তাতার খান
তাতার খান দিল্লির তুগলক সুলতানদের অধীনে সোনারগাঁ প্রদেশের শাসনকর্তা। তাতার খান ছিলেন জাতিতে তুর্কি। তিনি খোরাসানের কোনো এক সুলতানের পুত্র এবং দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুগলকের পালক পুত্ররূপে চিহ্নিত। খোরাসানের সুলতান একসময় মুলতান ও দিপালপুর অধিকারের উদ্দেশ্যে এক বিশাল বাহিনী নিয়ে এই দুই নগরের অনতিদূরে শিবির স্থাপন করেন। এই অভিযানের সংবাদ পেয়ে সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুগলক স্বয়ং এক বাহিনী নিয়ে মুলতান অভিমুখে অগ্রসর হন। তিনি খোরাসানের সুলতানের শিবিরে রাতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে তাঁকে পর্যুদস্ত ও বিতাড়িত করেন। যে রাতে তুগলক শাহ খোরাসানের সুলতানের শিবির আক্রমণ করেন ঐ রাতেই শিবিরে তাতার খানের জন্ম হয়। অতর্কিত আক্রমণে বিপর্যস্ত খোরাসানের সুলতানের পরিবারের লোকেরা নবজাতককে দোলনায় ফেলে রেখে যায়। পরে শিশুটিকে সুলতান গিয়াসউদ্দিনের সামনে হাজির করা হয়। সুলতান এরপর তাকে নিজ সন্তানের মতো লালন পালন করেন এবং তার নাম দেন তাতার খান। সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুগলকের পালক পুত্র ও এক সময়ের ক্ষমতাধর সেনাপতি তাতার খান বাংলায় তুগলক সুলতানের আধিপত্য সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুগলক ত্রিহুত ও বাংলা অধিকারের লক্ষ্যে ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পূর্বাঞ্চলীয় অভিযানে তাতার খানকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। তাতার খান তখন জাফরাবাদের (জৌনপুরের নিকটবর্তী) শাসনকর্তা ছিলেন। লখনৌতি ও সোনারগাঁয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে অভিযানের দায়িত্ব দেয়া হয় তাতার খানকে। তাতার খান লখনৌতি থেকে বাহাদুর শাহকে বিতাড়িত করেন। লখনৌতিতে পরাজয়ের পর গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ যখন পূর্ববাংলা অভিমুখে পশ্চাদপসরণ করেন, তখন তাতার খান তাঁকে পরাজিত ও বন্দী করেন (১৩২৪)। সুলতান গিয়াসউদ্দিন দিল্লি ফেরার প্রাক্কালে তাতার খানকে সোনারগাঁ ও সাতগাঁয়ের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। পরবর্তী সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহকে মুক্ত করে (১৩২৫) তাঁর উপর সোনারগাঁয়ের শাসনভার অর্পন করেন এবং সোনারগাঁয়ের শাসন পরিচালনায় তাতার খানকে সুলতানের প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়। ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দে বাহাদুর শাহ নিজ নামে মুদ্রা চালু করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাতার খান তখন এক যুদ্ধে বাহাদুর শাহকে পরাজিত ও বন্দী করেন। তাতার খান কর্তৃক বাহাদুর শাহ নিহত হওয়ার ফলে বাংলায় নব্য মামলুক শাসনের অবসান ঘটে। বাংলায় তুগলক অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাতার খানের কৃতিত্বের জন্য সুলতান মুহম্মদ বিন তুগলক তাঁকে খান-ই-আযম বাহরাম খান উপাধিতে ভূষিত করেন। তাতার খানকে ১৩২৮ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁয়ের শাসনকর্তা (ওয়ালি) নিয়োগ করা হয়। ১৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন। তাতার খান ছিলেন জ্ঞানচর্চার উদার পৃষ্ঠপোষক। তিনি পবিত্র কোরআনের বহুসংখ্যক তফসির ও ব্যাখ্যা সম্বলিত পুস্তক সংগ্রহ করেন এবং সোনারগাঁয়ে কয়েকজন আলেমের সহায়তায় কোরআন শরীফের ব্যাখ্যা সম্বলিত এক তফসির সংকলন করান। তিনি এর নাম দেন তফসির-ই-তাতারখানি। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় সংকলিত হয় আইনের এক গ্রন্থ ফতোয়ায়ে তাতারখানি। কামাল-ই-করিম নামে এক ফিকাহশাস্ত্রবিদ আরবি ভাষায় মাজমু-ই-খানী ফি আইন আল-মাআনি শীর্ষক ফিকাহ শাস্ত্রীয় একটি গ্রন্থ রচনা করেন এবং গ্রন্থটি তিনি বাংলার জনৈক শাসনকর্তা উলুগ কুতলুগ আইজ্জুদ্দিন বাহরাম খানের নামে উৎসর্গ করেন। বাংলার এই শাসনকর্তা নিঃসন্দেহে ছিলেন বাহরাম খান ওরফে তাতার খান। ১৩৩৭ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁয়ে তাতার খান এর মৃত্যু হয়। [মুয়ায্যম হুসায়ন খান]