রায়, দাশরথি
রায়, দাশরথি (১৮০৬-১৮৫৭) স্বভাবকবি ও পাঁচালিকার। ‘দাশু রায়’ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার বাঁধমুড়া গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। গ্রামের পাঠশালায় বাল্যশিক্ষা এবং পরে মাতুলের প্রচেষ্টায় বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিখে দাশরথি স্থানীয় নীলকুঠিতে কিছুকাল কেরানির চাকরি করেন। স্বভাবকবির গুণে তিনি একদিন আত্মীয়বর্গের আপত্তি সত্ত্বেও আকা বাঈর (অক্ষয় কাটানী) কবিয়াল দলে যোগ দেন এবং বিখ্যাত কবিয়াল নিধিরাম শুঁড়ির সঙ্গে কবির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। এরূপ প্রতিযোগিতায় ব্যক্তিগত আক্রমণে অপমানিত ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি কবিগান ছেড়ে দেন এবং ১৮৩৬ সালে আখড়া গঠন করে ছড়া ও পাঁচালি রচনায় মনোনিবেশ করেন।
অল্পদিনের মধ্যেই দাশরথি খ্যাতনামা পাঁচালিকার হিসেবে নবদ্বীপের পন্ডিতসমাজে উচ্চ প্রশংসিত হন। তিনি নিছক পৌরাণিক কাহিনী আশ্রিত ধর্ম ও ভক্তিরসের পাঁচালিকাব্য রচনা করেননি, বরং অনুপ্রাসাদি অলঙ্কারযোগে ছড়ার চটুল ছন্দের ঝংকার, সঙ্গীতের সুরেলা মাধুর্য এবং রঙ্গ-ব্যঙ্গরস যুক্ত করে পাঁচালিকে বিভিন্ন শ্রেণির শ্রোতাদের উপভোগ্য করে তোলেন, যা ‘দাশুরায়ের পাঁচালি’ নামে খ্যাত। ধর্ম, সমাজ, নীতিশিক্ষা, রঙ্গ-কৌতুক, শ্লীল-অশ্লীল ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তিনি গান রচনা করে নিজেই পরিবেশন করতেন। তাঁর গানগুলি রাগসুরে রচিত এবং তাতে টপ্পা অঙ্গের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বর্ধমানের মহারাজা এবং কলকাতার শোভাবাজারের রাধাকান্ত দেব তাঁর গান শুনে তাঁকে পুরস্কৃত করেন। তিনি বিভিন্নবিষয়ক ৬৪টি পালাভুক্ত প্রায় ৬৭৫টি গান রচনা করেন। সেগুলি সংকলিত ও সম্পাদিত হয়ে ১৯৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। হরিমোহন মুখোপাধ্যায় ৬৪টি পালার এক বৃহৎ সংস্করণ প্রকাশ করেন।
দাশরথি পাঁচালি গীতির যে ধারার প্রবক্তা সেই ধারায় পূর্ববর্তীদের মধ্যে গঙ্গানারায়ণ নস্করের নাম উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীদের মধ্যে ঠাকুরদাস দত্ত, রসিক রায়, ব্রজমোহন রায় প্রমুখ বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। ১২৬৪ বঙ্গাব্দের (১৮৫৭) ২ কার্তিক দাশরথি রায়ের মৃত্যু হয়। [ওয়াকিল আহমদ]