কাপ্তাই লেক
কাপ্তাই লেক (Kaptai Lake) বাংলাদেশে, এমন কি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম মনুষ্যসৃষ্ট স্বাদুপানির হ্রদ। প্রধানত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এর সৃষ্টি হলেও, এ জলাধারে প্রচুর পরিমাণে মিঠাপানির মাছ চাষ হয়। নৌবিহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি আবাদ ইত্যাদিতেও এর অবদান উল্লেখযোগ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে (২২°০৯´ উত্তর অক্ষাংশ ও ৯২°১৭´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) কর্ণফুলি নদীতে বাঁধ দেওয়ার কারণে জলাধারটি গড়ে ওঠে। মূল লেকের আয়তন প্রায় ১,৭২২ বর্গ কিমি, তবে আশপাশের আরও প্রায় ৭৭৭ বর্গ কিমি এলাকাও প্লাবিত হয়েছে। মূলত রাঙ্গামাটি জেলাতেই জলাধারটি সীমিত যার অন্তর্ভুক্ত উপজেলাসমূহ হচ্ছে রাঙ্গামাটি সদর, কাপ্তাই, নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি।
ইংরেজি এইচ বর্ণের আকৃতি বিশিষ্ট কাপ্তাই লেকের দুটি বাহু সুভলং-এর কাছে একটি সংকীর্ণ গিরিসঙ্কট দ্বারা সংযুক্ত যা কর্ণফুলি নদীর গতিপথের একটি অংশ। হ্রদের ডান বাহু অর্থাৎ কাসালং দক্ষিণ দিকে দুটি অন্তঃপ্রবাহী নদী মাইনি ও কাসালং দ্বারা এবং পাশ দিয়ে কর্ণফুলি নদী দ্বারা পুষ্ট। রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই, অর্থাৎ বাম বাহুটি দুটি নদী, উত্তরে চেঙ্গী (বা চিংগ্রী) ও দক্ষিণে রাইনখিয়াং দ্বারা পুষ্ট। কর্ণফুলি নদী তিনটি প্রধান শাখার জন্ম দিয়েছে- একটি রাঙ্গামাটিতে, একটি ধুলিয়াছড়িতে ও অপরটি কাপ্তাইয়ে। রাঙ্গামাটি ও ধুলিয়াছড়ি শাখাদ্বয় বর্তমানে কাপ্তাই বাঁধ দ্বারা সৃষ্ট জলাধারের অধীনে। কাপ্তাই হ্রদ মধ্য কর্ণফুলি উপত্যকার প্রায় সমগ্র অংশ এবং চেঙ্গী, কাসালং ও রাইনখিয়াং নদীর নিম্ন মোহনাসমূহকে নিমজ্জিত করেছে। কাপ্তাই হ্রদের তটরেখা ও অববাহিকা খুবই অনিয়মিত। এর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংস্থানিক (morphometric) ও জলবিজ্ঞানসংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যাদি নিম্নরূপ: পৃষ্ঠদেশের উচ্চতা ৩১.১ মিটার, তলদেশের আয়তন ৫৮,৩০০ হেক্টর, ঘনমান (volume) ৫,২৪,৭০০ ঘন মিটার, মোট বার্ষিক ক্ষরণ ১৭,০৭,০০০ ঘন মিটার, সঞ্চয় অনুপাত ০.৩১, গড় গভীরতা ৯ মিটার, সর্বোচ্চ গভীরতা ৩২ মি, নির্গমদ্বারের গভীরতা ১৫.৫মি, পানি সীমার বাৎসরিক গড় হ্রাসবৃদ্ধি ৮.১৪ মি, বর্ধিষ্ণু মৌসুম ৭৬ দিন এবং ২৫° সে তাপমাত্রায় আপেক্ষিক পরিবাহিতা ১৪৪ মাইক্রো-মোহ্স (µmhos)।
ভূতাত্ত্বিকভাবে কাপ্তাই-রাঙ্গামাটি অঞ্চলের কাপ্তাই হ্রদের নিম্নাঞ্চল (অর্থাৎ কাপ্তাই নিম্নভঙ্গ) প্রতিবর্তী কর্দমশিলা ও পলিশিলার সঙ্গে প্রধানত হলুদাভ-বাদামি, সূক্ষ্ম থেকে মাঝারি দানাদার, ঘন থেকে তির্যক স্তরিত বেলেপাথরে গঠিত (টিপাম বেলেপাথর স্তরসমষ্টি) এবং ঊর্ধ্বাঞ্চল হলুদাভ-বাদামি, সূক্ষ্ম থেকে মাঝারি দানাদার, উপকৌনিক থেকে উপগলিত, মাঝারি থেকে কম বাছাই, ভারি থেকে ঘন স্তরিত এবং সুরক্ষিত পত্রছাপসমৃদ্ধ মাঝে মাঝে তির্যক স্তরিত বেলেপাথর এবং তার সঙ্গে স্ফটিক দানা, নুড়ি ও কাদা পাথর দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত (ডুপি টিলা স্তরসমষ্টি)।
সুভলং ও বরকলের আশপাশে অবশ্য হ্রদটি প্রধানত ভুবন স্তরসমষ্টি দ্বারা গঠিত। স্থানীয় লোকজন হ্রদটিকে ঘিরে রাখা প্রতিরক্ষামূলক গাছপালা উজাড় করে ফেলায় এ সব শিলাপাথর বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে সহজেই ক্ষয়িত হচ্ছে। এতে ভূমিধস সংঘটিত হচ্ছে এবং আলগা শিলা পদার্থসমূহ ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নদীবাহিত হয়ে হ্রদে গিয়ে পড়ছে। ফলে হ্রদটি দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নববইয়ের দশকের প্রথম দিকে যখন হ্রদটির বয়স ৩০ বছর, তখনই এর প্রায় ২৫% ভরাট হয়ে এসেছিল।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও হ্রদটি অন্যান্য দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। লেকটির মাধ্যমে একটি বৈচিত্রপূর্ণ ও দীর্ঘ জলপথের সৃষ্টি হয়েছে। আগে যেখানে অনেক জায়গায় যেতে সারাদিন বা তারও বেশি লেগে যেত, এখন সেখানে স্পিড বোট বা লঞ্চে যেতে লাগছে মাত্র কয়েক ঘন্টা সময়। পাহাড়ব্যাপী জঙ্গলে বনজ সম্পদ অনুসন্ধানে এখন অনেক দূর্গম অঞ্চলেও সহজে ঢোকা সম্ভব হচ্ছে। সমগ্র হ্রদটি পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। কৃষি ও মৎস্যসম্পদ উন্নয়নেও হ্রদটির অবদান উল্লেখযোগ্য। বছরের বিভিন্ন মাসে হ্রদে পানির উচ্চতা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায়, হ্রদতীরবর্তী এলাকা এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় সেচ সুবিধা লাভ করছে যা চাষের জন্য জমিকে খুব উর্বর করে তুলছে। এখানকার জনগণ স্থানীয় সরকার-এর সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে ইজারা ব্যবস্থায় প্রায় ৬,০৭৫ হেক্টর এলাকায় নিয়ন্ত্রিত কৃষিকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। হ্রদটির আনুমানিক আয়ুষ্কাল ৯০ বছর যার পর এর তলদেশ পলিপাথরের আস্তরণে সম্পূর্ণ মজে যাওয়ার কথা। সে পর্যন্ত হ্রদটি হ্যাচারী ও মৎস্য উৎপাদনের মূল্যবান আধার হিসেবে চালু থাকবে। জলাধারের উৎপাদিত মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও দেশের অন্যান্য এলাকায় চালান করা হয়। বার্ষিক মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ ৭,০০০ টনের বেশি। তবে বর্ষাকালে ঘন ঘোলাস্রোতের কারণে প্ল্যাঙ্কটন উৎপাদন ব্যাহত হয়। তবে পানির স্রোতের সঙ্গে বয়ে আসে অতি উচ্চমানের পুষ্টি সরবরাহ। তাই পানি পরিষ্কার হয়ে এলে প্ল্যাঙ্কটনের উৎপাদন আবার বৃদ্ধি পায়। নীলসবুজ ও সবুজ শৈবাল ও ডায়াটম এ জলাধারের উদ্ভিদকণার প্রধান উপাদান যা রুই-কাতল মাছের প্রধান খাদ্য। এখানকার জুপ্লাঙ্কটন (zooplankton) রোটিফার (rotifers) দ্বারা প্রভাবিত। অন্যান্য জুপ্লাঙ্কটনের উপাদান খুবই কম যা অধিকাংশ গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলাধারের বৈশিষ্ট্য। বেন্থিক প্রাণীকুলের (Benthic fauna) মধ্যে রয়েছে প্রধাণত রক্ত-কৃমি বা জোঁক (leesh), শামুকজাতীয় প্রাণী, এনিলিডস ও কেওবারিডস।
বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, ফ্রেশ ওয়াটার রিসার্চ সাব-স্টেশন এবং অ্যাকুয়াটিক রিসার্চ গ্রুপ-এর ব্যাপক মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণের রেকর্ড থেকে দেখা গেছে ১৯৮৫ সালে হ্রদে মাছের প্রধান প্রজাতি রুই এর উৎপাদন দারুণভাবে কমে যায়, যা ছিল কাপ্তাই লেকের মৎস্য উৎপাদন ইতিহাসে সবচেয়ে কম। অত্যধিক পরিমাণ রুই মাছ তুলে নেওয়ার কারণেই এটা ঘটেছিল। হেক্টর প্রতি লেকের মাছের উৎপাদন বর্তমানে ১০০ কিলোগ্রামের বেশি। রুইমাছের উৎপাদনের অনুপাত ধীরে ধীরে কমে আসায় সামুদ্রিক ক্লুপিডের (Pelagic Clupeids) প্রজনন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে যে দুটি প্রজাতি সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ছে সেগুলি হচ্ছে চাপিলা (Gudnsia chapra) ও কাচকি (Corica soborna)। বর্তমানের মোট ধৃত মাছে এ দুই প্রজাতির অনুপাত ৫০%। প্রাপ্ত মাছের তালিকায় আট প্রজাতির মাছের বাণিজ্যিক গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এগুলি হচ্ছে কাতলা (Catla catla), মৃগেল (Cirrhinus mrigala), রুই (Lebeo rohita), কালিবাউস (L. calbasu), ঘনিয়া (L goinus), চিতল (Notopterus chitala), বোয়াল (Wallago attu) এবং চাপিলা (Gudusia chapra)। কাপ্তাই লেকে রয়েছে মৎস্য চাষের সম্ভাবনা। মৎস্য বিধির বাস্তবায়ন ও উন্নত ব্যবস্থাপনার প্রবর্তন লেকটিকে আরও লাভজনক ও দীর্ঘস্থায়ী করে তুলতে পারে।
সাম্প্রতিক কালে কাপ্তাই লেকের চারপাশে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে পানি দূষিত হওয়ায় জলজপ্রাণীর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে। ১৯৬৬ সালে যেখানে মোট মাছ উৎপাদনের মধ্যে বড় মাছের অংশ ছিল ৭৮%, ১৯৯৩ সালে তা মাত্র ২ শতাংশে নেমে এসেছে। এ ছাড়াও প্রতিদিন লেকটিতে ৫ টনেরও বেশি মনুষ্য বিষ্ঠা ও অন্যান্য বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। লেকের চারপাশের ৮৫ শতাংশ মানুষই পানীয় জল, রান্না, ধোয়া-মোছা, গোসল ইত্যাদির জন্যে এ লেকের পানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ রাঙ্গামাটি শহরে যে পানীয় জল সরবরাহ করছে তাতেও জীবাণুর অনুপাত গ্রহণযোগ্য মাত্রার ১০ গুণেরও বেশি। বদ্ধ ও ধীর গতিসম্পন্ন বিশাল জলাধার মশা ও অন্যান্য পোকামাকড় বংশবিস্তারে খুবই সহায়ক হওয়ায় ম্যালেরিয়া রোগের ঝুঁকিও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। লেকের কারণে আরও কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, নৌপরিবহণের কারণে অনেকের পক্ষেই অবৈধভাবে বনজসম্পদ উজাড় করা সম্ভব হচ্ছে বিশেষ করে এমন সব প্রত্যন্ত অগম্য অঞ্চল থেকে, যেখানে লেক সৃষ্টি হওয়ার আগে যোগাযোগ খুবই অসুবিধাজনক ছিল। এর দরুণ ১২৭ বর্গ কিমি ব্যাপী সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং ৬০৬ বর্গ কিমি খাসজমি ও পাহাড়ি বন-জঙ্গল উজাড় হতে চলেছে। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী এবং নূরউদ্দিন মাহমুদ]