মিত্র, রাজা রাজেন্দ্রলাল
মিত্র, রাজা রাজেন্দ্রলাল (১৮২৩/২৪-১৮৯১) বাংলার নবজাগরণের অন্যতম প্রণেতা। তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি সাফল্যের সঙ্গে নব উদ্ভাবিত প্রত্নতাত্ত্বিক বিজ্ঞানের (science of archaeology) ওপর শিক্ষা লাভ ও বিষয়টি চর্চা করেন। ভারতীয়দের প্রথমদিককার কয়েকজনের মধ্যে তিনিই প্রথম যিনি মানুষের অগ্রগতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুরুত্ব উপলব্ধি করেন।
১৮২৩ (বা ১৮২৪) সালে কলকাতার পূর্ব উপকণ্ঠ সুরার এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে রাজেন্দ্রলাল জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক দৈন্যদশা থাকা সত্ত্বেও এ সম্ভ্রান্ত পরিবার বাংলার নওয়াবদের নিকট থেকে বিভিন্নভাবে সম্মানিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে এ পরিবার অযোধ্যার নওয়াব উজির কর্তৃকও সম্মানিত হয়। পলাশী বিপর্যয়ের পর রাজেন্দ্রের প্র-প্রপিতামহ অযোধ্যারাম সপরিবারে বাংলা থেকে অযোধ্যায় চলে যান এবং এ পরিবার কয়েক পুরুষ সেখানে বসবাস করে। দিল্লীর সম্রাট কর্তৃকও অযোধ্যারাম সম্মানিত হয়েছিলেন। রাজেন্দ্রলালের পূর্বপুরুষদের সাহিত্য অঙ্গনেও খ্যাতি ছিল। পীতাম্বর এবং রাজেন্দ্রলালের পিতা জন্মেজয় মিত্র (Janmejay Mitra) উভয়ই ‘ব্রজবুলি’তে কবিতা লিখেছিলেন। উল্লেখ্য যে, জন্মেজয় একজন বিশিষ্ট উর্দু কবিও ছিলেন। রাজেন্দ্রলাল ছিলেন জন্মেজয় মিত্রের তৃতীয় পুত্র।
রাজেন্দ্রলাল মিত্র পরবর্তীকালে ভারতের সমসাময়িক শিক্ষিত ব্যক্তিদের অন্যতম হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। ইংরেজি ভাষার ওপর পান্ডিত্যের জন্যও তিনি খ্যাতি লাভ করেন। রাজেন্দ্রলালের ধারাবাহিক শিক্ষায় ব্যত্যয় ঘটেছিল। প্রথম পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করে তিনি ১৮৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৪১ সালে কলেজ ত্যাগ করায় তাঁর চিকিৎসা শিক্ষা অসমাপ্ত থেকে যায়। আইন সম্বন্ধীয় শিক্ষা অসমাপ্ত থাকায় তাঁর আইনজীবী হওয়ার প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। বহুভাষা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের যে পারিবারিক ঐতিহ্য তাঁর ছিল তা তিনি গ্রহণ করেছিলেন এবং সংস্কৃত, ফারসি, উর্দু এবং হিন্দি ভাষায় পান্ডিত্য লাভে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ভাষার উপর দখল কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটিতে কর্মজীবন প্রতিষ্ঠায় তাঁকে সাহায্য করে, যা ছিল তাঁর কর্ম ও খ্যাতির স্থায়ী ভিত্তি। পরে তিনি ফরাসি, গ্রিক এবং ল্যাটিন ভাষায়ও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।
১৮৪৬ সালে রাজেন্দ্রলাল এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারিক এবং অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৮৮৫ সালে তিনি এর প্রথম দেশীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৮৫৭ ও ১৮৬৫ সালে রাজেন্দ্রলাল সোসাইটির সম্পাদক এবং ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ ও ১৮৭০ থেকে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি এর সহ-সভাপতি হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। ১৮৮৬ থেকে ১৮৯১ পর্যন্ত তিনি পুনরায় সোসাইটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সম্পূর্ণভাবেই ব্রিটিশপ্রভাবাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে একজন ভারতীয়ের ওপর অর্পিত এ সম্মান ছিল দূর্লভ। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির ‘শতবার্ষিকী ইতিহাস’ রচনা করেন যা প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ সালে।
১৮৫৬ সালে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন এবং জমিদারদের পোষ্যদের শিক্ষার জন্য নবপ্রতিষ্ঠিত সরকারি ওয়ার্ড ইনস্টিটিউশনের পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৮০ সালে ওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন অবলুপ্ত হওয়া পর্যন্ত তিনি এ চাকরিতে কর্মরত ছিলেন।
১৮৫৪ থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত (১৮৯১ সালে) এশিয়াটিক সোসাইটির প্রসিদ্ধ Bibliotheca Indica সিরিজের অধীনে অন্তত ১৪টির মতো গ্রন্থ তিনি সম্পাদনা করেন। ইতোমধ্যে এশিয়াটিক সোসাইটি এবং ভারতীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং কিছু ক্ষেত্রে তাঁর নিজের উদ্যোগে বাংলা ও অন্যান্য প্রদেশ এবং দেশীয় রাজন্যবর্গের লাইব্রেরি, এমনকি নেপালেও পূর্ণোদ্যমে সংস্কৃত পান্ডুলিপির আবিষ্কার, সংগ্রহ তালিকাভুক্তিকরণ এবং বর্ণনামূলক কাজ চলছিল। দেশ-বিদেশে তাঁর প্রস্ত্ততকৃত বেশ কিছু সুবিন্যস্ত তালিকা ও অনুবাদ বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত তাঁর The Sanskrit Buddhist Literature of Nepal গ্রন্থটি একটি নবযুগের সূচনা করে। সম্পাদনা, অনুবাদ ও তালিকাপ্রণয়ন ছাড়াও তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ পথিকৃৎ গ্রন্থ হলো The Antiquities of Orissa (১৮৭৫, ১৮৮০) এবং Buddha Gaya, the Hermitage of Sakya Muni (১৮৭৮)। তবে এটিও মনে রাখার বিষয় যে, তাঁর এই মূল কাজ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর তিনি ইংরেজি ও বাংলায় অসংখ্য বক্তৃতা প্রদান করেন এবং এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকা এবং কার্যবিবরণীতে (proceedings) ১২০টিরও অধিক নিবন্ধ লিখেন। তিনি Journal of the Asiatic Society of Great Britain and Ireland; Journal of the Anthropological Society; Journal of the Photographic Society of Bengal; calcutta review এবং Mookerjee's Magazine-এর নিয়মিত লেখক ছিলেন। তিনি The Englishman; The Daily News; The statesman, The Phoenix, The Citizen, The Friend of India, The Indian Field এবং The hindu patriot পত্রিকাতেও বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখেন। তিনি বেশ কয়েক বছর দি হিন্দু প্যাট্রিয়ট সম্পাদনা করেন। তিনি মাতৃভাষায়ও বিভিন্ন নিবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেন। রাজেন্দ্রলাল প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য সম্পাদনায় প্রফেসর ম্যাক্সমুলারকে সহায়তা করেছিলেন। তিনি কিছু প্রাচীন লিপির পাঠোদ্ধারও করেন। একইভাবে তিনি সমকালীন ইউরোপের বড় বড় তাত্ত্বিকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন। ম্যাক্সমুলার তাঁর নিজের লেখায় রাজেন্দ্রলালের প্রশংসা করেন।
এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডের মতোই ১৮৫২ থেকে ১৮৫৯ সালের মধ্যে ‘দেশজ সাহিত্য কমিটি’র পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ নামক সমকালীন জনপ্রিয় এবং একমাত্র সচিত্র মাসিক পত্রিকায় শিক্ষামূলক সাংবাদিকতায় তিনি অবদান রাখেন। ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ তাঁর ভক্ত যুবক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর মন জয় করেছিল। রাজেন্দ্রলালের সম্পাদনায় ১৮৬৩ সালে ‘বিবিধার্থ সংগ্রহে’র পরিবর্তে ‘রহস্য সন্দর্ভ’ নামে অপর একটি বিশ্বস্ত সচিত্র মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। রাজেন্দ্রলাল ছয় বছর অর্থাৎ ৬৬তম সংখ্যা প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত এটি সম্পাদনা করেন। এর বেশ কিছুদিন পূর্বে ১৮৪৮ সালে ২৪ বছর বয়সে এবং পুনরায় ১৮৫০ সালে তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশের জন্য লেখা নির্বাচন কমিটির একজন সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। তিনি ১৮৮২ সালে ঠাকুর পরিবার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘সারস্বত সমাজ’-এর সভাপতি মনোনীত হন। বাংলা ভাষার উন্নয়ন এবং ইংরেজি শব্দের, বিশেষত ভৌগোলিক পরিভাষার বাংলা সমার্থক শব্দের উন্নতি সাধনের জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রাচীন বিদ্যা আহরণে বিশেষ আগ্রহ থাকেলও বাংলার রেনেসাঁ যুগের রাজেন্দ্রলাল তাঁর অনুসারীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। এ প্রয়োজনে তিনি অবদান রাখেন তৎকালীন বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে যুবকদের শিক্ষা-দীক্ষা তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে।
এ ধরনের সংগঠনের মধ্যে ছিল Central School Book Committee, Vernacular Literature Society, Calcutta School Book Society, Sarasvat Samaj, bethune society, Society for Promotion of Industrial Art এবং Association of Friends for the Promotion of Social Improvement। তিনি নিজে বাংলার বিভিন্ন বিষয়, বিশেষ করে ভূগোল এবং ব্যাকরণের ওপর পাঠ্যবই রচনা করেন। তিনি ভৌগোলিক জ্ঞান বিস্তারের ওপরও বিশেষ জোর দেন। তিনি Photographic Society, Philharmonic Academy of Bengal-এর সদস্য এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর একজন সভ্য ছিলেন। পূর্বে অজানা ছিল এমন বিভিন্ন শাখার বিভিন্ন পরিশাব্দিক বিষয়ে লেখার মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়ন সাধন করেন। তিনি ১৮৫০ থেকে ১৮৫৮ সালের মধ্যে কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটির জন্য বাংলায় মানচিত্র প্রকাশ করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর অপর অর্জন হলো বাংলা ও উড়িষ্যা ভাষায় প্রকাশিত বাংলা, উড়িষ্যা ও বিহারের বিভিন্ন জেলার মানচিত্র প্রকাশ (১৮৬৮)। তিনি ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৫ সালের মধ্যে বর্তমান উত্তর প্রদেশ সরকারের জন্য হিন্দি এবং উর্দুতে ভারতের মানচিত্র এবং ফারসি ভাষায় এশিয়ার মানচিত্র তৈরি করেন। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ বাংলা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে শিবাজীর জীবনী (১৮৬০) এবং বিবিধার্থ সংগ্রহে প্রকাশিত পারিভাষিক প্রবন্ধসমূহ (১৮৬০)।
ভারতীয়দের দ্বারা দেশজ প্রত্ন-নিদর্শন সম্পর্কিত বিদ্যাচর্চার ভিত্তি স্থাপন করেন রাজেন্দ্রলাল। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কঠোর ও নিরলস শ্রম দেশ-বিদেশ থেকে তাঁর জন্য সম্মান বয়ে আনতে শুরু করে। উপনিবেশিক যুগের প্রাথমিককালের ভারতীয়দের মধ্যে পান্ডিত্য এবং শিক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে তিনি ইউরোপে সম্মানিত হন। তিনি ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডের ‘রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি’র সদস্যপদ লাভ করেন। ভিয়েনা এবং ইতালিতেও তিনি সম্মানিত হয়েছিলেন। সরকার তাঁকে ‘রায় বাহাদুর’ (১৮৭৭), ‘সি.আই.ই’ (১৮৭৮) এবং ‘রাজা’ (১৮৮৮) উপাধিতে ভূষিত করে।
সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে ব্যাপক সম্পৃক্তির কারণে রাজেন্দ্রলাল জনতার নেতা হিসেবে জাতীয় মর্যাদা লাভ করেছিলেন। ১৮৬৩ সাল থেকে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একজন ‘Justice of the Peace’ ছিলেন এবং ১৮৭৬ সালে কলকাতা পৌরসভার নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রায় প্রথমদিক থেকেই তিনি ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ১৮৮১-৮২, ১৮৮৩-৮৪ ও ১৮৮৬-৮৭ সালে এর সভাপতি হন। ১৮৭৮-৮০, ১৮৮৭-৮৮ ও ১৮৯০-৯১ সালে তিনি এর সহ-সভাপতি ছিলেন। তবে ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সত্যিকারের একজন ভারতীয় জাতীয় নেতার মর্যাদা লাভে সমর্থ হন। ১৮৮৬ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সমকালীন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন এর সভাপতি রাজেন্দ্রলাল উক্ত অধিবেশনের সম্বর্ধনা কমিটির চেয়াম্যানের ন্যায় উচ্চপদের জন্য মনোনীত হন। ১৮৯১ সালের ২৬ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। [আবু ইমাম]