মা হুয়ান
মা হুয়ান চৈনিক পরিব্রাজক। জেং হি (চেং হো)-র ভারত মহাসাগরে (চীনাদের কাছে পশ্চিম সাগর নামে পরিচিত) অভিযাত্রায় সফরসঙ্গী চার প্রধান কর্মকর্তার মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জেং হি ভারত মহাসাগরে মোট সাতবার অভিযাত্রায় বের হন। তাঁর দুজন সহযাত্রী তাঁদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখে গেছেন। ইংরেজিতে অনুদিত বৃত্তান্ত দুটি হল, ফেই জিন (ফেই সিন)-এর The Overall Survey of the Star Raft (১৪৩৬ খ্রি) এবং গং জেন (কুং চেন)-এর Records of Foreign Countries in the Western Ocean (১৪৩৪ খ্রি)। শেষোক্ত গ্রন্থটি মা হুয়ানের বিবরণের প্রায় অনুরূপ। চতুর্থ সহকারী গুয়ো চংলী মা হুয়ানের সাথে একত্রে The Overall Survey of the Ocean's Shores কিংবা The Captivating Views of the Ocean's Shores (১৪৩৩ খ্রি) শিরোনামে তাঁদের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখে যান।
মা হুয়ান-এর সৌজন্য পদবি ছিল জংদাউ। তিনি উপকূলীয় প্রদেশ জেজিয়াং-এর শাওজিং জেলার গুইজি নগরের অধিবাসী ছিলেন। মা এবং গুয়ো দুজনই ছিলেন মুসলমান। মা শব্দটি চীনের একটি প্রচলিত পদবি; এটি মুহম্মদ (সঃ)-এর পরিবর্তেও ব্যবহূত হয়। কিন্তু গুয়ো শব্দটি কোন মুসলিম পদবি কিনা তা জানা যায় না। অন্য আরেকটি চৈনিক মুসলিম পদবি হলো ‘পু’; এটি আবু, আবদুল অথবা আবুল-এর প্রতিশব্দ।
এ্যাডমিরাল জেং হি নামে সাধারণ্যে পরিচিত জেং হি-ও ছিলেন একজন মুসলমান। তিনি মধ্য ইউনান থেকে দক্ষিণ চীনে আসেন এবং তাঁর পারিবারিক নামও ছিল ‘মা’ (পুরো নাম মা হি)। অ্যাডমিরাল হি-র নেতৃত্বে বিশাল চৈনিক নৌ-বহর ভারত মহাসাগরে মোট সাত বার পরিভ্রমণ করে। তাঁর দাদা এবং বাবা সম্ভবত মোঙ্গল অথবা আরব বংশোদ্ভূত ছিলেন। তাঁরা উভয়েই হজ্জ পালন করেছিলেন। মিং বাহিনী যখন ইউনান শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করে তখন তিনি ধৃত হন, তাঁকে খোজায় পরিণত করা হয় এবং মিং বংশের তৃতীয় শাসক ইয়ংলের হারেমে প্রহরী হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন। মিং সম্রাট তাঁর (মা হি’র) পারিবারিক নাম পরিবর্তন করে ‘জেং’ রাখেন। কারণ সম্রাটের মা’য়ের পারিবারিক নামও ছিল ‘মা’। তাই সম্রাটের দৃষ্টিতে একজন সম্রাটের রাজকীয় পদবি কখনো একজন সাধারণলোকের পদবির সমান হতে পারে না।
জেং সম্রাট ইয়ংলের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। যখনই সম্রাট বিদেশী কোন রাষ্ট্রের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে আগ্রহী হন, তখনই জেং হি-কে তাঁর একজন বিশ্বস্ত সহকারী হিসেবে নির্বাচিত করেন। জেং হি বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযানেও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। যে কোন বৈদেশিক দায়িত্ব খোজাদের উপর অর্পণ করা ছিল চৈনিক সম্রাটদের প্রচলিত রীতি, কারণ তাদেরকে পারিবারিক দায়বদ্ধতা ও পার্থিব বন্ধন থেকে মুক্ত মনে করা হতো। তাদের বিশ্বস্ততাও ছিল প্রশ্নাতীত।
মা হুয়ান তাঁর নিজের বয়সের কোন ধারণা দেননি। তবে ধারণা করা হয় তিনি ১৩৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর লেখার প্রকাশভঙ্গিতে ধ্রুপদী চৈনিক সাহিত্যের প্রভাব এবং বৌদ্ধ গ্রন্থের সাথে একাত্ম প্রমাণ করে যে, তিনি উপযুক্ত শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি কবিতাও লিখতে পারতেন, তবে তা হতো খুব সাধারণ শৈলীর। যুবক বয়সে তিনি আরবী ও ফারসি ভাষায় শিক্ষালাভ করেন। সম্ভবত একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের অধীনে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, ফলে তিনি একজন দক্ষ দোভাষীতে পরিণত হন।
জেং হি-র ১৪১৩-১৪১৫ খ্রিস্টাব্দের চতুর্থ অভিযাত্রায় মা হুয়ান অন্য দোভাষী গুয়ো চংলীসহ সফরসঙ্গী হন এবং প্রথম বারের মতো তাঁরা হরমুজ পৌঁছান। এরপর তিনি ১৪২১-২৩ খ্রি তাঁর পরবর্তী সফরে যান। ১৪৩১-৩৩ খ্রি তিনি তাঁর শেষ সফরে বের হন। মক্কার উদ্দেশ্যে এটিই ছিল তাঁর প্রথম ও শেষ সফর। এই তিনটি অভিযানেই চৈনিক অভিযাত্রিগণ বাংলায় আসেন এবং মা হুয়ান এই দেশ সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করার সুযোগ পান। ১৪১৬ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে তিনি তাঁর গ্রন্থের প্রথম খসড়া রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম দেন ইয়াংয়াই সেংলান (The Overall Survey of the Ocean's Shores)। ১৪৩৪-৩৬ খ্রিস্টাব্দে এটি পূর্ণতা পায়। ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সহযাত্রী গুয়ো চংলী গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। রাজকীয় লেখক গু পো প্রদত্ত মুখবন্ধ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
তিন অভিযাত্রীর ভ্রমণ বৃত্তান্তের মধ্যে মা হুয়ানের বিবরণটিই ছিল সমধিক বিস্তারিত। তাই সরকারি গ্রন্থ History of the Ming Dynasty সহ পরবর্তী সমস্ত গ্রন্থই বিদেশী রাষ্ট্রের তথ্য সংগ্রহে মা হুয়ানের গ্রন্থের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। ফার্সি ভাষায় তাঁর জ্ঞান (সম্ভবত আরবি ভাষায়ও) এবং অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা বিভিন্ন দেশে তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তকে সমৃদ্ধ করেছে। ফলে বাংলার (বাং-গে-লা) ভূমিরূপ, ভ্রমণপথ এবং বিভিন্ন স্থানের দূরত্ব সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ যেমন তাঁর বর্ণনাকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি এখানকার বিভিন্ন বস্ত্রশিল্প, নানা রকমের মাদক দ্রব্য, শস্য, বিবাহ ও শেষকৃত্যানুষ্ঠান, ভাষা, পোশাক ও অলংকার, মুদ্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য, রেশম ও রেশম গুটি, নর্তকী ও বাঘ-শিকারি এমনি অনেক কিছুই তাঁর বিবরণে স্থান পেয়েছে। অনেকেই মনে করেন তিনি বাংলায় থাকাকালে বাংলা ভাষাও কিছুটা শিখেছিলেন।
মা হুয়ান ছিলেন খুব সাধারণ মনের মানুষ। তিনি যে কোন ধরনের সহিংসতাকে ঘৃণা করতেন। তাই জাভার বিচারব্যবস্থায় মৃত্যুদন্ডের প্রকোপ দেখে তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর বিবরণে একজন ভ্রমণ বৃত্তান্ত লেখকের মাঝে একজন নব-জিজ্ঞাসা লালনকারী মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়। তাই কোন ভিনদেশের দূরত্ব, ভ্রমণ পথ,পণ্য-দ্রব্য, রাজনৈতিক অবস্থা প্রভৃতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি ছাড়াও সে দেশের লোককাহিনী ও লোকগাথা যেমন: কালিকটে প্রচলিত মোজেস ও স্বর্ণ গো-বৎসের কাহিনীসহ চৈনিকদের কাছে বিরল বস্ত্তসমূহ যেমন: কাঁঠাল, গন্ডার, জেব্রা, জিরাফ ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন। মা হুয়ানের লেখা পড়ে মনে হয় তাঁর বিবরণ বস্ত্তনিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীন।
আব্দুর রাজ্জাক, নিকিতিন এবং আরও কয়েকজন লেখক ব্যতীত চৌদ্দ শতকের প্রথম থেকে পনেরো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় দেড়শ বছর সময়ে ছয়জন পর্যটক গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ রেখে গেছেন। তাঁরা হলেন ইবনে বতুতা (১৩২৬-৪৯ খ্রি), ওয়াং দাইউয়ান (আনু. ১৩৩০-৫০ খ্রি), ফেই সিন (১৪০৯-৩৩ খ্রি), মা হুয়ান, গং জেন (১৪১৩-৩৩ খ্রি) এবং নিকোলো ডি কন্টি (১৪২০-৪৪ খ্রি)। এই ছয়জনের মধ্যে চারজন ছিলেন চৈনিক পর্যটক; আর তথ্য প্রদানে চৈনিক পর্যটকদের মধ্যে মা হুয়ান ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। মা হুয়ান বর্ণিত ২০টি দেশের মধ্যে ইবনে বতুতা বর্ণনা দিয়েছেন মাত্র ১০ টির। ফেই জিন যদিও ১৮টি দেশের বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর বর্ণনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। আর বিজয়নগর ব্যতীত কন্টির বর্ণনা অত্যন্ত দুর্বল। তবে মা হুয়ান বিজয়নগর ভ্রমণ করেননি। শ্রীলংকা, কুইলোন (কোলাম) ও মালদ্বীপ ছাড়া অন্যান্য অঞ্চলের উপর মা হুয়ান-এর বর্ণনা ইবনে বতুতা অপেক্ষা উন্নত মানের। চম্পা ও কুইলোন সম্পর্কে ফেই জিন-এর এবং কুইলোন সম্পর্কিত কন্টির বর্ণনা ব্যতীত অপরাপর ক্ষেত্রে মা হুয়ানের বিবরণ প্রকৃতই সমৃদ্ধ। [হরপ্রসাদ রায়]