শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ
শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ (১৩০১-১৩২২ খ্রি) লখনৌতির মুসলিম রাজ্যের সুলতান। ৭০১ হতে ৭২২ হিজরি পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। ‘আস্সুলতান-উল আজম শামসুদ্দুনিয়া ওয়াদ্দীন আবুল মোজাফ্ফর ফিরুজ শাহ আস্সুলতান’ উপাধি নিয়ে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং নিজের মুদ্রায় আববাসীয় খলিফা মুসতাসিম বিল্লার নাম উৎকীর্ণ করেন।
ফিরুজ শাহের উদ্ভব ও বংশপরিচয় নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইবনে বতুতার মতে, তিনি নাসিরউদ্দীন বুগরা খানের পুত্র ছিলেন এবং সেই হিসেবে তিনি সুলতান গিয়াসউদ্দীন বলবনের পৌত্র। আমীর খসরু বুগরা খানের দুপুত্রের নাম উল্লেখ করেন কায়কোবাদ ও কায়কাউস। কিন্তু তিনি শামসুদ্দীন ফিরুজের নাম উল্লেখ করেন নি। এছাড়া, গিয়াসউদ্দীন বলবন পারস্য রীতি অনুসরণ করে তাঁর পৌত্রদের নাম কায়কোবাদ, কায়কাউস, কায়খসরু, কায়মুরস ইত্যাদি রাখেন। কিন্তু ‘ফিরুজ’ নাম পারস্য রীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তদুপরি, কায়কোবাদ ১২৮৮ খ্রিস্টাব্দে যখন দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র উনিশ বছর। কায়কাউস কায়কোবাদের ছোট ভাই ছিলেন এবং সে কারণে, যদি ফিরুজ কায়কাউসের ছোট ভাই হন তাহলে ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বয়স হবে মধ্য ত্রিশ। ফিরুজের সিংহাসনারোহণের পর তাঁর দুজন প্রাপ্তবয়স্ক পুত্র রাষ্ট্রীয় কাজে পিতাকে সাহায্য করেছেন। কিন্তু এ বয়সে কোন ব্যক্তির দুজন বা ততোধিক প্রাপ্তবয়স্ক পুত্র থাকার কথা নয়। এ সকল কারণে এবং তাঁর মুদ্রাগুলি যথার্থভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আধুনিক পন্ডিতগণ বলেন যে, শামসুদ্দীন ফিরুজ বলবনি বংশের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। শামসুদ্দীন ফিরুজ কোথাও নিজেকে সুলতানের পুত্র বলে দাবি করেন নি, অথচ তাঁর উত্তরাধিকারী পুত্রগণ সকলেই নিজেদেরকে ‘সুলতান বিন সুলতান’ অর্থাৎ ‘সুলতানের পুত্র সুলতান’ বলে অভিহিত করেছেন।
লখনৌতির শাসনকর্তা বুগরা খানকে সাহায্য করার জন্য বলবন ফিরুজ নামধারী দুজনকে নিয়োজিত করেন। অনুমান করা হয় যে, শামসুদ্দীন ফিরুজ এ দুজনেরই একজন। এ দুজন কর্মকর্তার মধ্যে বিহারের শাসনকর্তা ফিরুজ ইতিগীন ছিলেন অধিকতর যোগ্য। সম্ভবত, দুজন ফিরুজের মধ্যে ফিরুজ ইতিগীনই কায়কাউসের মৃত্যুর পর অথবা শক্তি বলে তাঁকে সরিয়ে ৭০১ হিজরিতে (১৩০১ খ্রি.) সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ উপাধি নিয়ে বাংলার সিংহাসনে বসেন। সিংহাসনে আরোহণ করে সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ তাজউদ্দীন হাতিম খান নামক তাঁর এক পুত্রকে বিহারের শাসনভার অর্পণ করেন।
নিজের অবস্থা সুসংহত করার পর ফিরুজ শাহ রাজ্য বিস্তারের দিকে মনোনিবেশ করেন। এই সময়ে লখনৌতির ক্ষুদ্র মুসলিম রাজ্য বিহার, উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম বাংলা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার লখনৌর এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। রুকনুদ্দীন কায়কাউস বাংলার পূর্বাঞ্চলে বিজয়াভিযান শুরু করেছিলেন। কায়কাউসের সে অভিযান ফিরুজ শাহের আমলে শেষ হয়। কথিত আছে যে, কায়কাউস প্রথমবারের মতো বংলার খারাজ (রাজস্ব) থেকে মুদ্রা প্রবর্তন করেন। কিন্তু ফিরুজ শাহের সময়ে সোনারগাঁও অঞ্চল (দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা) মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। তিনি সোনারগাঁও-এ একটি টাকশাল স্থাপন করেন। এখান থেকে তাঁর মুদ্রা প্রকাশিত হয়েছে। একইভাবে সাতগাঁও বিজয়াভিযানও শুরু হয়েছে জাফর খানের নেতৃত্বে কায়কাউসের আমলে এবং তা শেষ হয়েছে ফিরুজ শাহের শাসনকালে। ফিরুজ শাহের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, জনৈক জাফর খান ৭১৩ হিজরিতে (১৩১৩ খ্রি.) দার-উল-খয়রাত নামে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। ফিরুজ শাহের ময়মনসিংহ বিজয় সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। কেবল এটুকুই জানা যায় যে, তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর গিয়াসপুর টাকশাল থেকে মুদ্রা প্রচলন করেন। গিয়াসপুরকে ময়মনসিংহের প্রায় ২৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ওই নামের একটি গ্রামের সাথে অভিন্ন মনে করা হয়। ফিরুজ শাহের রাজত্বকালে সিকান্দর খান গাজী সুন্দরবন অঞ্চলের হিন্দু রাজা মটুকের বিরুদ্ধে এক সফল অভিযান পরিচালনা করেন। সুলতান ফিরুজ শাহের একটি মুদ্রা সাতক্ষীরা জেলার দক্ষিণ প্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত একটি গ্রামে আবিষ্কৃত হয়েছে। সিলেট বিজয় ছিল সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহের রাজত্বকালের সর্বাপেক্ষা উলেখযোগ্য ঘটনা। শিলালিপি অনুসারে ফিরুজশাহ ৭০৩ হিজরিতে (১৩০৩ খ্রি.) সিলেট জয় করেন। সিলেট বিজয়ের সাথে বিখ্যাত দরবেশ হজরত শাহজালাল (রঃ) এবং সেনাপতি সৈয়দ নাসিরউদ্দীনের নাম জড়িত আছে।
ফিরুজ শাহ খলজীদের বিরুদ্ধে বিহারেও তাঁর ক্ষমতা সুদৃঢ়রূপে ধরে রেখেছিলেন। এ তথ্যের প্রমাণ মেলে বিহারে আবিষ্কৃত তাঁর আমলের দুটি শিলালিপি থেকে। এভাবে বাংলার সালতানাত সুলতান শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহের আমলে কমপক্ষে পশ্চিমে শোন ও গোগরা নদী হতে পূর্বে সিলেট পর্যন্ত এবং উত্তরে দিনাজপুর-রংপুর হতে দক্ষিণে হুগলি ও সুন্দরবন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
ফিরুজ শাহের ছয়জন প্রাপ্তবয়স্ক পুত্র ছিলেন। শিহাবুদ্দীন বুগদা, জালালুদ্দীন মাহমুদ, গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর, নাসিরুদ্দীন ইবরাহিম, হাতিম খান এবং কুতলু খান। এ ছয় পুত্রের মধ্যে তাজউদ্দীন হাতিম খান বিহারের শাসনকর্তা ছিলেন। মুদ্রা সাক্ষ্যে প্রমাণিত হয় যে, ফিরুজ শাহের জীবদ্দশায় তাঁর পুত্র জালালুদ্দীন মাহমুদ, শিহাবউদ্দীন বুগদা এবং গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর তাঁদের নিজ নিজ নামে লখনৌতি টাকশাল থেকে মুদ্রা প্রবর্তন করেন। গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর সোনারগাঁও এবং গিয়াসপুর টাকশাল থেকেও মুদ্রা প্রবর্তন করেন। এ মুদ্রাগুলির ভিত্তিতে পন্ডিতদের ধারণা, ফিরুজ শাহের পুত্রগণ পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়েছিলেন এবং তাঁরা পর্যায়ক্রমে লখনৌতি শাসন করছিলেন। তবে ফিরুজ শাহের পুত্রদের মুদ্রা প্রবর্তন তাঁদের বিদ্রোহের ফল নয়, বরং পিতার সঙ্গে পুত্রদের ক্ষমতা ভাগাভাগির ফল ছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। আসলে শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহ বেশি বয়সে লখনৌতির সিংহাসনে আরোহণ করেন। সে সময়ে তাঁর ছয়জন পুত্রই প্রাপ্তবয়স্ক ছিল। এঁরা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করতেন। পুত্রদের সহযোগিতায় সন্তুষ্ট হয়ে ফিরুজ শাহ তাঁদেরকে সাম্রাজ্যের কোন কোন অংশে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করার এবং মুদ্রা প্রচলন করার মতো রাজকীয় ক্ষমতা প্রয়োগের অনুমতি দেন। যদি তাঁর পুত্ররা পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন, তাহলে সাম্রাজ্যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করত এবং সাম্রাজ্যের এত বিস্তৃতি সম্ভব হতো না। তাঁর রাজ্যে তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারে সাহায্য করেছেন।
শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহের মৃত্যু হয় ৭২২ হিজরিতে (১৩২২ খ্রি.)। [এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমদ]