সামাজিক বনায়ন
সামাজিক বনায়ন জনসাধারণ, বিশেষ করে পলীর জনগণ এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের অর্থনৈতিক, বাস্ত্তসংস্থানিক ও সামাজিক সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে পরিচালিত বনায়ন। সামাজিক বনায়নের লক্ষ্য কেবল ‘গাছ নয়, গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীও’। এ ধরনের সহায়তার লক্ষ্য শুধু গাছ লাগানো ও সেসব গাছের যত্ন নেওয়ার জন্য নয়, বরং গাছ রোপণকারীরা যাতে লাগানো গাছের সুফল পাওয়ার আগ পর্যন্ত সসম্মানে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে তারও নিশ্চয়তা বিধান। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রদত্ত সামাজিক বনায়নের সংজ্ঞা হচ্ছে ‘বনায়ন কার্যক্রমে জনগণকে সরাসরি সম্পৃক্তকরণের যেকোন পরিস্থিতি’। শিল্পভিত্তিক বৃহদায়তন বনায়ন এবং কেবল কর্মসংস্থান ও মজুরিভিত্তিক উন্নয়ন সহায়ক অন্যান্য ধরনের বনায়ন সামাজিক বনায়ন নয়, বরং গোষ্ঠীভিত্তিক বনায়নে উৎসাহ ও সহায়তা প্রদানকল্পে বনশিল্প ও সরকারি প্রচেষ্টায় পরিচালিত কর্মকান্ড সামাজিক বনায়নের অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশে সামাজিক বনায়নের ইতিহাস প্রাতিষ্ঠানিক বন সম্প্রসারণ কার্যক্রম প্রবর্তনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৬২-৬৩ সালে রাজশাহী ও ঢাকায় বন সম্প্রসারণ বিভাগ গঠন এবং ১ জুনকে বৃক্ষরোপণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। চারাগাছ উৎপাদন ও বিতরণের জন্য বন সম্প্রসারণ বিভাগ সৃষ্টির পর থেকেই বনায়ন কার্যক্রমের প্রসার ঘটতে থাকে। এই বনায়ন কর্মকান্ড অবশ্য জেলা সদর ও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নার্সারি স্থাপন ও আনুষ্ঠানিক বৃক্ষরোপণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। বৃক্ষরোপণ অভিযান প্রথমদিকে একদিনের জন্য শুরু হলেও পরে তা এক সপ্তাহ, এক মাস এবং সর্বশেষ তিন মাসে বৃদ্ধি পায়। কর্মসূচি শুরুতে খুবই সীমিত ছিল এবং তা জনগণের উপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারে নি। এটি সম্প্রসারণ কর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গির বা জনগণের মানসিক পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ হয়। ফলে ভূমিহীন জনগণকে বনায়ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়।
বাংলাদেশে সামাজিক বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ করেন মাহবুবুল আলম চাষী, অধ্যাপক ইউনুস ও অধ্যাপক আলীমসহ কয়েকজন উদ্যোক্তা। তাঁরা চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত বেতাগী ও পামোরা নামের দুটি বিরান পাহাড়ে এ প্রকল্প গ্রহণ করেন। এজন্য ১০১টি পরিবার বাছাই করে তাদের সেখানে জমি দেওয়া হয়।
এই কর্মসূচি ছিল স্বনির্ভর ধরনের। এসব কৃষক বাইরের কোন অনুদান পেতো না। কৃষি ব্যাংক গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ ও ঋণ আদায়ের শর্তে ঋণ বিতরণ করত। এ কার্যক্রম দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে মূল্যায়ন করা হয় এবং সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া যায়। তবে নির্বাচিত ১০১টি পরিবারের সংখ্যা হ্রাস পেয়ে ৮৩টিতে দাঁড়ায়। এই প্রকল্পলব্ধ অভিজ্ঞতা আরও কর্মসূচি প্রণয়নে যথেষ্ট সহায়তা করে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থসাহায্যে গৃহীত গোষ্ঠী বনায়ন প্রকল্প থেকেই মূলত সামাজিক বনায়নের কর্মসূচি শুরু। এজন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ১ কোটি ১০ লক্ষ মার্কিন ডলার ঋণ মঞ্জুর করে। এছাড়া জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মাধ্যমে কারিগরি সাহায্য হিসেবে ২০ লক্ষ মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেয়। উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের সাতটি বৃহত্তর জেলায় দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, রাজশাহী, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও যশোরে এই প্রকল্প কার্যক্রম ১৯৮২ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত চলে। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল জ্বালানি কাঠ, গবাদি পশুর খাদ্য, ছোটখাটো কাঠ, ফল ও অন্যান্য উৎপন্ন দ্রব্যের সরবরাহ বৃদ্ধি।
প্রকল্পটির প্রধান উপাদান ছিল ১. সড়ক, রেলপথ ও বেড়িবাঁধের পাশাপাশি প্রায় ৪,৮০০ কিলোমিটার গাছ লাগানো; ২. জ্বালানি কাঠ সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ৪,৮০০ হেক্টর জমিতে বৃক্ষরোপণ এবং ১২০ হেক্টর বিরান বনভূমির ওপর কৃষি বনায়ন প্রদর্শন খামার প্রতিষ্ঠা; ৩. রাজশাহীতে একটি সামাজিক বনায়ন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন; ৪. প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা হিসেবে কর্মচারীদের প্রশিক্ষণদান ও সরঞ্জামাদি সরবরাহ; ৫. বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা; এবং ৬. প্রকল্প এলাকায় আঞ্চলিক ও বিভাগীয় কার্যালয় প্রতিষ্ঠা। বনায়ন কার্যক্রমে জনগণকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে প্রকল্পটি সার্বিক সফলতা অর্জন করে। প্রকল্পটি প্রথমবারের মতো গোষ্ঠীভিত্তিক বনায়ন কর্মসূচিতে মহিলাদের সম্পৃক্ত করে।
গোষ্ঠীভিত্তিক বনায়ন প্রকল্পের সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ‘থানা বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন’ প্রকল্প অনুমোদন করে। এ প্রকল্প সুন্দরবন ও বৃহত্তর চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের জেলাগুলি ছাড়া সারাদেশে বিস্তৃত ছিল। প্রকল্পের উপাদানভিত্তিক লক্ষ্য ছিল ১৬,১৯৪ হেক্টর উজাড় হওয়া শালবনে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে বন তৈরি; ৩২৮৯ হেক্টর অনাচ্ছাদিত বেদখলকৃত শালবনে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কৃষি বনায়ন খামার স্থাপন; পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকার বাইরে ৮১০ হেক্টর জমিতে বনসৃষ্টি; সাবেক গোষ্ঠীভিত্তিক বনবৃদ্ধি কেন্দ্রের ৮টির উন্নয়ন, ৩২টির উন্নীতকরণ ও ৫১টির রক্ষণাবেক্ষণ এবং এগুলিকে বন সম্প্রসারণ নার্সারি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (Forestry Extension Nursery and Training Centre/FENTC) হিসেবে নতুন নামকরণ; প্রকল্পের মেয়াদে ৪.৮০-৪.০০ কোটি চারা উৎপাদন ও বণ্টন; ৭৫,০০০ জন গ্রামের নেতৃ-স্থানীয় ব্যক্তি, বক-সুপারভাইজার, থানা কৃষি কর্মকর্তা এবং বন দপ্তরের রোপণ সহকারী, মালি, কর্মচারী ও কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণদান; থানা কমপেক্সে আরও ৩৪৫টি নার্সারি স্থাপন; সড়ক, রেলপথ ও খালের বাঁধের ধারে ১৭,৭৬০ কিমি ফালি-বন সৃষ্টি; নবগঠিত থানা নার্সারিগুলিতে ১.০৯৭ কোটি চারাগাছ উৎপাদন ও বণ্টন; এবং উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ১০০ বেসকারি নার্সারি স্থাপন।
আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা কর্তৃক ১৯৯২-৯৩ সালে শুরু ৭ বছর মেয়াদি প্রকল্পে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বন বিভাগে বন ব্যবস্থাপনার দুটি অংশগ্রহণমূলক মডেল উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত ছিল। একটি পরীক্ষাধীন প্রকল্প বন বিভাগের সম্প্রসারণ শাখার অধীনে গড়ে তোলার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে বনের ২-৩টি বকে অংশগ্রহণমূলক কৃষি বনায়ন কার্যক্রম শুরু করা হবে। ইতোমধ্যেই উপদেষ্টা নিয়োগ এবং প্রকল্প তৈরির কাজ শেষ হয়েছে, কিন্তু মাঠপর্যায়ের পরীক্ষণ এখনও শুরু নি।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে উপকূলীয় সবুজবেষ্টনী নামে আরেকটি শরিকানামূলক সামাজিক বনায়ন প্রকল্প থানা বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্পের ধারনার ভিত্তিতে ১৯৯৪-৯৫ সালে শুরু হয়। উপকূলীয় ১০টি জেলা এই প্রকল্প অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো প্রকল্প অঞ্চলে অধিক পরিমাণে গাছপালা লাগিয়ে ঘূর্ণিঝড়জনিত প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করা। বেসরকারি সংগঠনগুলিকে সম্পৃক্ত করে স্থানীয় জনসাধরণের মধ্যে উপকূলে বৃক্ষরোপণ কর্মকান্ড বৃদ্ধির মাধ্যমে সবুজবেষ্টনী নির্মাণ বাস্তবায়িত হবে। [সৈয়দ সালামত আলী]
আরও দেখুন কৃষি বনায়ন; বসতবাড়ির গাছগাছালি।