মন্ডল, যোগেন্দ্রনাথ
মন্ডল, যোগেন্দ্রনাথ (১৯০৪-১৯৬৮) রাজনীতিবিদ এবং তফসিলি সম্প্রদায়ের নেতা। বরিশাল জেলার গৌড়নদী উপজেলার মাইস্তারকান্দি গ্রামে ১৯০৪ সালের ২৯ জানুয়ারি তাঁর জন্ম। বাবা রামদয়াল ও মায়ের নাম সন্ধ্যা। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ১৯২৪ সালে মেট্রিকুলেশন এবং ১৯২৬ সালে বরিশাল বি.এম কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯২৯ সালে ডিগ্রি পাস করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯০৪ সালে আইন পাস করেন। এরপরেই তিনি বরিশাল সদর কোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এ সময়ে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বরিশাল জেলা বোর্ড-এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালের বঙ্গীয় আইন পরিষদ নির্বাচনে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বাকেরগঞ্জ উত্তর-পূর্ব সাধারণ নির্বাচনী এলাকা থেকে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে সরলকুমার দত্তকে পরাজিত করে জয়ী হন। ১৯৪৫-১৯৪৬ সালের নির্বাচনেও তিনি দলের মেন্ডেট নিয়ে তফসিলি ফেডারেশনের হয়ে বাকেরগঞ্জ দক্ষিণ-পশ্চিম (সংরক্ষিত) নির্বাচনী অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হন।
রাজনীতি জীবনের শুরুতে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল কংগ্রেস নেতা শরৎচন্দ্র বসু এর অভিভাবকত্ব লাভ করেন। সে সময়ে তিনি স্বতন্ত্র তফসিলি দলের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৩৮ সালের ১ আগস্ট মন্ত্রিসভার বিপক্ষে দাঁড়ানোর এবং অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। যদিও ১৯৪০ সালে কলকাতা কর্পোরেশন এর নির্বাচনে বসু দে’র সুপারিশক্রমে তিনি কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে তফসিলি সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত আসনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
১৯৪৩ সালের ২৪ এপ্রিল খাজা নাজিমুদ্দীন মন্ত্রিসভা গঠন করলে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল তাঁর ২১ জন তফসিলি সদস্য সহকারে ওই মন্ত্রিসভার পক্ষে সমর্থন জানান। এর প্রতিদানে তাঁকে উক্ত মন্ত্রিসভার সমবায় মন্ত্রীর পদ প্রদান করা হয় এবং প্রেমবিহারী বর্মন ও পুলীন বিহারী মল্লিক নামের তাঁর অপর দু’জন তফসিলি সহযোগীকেও মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। যদিও এ মন্ত্রিসভা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৪৫ সালের ২৯ মার্চ তা ভেঙ্গে দেয়া হয়। ইতোঃমধ্যে মন্ডল ‘All India Scheduled Caste Federation’ গঠন করেন।
মন্ত্রিসভায় থাকাকালে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল সর্বভারতীয় পর্যায়ের তফসিলি নেতা ড. বি, আর, আম্বেদকরের সাহচার্যে আসেন। তাঁরই পরামর্শে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল বাংলায় ‘Bengal Provincial Scheduled Caste Federation’ গঠন করেন এবং সভাপতি হিসেবে একে বাংলার তফসিলি সম্প্রদায়ের একমাত্র দেশভক্ত সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেন। তাঁর দৃষ্টিতে কংগ্রেস ছিল শুধুমাত্র হিন্দু সম্প্রদায়ের সংগঠন। তিনি নিজেকে ‘হিন্দু’ মনে না করলেও নিজেকে তফসিলি সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে এ শ্রেণির উন্নয়নে তাঁর যথাসাধ্য চেষ্টা করেন।
১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী করে লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করে। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ছিলেন মন্ত্রিসভার একমাত্র তফসিলি সদস্য।
১৯৪৬ সালে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে মুসলিম লীগ তাৎক্ষণিকভাবে যোগ না দিলেও মাস খানেক পরে যোগ দেয়। মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভূক্ত মুসলিম লীগের পাঁচ সদস্যের মধ্যে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল তফসিলি সম্প্রদায়ের হিন্দু একমাত্র সদস্য হিসেবে আইন মন্ত্রীর পদ লাভ করেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন ‘মুসলিম লীগের হিন্দু প্রতিনিধি।’ জিন্নাহ তাঁকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, মুসলিম লীগ কেবলমাত্র মুসলিম জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে না, তারা হিন্দু সম্প্রদায়েরও প্রতিনিধিত্ব করে। ইতোঃমধ্যে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের ডাকা প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস উপলক্ষে সারা ভারতব্যাপী সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার সূত্রপাত হয়। তফসিলি সম্প্রদায় ও মুসলমানদের মধ্যে কোন প্রকার ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি যাতে না হতে পারে তা তত্ত্বাবধানের জন্য যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে বিভিন্ন জেলায় প্রেরণ করা হয়। মন্ডল বিশ্বাস করতেন যে, ভারতবর্ষে মুসলিম ও তফসিলিদেরই অভিন্ন অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল।
১৯৪৭ সালের ২০ জুন মন্ত্রিসভার বিশেষ অধিবেশনে সদস্যগণ বাংলা বিভাগের পক্ষে ভোট প্রদান করেন। কিন্তু যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এরূপ বিভাগের বিপক্ষে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিবাদ সভা করেন। বাংলা বিভাগের প্রয়োজনেই সাংবিধানিক সভার জন্য ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে নতুন নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। ভারতীয় সাংবিধানিক সভার এ নির্বাচনে পশ্চিম বাংলা থেকে মোট ২৫ জন (২১ সাধারণ ও ৪ জন মুসলিম) প্রার্থী নির্বাচিত হন। পূর্ব বাংলা থেকে ৪১ জন (২৯-মুসলিম ও ১২-সাধারণ) প্রার্থী নির্বাচিত হন। মন্ডল ও তাঁর তফসিলি ফেডারেশন জিন্নাহকে তাদের বন্ধু হিসেবে বিবেচিত করতেন বলে এ নির্বাচনে তিনি পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন প্রদান করেন এবং নির্বাচিত হন।
১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর যোগেন্দ্রনাথ পাকিস্তানের প্রথম মন্ত্রিসভার আইন ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্ব লাভ করেন। তিনি মুসলিম লীগের সংসদীয় বোর্ডেরও সদস্য হন। ১৯৪৮ সালে করাচীতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মন্ডল মন্ত্রী হিসেবে তাঁর সম্প্রদায়কে নিরাপদ রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৯৫০ সালে পূর্ব বাংলায় সংঘটিত ধ্বংসাত্মক দাঙ্গার সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও মন্ডল সংখ্যালঘিষ্টদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। এ পর্যায়ে এসে মন্ডল অনুধাবন করতে পারেন যে, তিনি মুসলীম লীগের নেতৃস্থানীয়দের বা সরকারের কাছ থেকে পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে যেরূপ গুরুত্ব পেতেন সেরূপ আর পাচ্ছেন না। তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৫০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর করাচি থেকে পালিয়ে কলকাতায় আসেন এবং ভারত সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন।
যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল একজন সাংবাদিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এবং ১৯৪৩ সাল থেকে জাগরণ নামে একটি খবরের কাগজ প্রকাশ করে আসছিলেন। ১৯৪৭ সালের বিভাগের পর এ পত্রিকার অফিস ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ১৯৬৮ সালের ৫ অক্টোবর কলকাতায় মারা যান। [দিলীপ ব্যানার্জী]