বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি
বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি (১৯১০-১৯৬৩) বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান। সাধারণভাবে বাংলার ও বিশেষভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে ১৯১০ সালে রাজশাহীতে এ সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। দিঘাপতিয়া রাজ পরিবারের বংশধর শরৎকুমার রায়, রাজশাহীর নেতৃস্থানীয় আইনজীবী ও ইতিহাসবিদ অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এবং ইতিহাস, শিল্পকলা ও প্রত্নতত্ত্বে সুপন্ডিত রামপ্রসাদ চন্দ হলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। বাংলার শিল্পকলা ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণায় তাঁদের অভিন্ন আগ্রহ ছিল। মানুষ ও প্রকৃতির ধ্বংসলীলা এড়িয়ে যেসব সৌধ এখনও টিকে আছে সেগুলির তথ্য উদ্ঘাটন করে অতীত ঐতিহ্য তুলে ধরাই ছিল তাঁদের আজীবন প্রয়াস।
১৯১০ সালের এপ্রিলের গোড়ার দিকে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়সহ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে শরৎকুমার রায় দেওপাড়া, পালপাড়া, মালঞ্চ, জাগপুর, ইতাহার, চবিবশনগর, মান্দইল, কুমারপুর, খেতুর, বিজয়নগর ও রাজশাহীর সংলগ্ন এলাকাগুলিতে এক অনুসন্ধানমূলক সফরে যান। তাঁরা মান্দইল থেকে পূর্ণাবয়ব একটি চন্ডীমূর্তিসহ বত্রিশটি ভাস্কর্য সংগ্রহ করতে সমর্থ হন। রাজশাহীতে ফেরার পর কুমার ও তাঁর সহকর্মীদেরকে শহরের নেতৃস্থানীয় অধিবাসীরা তাঁদের সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ এক জনসংবর্ধনা প্রদান করেন। এ সংবর্ধনা সভাতেই ভুবনমোহন মৈত্র ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের স্থানীয় শাখার অবৈতনিক সম্পাদক শশধর রায় সংগৃহীত সামগ্রীগুলি রাজশাহীতেই সংরক্ষণ করার জন্য কুমারের প্রতি অনুরোধ জানান। কুমার এর প্রয়োজন উপলব্ধি করে রাজশাহীতে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। এভাবেই বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে উদ্যোক্তারা বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে সোসাইটির উদ্বোধন করা হয়। কুমার চলতি ব্যয় নির্বাহ ও পুরাকীর্তি রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় বাবদ মাসিক ২০০ টাকা হারে অনুদান প্রদানের অঙ্গীকার করেন।
১৯১০ সালে কলকাতাস্থ ভারতীয় জাদুঘর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংগৃহীত সকল নিদর্শন চেয়ে পাঠালে এর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়। অবশ্য রাজশাহী বিভাগের তৎকালীন কমিশনার এফ.জে মোনাহানের সহানুভূতিশীল মনোভাবের সুবাদে এ পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হয়। বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ১৯১২ সালে রাজশাহীতে এসে সোসাইটির সংগৃহীত নিদর্শনগুলি দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হন। এর কিছুদিন পর বঙ্গীয় সরকার ১৯১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ১১নং সার্কুলারের মাধ্যমে প্রাচীন ভাস্কর্য ও অন্যান্য প্রত্ননিদর্শনাবলি সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের প্রশ্নে স্থানীয় জাদুঘরগুলির পরিচালকদের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। কুমার পূর্বের মতোই অনুসন্ধানমূলক প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানের ব্যয় বহন করতে থাকেন। ১৯১০ সালের ডিসেম্বর, ১৯১১ সালের এপ্রিল ও ১৯১২ সালের অক্টোবর মাসে এবং পরবর্তী বছরগুলিতে বিভিন্ন সময়ে প্রত্নতাত্বিক অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
১৯১৪ সালে সমিতি হিসেবে নিবন্ধিত এ সোসাইটি বাংলার প্রাচীন স্থানগুলিতে অনুসন্ধান, বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণা, প্রত্ন-নিদর্শনাবলি ও প্রাচীন পান্ডুলিপি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন গবেষণাকর্ম ও বিরল পান্ডুলিপি প্রকাশনার কাজ হাতে নেয়। সোসাইটির জাদুঘর ও গ্রন্থাগারের জন্য কুমার নিজ ব্যয়ে একটি ভবন নির্মাণ করেন এবং ভবনে প্রয়োজনীয় আসবাবেরও ব্যবস্থা করেন। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমদনাথ রায় ভবন নির্মাণের জন্য জমি দান করেন। লর্ড কারমাইকেল ১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বর এ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর একটি অছিনামা সম্পাদিত হয় এবং ঐ একই দিন বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড রোনাল্ডসে জনসাধারণের জন্য এ জাদুঘর উন্মুক্ত করেন।
ভাস্কর্য, শিলালিপি, পান্ডুলিপি, মুদ্রা ও অন্যান্য প্রত্নতাত্বিক গুরুত্বসম্পন্ন সামগ্রী সংগ্রহের জন্য কুমার ও তাঁর সহযোগীরা বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানমূলক সফরের আয়োজন করেন। সফরগুলি রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, ঢাকা, মালদহ, ২৪ পরগনা ইত্যাদি জেলার প্রত্নস্থলগুলিতে পরিচালিত হয়। এ সফরগুলি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয় এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রত্ননিদর্শন আবিষ্কৃত, শনাক্তীকৃত ও সংগৃহীত হয়।
এসব অনুসন্ধানের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সোসাইটি বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানে খননকার্য পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজশাহী জেলার দেওপাড়ার পদ্যুম্নেশ্বর পুষ্করিণী খনন করে এর তলদেশ থেকে ৬৪টি ভাস্কর্য ও পোড়ামাটির তিনটি ‘মনসা-ঘট’ উদ্ধার করা হয়। ১৯১১ সালে সোসাইটির কয়েকজন সদস্য পশ্চিম দিনাজপুরের বালুরঘাট থেকে ৫ মাইল দূরে কাশীপুরে এক সুউচ্চ স্তূপের সন্ধান পান। তাঁরা এ স্তূপ খনন করে ইটের প্রাচীর, স্তূপাভিমুখী ইটের রাস্তা ও কয়েকটি ভাস্কর্য আবিষ্কার করেন। এ ভাবেই সোসাইটির সদস্যরা ১৯১৬ সালের নভেমতরে মাহীসন্তোষে এবং রাজশাহী জেলার কুমারপুরে খননকার্যের মাধ্যমে প্রচুর প্রত্ননিদর্শন সংগ্রহ করেন। ১৯২৩ সালে সোসাইটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর সহযোগিতায় ও অধ্যাপক ডি.আর ভান্ডারকরের নির্দেশনায় পাহাড়পুরে খননকার্য শুরু করে।
কুমার এ প্রকল্পে পাঁচ বছরের জন্য বার্ষিক ২০০০ টাকা হারে অনুদান প্রদানের অঙ্গীকার করলেও প্রথম পর্যায়ের শেষেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ প্রকল্প পরিত্যাগ করে। পরে এ খননকার্য চলতে থাকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে। বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের কিউরেটর এ কাজে সক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। কুমার এ কাজে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে ১৯২৫-২৬, ১৯৩০-৩১ ও ১৯৩৪-৩৫ সালে তিনটি পর্যায়ে প্রতি বছর ২০০০ টাকা করে অনুদান প্রদান করেন। পাহাড়পুরে উৎখননের ফলে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শনের মধ্যে বরেন্দ্র জাদুঘর তার প্রাপ্য অংশ হিসেবে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া এর কাছ থেকে ২৬৫টি নিদর্শন লাভ করে।
১৯৩৭ সালের ৬ নভেম্বর সরকারি বিজ্ঞপ্তি বলে বরেন্দ্র জাদুঘর একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হলে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি সরকারি নির্দেশ মোতাবেক গঠিত ব্যবস্থাপনা কমিটির নিকট জাদুঘর ভবনের দায়িত্ব হস্তান্তর করে। একই সাথে সোসাইটির সংগৃহীত সকল প্রত্ননিদর্শন, পান্ডুলিপি, মুদ্রিত পুস্তক ও আসবাবও কমিটিকে বুঝিয়ে দেয়।
সোসাইটির পরিচালক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র সুযোগ্য নির্দেশনায় এখানে পরিচালিত গবেষণা-কর্মের বিষয় কলকাতা ও অন্যান্য স্থান থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়াও সোসাইটি ১২টি বার্ষিক প্রতিবেদন ও ৩১টি প্রবন্ধ সম্বলিত ৯টি মনোগ্রাফ, শিলালিপিভিত্তিক দুটি প্রকাশনা (জাতিতত্ত্ব সংক্রান্ত একটি, রাজবংশীয় ইতিহাসের উপর একটি), জাদুঘরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ক্যাটালগ, সংগৃহীত শিলালিপির তালিকা এবং কয়েকটি সংস্কৃত পান্ডুলিপির সম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশ করেছে।
জাদুঘরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলেও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সোসাইটি টিকে থাকতে পারে নি। ১৯৩০ সালে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, এস.সি চক্রবর্তী ও ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কুমারের মৃত্যুর কারণে এবং আর.জি বসাক, ইউ.এন ঘোষাল, আর.পি চন্দ, এন.জি মজুমদার প্রমুখের দেশত্যাগের ফলে সোসাইটি তার পৃষ্ঠপোষক ও কর্মীদের হারায়। ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশ বিভাগের পরবর্তী ১৮ বছর ছিল সোসাইটির জন্য প্রকৃতই ক্ষীণ তৎপরতার কাল। অবশেষে ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠানটি বিলুপ্ত হয়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও জ্ঞানচর্চার বিকাশে সোসাইটির প্রচেষ্টা ও গৌরবের স্মারক হিসেবে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর আজও টিকে আছে। [সাইফুদ্দীন চৌধুরী]