, ধোলাইপাড়, পোস্তগোলা) খুলনা, চট্টগ্রাম,  রাজশাহী এবং  নারায়ণগঞ্জ। কাঠের আসবাবপত্রের বেলায় অবস্থাটা ঠিক এর বিপরীত।

জাপান, মালয়েশিয়া, চীন, ভারত থেকে বাংলাদেশ স্টিলের পাত এবং ইংল্যান্ড, চীন ও ভারত থেকে তালা আমদানি করে। এ ছাড়া সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে স্টিলের তৈরি আধুনিক আসবাবপত্র, যথা ফোল্ডিং চেয়ার, নথি রাখার ক্যাবিনেট, রিভলরিং চেয়ার, শয়নকক্ষে ব্যবহূত সেট, আগুনে পোড়ে না এমন সিন্দুক আমদানি করে। বাংলাদেশ স্টিলের তৈরি শোপিস, পুতুল, পদক, চারা সংরক্ষণের খাঁচা, গাছের ও প্রাণীর প্রতিকৃতি ইউরোপ, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানি করে।

স্টিলের তৈরি আসবাবপত্রে তুলনামূলকভাবে খরচ পড়ে বেশি, তবে এগুলি দেখতে সুন্দর, মজবুত এবং নতুন নকশা সংযোজনের জন্য উত্তম। এগুলি ব্যবহারকারীদের মধ্যে গরিব এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মানুষ তেমন একটা নেই। তথাপি স্টিলের তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা বাড়ছে এবং অধিক হারে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দাম কমছে।  [গোফরান ফারুকী]