ইসলাম খান মাশহাদি
ইসলাম খান মাশহাদি (১৬৩৫-১৬৩৯) ১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দে আজম খান-এর স্থলাভিষিক্ত বাংলার সুবাহদার। তাঁর মূল নাম মীর আবদুস সালাম। সম্রাট শাহজাহান তাঁকে ইসলাম খান উপাধি প্রদান করেন। বাংলায় নিযুক্তি লাভের পূর্বে গুজরাটের শাসনকর্তার পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে প্রশাসনিক কর্মকান্ডে তিনি প্রভূত অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
ইসলাম খান মাশহাদির শাসনামল আসাম ও আরাকান এর সাথে মুগলদের বিরোধের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। আসামের রাজা প্রতাপ সিং কামরূপের রাজা পরীক্ষিৎ নারায়ণের (ইতিপূর্বেই মুগলদের বশ্যতা স্বীকার করেন) ভাই বলী নারায়ণকে কামরূপ আক্রমণে উৎসাহ প্রদান করে তাঁর গৃহীত সম্প্রসারণ নীতির প্রয়োগ শুরু করেন। এমনকি কামরূপের মুগল থানাদার রাজা ছত্রজিৎ বিশ্বাসঘাতকতা করে বলী নারায়ণকে কামরূপের মুগল সদর দফতর হাজো আক্রমণে উৎসাহিত করেন। কামরূপের ফৌজদার আবদুস সালামের সাহায্যার্থে ইসলাম খান শেখ মহিউদ্দীন, মুহম্মদ সালিহ্ কাম্বুহ্, মির্জা মুহম্মদ বুখারী ও জয়নাল আবেদীনের অধীনে সৈন্য সাহায্য প্রেরণ করেন। প্রথমদিকে মুগল বাহিনী সাফল্যের সঙ্গে শত্রুপক্ষকে তাদের সীমান্তের ওপারে বিতাড়িত করে। তবে শেষ পর্যন্ত মুগল বাহিনী প্রতিপক্ষ অহোম বাহিনীর আকস্মিক আক্রমণ ও ছত্রজিতের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। মীর জৈনউদ্দীন আলীর নেতৃত্বে অচিরেই ঢাকা থেকে অপর একটি বাহিনী প্রেরিত হয়। এবার মুগল বাহিনী অহোমদের পরাজিত এবং ধুব্রী পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে বিশ্বাসঘাতক ছত্রজিৎকে বন্দি করে। বন্দিকে ঢাকায় পাঠিয়ে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। মুগল বাহিনী শ্রীঘাট ও পান্ডু অধিকার করে। বলী নারায়ণ আসামে পালিয়ে যান। ১৬৩৮-৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সম্পাদিত চুক্তির ফলে এ শত্রুতার অবসান ঘটে এবং উত্তরে বরনদী পর্যন্ত মুগল রাজ্যসীমা নির্ধারিত হয়। এ সময় গৌহাটিতে মুগল সদর দফতর প্রতিষ্ঠিত হয়।
অহোম-মুগল দ্বন্দ্বের অবসানের সাথে সাথেই আরাকানের সঙ্গে মুগলদের বৈরি সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের রাজা শ্রীসুদর্শন এর মৃত্যু হলে প্রভাবশালী এক রাজকর্মচারী সিংহাসন দখল করে ‘নরপতি’ উপাধি ধারণ করেন। অবিলম্বে মৃত আরাকান-রাজের ভাই মংগত রায় চট্টগ্রামে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীকে বিতাড়িত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সৈন্য সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় তিনি মুগলদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ইসলাম খান মাশহাদি আরাকানের পলাতক যুবরাজকে সাহায্য করার জন্য ভুলুয়া ও জগদিয়ার মুগল থানাদারদের নির্দেশ দেন। মুগল বাহিনী আরাকান নৌবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে এবং মংগত রায় ফেনী নদী অতিক্রম করতে সক্ষম হন। ক্ষমতা দখলকারী পুনরায় মুগল বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। ইসলাম খান দ্রুত পর্যাপ্ত সৈন্য সাহায্য পাঠান এবং হামলাকারীদের তাদের পূর্বতন অবস্থানে হটে যেতে বাধ্য করেন। এরপর চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনকারী পর্তুগিজরা মংগত রায়ের পক্ষ অবলম্বন করে এবং এভাবে চট্টগ্রাম জলদস্যুদের উপদ্রব থেকে রক্ষা পায়। এর পর থেকে পর্তুগিজ নৌ-বাহিনীর সাহায্য বঞ্চিত আরাকানিদের নৌ-শক্তি ক্রমশই দুর্বল হতে থাকে। ফলে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খানের অধীনে মুগলদের চট্টগ্রাম অধিকারের পথ প্রশস্ত হয়।
অহোমীয় ও আরাকানিদের সাথে মুগলদের বৈরিতার অবসানের অব্যবহিত পর ইসলাম খান মাশহাদিকে প্রধানমন্ত্রীর (উজির-ই-দীউয়ান-ই-আলা) দায়িত্ব গ্রহণের জন্য রাজ দরবারে ডেকে পাঠানো হয় এবং তাঁর স্থলে সম্রাটের দ্বিতীয় পুত্র শাহজাদা শাহ সুজাকে বাংলার সুবাহদার নিয়োগ করা হয়। [কে.এম করিম]