কার্তাজ পদ্ধতি
কার্তাজ পদ্ধতি ষোল শতকের প্রথমদিকে পর্তুগিজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত মহাসাগর অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য কার্তাজ পদ্ধতি নামে এক ধরনের অনুমতিপত্রের প্রচলন করে। ঐতিহ্যগতভাবে, আরব ও পারসিক নাবিকগণ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যাতায়াতের পথে প্রভাবশালী ছিল এবং তারা সমুদ্র অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। ষোল শতকের প্রথমদিক থেকে ভারত মহাসাগরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পুর্তুগিজরা মুসলমানতের হটিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। ভারত মহাসাগরে নিজেদের সার্বভৌম ক্ষমতা ঘোষণা করে পর্তুগিজরা তাদের আধিপত্যের স্মারক হিসেবে কার্তাজ পদ্ধতির প্রচলন করে। ভারত মহাসাগরে তারা বলপূর্বক অন্যান্য এশিয় অংশীদারীদের নিকট থেকে কার্তাজ নামের এ শুল্ক আদায় করে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে বাধ্য করে। কার্তাজ ছিল এক ধরনের অনুমতি পত্র। এই অনুমতিপত্র বহনকারীকে পর্তুগিজ নাবিকদের বলপূর্বক হরণ করা থেকে মুক্ত ঘোষণা করা হয়। কার্তাজ বহনকারীকে ভারত মহাসাগরে অবাধে যাতায়াতের অধিকার প্রদান করা হয়।
কার্তাজ শব্দটি আরবি কিরতাস (কাগজ বা দলিল) শব্দ থেকে উদ্ভুত। শুরুতে বলা হত যে, আরব সাগরে যাতায়াতকারী অ-আরবীয় নাবিকদের জন্য আরব-নাবিকগণ কার্তাজ পদ্ধতির প্রচলন করে। শুল্ক আদায়কে ন্যায্য প্রতিপন্ন করার জন্য পর্তুগিজগণ দাবি করে যে, ভারত মহাসাগরে তাদের আগমনের পূর্বেই এই কার্তাজ প্রথা চালু ছিল। ভারতে আসার পথে প্রথম আরব সাগরে প্রবেশ করলে আরবদের নিকট থেকে তাদেরকেও কার্তাজ কিনতে হতো। কিন্তু এই অভিযোগের সমর্থনে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় নি। পর্তুগিজদের নিকট থেকে কার্তাজ আদায় করা বাস্তবেই অসম্ভব ব্যাপার ছিল। কারণ পারসিক-আরবদের সমুদ্রপথে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যক্তিগত উদ্যোগেই করা হতো এবং কোন বিশেষ বানিজ্য জাহাজের পক্ষে পর্তুগিজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো একটি যৌথ সংস্থার ওপর কার্তাজের মতো পদ্ধতি আরোপ করা মোটেও বাস্তবে সম্ভব ছিল না।
ভারত মহাসাগরে আসার পূর্বে পর্তুগিজরা ভূমধ্যসাগরে জলদস্যুতার জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিল; এবং ভারত মহাসাগরে আসার পর তারা একই কাজ চালিয়ে যায়। জলদস্যুতা ও বন্দি নাবিকদের ক্রীতদাসে পরিণত করার সমস্যা ভারত ইতিপূর্বে মহাসাগরে অজানা ছিল। ১৫০২ সালে প্রথম কার্তাজ প্রথা চালু হয়, যখন ভাস্কো ডা গামা পর্তুগিজদের নিরাপদ স্থান হিসেবে মালাবার উপকূলে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কয়েক দশক ধরে পর্তুগিজদের সঙ্গে শান্তিচুক্তির বিনিময়ে স্থানীয় শাসকগণ অর্থের বিনিময়ে কার্তাজ বিতরণ করত। কিন্তু অচিরেই পর্তুগিজরা স্থানীয় শাসকদের নিকট থেকে এই অধিকার হরণ করে। ১৫৩৩ সালে জাহাজ প্রতি কার্তাজ ছিল এক পারদো। অপরাপর পাশ্চাত্য সমুদ্র ব্যবসায়ী শক্তি কর্তৃক চাপ সৃষ্টি-পূর্ব না আসা পর্যন্ত এই হার অপরিবর্তিতই ছিল। সতেরো শতকের প্রথমদিকে পাশ্চাত্য-সমুদ্র ব্যবসায়ী শক্তি ভারত মহাসাগরে ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করে। ভারত মহাসাগরে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কার্তাজ পদ্ধতির প্রভাব ছিল বিপর্যয়কর। কার্তাজ পদ্ধতির মাধ্যমে তারা যে রাজস্ব আদায় করত তা উল্লেখযোগ্য ছিল না। এই অনুমতি পদের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিকটি ছিল এই যে, এতে সীমিত সংখ্যক জাহাজকে বিশেষ কোনো গন্তব্যে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করত। এশিয় ব্যবসায়ীদের নিজ ইচ্ছা মতো তাদের বাণিজ্য জাহাজকে যেকোনো গন্তব্যস্থানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হত না। কার্তাজ পদ্ধতির অধীনে শুধু পর্তুগিজরাই স্থির করত কোন গন্তব্যে কতগুলো জাহাজ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। উদাহরণস্বরূপ, গুজরাট ব্যবসায়ীদের আরব উপদ্বীপ ও পূর্ব আফ্রিকার সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল, অথচ তাদের দাবি মাফিক তাদের কখনোই কার্তাজ দেওয়া হয়নি। বরাবরই তা ছিল চাহিদার অর্ধেকেরও কম। এর ফলে ভারতীয় এবং পারস্য-আরব ব্যবসায়ীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরিণামে তাদের সমুদ্র ব্যবসায় ধস নামে। করোমন্ডল উপকূল ও বাংলার সমুদ্র ব্যবসায়ীদের ভাগ্যেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। [সিরাজুল ইসলাম]