কররানী শাসন
কররানী শাসন বাংলায় ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে তাজ খান কররানী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়ে ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে এ বংশের শেষ শাসক দাউদ খান কররানী আকবরের সেনাপতি মুনিম খান এর কাছে পরাজিত হওয়া পর্যন্ত টিকে ছিল। নানা কারণে কররানীদের সংক্ষিপ্ত শাসন বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। কররানী শাসন বাংলার স্বাধীনতার সমাপ্তি এবং মুগল শাসনের সূত্রপাত চিহ্নিত করে। কররানীদের আদি নিবাস ছিল আফগানিস্তানের বঙ্গাশ নামক স্থানে। বর্তমানে এটি কুররম নামে অভিহিত। পাঠানদের কররানী শাখা আফগানিস্তানে করলানি নামে পরিচিত।
এ বংশের প্রতিষ্ঠাতা তাজখান কররানী ছিলেন শেরশাহের অন্যতম উচ্চপদস্থ কর্মচারী। তিনি শেরশাহের পুত্র ইসলামশাহের সময়ে দক্ষিণ বিহারের শাসনকর্তা ছিলেন। আদিলশাহের শাসনামলে তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমীর। গোয়ালিয়রে আদিলশাহের দরবারে রাজনৈতিক অরাজকতার কারণে তাজখান সেখান থেকে পলায়ন করেন এবং গাঙ্গেয় দোয়াব অঞ্চলে নিজের কতৃর্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ফররুখাবাদের ১৮ মাইল দক্ষিণে ছিব্রা-মউয়ে আদিলশাহের নিকট পরাজিত হয়ে তাজখান তার ভাই, আহমদ, সুলায়মান এবং ইলিয়াসের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁরা খাবাসপুর, তান্ডা এবং গঙ্গার তীরবর্তী কিছু গ্রামের জায়গিরদার ছিলেন। তাজখান এবং তাঁর ভাইয়েরা জনগণের নিকট থেকে কর আদায়, পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি লুণ্ঠন এবং দিল্লির সুলতানের প্রায় একশ হাতি দখল করে নিজেদেরকে শক্তিশালী করেন।
ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক আফগান তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয়। ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে আদিলশাহের সেনাপতি হিমুর নেতৃত্বাধীন বাহিনীর নিকট তারা পরাস্ত হন। তাজ খান ও সুলায়মান কররানী বাংলায় পালিয়ে যান। বাংলার আফগান দলপতিদের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে নানা উপায়ে তাজখান ও সুলায়মান নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করেন। অবশেষে তাজখান সুলতান তৃতীয় গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে কররানী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু তাজ খান বেশিদিন তাঁর সুফল ভোগ করতে পারেন নি। ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যু হয়।
তাঁর ভাই সুলায়মান কররানী তাঁর উত্তরাধিকারী হন (১৫৬৩ খ্রি.) এবং গৌড় থেকে তান্ডায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। মুগলগণ উত্তর ভারত দখল করার পর সেখান থেকে এসে তাঁর রাজধানীতে একত্রিত হওয়া আফগানদের নিয়ে তিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। একজন বিচক্ষণ কুটনীতিবিদ সুলায়মান কররানী সব সময়ই আকবরের সাথে প্রকাশ্য বিরোধিতা এড়িয়ে চলেন। তিনি মুগল রাজদরবারে নিয়মিত উপহার পাঠাতেন এবং কখনোই প্রকাশ্যে স্বাধীনতা দাবি করেন নি। তিনি আকবরের নামে খুৎবা পাঠ করান ও মুদ্রা প্রচলন করেন। বাহ্যত সুলায়মান কররানী মুগলদের আধিপত্য স্বীকার করলেও তিনি হযরত-ই-আলা উপাধি নেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, কার্যত তিনি একজন স্বাধীন শাসক ছিলেন।
পশ্চিম সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সুলায়মান কররানী উড়িষ্যা জয় করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর পুত্র বায়েজীদ কররানীকে ১৫৬৭-৬৮ খ্রিস্টাব্দে একটি শক্তিশালী সৈন্যদলসহ ওই দেশের বিরুদ্ধে পাঠান। যুদ্ধে বায়েজীদ উড়িষ্যার রাজাকে পরাজিত ও হত্যা করেন। ইতোমধ্যে সুলায়মান কররানী স্বয়ং উড়িষ্যার দিকে অগ্রসর হন এবং এর রাজধানী তাজপুর দখল করেন। সুলায়মান কররানীর নির্ভীক সেনাপতি কালাপাহাড় পুরী পর্যন্ত অগ্রসর হন এবং প্রত্যন্ত এলাকাসমূহ দখল করেন। এভাবে উড়িষ্যা সরাসরি কররানী শাসনাধীনে আসে।
উড়িষ্যায় সুলায়মান কররানীর ব্যস্ততার সুযোগে কোচ রাজা তার পুত্র শুক্লধ্বজের নেতৃত্বে একটি সৈন্য বাহিনী বাংলার উত্তর পশ্চিম অঞ্চল আক্রমণ করার জন্য পাঠান। কিন্তু কোচ বাহিনী সম্পূর্ণ পরাজিত হয় এবং রাজপুত্র বন্দি হন। কালাপাহাড় কোচ রাজধানী অবরোধ করেন। ইতোমধ্যে উড়িষ্যায় বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং সম্ভাব্য মুগল আক্রমণের আশঙ্কায় সুলায়মান কররানী কোচবিহারের রাজার সাথে শান্তি স্থাপন করেন। তিনি তাঁর সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করেন, বিজিত এলাকা কোচ রাজাকে ফিরিয়ে দেন এবং রাজপুত্রকে মুক্তি দেন।
সুলায়মান কররানী আট বছর বাংলা শাসন করেন। তাঁর রাজ্য উত্তরে কোচবিহার থেকে দক্ষিণে পুরী পর্যন্ত এবং পশ্চিমে শোন নদী থেকে পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৫৭২ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর সুলায়মান কররানীর মৃত্যু হয়।
সুলায়মান কররানীর জ্যেষ্ঠ পুত্র বায়েজীদ কররানী তাঁর উত্তরাধিকারী হন। তিনি তাঁর পিতার নীতি পরিহার করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি নিজের নামে খুৎবা পাঠ এবং মুদ্রা প্রচলন করেন।
বায়েজীদ কররানী মাত্র অল্প কয়েকমাস বাংলা শাসন করেন। তাঁর চাচাত ভাই এবং ভগ্নীপতি হান্সু তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করেন এবং ক্ষমতা দখল করেন। কিন্তু শীঘ্রই সুলায়মান কররানীর বিশ্বস্ত উজির লোদী খান কিছু সংখ্যক আমীরের সহায়তায় হান্সুকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁকে হত্যা করেন। অতঃপর তারা ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে বায়েজীদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা দাউদ কররানীকে বাংলার সিংহাসনে অভিষিক্ত করেন। দাউদ তাঁর ভাইয়ের স্বাধীন নীতি অনুসরণ করে নিজের নামে খুৎবা পাঠ ও মুদ্রা প্রচলন করেন।
দাউদ কররানী উত্তরাধিকারসূত্রে একটি বিশাল সৈন্য বাহিনী ও বিপুল ধন সম্পদ লাভ করেন। এর সাহায্যে তিনি আকবরের বিরুদ্ধাচরণ করেন এবং গাজীপুরের নিকট জামানিয়া অবরোধ করেন। বাদশাহ জৌনপুরের শাসক মুনিম খানকে দাউদ কররানীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার জন্য আদেশ দেন। মুনিম খান পাটনায় পৌঁছে লোদীখানের মুখোমুখি হন এবং সহজ শর্তে সন্ধি সম্পাদন করে সন্তুষ্ট হন। আকবর অথবা দাউদ কেউই এ সন্ধিতে খুশী হন নি। দাউদ তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করে তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। অপর দিকে বাদশাহ মুনিম খানকে আবার বাংলা ও বিহার আক্রমণের আদেশ দেন। তদনুসারে মুনিম খান বিহারে পৌঁছান এবং পাটনা অবরোধ করেন। এ অবস্থায় ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে আকবর স্বয়ং দাউদ খানের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তিনি সরাসরি হাজীপুর আক্রমণ করে সহজেই তা দখল করেন। সম্রাট পাটনা দখল করে মুনিম খানকে বিহার ও বাংলার শাসক নিযুক্ত করেন এবং দাউদ কররানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যহত রাখার নির্দেশ দিয়ে দিল্লি অভিমুখে রওনা হন।
মুনিম খান বাংলার বিরুদ্ধে তার অভিযান চালু রাখেন। তিনি তান্ডা ও সাতগাঁও দখল করে নেন। দাউদ খান উড়িষ্যায় পালিয়ে যান। মুনিম খান ও টোডরমল দাউদের পশ্চাদ্ধাবন করে উড়িষ্যার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। বালাশোর জেলার তুকারয়ে সংঘটিত যুদ্ধে দাউদ খান পরাজিত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করেন (১৫৭৫ খ্রি.)। দাউদ কররানী ও মুগলদের মধ্যে অতঃপর কটকে একটি শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়। দাউদ কররানী বাংলা ও বিহার মুগলদেরকে ছেড়ে দেন এবং শুধু উড়িষ্যা নিজের দখলে রাখেন।
১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে মুনিম খানের আকস্মিক মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে, দাউদ কররানী বাংলা অভিমুখে অগ্রসর হন এবং তেলিয়াগড়ি গিরিপথ পর্যন্ত দখল করেন। এ পরিস্থিতিতে আকবর হোসেন কুলী বেগকে খানজাহান উপাধি দিয়ে বাংলার শাসক নিযুক্ত করেন ও দাউদ কররানীকে আক্রমণ করার আদেশ দেন। খানজাহান টোডরমলকে সঙ্গে নিয়ে দাউদের রাজধানী তান্ডা অভিমুখে যাত্রা করেন। উত্তর-পশ্চিমে গঙ্গা এবং দক্ষিণ-পূর্বে পাহাড়ের মধ্যবর্তী রাজমহল এর সংকীর্ণ প্রবেশ পথে কররানী তাদের পথ অবরোধ করেন। খান জাহান প্রথমে তেলিয়াগড়িতে আফগানদের সম্মুখীন হন এবং যুদ্ধের পর এটি অধিকার করেন। ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই রাজমহলের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দাউদ কররানী বন্দি হন এবং তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় এবং সম্রাটের নিকট তাঁর মস্তক প্রেরিত হয়। দাউদ কররানীর মৃত্যুদন্ডের ফলে বাংলায় স্বাধীন মুসলিম শাসনের অবসান ও মুগল শাসনের সূচনা হয়। [এ.বি.এম. শামসুদ্দীন আহমদ]