আদিবুদ্ধ
আদিবুদ্ধ বৌদ্ধদেবতা। বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে না বলে একে সাধারণত নাস্তিক্যবাদী বা জড়বাদী ধর্ম বলা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে মহাযান মতবাদে সৃষ্টিকর্তারূপে আদিবুদ্ধের সংযোজন বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনকে আস্তিকতার পর্যায়ভুক্ত করে। এ মতবাদ অনুসারে আদিবুদ্ধই সৃষ্টির আদি কারণস্বরূপ শূন্য বা বজ্র।
আদিবুদ্ধকে মনে করা হয় সর্বব্যাপী, সর্বকারণ, সর্বশক্তির আধার ও সর্বজ্ঞ। সৃষ্টির সব বস্ত্তই শূন্যরূপ, নিঃস্বভাব ও বুদবুদসদৃশ; কেবল শূন্যই নিত্য। এ শূন্যের রূপকল্পনাকে ভিত্তি করেই উদ্ভূত হয়েছে আদিবুদ্ধের ধারণা বা মতবাদ। বৌদ্ধধর্মে আদিবুদ্ধ শীর্ষক এ আস্তিক্যবাদী ধারণার উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে মতভেদ আছে। কারও কারও মতে, এর উৎপত্তি হয়েছে বাংলায় এবং এখান থেকেই বহির্ভারতে এর বিস্তার ঘটেছে। নেপাল ও তিববতে আদিবুদ্ধের প্রচলন সর্বাধিক এবং আনুমানিক দশ শতকে তন্ত্রসাধনার প্রাণকেন্দ্র নালন্দা মহাবিহারে এ মতবাদ গৃহীত হয়।
বহুধাবিভক্ত মহাযান শাখার অন্তর্গত বজ্রযানের একটি অংশ কালচক্রযানই প্রথম এ মতবাদ গ্রহণ ও অনুশীলন করে। শুধু তাই নয়, এ মতবাদকে ভিত্তি করেই কালচক্রতন্ত্রের সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে মন্ত্র ও কালচক্রযান মিলে বজ্রযানের উদ্ভব ঘটে এবং এর অনুগামীরা বজ্রাচার্য নামে পরিচিত হয়। উল্লেখ্য যে, আধুনিক নেপালের রাজধানী কাঠমন্ডুর সন্নিকটে স্বয়ম্ভূ পাহাড়ে অবস্থিত প্রধান মন্দিরটি আদিবুদ্ধের নামে উৎসর্গীকৃত। স্বয়ম্ভূপুরাণে উদ্ধৃত একটি উপকথায় নেপালে অগ্নিশিখার আকারে আদিবুদ্ধের প্রথম অভিব্যক্তির বিবরণ সন্নিবেশিত আছে। সেখানে আদিবুদ্ধকে আদিনাথ (ঈশ্বর, স্রষ্টা, প্রথম রক্ষক) এবং স্বয়ম্ভূ লোকনাথ (স্বয়ংজাত হয়ে যিনি পৃথিবীকে রক্ষা করেন) অথবা স্বয়ম্ভূ (স্বয়ংজাত প্রভু) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কল্পারম্ভের শুরু থেকেই তাঁর যাত্রারম্ভ এবং তিনিই শূন্যবাদের প্রবর্তক।
করন্ডব্যূহের পৌরাণিক উপাখ্যান থেকে জানা যায় যে, আদিবুদ্ধ সর্বপ্রথম অবলোকিতেশ্বরকে সৃষ্টি করেন; তারপর তাঁর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে চন্দ্র, সূর্য, মহেশ্বর, ব্রহ্মা, নারায়ণ, সরস্বতী, বায়ু, পৃথিবী ও বরুণকে সৃষ্টি করেন। আদিবুদ্ধকে চীনা ভাষায় বলা হয় ‘পেন-চু-ফো’ বা ‘সেঙ-চু-ফো’; এর অর্থ ‘সর্বপ্রথম বুদ্ধ’ বা ‘পরমাদি বুদ্ধ’। তিববতি ভাষায় বলা হয় ‘ডন পোহি-সংস-রগ্যস’ বা ‘মচোগ-গি-ডন পোহি সংস-রগ্যস’ অথবা ‘থোগমহি-সংস-রগ্যস’। এ শব্দগুলির অর্থ যথাক্রমে ‘তিনি সকল বুদ্ধের বুদ্ধ’, ‘তিনিই স্বয়ংজাত প্রথম বুদ্ধ’ এবং ‘মৌলিক সত্তা নিয়ে তিনিই প্রথম আবির্ভূত বুদ্ধ’।
বজ্রযানমতে আদিবুদ্ধ বজ্রধর সর্বব্যাপী ও সর্বোত্তম দেবতা। তিনিই সর্বপ্রথম একেশ্বরবাদী দেবতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি শূন্যের মূর্ত প্রতীক এবং পঞ্চধ্যানী বুদ্ধগণ তাঁর ইচ্ছাশক্তিতেই আবির্ভূত হন। তিনি পাঁচ প্রকার গুণের অধিকারী। এ পঞ্চগুণ থেকেই পাঁচ প্রকার ধ্যানের উৎপত্তি এবং সে ধ্যান থেকে ঐশ্বরিকভাবে পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধ আবির্ভূত হন। কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন, বজ্রসত্ত্ব নামক এক ধ্যানীবুদ্ধ আদিবুদ্ধ থেকে উৎপন্ন হয়েছেন। আদিবুদ্ধ যখন মানবীয় আকারে প্রতিনিধিত্ব করেন তখনই তাঁকে বলা হয় বজ্রধর। এ যাবৎ আদিবুদ্ধ বজ্রধরের যেসব একক মূর্তি পাওয়া গেছে তার সবগুলিই উপবিষ্ট অবস্থায়; পা দুটি আড়াআড়িভাবে রেখে পদ্মাসনে ধ্যানমগ্নাবস্থায় অথবা বজ্রপর্যঙ্ক আসনে। বোধিসত্ত্ব মুকুট, পরিধেয় বস্ত্র এবং মণিরত্নালঙ্কারে অলঙ্কৃত তাঁকে দেখতে একজন ভারতীয় রাজপুত্রের মতো মনে হয়। তাঁর ঊর্ণা ও উষ্ণীষ বর্তমান, হাতদুটি বজ্রহুঙ্কার মুদ্রায় আড়াআড়িভাবে বুকের মধ্যে ন্যস্ত; তাঁর ডানহাতে বজ্র ও বামহাতে ঘণ্টা।
বজ্রধরকে যুগলরূপেও কল্পনা করা হয়, যখন তিনি শক্তির সঙ্গে যুগলবদ্ধ থাকেন। বজ্রধরের এ শক্তির নাম প্রজ্ঞাপারমিতা। বজ্রধরের এ একক ও যুগলবদ্ধ মূর্তির বিশ্লেষণ বিভিন্নভাবে করা হয়েছে। যেমন একটি (একক) শূন্যমূর্তি অন্যটি (যুগলবদ্ধ) বোধিচিত্ত, একটি শূন্যতা অপরটি করুণা, একটি পরমাত্মা অপরটি জীবাত্মা ইত্যাদি। যতক্ষণ মূর্তিদুটি একসঙ্গে দেখা যায় ততক্ষণ এর দ্বয়ভাব বর্তমান থাকে। এ দ্বয়ভাব যখন অদ্বয়ে পরিণত হয় তখন দুটি মিলে একক মূর্তিতে পরিণত হয়। [ভিক্ষু সুনীথানন্দ]