সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবির বাস্তবায়ন এবং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধান ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে গঠিত একটি সংগ্রাম পরিষদ। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান সংগঠন ও সুসংবদ্ধকরণ এবং নেতৃত্ব প্রদানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মূখ্য ভূমিকা পালন করে।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের অবসানের পর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলা ও উদাসীনতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান সোচ্চার হন। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় নেতারা যুদ্ধোত্তর রাজনীতির গতিধারা নিরূপণের উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক জাতীয় সম্মেলন আহবান করেন। উক্ত সম্মেলনে শেখ মুজিব কর্তৃক উত্থাপিত ছয়দফা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি দাবিসমূহ আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। কিন্তু ৭ জুনের গণআন্দোলনের পর আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ও কর্মী কারারুদ্ধ হন। রাষ্ট্রদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে সরকার ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে। ছয় দফাকে কেন্দ্র করে প্রধান বিরোধী দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আন্তঃমতাদর্শগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য বিরোধী দল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (নিষিদ্ধ ছিল), জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান, নেজামে ইসলাম পার্টি, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট এবং পিপলস পার্টির নেতারাও আন্দোলনে তৎপরতা দেখাতে পারেন নি। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে কিছুটা স্থবিরতা পরিলক্ষিত হয়। এমতাবস্থায় ১৯৬৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন [মেনন], পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন [মতিয়া], ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (DUCSU) আট জন ছাত্রনেতা সম্মিলিতভাবে গঠন করেন সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। উল্লেখ্য, জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন এনএসএফ-এ ভাঙ্গন ধরে এবং একাংশ (মাহবুবুল হক দুলন, ইব্রাহিম খলিল, নাজিম কামরান) সংগ্রাম পরিষদে যোগ দেয়। ১৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এগারো দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা শহর। কিন্তু তাদের প্রদত্ত কর্মসূচি অন্যান্য বিভাগীয় শহর এবং জেলা শহরের ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনগণ পালন করে। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররাও এগারো দফার সমর্থনে আন্দোলন করে। তখন বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আন্তঃবিরোধ, মতাদর্শগত বিরোধ এবং দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একটি প্রধান রাজনৈতিক শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়।
১৭ জানুয়ারি সংগ্রাম পরিষদ ‘দাবি-দিবস’ পালন উপলক্ষে প্রথম ছাত্রসভা আহবান করে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে (১৯৬৮ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে বলবৎ) মিছিল বের করে। কিন্তু দায়িত্বরত পুলিশ কাঁদানে গ্যাস, রায়ট গাড়ি থেকে লাল রঙের পানি নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জ করে ছাত্রদের মিছিলটি ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে বাংলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মোশাররফ হোসেনসহ বহু ছাত্র আহত হন। পুলিশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ১৮ জানুয়ারি ঢাকা শহরে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের সময় ছাত্ররা ই.পি.আর বাহিনীর ডবল ডেকার বাসে অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্র গ্রেফতার হন। ছাত্র গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৯ জানুয়ারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ধর্মঘট আহবান করে মিছিল বের করলে পুলিশ আট জন ছাত্রকে আটক করে। সরকারি নির্যাতন বন্ধ, গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তি ও এগারো দফার সমর্থনে সংগ্রাম পরিষদ ২০ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট আহবান করে। এ দিন ধর্মঘটের সমর্থনে ঢাকায় ছাত্ররা মিছিল বের করে। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে এক পুলিশ অফিসারের পিস্তলের গুলিতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) ছাত্রনেতা আসাদ (আসাদুজ্জামান) শহীদ হন। এদিন চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর সকল প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররাও মিছিল বের করে এবং ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ হয়। শহীদ আসাদুজ্জামানের স্মরণে ২১ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঢাকায় সাধারণ হরতাল পালন ও গায়েবানা জানাজার আয়োজন করে। এ দিন সংগ্রাম পরিষদ তিনদিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করে: ২২ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী মিছিল ও প্রতিবাদ সভা, ২৩ জানুয়ারি মশাল মিছিল এবং ২৪ জানুয়ারি হরতাল।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে ২৪ জানুয়ারির হরতাল পালনের সময় ময়মনসিংহে ২ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়। নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষ এবং টাঙ্গাইলে ৯ জন আহত হয়। ঢাকায় নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিয়ূর রহমান ও জনৈক রুস্তম আলী নিহত হন। সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে বিকালে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি প্রদান করে। বিবৃতিতে নিম্নোক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের আহবান জানানো হয় (সংক্ষিপ্ত):
১. প্রদেশের সকল জেলা, মহকুমা, থানা, গ্রাম, মহল্লাসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং প্রত্যেক শ্রমিক অঞ্চলে সর্বদলীয় ছাত্র সমাজের উদ্যোগে সংগ্রাম কমিটি গঠন। উপরোক্ত কমিটি দ্বারা শৃঙ্খলা সহকারে ও সুসংগঠিতভাবে আন্দোলন পরিচালনা এবং সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে স্থানীয় কমিটিগুলোর যোগাযোগ স্থাপন।
২. আন্দোলনের কর্মপন্থা ঘোষণার জন্য এ সকল কমিটির উদ্যোগে প্রচারপত্র ছাপানো, প্রচারপত্র বিলি ও মাইক প্রভৃতির সাহায্যে ব্যাপক গণসংযোগ গড়ে তোলা।
৩. সকল প্রকার জনমতকে সুসংগঠিত করা।
৪. গ্রামাঞ্চলে আন্দোলনের বাণী ছড়িয়ে দেয়া।
৫. দেশের আনাচে কানাচে সুশৃঙ্খল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন।
৬. আন্দোলনকে সফল করে তোলার জন্য ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকসহ সকল শ্রেণির নাগরিককে সম্পৃক্ত করা।
৭. সকল সময় শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সকল প্রকার সরকারি উস্কানির প্রতি সতর্ক থাকা।
৮. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা।
৯. সব সময় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশাবলি বিনা প্রশ্নে মেনে চলা।
সংগ্রাম পরিষদের এগারো দফা ছিল সকল শ্রেণি পেশার অধিকার ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। তাই জাতীয় রাজনীতির সাথে ছাত্র আন্দোলন সম্পৃক্ত হয়ে যায়। ২৫ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন গণবিক্ষোভে রূপ নেয়। ২৭ জানুয়ারি সংগ্রাম পরিষদ নারায়ণগঞ্জ ও আদমজীর শ্রমিকদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করে এবং শ্রমিকদের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সচেতন থাকার পরামর্শ দেয়। এভাবে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ একের পর এক সংগ্রামের নির্দেশিকা প্রদান করে। তখন এমন একটি অবস্থার উদ্ভব ঘটে যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। ছাত্রসমাজ ছাড়া জনসাধারণের সংগ্রামের পাশে দাঁড়ানো ও নেতৃত্ব প্রদানের মতো কোনো রাজনৈতিক শক্তি তখন ছিল না। ২৯ জানুয়ারি আইয়ুব সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকের ঘোষণা দিলে পরবর্তী দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এগারো দফা কর্মসূচির বাস্তবায়ন ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিঃশর্ত মুক্তি ব্যতিরেকে কোন প্রকার আপস-মীমাংসার সুযোগ নেই। ১৯৬৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘শপথ দিবস’ পালন করে। এদিন ছাত্রনেতারা পল্টনের জনসভায় কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যেমন:
শোক প্রস্তাব শহীদ আসাদ, মতিয়ুর, মিলন, আলমগীর, রুস্তম আলীসহ যাঁরা এগারো দফা সংগ্রামে আত্মাহূতি দিয়েছেন তাঁদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করা হচ্ছে; উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সালে সারা বাংলায় ৬১ জন নিহত হন যাঁদের মধ্যে ২১ জন ছাত্র।
শপথ প্রস্তাব স্বৈরাচারী ব্যবস্থার অবসান, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও এগারো দফা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে নেয়ার শপথ গ্রহণ করা হচ্ছে;
রাজনৈতিক প্রস্তাব: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং জরুরি আইন, দেশরক্ষা আইন, নিরাপত্তা আইন প্রভৃতি কালাকানুনে আটক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মুক্তিদান করতে হবে; সকল কালাকানুন বাতিল করতে হবে, ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারসমূহকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং এ সকল দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বিরোধী দলের নেতাদের গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত হতে দেয়া হবে না।
অন্যান্য প্রস্তাব ২১ ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি ঘোষণা ও কালো পতাকা উত্তোলন। সভায় আইয়ুব নগরের নাম শেরে বাংলা নগর, আইয়ুব গেট শহীদ আসাদুজ্জামান গেট এবং আইয়ুব চিলড্রেন্স পার্কের নাম শহীদ মতিয়ুর রহমান পার্ক রাখার প্রস্তাব করা হয়।
১২ ফেব্রুয়ারি জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ঢাকা ত্যাগ করেন এবং ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারে অসম্মতি জানান। ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারাধীন আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার ও প্রক্টর ড. মুহম্মদ শামসুজ্জোহাকে হত্যা সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তোলে। ১৯ ফেব্রুয়ারি সরকার সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি প্রদান করা হয়। পরদিন সংগ্রাম পরিষদ রেসকোর্স ময়দানে এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানকে ’বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। ২৫ মার্চ (১৯৬৯) জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে ছাত্রদের নানা সুযোগ সুবিধা প্রদান, ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে সামরিক কর্মকর্তাদের বৈঠক এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্তি ও ভাঙ্গন ছাত্র আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেয়।
আইয়ুব সরকারের শেষের দিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে ভাঙ্গন পরিলক্ষিত হয়। ১৯৬৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) একটি উপদল কর্তৃক ‘সংগ্রামী ছাত্র সমাজ’ শিরোনামে একটি প্রচারপত্র বিলিকে কেন্দ্র করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে বিরোধের সৃষ্টি হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি জননেতাদের সংবর্ধনা দেয়ার প্রস্তাব নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ও ছাত্রলীগের (তোফায়েল) মধ্যে মত পার্থক্য দেখা দেয়। অবশেষে ওই দিন রেসকোর্স ও পল্টনে দু’টি পৃথক সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর ইয়াহিয়া খানের সামরিক প্রশাসন কিছুটা নমনীয় হতে থাকলে ছাত্র সংগঠনগুলি নিজ নিজ দল গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে দ্বিতীয় দফা বিরোধ দেখা দেয় জাতীয় পরিষদ সদস্য ও অন্যান্য স্থানীয় সংস্থার সদস্যদের পদত্যাগের সময়সীমা নিয়ে। ইতিপূর্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১ মার্চের মধ্যে তাদের পদত্যাগ করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু ছাত্রলীগ পূর্ব নির্ধারিত সময়কে ৩ মে পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করলে ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ৭ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে আইয়ুব সরকারের ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীদের পদত্যাগের মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে আরেক দফা বিরোধ দেখা দিলে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) সংগ্রাম পরিষদ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অতঃপর ছাত্র সংগঠনগুলো পৃথক কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যায়। ১৯৭০ সালের ১২ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন (উভয় গ্রুপ) ও এন.এস.এফ-কে বাদ দিয়ে ছাত্রলীগ ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করলে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটে। কিন্তু ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত এগারো দফা ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ছিল। [গাজী মোঃ মিজানুর রহমান]
আরও দেখুন এগারো দফা।
গ্রন্থপঞ্জি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খন্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮২; লেনিন আজাদ, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান: রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতি, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ১৯৯৭; প্রফেসর সালাহ্ উদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য (সম্পা.), বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস (১৯৪৭-১৯৭১), আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৭; ড. মোহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (১৮৩০-১৯৭১), আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯; অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি (১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫), খোশরোজ কিতাব মহল, ঢাকা, ২০০২।