সিমলা ডেপুটেশন
সিমলা ডেপুটেশন ভারতের মুসলিমদের একটি প্রতিনিধি দল। দলটি ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর সিমলায় গভর্নর জেনারেল ও ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সাথে সাক্ষাৎ করে। এর উদ্দেশ্য ছিল নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে ব্রিটিশ রাজের সহানুভূতি লাভ করা। সাক্ষাৎকারটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। উপমহাদেশের ইতিহাসে এ সাক্ষাৎকার সিমলা ডেপুটেশন নামে অভিহিত।
১৯০৬ সালের ২০ জুলাই কমন্সসভায় ভারত সচিব লর্ড মর্লি ভারত শাসনতন্ত্র বিষয়ক সংস্কারের কথা ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার ফলে মুসলিম নেতৃবৃন্দের মধ্যে বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনে মুসলমানদের স্বার্থ ভীষণভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। এ আইনে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে প্রতিনিধি প্রেরণের যে রীতি প্রণীত হয়েছিল তা মুসলমানদের সঠিক প্রতিনিধিত্ব প্রদানে ব্যর্থ হয়। এমতাবস্থায় ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রে মুসলিমদের স্বার্থ যথাযথরূপে সংরক্ষণের লক্ষ্যে মুসলিম নেতৃবৃন্দ প্রস্তাবিত কাউন্সিলের গঠন প্রকৃতি সম্পর্কে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি শাসকদের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন।
এ উদ্দেশ্য বিবেচনায় রেখে আলীগড় কলেজের সেক্রেটারি নওয়াব মুহসিন-উল-মুলক কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ.এ.জে আর্চবোল্ড-এর মাধ্যমে বড়লাট লর্ড মিন্টোর কাছে আসন্ন শাসনতান্ত্রিক সংস্কার সম্বন্ধে আলোচনার জন্য মুসলিম নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধিদল গ্রহণ করার আবেদন জানান। লর্ড মিন্টো প্রস্তাবিত প্রতিনিধিদলের সাথে সাক্ষাৎ করতে সম্মত হলে ৬ সেপ্টেম্বর মুসলিম নেতৃবৃন্দ স্যার আব্দুর রহমানের সভাপতিত্বে লক্ষ্ণৌতে এক ঘরোয়া বৈঠকে মিলিত হন এবং এ বৈঠকেই ভাইসরয়ের নিকট পেশ করার জন্য ভারতীয় মুসলিমদের দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত একটি স্মারকলিপি প্রস্ত্তত করা হয়। অতঃপর ১ অক্টোবর আগাখানের নেতৃত্বে ৩৫ জনের একটি প্রতিনিধিদল লর্ড মিন্টোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এ প্রতিনিধিদলে পশ্চিম বাংলা থেকে পাঁচ জন এবং পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশ থেকে একমাত্র নওয়াব নওয়াব আলী চৌধুরী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
প্রতিনিধিদল লর্ড মিন্টোর কাছে যে দাবিসমূহ পেশ করে সেগুলি হলো: (ক) সামরিক, বেসামরিক এবং বিচার বিভাগে মুসলমানদের যথেষ্ট সংখ্যায় নিয়োগ করতে হবে এবং কোন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাই উচ্চতর পদগুলি লাভে বাঁধা হবে না; (খ) পৌরসভা, জেলাবোর্ড এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ও সিন্ডিকেটে মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে; (গ) জনসংখ্যার অনুপাতে নয় বরং তাদের রাজনৈতিক গুরুত্বের ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাদেশিক কাউন্সিলে মুসলমানদের নির্বাচিত করতে হবে; (ঘ) মুসলমানগণ যাতে গুরুত্বহীন সংখ্যালঘুতে পরিণত না হয় সেজন্য পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে যথেষ্ট সংখ্যায় মুসলমানদের নির্বাচনের রক্ষাকবচ থাকতে হবে এবং (ঙ) একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে যা হবে মুসলমানদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের গর্ব।
গভর্নর জেনারেল স্মারকলিপিতে উল্লিখিত মুসলমানদের প্রধান দাবি অর্থাৎ, মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন ব্যক্ত করেন। এর ফলে প্রতিনিধিদলের সাফল্য প্রকাশ পায়। অবশেষে ১৯০৯ সালে মর্লি-মিন্টো সংস্কার-এ মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ও প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এভাবেই মুসলমানগণ একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসেবে শাসনতান্ত্রিক মর্যাদা লাভ করে, যা শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান সৃষ্টির দিকে পরিচালিত করে।
[আরিফা সুলতানা]