নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ
নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহ (১৪৩৫-১৪৫৯) বাংলার সুলতান এবং সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ এর বংশধর। ৮৩৯ হিজরিতে (১৪৩৫ খ্রি.) নাসিরুদ্দীন আবুল মুজাফফর মাহমুদ শাহ উপাধি নিয়ে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর সিংহাসনারোহণের ফলে প্রায় তেইশ বছর (১৪১২-১৪৩৫ খ্রি.) বিরতির পর ইলিয়াস শাহী বংশ পুনরায় বাংলার শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়।
নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শান্তিপ্রিয় লোক ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে বাংলা দিল্লি সালতানাতের সাথে কোন যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হয় নি। জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহ এর সময় থেকে জৌনপুরের শর্কী সুলতানগণ বাংলার সুলতানদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁরা দিল্লির লোদী সুলতানদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাপৃত হন। ফলে শর্কী কিংবা দিল্লির সুলতানদের কেউ বাংলার দিকে তাঁদের লোলুপ দৃষ্টি ফেলতে পারেন নি। এ পরিস্থিতিতে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ তাঁর রাজ্যের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের দিকে সময় ও মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পান। তদুপরি নাসিরুদ্দীন মাহমুদ বাংলার সামরিক শক্তিও পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন এবং এর ফলে সামরিক বিজয়ও লাভ করেন।
শিলালিপি থেকে প্রমাণিত হয় যে, তাঁর রাজত্বকালে খান জাহান খুলনা-যশোহর এলাকা জয় করেন। উড়িষ্যার একটি ভূমিদান লিপি থেকে জানা যায় যে, নাসিরুদ্দীন মাহমুদ উড়িষ্যার রাজা কপিলেন্দ্র দেবের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং এ যুদ্ধে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ পরাজিত হন। কিন্তু অস্পষ্ট তথ্যাদির উপর প্রতিষ্ঠিত এ ধারণা নিতান্তই কল্পনাপ্রসূত। এমনও বলা হয়েছে যে, নাসিরুদ্দীন মাহমুদ মিথিলা জয়ের উদ্দেশ্যে মিথিলা অভিমুখে অভিযান করেন। কিন্তু মিথিলারাজ ভৈরব সিংহ তাঁর সে প্রয়াস ব্যর্থ করে দেন। এটি ঘটনার অতিরঞ্জিত বিবরণ বলে মনে হয়। নাসিরুদ্দীন মাহমুদের শিলালিপির প্রাপ্তিস্থল এবং তাঁর মুদ্রায় উল্লিখিত টাকশাল শহরের নাম থেকে বোঝা যায় যে, তিনি পশ্চিমে ভাগলপুর, পূর্বে ময়মনসিংহ ও সিলেট, উত্তরে গৌড়-পান্ডুয়া এবং দক্ষিণে হুগলি পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল রাজ্যের অধিকারী ছিলেন।
নাসিরুদ্দীন মাহমুদের রাজত্বকালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অগ্রগতি ছিল মুসলিম উপনিবেশের দৃঢ় সম্প্রসারণ এবং বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁদের বসতি স্থাপন। দক্ষিণ বাংলায় মুসলিম বসতি স্থাপনের এ প্রক্রিয়ার পুরোধা ছিলেন খান জাহান। মসজিদ নির্মাণ, পুকুর খনন এবং এ ধরনের আরও বহু জনহিতকর কাজের মাধ্যমে তিনি পুনর্বাসনের একটি সুনিয়ন্ত্রিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রাজ্যের অন্যান্য অংশেও মুসলিম বসতি স্থাপন ও উপনিবেশ সম্প্রসারণের অনুরূপ কাজ চলতে থাকে।
নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শিল্প ও স্থাপত্যের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, তাঁর রাজত্বকালে বহু মসজিদ, খানকাহ, সেতু ও সমাধিসৌধ নির্মিত হয়। তাঁর রাজত্বকালে নির্মিত মসজিদগুলির মধ্যে বাগেরহাটের খান জাহানের ষাটগম্বুজ মসজিদ, মুর্শিদাবাদ জেলার জঙ্গীপুরে সরফরাজ খানের নির্মিত দুটি মসজিদ (১৪৪৩), গৌড়ের নিকটবর্তী এলাকায় জনৈক হিলালী কর্তৃক নির্মিত মসজিদ (১৪৫৫), ঢাকার বখত বিনত মসজিদ (১৪৫৫) এবং ভাগলপুরে খুরশীদ খানের মসজিদ (১৪৪৬) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাগেরহাটে খান জাহান আলীর সমাধিসৌধ এবং হজরত পান্ডুয়ায় জনৈক আল্লামার সমাধিসৌধ তাঁর রাজত্বকালে নির্মিত হয়। নাসিরুদ্দীন মাহমুদ নিজে গৌড়ে একটি দুর্গ ও প্রাসাদের ভিত্তি স্থাপন করেন। বহু ইমারত দ্বারা তিনি গৌড় শহর সুসজ্জিত করেন। স্থাপত্যকীর্তিসমূহের মধ্যে পাঁচটি খিলানবিশিষ্ট পাথরের সেতু, দুর্গের পুরু দেয়াল এবং কোতোয়ালী দরওয়াজার অস্তিত্ব এখনও বিদ্যমান। উপরিউক্ত ইমারতসমূহ নাসিরুদ্দীন মাহমুদের রাজত্বকালে শান্তি ও সমৃদ্ধির উজ্জ্বল সাক্ষ্য বহন করছে।
নিজামউদ্দীন আহমদ ও ফিরিশতা নাসিরুদ্দীন মাহমুদের প্রশংসা করেন। তাঁদের মতে, তিনি একজন আদর্শ সুলতান ছিলেন এবং তাঁর রাজত্বকালে সাধারণ ও অভিজাত, ধনী ও দরিদ্র সর্বস্তরের মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে সুখী ও পরিতৃপ্ত জীবন যাপন করত। গোলাম হোসেইন সলিমও তাঁকে উদার ও ন্যায়পরায়ণ সুলতান বলে বর্ণনা করেন। তিনি আরও বলেন যে, তাঁর সুশাসনে যুবক-বৃদ্ধ সকলেই সন্তুষ্ট ছিলেন এবং পূর্ববর্তী সুলতান সামসুদ্দিন আহমদ শাহের নির্যাতনের ক্ষত নিরাময় হয়েছিল। চবিবশ বছর শান্তিপূর্ণ রাজত্বের পর ৮৬৪ হিজরিতে (১৪৫৯ খ্রি.) সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ এর মৃত্যু হয়। [এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমদ]