ভাইরাসজনিত রোগ
ভাইরাসজনিত রোগ (Viral diseases) ভাইরাস রোগ। মানুষের প্রায় এক ডজন গুরুত্বপূর্ণ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস। সচরাচর সংক্রামিত এসব রোগের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডেঙ্গুজ্বর ইয়োলো (yellow fever), পোলিওমাইলিটিস (poliomyelitis), জন্ডিস (hepatitis), রেবিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, মাম্পস, হাম (measles), বসন্ত, হার্পিস (herpes), রোটাভাইরাস ডায়রিয়া, ফিভার এবং কয়েক ধরনের এনসেফালাইটিস। কতক ক্যানসারও ভাইরাসজনিত বলে মনে করা হয়।
পক্সভাইরাস দলের Variola নামের ভাইরাসটি মানুষের গুটিবসন্তের জন্য দায়ী, যা দীর্ঘদিন ছিল অসহনীয় দুর্ভোগ ও যন্ত্রণাময় এক রোগ। এ দলের কম ক্ষতিকর কতিপয় ভাইরাস মানুষের আরো কয়েকটি রোগের কারণ হলেও সেসব অতটা তীব্র নয়। এসব ভাইরাস থেকেই গুটি বসন্তের টীকা উদ্ভাবিত হয়েছিল।
১৯৬৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) সর্ব প্রথম সারা বিশ্বে গুটি বসন্ত নির্মূলের প্রচারণা চালায় এবং সফলভাবে এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত করে। ফলে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই পৃথিবী থেকে গুটি বসন্ত তিরোহিত হয়। বাংলাদেশে সর্বশেষ গুটি বসন্তের ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে ১৯৭৫ সালে। সোমালিয়ায় গুটি বসন্তে আক্রান্ত শেষ রোগী মারা যায় ১৯৭৭ সালে। Institute of Public Health (IPH) বাংলাদেশে সফলভাবে বসন্ত নির্মূল কার্যক্রমে এবং টীকা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশে সচরাচর দৃষ্ট ভাইরাসজনিত রোগসমূহের মধ্যে রয়েছে জন্ডিস, পোলিওমাইলিটিস, হাম, মাম্পস এবং জল বসন্ত (Chickenpox)। জল বসন্ত সংক্রমণের জন্য দায়ী ভাইরাসের সঙ্গে গুটি বসন্তের ভাইরাসের সম্পর্ক নেই। উপরে উল্লিখিত রোগগুলি তাদের বৈশিষ্ট্যময় উপসর্গের মাধ্যমে এবং কতক ল্যাবরেটরি-পরীক্ষার সহায়তায় চিকিৎসকরা শনাক্ত করতে পারেন। ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলিতে রোগ নির্ণয়ের জন্য এখন সুযোগ-সুবিধা গড়ে উঠেছে। মারাত্মক হেপাটাইটিস বি-ভাইরাস শনাক্তির জন্যও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা পদ্ধতি এখন দেশেই লভ্য। তবে এনসেফালাইটিসসহ কয়েকটি ভাইরাসজনিত রোগ নির্ণয় এখনও ততটা সহজলভ্য হয় নি।
দেশে বিভিন্ন ভাইরাসজনিত রোগের তুলনামূলক তথ্য ও প্রাদুর্ভাবের হার জাতীয় পর্যায়ে তেমন লিপিবদ্ধ নেই। এ ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনশক্তি ও অর্থের অভাব প্রধান অন্তরায়। সম্প্রতি হেপাটাইটিস রোগের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি বড় বড় শহরের রোগনির্ণয় কেন্দ্রগুলি লিপিবদ্ধ করছে। এখন পর্যন্ত হেপাটাইটিস রোগের সাতটি ভাইরাস শনাক্ত করা গেছে; এগুলি হেপাটাইটিস এ ভাইরাস (HAV), হেপাটাইটিস বি ভাইরাস (HBV) এবং সমভাবে HCV, HDV, HEV, HFV ও HGV নামে পরিচিত। এ ভাইরাসগুলির মধ্যে A এবং E পৌষ্টিক নালি পথে, অপরদিকে B, C, D এবং G ইনজেকশন, রক্তভরণ (blood transfusion) অথবা দেহের কোন ক্ষত স্থানের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৮৩ ভাগ লোক হেপাটাইটিস এ-ভাইরাসের এন্টিবডিজ (antibodies) বহন করে। এতে বোঝা যায় জীবনের কোন এক পর্যায়ে তারা সম্ভবত এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। শতকরা প্রায় ৭.৫ ভাগ মানুষে হেপাটাইটিস বি-ভাইরাসের উপস্থিতির কথা জানা গেছে, অর্থাৎ দেশের প্রায় ১ কোটি মানুষের শরীরে বি-ভাইরাস রয়েছে। বাংলাদেশে অন্যান্য হেপাটাইটিস ভাইরাসগুলির উপস্থিতির সম্ভাব্য পরিমাণের কোন হিসাব পাওয়া যায় না।
রোটাভাইরাস ডায়রিয়া বাংলাদেশের এক সাধারণ রোগ। জীবনের শুরুতে প্রথম কয়েক মাসের মধ্যেই প্রায় প্রতিটি শিশুই এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগ বিশেষ কৌতূহলপূর্ণ এ কারণে যে, ব্যাকটেরিয়া অথবা পরজীবীঘটিত অন্যান্য উদরাময় রোগের মতো অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বা অপরিষ্কার খাবার পানি এর জন্য দায়ী নয়। এ রোগের ব্যাপ্তী সারা বিশ্বে এবং অর্থনৈতিক অবস্থা বা স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির মতো শিল্পোন্নত দেশেও এর প্রাদুর্ভাব রয়েছে।
এ রোগের প্রতিরোধের জন্য মুখে খাবার উপযোগী টীকা উদ্ভাবনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (ICDDR,B) বিগত দু’শতক হলো রোটাভাইরাস ডায়রিয়ার উপর গবেষণা অব্যাহত রেখেছে। [জিয়া উদ্দিন আহমেদ]
আরও দেখুন হেপাটাইটিস; হাম; মাম্পস; বসন্ত।