বেন্টিঙ্ক, লর্ড উইলিয়ম
বেন্টিঙ্ক, লর্ড উইলিয়ম (১৭৭৪-১৮৩৯) ১৮২৮ থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত ভারতের গভর্নর জেনারেল। লর্ড উইলিয়ম ক্যাভেন্ডিস বেন্টিঙ্ক ১৭৭৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। মাদ্রাজের গভর্নর হিসেবে ১৮০৩ সালে তিনি প্রথম ভারতে আসেন এবং ১৮০৬ সালে ভেল্লোরে সিপাইদের বিদ্রোহের কারণে ১৮০৭ সালে তাঁকে ডেকে পাঠানো হয়। প্রায় দ’ুদশক পর তাঁকে বাংলার গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করা হয় এবং তিনি ১৮২৮ সালে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৮৩৩ সালের সনদ আইন (Charter Act-1833) দ্বারা পরে তাঁর পদবিকে ভারতের গভর্নর জেনারেল হিসেবে পুনরাখ্যায়িত করা হয়। কোর্ট অব ডাইরেক্টরস (Court of Directors) বেন্টিঙ্ককে সমর্থন করেছিলেন। কারণ তিনি শান্তি, শৃঙ্খলা ও মিতব্যয়িতার ধ্বজাধারী ছিলেন। ভারতে তাঁর প্রশাসন শান্তিপূর্ণ কার্যাবলির জন্য বিশিষ্টতা অর্জন করেছিল। লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক সাধারণত হস্তক্ষেপ না করা এবং অনাক্রমণের নীতি অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু ১৮৩১ সালে মহিশূরে অনেকদিন যাবৎ চলতে থাকা কুশাসন ঐ রাজ্যটিকে ব্রিটিশ প্রশাসনে আনতে তাঁকে বাধ্য করে। বেন্টিঙ্ক তাঁর নিজস্ব আদর্শবাদী মতে বিশ্বস্ত থেকে ভারতীয় সাম্রাজ্যের অবস্থা অনুধাবন, প্রশাসন যাচাই করে দেখা, সেনাবাহিনী পরিদর্শন ও সকল ক্ষেত্রে সংস্কার সাধনে মনোনিবেশ করেন। প্রধান সেনাধ্যক্ষ হিসেবে তিনি সকল সেনানিবাস পর্যবেক্ষণে যান এবং বেসামরিক ও সামরিক চাকরি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও মিতব্যয়িতা জোরদার করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি বাট্টা অর্থাৎ সৈন্যরা সক্রিয় চাকরিতে থাকার সময় যে ভাতা পেত, তা তিনি কমিয়ে দেন এবং এভাবে দেড় মিলিয়ন পাউন্ড সাশ্রয় করে কোষাগারকে উদ্বৃত্ত করেন। বেন্টিঙ্ক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করেন এবং সেখানে রাজস্ব বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেন।
কর্নওয়ালিস কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রাদেশিক আপীল ও সার্কিট কোর্টসমূহ, যা দীর্ঘসূত্র পদ্ধতির দ্বারা প্রচুর পরিমাণ মামলাকে বিলম্বিত করতে অনেকাংশে দায়ী ছিল, বেন্টিঙ্ক বিলুপ্ত করেন। সর্বনিম্ন গ্রেড ব্যতিরেকে ভারতীয়দের বিচারক হিসেবে নিয়োগকেও কর্নওয়ালিস প্রতিরোধ করেছিলেন। অনেক ভারতীয়কে নিম্নপদস্থ বিচারক হিসেবে নিয়োজিত করে বেন্টিঙ্ক এ পদ্ধতিটির সংস্কার করেন। ভারতীয় বিচারকদের এক্তিয়ার ও বেতনও বৃদ্ধি করা হয়। কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেটদের কার্যাবলি তদারক করতে তিনি বিভাগীয় কমিশনারের পদ সৃষ্টি করেন এবং ফারসির স্থলে নিম্ন আদালতে স্থানীয় ভাষা এবং উচ্চ আদলতে ইংরেজি ভাষার প্রচলন করেন। তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পদ জেলা কালেক্টরের পদের সঙ্গে যুক্ত করেন এবং ভারতীয়দেরকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদের মতো নির্বাহী পদে নিয়োগ দান করেন। নিম্ন আদালতে মাতৃভাষা ব্যবহারের অনুমতিদানের ফলে ন্যায়বিচার সকল শ্রেণীর লোকের নিকট সহজলভ্য হয়।
উচ্চ আদালতে ও সরকারি কাজকর্মে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার প্রচলন ইংরেজি অধ্যয়নকে উৎসাহিত করে এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তার লাভ করে। ভারতীয়দের আধুনিক ধারায় শিক্ষিত করার মানসে টমাস বেবিংটন ম্যাকলে ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্যের ধারণাসমূহ ছড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তদনুসারে বেন্টিঙ্ক ইংরেজি ভাষা ও বিজ্ঞান পাঠকে উৎসাহিত করার পদক্ষেপ নেন। অনেক জায়গায় স্কুল খোলা হয় এবং ভারতীয় ডাক্তারদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে ১৮৩৫ সালে কলকাতায় একটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এরপর বেন্টিঙ্ক সমাজ সংস্কারে মনোনিবেশ করেন এবং হিন্দুদের মধ্যে দাম্পত্যের পবিত্র কর্তব্যের আদর্শ বলে দীর্ঘকাল যাবৎ পরিগণিত প্রথা মৃত স্বামীর চিতায় হিন্দু বিধবাদের পুড়ে মারা অর্থাৎ সতীদাহ প্রথা বিলোপ করেন। বেন্টিঙ্ক এ প্রথাটিকে বেআইনী ঘোষণা করেন এবং কঠোরভাবে এর চর্চাকে দমন করেন, যদিও অনেক গোঁড়া হিন্দু এটিকে তাঁদের ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে মনে করেছিলেন।
বেন্টিঙ্ক দুর্ধর্ষ ঠগীদের দমন করতেও পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দুষ্কৃতকারীর দল ঠগীরা গোপনে ব্যবসায়ী অথবা তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে দেশময় ঘুরে বেড়াত। তারা অরক্ষিত পথচারীদের ওপর হানা দিয়ে তাদের সর্বস্ব অপহরণ করে শ্বাসরোধ করে হত্যা করত। তারা ভারতের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ভয়াবহ বিপদের কারণ ছিল। লুণ্ঠিত দ্রব্যে ভাগ বসাতে শক্তিশালী ভূ-স্বামীরা প্রায়শ তাদের পৃষ্ঠপোষণ করত। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করে কর্নেল উইলিয়ম স্লীম্যান তাদের মূলোৎপাটন করতে সফল হন। বেন্টিঙ্ক গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন দেওয়া ও শিশুহত্যাও নিবারণ করেন।
তাঁর শাসনামলে ১৮৩৩ সালে কোম্পানির সনদ আরও ২০ বছরের জন্য নবায়ন করা হয় যা, অন্য সকল বিষয়ের মধ্যে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার বিলোপ করে। তখন থেকে কোম্পানি একটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক সংস্থায় পরিণত হয়। এটি বাংলার গভর্নর জেনারেল উপাধিকেও ভারতের গভর্নর জেনারেল-এ রূপায়িত করে। বেন্টিঙ্ক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মনের অধিকারী ছিলেন এবং অবাধ বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে তিনি ট্রানজিট কর বিলোপ করেন, নদী ও সমুদ্রে বাষ্পচালিত যানবাহনের উন্নয়ন করেন, চা ও কফি চাষ এবং লৌহ ও কয়লা উৎপাদনে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। রাস্তাঘাট, নিষ্কাশন ও সেচব্যবস্থার একটি নেটওয়ার্ক গড়ার পরিকল্পনাও তিনি করেছিলেন। তাঁর উদারবাদী ধারণাসমূহ ও সংস্কারমূলক কার্যাবলির জন্য লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ভারতীয়দের প্রশংসা অর্জন করেন। ১৮৩৫ সালে তিনি অবসর নেন এবং ১৮৩৯ সালের ১৭ জুন ইংল্যান্ডে তাঁর মৃত্যু হয়। [কে.এম মোহসীন]