মাঠ প্রশাসন
মাঠ প্রশাসন বলতে প্রশাসনিক বিভাগ যেমন জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রশাসনকে বুঝায়। এদের মধ্যে সর্বনিম্ন একক হলো ইউনিয়ন, যা কতগুলি গ্রাম নিয়ে গঠিত স্থানীয় সরকারের নিম্নতম প্রতিষ্ঠান। সম্ভবত জেলাই সবচাইতে প্রাচীন প্রশাসনিক কেন্দ্র। এর জন্ম হয়েছিল বাংলার ভূমি ব্যবস্থাপনাকে সুসংহত করার স্বার্থে।
অতি প্রাচীনকালেও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং রাজস্ব সংগ্রহের স্বার্থে সমগ্র রাষ্ট্রকে কতিপয় ব্যবস্থাপনাযোগ্য এককে ভাগ করা হতো। সুলতানি আমলের শাসকদের নিকট সে সময়ে প্রচলিত প্রশাসনিক অবকাঠামো কার্যকর বলে বিবেচিত হওয়ায় তারা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি এবং অবকাঠামোতে কিছুটা পরিবর্তন সাধন করে পুরাতন ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা চালু রাখে। মুগল আমলে জেলা প্রশাসন অবকাঠামোতে কতিপয় মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়। তারা সমগ্র রাজ্যকে বৃহত্তর জেলা বা সরকারে বিভক্ত করে এবং সরকারগুলোকে জেলায় এবং জেলাকে পরগনায় ভাগ করে। এ পরগনাগুলি বেশ ক’টি মৌজা সমন্বয়ে গঠিত হতো। ব্রিটিশ শাসনের প্রথমদিকে মুগল প্রতিষ্ঠিত কতিপয় পরগনা সমন্বয়ে একটি প্রশাসনিক একক স্থাপন করা হয় এবং উক্ত এককের নাম দেওয়া হয় জেলা। এ পদ্ধতি ব্রিটিশ শাসনের পুরো সময় জুড়েই চালু ছিল। এটি বর্তমান জেলা প্রশাসন পদ্ধতির প্রায় অনুরূপ। প্রাচীনকালে পঞ্চায়েত বা গ্রাম প্রশাসনের স্থানীয় একক একটি শক্তিশালী শাসন ও নিয়ন্ত্রণ মাধ্যম ছিল। লর্ড কর্নওয়ালিস কোড এর মাধ্যমে (১৭৯৩) কোন প্রকার বিকল্প প্রতিষ্ঠান ব্যতিরেকেই শক্তিশালী ও কার্যকর মাঠ প্রশাসনের এককটির দাপ্তরিক বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। ফলশ্রুতিতে গ্রামীণ এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি দেখা দেয়। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি রোধকল্পে এবং সামগ্রিকভাবে গ্রাম পর্যায়ে একটি প্রশাসনিক ভিত্তি দাঁড় করানোর স্বার্থে ১৮৭০ সালে চৌকিদারি আইন প্রবর্তন করা হয়। এর মাধ্যমে কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করা হয় এবং প্রতিটি ইউনিয়নকে আবার ওয়ার্ডে বিভাজন করা হয়। এ সকল ইউনিয়নের কাজ ছিল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর নজর রাখা। প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর নজর রাখার জন্য ইউনিয়নের সৃষ্টি হলেও এ ইউনিয়নই পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারের প্রাথমিক একক হিসেবে পরিগণিত হয়। লর্ড রিপনের শাসনকালে (১৯৮০-৮৪) স্থানীয় সরকার পদ্ধতিকে ইউনিয়ন বোর্ড, পৌরসভা, রাজস্ব সার্কেল প্রভৃতি গঠনের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী করা হয়।
প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নে জেলা পর্যায়ে কর্মকর্তা ছিলেন মাত্র তিনজন। তারা হলেন জেলা ও দায়রা জজ, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর এবং পুলিশ সুপার। অবশ্য পরবর্তী সময়ে জেলা পর্যায়ে আরও অনেক বিশেষায়িত বিভাগ সৃষ্টি করা হয়। উপরোক্ত ৩টি কার্যভিত্তিক বিভাগের মধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর ছিলেন জেলার প্রধান নির্বাহী। তিনি বিচার, পুলিশ এবং রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত অগাধ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। এতদ্সত্ত্বেও বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি জেলা এবং দায়রা জজের অধস্তন ছিলেন। প্রশাসনিক এবং রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর বিভাগীয় কমিশনারের নিয়ন্ত্রণ তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনায় পরিচালিত হতেন। অনুরূপভাবে পুলিশ সুপার উপ-মহা পুলিশ পরিদর্শকের নিয়ন্ত্রণ এবং নির্দেশে পরিচালিত হতেন। উপনিবেশিক শাসনামলে উপ-মহা পুলিশ পরিদর্শকদের আওতাভুক্ত এলাকাকে রেঞ্জ নামে অভিহিত করা হতো। এ রেঞ্জসমূহের ভৌগোলিক আয়তন প্রশাসনিক বিভাগের আয়তনের তুলনায় কম বা বেশি হতে পারত। জেলা ও দায়রা জজ হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে ও নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব পালন করতেন।
খোদ ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলেও মাঠ প্রশাসন দুটি মূল জনহিতকর কাজের দায়িত্ব পালন করত। তার মধ্যে একটি ছিল দুর্ভিক্ষ সংক্রান্ত বিশেষ দায়িত্ব। মাঠ প্রশাসনকে দুর্যোগ-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব পালন করতে হতো। জনহিতকর কাজের দ্বিতীয়টি ছিল কৃষি ঋণের যথাযথ বিতরণ নিশ্চিত করা এবং টেস্ট রিলিফ ওয়ার্কের মাধ্যমে দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান করা। কাজেই দেখা যায় যে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ এবং ভূমি-রাজস্ব আদায়, এ দুটি মূল কাজ ছাড়াও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর জেলার প্রধান নির্বাহী হিসেবে বেশ কয়েকটি জনকল্যাণমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
জেলা পর্যায়ের বিভাগীয় কর্মকর্তাবৃন্দ নিজ নিজ বিভাগীয় প্রধানের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে কাজ করতেন। নিয়ন্ত্রণের এ ভিন্নতা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের সঙ্গে জেলা পর্যায়ের অন্যান্য বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সম্পর্কে বিতর্কের জন্ম দেয়। মন্টেগু-চেমস্ফোর্ড রিপোর্ট বেশ দক্ষতার সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক সংক্রান্ত বিতর্কের অবসান ঘটায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর বিশেষায়িত সেবামূলক বিভাগে কর্মরত জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন-অধস্তন রূপে সম্পর্কিত ছিলেন না। সে সময় জেলাপ্রশাসন ও অন্যান্য মাঠ পর্যায়ের (জেলা পর্যায়ের) কর্মকর্তাবৃন্দ কাজের ক্ষেত্রে পরস্পর স্বাধীন ছিলেন। কিন্তু উপনিবেশিক শাসনামলের শেষ পর্যায়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের পদটি স্থানীয় সরকার এবং পল্লী উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রাউল্যান্ডের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন কর্তৃক পেশকৃত প্রতিবেদনে ‘বেঙ্গল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এনকোয়ারি কমিটি, ১৯৪৫’ বহাল রাখার সুপারিশ করা হয়। স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে জেলা প্রশাসনের এ ভূমিকা ১৯৪৭ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান ও ভারতের অভ্যুদয়ের পরেও অব্যাহত থাকে।
১৯৬০ সালে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। এ পরিবর্তন সূচিত হয় মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে। এ সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরকে ডেপুটি কমিশনার নামকরণ করা হয়। বলা হয়ে থাকে যে, সে সময় সরকারি সম্পদের কাঙ্ক্ষিত ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। এ পদ্ধতিতে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি ও যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের মাঠ প্রশাসনের সকল পর্যায়ে পরিষদ গঠনের মাধ্যমে একত্রিত করা হয়। অতঃপর মাঠ পর্যায়ের আমলাদের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দাবি-দাওয়া মেটানো এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এ কারণে মৌলিক গণতন্ত্র এক ধরনের নির্দেশিত গণতন্ত্র হিসেবে পরবর্তী সময়ে সমালোচিত হয়েছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের কার্যকারিতা পুনরুদ্ধারের প্রয়োজন প্রবলভাবে অনুভূত হয়। এ সময় বাংলাদেশ সরকার বেসামরিক প্রশাসন কার্যকরভাবে পুনরুদ্ধারের স্বার্থে ‘বেসামরিক প্রশাসন পুনরুদ্ধার কমিটি’ নামে একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটি অন্যান্যের মধ্যে জরুরী ভিত্তিতে মাঠ প্রশাসনকে সুশৃঙ্খল করার সুপারিশ করে। এ সুপারিশে মাঠ প্রশাসনের অবকাঠামো ও কার্যাবলি প্রায় অক্ষুণ্ণ রাখা হয়।
মাঠ প্রশাসনের পুনরুদ্ধারের সঙ্গে স্থানীয় সরকার পদ্ধতির কার্যকর প্রয়োগ গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিল। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে এ সময়ে সরকার কতিপয় স্থানীয় সরকার পরিষদের বিলোপ ঘোষণা করে। শুধুমাত্র জেলা পরিষদ এবং ইউনিয়ন পরিষদে দুটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকেই অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। উক্ত আদেশে থানা পরিষদ বা বিভাগীয় পরিষদ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এতে অনুমিত হয় যে, তৎকালীন প্রশাসন ইউনিয়ন পরিষদ ও জেলা পরিষদ ব্যতীত অন্য কোন স্থানীয় সরকার পরিষদের অস্তিত্ব থাকুক তা চাননি। এ সময় ইউনিয়ন কাউন্সিল এবং জেলা কাউন্সিলকে যথাক্রমে ইউনিয়ন পঞ্চায়েত ও জেলা কাউন্সিল নামকরণ করা হয়। সাধারণ নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত মহকুমা প্রশাসকদের নিজ নিজ ভৌগোলিক সীমানার অন্তর্গত ইউনিয়নসমূহে প্রশাসক নিয়োগের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। জেলা বোর্ডসমূহে কমিটি গঠনের পূর্ব পর্যন্ত বোর্ডের কার্যাবলি পরিচালনার জন্য সরকার প্রশাসক নিয়োগ করে। ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রপতির ১৭ নং আদেশবলে স্থানীয় সরকার আইন সংশোধন করা হয়। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ডেপুটি কমিশনারকে থানা উন্নয়ন কমিটিতে লোক নিয়োগপূর্বক তা পুনর্গঠনের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এক সার্কুলারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে নির্বাচিত সংসদ- সদস্যদের, তথা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে থানা উন্নয়ন কমিটি গঠনের বিতর্কিত আদেশ জারি করা হয়। ১৯৭২ সালে জারিকৃত অপর এক সার্কুলারের মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়। এ সার্কুলারের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্য হতে প্রশাসক নিয়োগের বিধান করা হয়। নিয়ত পরিবর্তিত সার্কুলারসমূহের মাধ্যমে অন্তবর্তীকালীন সময়ের জন্য স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠনের পদ্ধতির নির্দেশ করা হয়। এ পদ্ধতিতে মাঠ প্রশাসনে জেলা পর্যায় এবং তার নিচের প্রশাসনিক এককসমূহকে রাজনৈতিক দল নিরপেক্ষ রেখে উক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যাবলি পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন সরকার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একক রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করে। এ সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) নামে একমাত্র জাতীয় দল গঠন করা হয়। এক-দলীয় শাসন প্রবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে মাঠ প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকারসমূহেও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রভাব দেখা দেয়। সংবিধান সংশোধন (চতুর্থ সংশোধনী) আইন (১৯৭৫ সালের ২ নং আইন) মূলে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতিকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। নতুন জারিকৃত এ পদ্ধতিতে জেলা পর্যায়ের মাঠ প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো হয়। প্রতিটি জেলার প্রধান হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা, জাতীয় সংসদ সদস্য এবং বাকশাল সদস্যদের মধ্য হতে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জেলা গভর্নর নিয়োগের বিধান করা হয়। সারাদেশে মোট জেলার সংখ্যা ২২ থেকে ৬১-তে উন্নীত হয়। জেলা গভর্নরকে জেলার সাধারণ প্রশাসন এবং রাজস্ব প্রশাসনের প্রধান হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আদালত ও আদালতের বিচারকাজে হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে জেলা গভর্নরকে জেলায় কর্মরত সকল কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের কার্যাবলি তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেওয়া হয়। নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত এ প্রশাসনিক পদ্ধতিতে মাঠ প্রশাসনে ডেপুটি কমিশনার গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন। জেলা গভর্নরের অবর্তমানে তিনি জেলা গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত শোকাবহ ঘটনার ফলে মাঠ প্রশাসনের এই নতুন কর্মসূচি কার্যকর হতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ২৭ আগস্ট জারিকৃত এক অর্ডিন্যান্সে (১৯৭৫ সালের ৪৫ নং অর্ডিন্যান্স) পরবর্তী সরকার এই জেলা প্রশাসন আইন বাতিল ঘোষণা করে।
১৯৭৬ সালে ইউনিয়ন ও জেলা পর্যায়ে নির্বাচনের বিধান করে নতুন স্থানীয় সরকার আইন জারি করা হয়। এ আইনে থানা পর্যায়ের স্থানীয় সরকার সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। এ আইনের আওতায় ১৯৭৭ সালে ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভাসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু জেলা বোর্ড নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এর থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, মাঠ প্রশাসন ষাটের দশকে চালুকৃত মৌলিক গণতন্ত্রের প্রায় অনুরূপই থেকে যায়।
সত্তরের দশকের শেষভাগে মাঠ প্রশাসনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। এর প্রথমটি হলো থানা কাউন্সিলের পাশাপাশি শুধুমাত্র ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে প্রতিটি থানায় থানা উন্নয়ন কমিটি গঠন। আর দ্বিতীয়টি হলো ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারী নিয়োগ। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত এ সকল জেলা উন্নয়ন সমন্বয়কারীদের উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হয়। ১৯৮২ সালে সামরিক বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা দখল এবং সামরিক আইন জারি সরকারের মাঠ প্রশাসন সংক্রান্ত সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবসান ঘটায়। অন্যদিকে সামরিক আইন জারির পর স্থানীয় সরকার প্রশাসনে সংস্কারের নামে নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। মাঠ প্রশাসনই মূলত এ সংস্কারের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। এর মাধ্যমে (ক) এক শতকেরও দীর্ঘ সময় ধরে প্রচলিত মাঠ প্রশাসনের একক মহকুমার বিলুপ্তি ঘটানো হয়; (খ) থানার সার্বিক মান উন্নীত করা হয় এবং উন্নীত থানা প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন উভয় ধরনের ক্ষমতা প্রদান করা হয়; (গ) প্রাচীন মহকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তর করা হয়। কিন্তু এ রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে নবগঠিত জেলা পর্যায়ে কোন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়নি; (ঘ) স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এ আইনের মাধ্যমে থানা কাউন্সিলগুলোকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করা হয় এবং থানা কাউন্সিলকে উপজেলা পরিষদ নামকরণ করা হয়; (ঙ) থানা কাউন্সিলের মৌলিক কাঠামোকে অবিকৃত রাখা হয় এবং একে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়; (চ) থানা (উপজেলা) পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন বিভাগের সকল কর্মকর্তাকে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে নেয়া হয়। প্রশাসনিক সংস্কারের অপর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচারের জন্য উপজেলা পর্যায়ে মুন্সেফ ও হাকিম (ম্যাজিস্ট্রেট) নিয়োগ। অবশ্য প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণমূলক অংশ যথা বিচার বিভাগ ও পুলিশ উপজেলা পরিষদ এবং এর নির্বাচিত চেয়ারম্যানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রাখা হয়।
উপরোক্ত সংস্কারমূলক কার্যক্রমের ফলে সারা দেশে ৬৪টি জেলায় ৪৬০টি উপজেলা পরিষদের সৃষ্টি হয়। এ সংস্কার উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন বিভাগে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও তাদের কার্যাবলি তত্ত্বাবধানের পদ্ধতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনয়ন করে। কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের উপর ন্যস্ত করা হয়। ফলে উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তা এ দুজনের দ্বৈত নিয়ন্ত্রণভুক্ত হন। উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নের ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট বিভাগ সংরক্ষণ করে। জেলা পর্যায়ে কোন নির্বাচিত পরিষদ গঠিত না হওয়ার ফলে মাঠ প্রশাসনে পূর্বের প্রচলিত পদ্ধতি বহাল থাকে। সকল মহকুমা এবং কতিপয় থানাকে জেলায় রূপান্তর করার ফলে জেলাসমূহের আয়তন অনেক ছোট হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিটি নতুন জেলায় পূর্বতন জেলাসমূহের প্রশাসনিক কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। ফলে মাঠ প্রশাসনে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীর সংখ্যা বহুলাংশে বেড়ে যায়। এভাবেই প্রশাসনিক এককসমূহের ভৌগোলিক এলাকার সংস্কার সাধন ও পুনর্গঠন করা হয়। এ পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে উপজেলা পরিষদের সম্পর্ককে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন দেখা দেয়।
স্থানীয় সরকার আইনে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের ক্ষমতার অপব্যবহার, অসদাচরণ ইত্যাদি সংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসকের তদন্ত করার ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে গঠিত একাধিক কমিটিতে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের সদস্য রাখা হয় এবং উক্ত কমিটিসমূহে সদস্য হিসেবে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের উপস্থিত থাকতে হয়। এমনকি জেলা প্রশাসকদের উপজেলা পরিষদ দপ্তর এবং প্রকল্প পরিদর্শনের ক্ষমতাও অর্পণ করা হয়। এ ধরনের মাঠ প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার পদ্ধতি প্রায় পাঁচ বছরকাল চালু থাকে। এ সময়ে কেন্দ্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণবিক্ষোভের ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয় এবং তা ১৯৯১ সালে সরকারের পরিবর্তন সূচনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময়ে সরকার পদ্ধতিরও পরিবর্তন হয়। কেন্দ্রে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের পরিবর্তে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার পদ্ধতি চালু হয়।
১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বে গঠিত সরকার স্থানীয় সরকার আইনকে অবাঞ্ছিত হিসেবে বাতিল করে। ফলে মাঠ প্রশাসন ১৯৮২ সালের আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কিন্তু ইতোমধ্যে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত জেলার আয়তন এবং সংখ্যা পূর্বের মতোই থেকে যায়। উপজেলাকে পুনরায় থানা নামকরণ করা হয়। কিন্তু পদায়নকৃত কর্মকর্তাবৃন্দ সেখানেই কর্মরত থাকেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে (ইউ.এন.ও) থানা নির্বাহী অফিসার (টি.এন.ও) হিসেবে পুনঃনামকরণ করা হয়।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে (১৯৯৬-২০০১) উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ পাস হয়। এ আইন প্রণয়নের পূর্বে সরকার স্থানীয় পদ্ধতি নির্ধারণকল্পে একটি কমিশন গঠন করে। এ কমিশন ১৯৯৭ সালে একটি প্রতিবেদন পেশ করে। উক্ত প্রতিবেদনে ইউনিয়ন, থানা ও জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত পরিষদ গঠনের সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়াও কমিশন গ্রাম পর্যায়ে নির্বাচিত গ্রাম পরিষদ গঠনেরও সুপারিশ করে। এ পরিষদে নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের বাইরে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী, যথা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ব্লক সুপারভাইজার, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সহকারি এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে কর্মরত অন্যান্য বিভাগের সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী, মুক্তিযোদ্ধা এবং সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি রাখার সুপারিশ করা হয়। কমিটির সদস্য সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের কোন ভোটাধিকার থাকবে না। ইউনিয়নের জন্যও প্রায় অনুরূপ পরিষদ গঠন করার পক্ষে কমিশন সুপারিশ করে।
থানা পর্যায়ের স্থানীয় সরকারকে মূলত পূর্বতন উপজেলা পদ্ধতিতে ফিরিয়ে নেয়ার পদক্ষেপ নেয়া হয়। তবে থানা পরিষদে সংশ্লিষ্ট থানা এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রাখার বিধান করা হয়। এর ফলে থানা পর্যায়ের মাঠ প্রশাসনে কতিপয় পরিবর্তন সহ পুনরায় উপজেলা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। ১৯৯৮ সালের উপজেলা আইনের মাধ্যমে ৬৪টি জেলায় মোট ৪৬৩টি উপজেলা পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। নতুন এ আইনের বৈশিষ্ট্য হলো সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদের অধীনে উপজেলাকে প্রশাসনিক একক হিসেবে ঘোষণা করা। এতে আরও বলা হয় যে, মাঠ পর্যায়ে কর্মরত বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাগণ উপজেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানে দায়িত্ব পালন করবেন। এ আইনে উপজেলা পরিষদকে দশটি বিভাগের থানা পর্যায়ের প্রধান কর্মকর্তার কর্মতৎপরতার বিবরণ সম্পর্কে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন পেশ করার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। অবশ্য পুলিশ ও বিচার বিভাগকে উপজেলা পরিষদের আওতা বহির্ভূত রাখা হয়। বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের জন্য (বিভাগীয় প্রধান) এ আইনে উপজেলা পরিষদের সভাসমূহে উপস্থিত থেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মতামত প্রদানের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদকে সহায়তা করা বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু উপজেলা পরিষদের কর্মকর্তা সদস্যবৃন্দ পরিষদ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভোট দিতে পারবেন না।
চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলাসমূহের প্রশাসন পদ্ধতি দেশের অন্যান্য এলাকার মাঠ প্রশাসনের তুলনায় ভিন্নতর। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রিত ও অনিয়ন্ত্রিত প্রদেশ এ দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। নিয়ন্ত্রিত প্রদেশসমূহের জেলা প্রশাসন এবং মাঠ প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে ব্রিটিশ প্রণীত আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। বাংলার বন্দোবস্তকৃত এলাকাসমূহ, মাদ্রাজ ও বোম্বে ছিল এই নিয়ন্ত্রিত প্রদেশসমূহের আওতাভুক্ত। অন্যদিকে ব্রিটিশদের নতুন অধিকৃত এলাকা ছিল অনিয়ন্ত্রিত প্রদেশভুক্ত। এ এলাকার সামগ্রিক অবস্থা ছিল তুলনামূলকভাবে অশান্ত এবং আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়ন্ত্রিত এলাকার তুলনায় প্রশাসকদের বেশি করে স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার প্রয়োজন ছিল। অনিয়ন্ত্রিত প্রদেশসমূহে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরদের পদবি ছিল ডেপুটি কমিশনার বা জেলা প্রশাসক।
১৯৪৭ সালের আগে তৎকালীন আসাম প্রদেশের অন্তর্গত সিলেট জেলায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় জেলা প্রশাসক কর্মরত ছিলেন। ১৯৬০ সালে সকল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরকে জেলা প্রশাসক নামে পুনঃনামকরণ করা হয়। এর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় অনিয়ন্ত্রিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা অক্ষুণ্ণ থাকে। এ জেলা পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা রেগুলেশন, ১৯০০ (১৯০০ সালের ১ নং আইন) দ্বারা পরিচালিত হতো। চট্টগ্রাম জেলার জেলা প্রশাসক এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেশের অন্যান্য অংশের জেলা প্রশাসক ও কমিশনারদের তুলনায় বহুলাংশে পৃথক ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচার ক্ষমতা এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কর্তৃত্ব প্রয়োগের অধিকারী ছিলেন (১৯০০ সালের ১ নং আইনের ৭ নং বিধি)। অনুরূপভাবে চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে দায়রা বিভাগ গঠন করা হয় এবং চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার উক্ত দায়রা বিভাগের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। দায়রা জজ হিসেবে বিভাগীয় কমিশনারকে ফৌজদারি কার্যবিধির আওতায় হাইকোর্টের সকল ক্ষমতাও অর্পণ করা হয়। উপরন্তু বর্ণিত আইনের ৯ নং বিধান অনুযায়ী দায়রা জজ হিসেবে বিভাগীয় কমিশনার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করলে হাইকোর্টের পরিবর্তে প্রাদেশিক সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে কার্যকর করার বিধান ছিল। এ বিধান অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামকে ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের সংজ্ঞানুযায়ী পুলিশী জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পূর্ববাংলার পুলিশ মহা-পরিদর্শককে চট্টগ্রাম পার্বত্য জেলায় মহা-পরিদর্শকের উপর অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগের কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়। পরবর্তী সময়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭-২০০৮) ২০০৮ সালে স্থানীয় সরকার পুনর্গঠনের একটি অধ্যাদেশ বলে উপজেলা প্রথা পুনঃপ্রবর্তন করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মাঠ প্রশাসনে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এই ব্যাপক প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা অদ্যাবধি প্রায় একইরূপে বহাল রয়েছে। অবশ্য অন্যান্য পর্যায়ে, বিশেষ করে স্থানীয় সরকার গঠনে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে প্রশাসনে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথম পরিবর্তন হলো ১৯৮৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিভাজনের মাধ্যমে তিনটি জেলায় তিনটি পৃথক স্থানীয় সরকার কাউন্সিল গঠন। পার্বত্য জেলাসমূহে গঠিত এ তিনটি স্থানীয় সরকার কাউন্সিল ১৮৮৯ সালের ১৯, ২০ এবং ২১ নং আইনবলে গঠন করা হয়েছে। উক্ত আইনের বিধানমতে পার্বত্য জেলাসমূহে গঠিত জেলা পরিষদসমূহের প্রধান নির্বাহী উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্য হতে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন এবং সদস্যদের মাঝে উপজাতীয় এবং অ-উপজাতীয় উভয় জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকবেন। জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে উক্ত পরিষদের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
এই স্থানীয় সরকার আইনমূলে পরিষদকে পুলিশ প্রশাসনের উপরও কিছু কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে। উক্ত আইনে এ মর্মে বিধান রাখা হয়েছে যে, সাব-ইন্সপেক্টর বা এর নিম্ন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা/কর্মচারীদের সংশ্লিষ্ট পরিষদ নিয়োগ দিতে পারবে। পরিষদ উক্ত পুলিশ কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বদলি করতে পারবে; এমনকি প্রয়োজনে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থাও নিতে পারবে। জেলার পুলিশ প্রশাসনকেও এ আইনমূলে সংশ্লিষ্ট পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে দায়বদ্ধ করা হয়। ফলে প্রতিটি পুলিশ কর্মকর্তা নিজ নিজ ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে সংঘঠিত অপরাধ সম্পর্কে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে অবহিত রাখতে বাধ্য।
১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকার এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পর ১৯৮৯ সালের আইনসমূহ ১৯৯৮ সালের ৯, ১০ এবং ১১ নং আইন দ্বারা সংশোধন করা হয়। এ আইনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল উপজাতি জনগোষ্ঠীকে বৃহত্তর কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতা অর্পণ এবং এর মাধ্যমে উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকান্ডে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
পরিশেষে, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বাক্ষরিত চুক্তির সূত্র ধরে ১৯৯৮ সালের ১২ নং আইনমূলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়। এ আঞ্চলিক পরিষদকে তাদের অন্তর্ভুক্ত পরিষদসমূহের সকল প্রকার উন্নয়ন কর্মকান্ড তত্ত্বাবধান ও সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সঙ্গে এ আঞ্চলিক পরিষদ আওতাভুক্ত জেলা পরিষদসমূহের অন্যান্য কার্যাবলিও তদারকি করার ক্ষমতা পায়। এ আঞ্চলিক পরিষদ জেলার অন্তর্গত পৌরসভাগুলির কার্যাবলি তত্ত্বাবধান এবং সমন্বয়ের ক্ষমতাও লাভ করে। [এ.এম.এম শওকত আলী]
গ্রন্থপঞ্জি AMM Shawkat Ali, Politics, Upazila and Development, Dhaka, 1986; AMM Shawkat Ali, Field Administration and Rural Development in Bangladesh, Dhaka, 1982; Hugh Tinker, The Foundation of Local Self-government in India, Pakistan and Burma, London, 1968.