চলন বিল
চলন বিল (Chalan Beel) বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল এবং সমৃদ্ধতম জলাভূমিগুলির একটি। দেশের সর্ববৃহৎ এ বিল বিভিন্ন খাল বা জলখাত দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত অনেকগুলি ছোট ছোট বিলের সমষ্টি। বর্ষাকালে এগুলি সব একসঙ্গে একাকার হয়ে প্রায় ৩৬৮ বর্গ কিমি এলাকার একটি জলরাশিতে পরিণত হয়। বিলটি সংলগ্ন তিনটি জেলা রাজশাহী, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ-এর অংশবিশেষ জুড়ে অবস্থান করছে। চলন বিল সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ ও পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলা দুটির অধিকাংশ স্থান জুড়ে বিস্তৃত। এটি নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলা ও গুমনী নদীর উত্তর পাড়ের মধ্যে অবস্থিত। বিলটির দক্ষিণপূর্ব প্রান্ত পাবনা জেলার নুননগরের কাছে অষ্টমনীষা পর্যন্ত বিস্তৃত। এ জেলায় চলন বিলের উত্তর সীমানা হচ্ছে সিংড়ার পূর্ব প্রান্ত থেকে ভদাই নদী পর্যন্ত টানা রেখাটি যা রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া জেলার মধ্যবর্তী সীমানা নির্দেশ করে। ভদাই নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত তাড়াস উপজেলা ও পাবনা জেলা বরাবর উত্তর-দক্ষিণমুখী একটি রেখা টানলে তা হবে বিলটির মোটামুটি পূর্ব সীমানা। বিলটির প্রশস্ততম অংশ উত্তর-পূর্ব কোণে তাড়াস থেকে গুমনী নদীর উত্তর পাড়ের নারায়ণপুর পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিমি বিস্তৃত সিংড়া থেকে গুমনী পাড়ের কচিকাটা পর্যন্ত অংশে এটির দৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি, ২৪ কিমি।
চলন বিল গঠনকারী ছোট ছোট বিলগুলি পশ্চিম থেকে পূর্বে যথাক্রমে: ১) পূর্ব মধ্যনগর, ২) পিপরুল, ৩) ডাঙাপাড়া, ৪) লারোর, ৫) তাজপুর, ৬) নিয়ালা, ৭) চলন, ৮) মাঝগাঁও, ৯) ব্রিয়াশো, ১০) চোনমোহন, ১১) শাতাইল, ১২) খরদহ, ১৩) দারিকুশি, ১৪) কাজীপাড়া, ১৫) গজনা, ১৬) বড়বিল, ১৭) সোনাপাতিলা, ১৮) ঘুঘুদহ, ১৯) কুরলিয়া, ২০) চিরল, ২১) দিক্ষিবিল এবং ২২) গুরকা। বড় আকারের বিলগুলির বেশিরভাগই পাবনা জেলায় অবস্থিত, যেমন- গজনা বিল, বড়বিল, সোনাপাতিলা বিল, ঘুঘুদহ, চিরল বিল এবং গুরকা বিল। গজনা বিল দুলাই-এর দক্ষিণে ১২৩ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে অবস্থিত। বড়বিলের আয়তন ৩১ বর্গ কিমি। প্রায় ৩৫ বর্গ কিমি আয়তনের সোনাপাতিলা বিল পাবনা জেলার উত্তরাংশ জুড়ে অবস্থিত। চাটমোহর উপজেলায় কুরলিয়া ও দিক্ষিবিল দুটি যথাক্রমে ১৮ ও ১৫ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে অবস্থিত। চিরল ও গুরকা বিল- উভয়েরই আয়তন ৮ বর্গ কিমি এবং ঘুঘুদহ ৪ বর্গ কিমি।
ব্রহ্মপুত্র নদ যখন তার প্রবাহপথ পরিবর্তন করে বর্তমান যমুনায় রূপ নেয়, সে সময়েই চলন বিলের সৃষ্টি। করতোয়া ও আত্রাই নদীর পরিত্যক্ত গতিপথ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে একটি ব্যাপক বিস্তৃত হ্রদে পরিণত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এটি সম্ভবত একটি পশ্চাৎজলাভূমি ছিল। চলন বিলের গঠন ঐতিহাসিকভাবেই আত্রাই ও বড়াল নদীর সংকোচনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আত্রাই নদী ছিল চলন বিলের প্রধান যোগানদানকারী প্রণালী যা বৃহত্তর রাজশাহী জেলার উত্তরাংশ ও দিনাজপুর এলাকার জল নিষ্কাশন করত। বড়াল চলন বিল থেকে জল নির্গম পথ হিসেবে কাজ করে এবং বিলের পানি বহন করে যমুনা নদীতে ফেলে। গঠিত হওয়ার সময় চলন বিলের আয়তন ছিল প্রায় ১,০৮৮ বর্গ কিমি।
চলন বিলের দক্ষিণ প্রান্ত ঘেঁষে রয়েছে গুমনী নদী যা বিলটির পানি বয়ে নিয়ে প্রথমে বড় বিলে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত যমুনায় পতিত হয়। যমুনা বন্যাপ্লাবিত হয়ে পানির উচ্চতা বেড়ে গেলে বড়াল সে পানি কিছুটা ধরে রাখে এবং বিলের পানিও বেড়ে যায়; যমুনার পানি নেমে না যাওয়া পর্যন্ত পানির এ উচ্চতা কমে না। শুষ্ক মৌসুমে বিলের বৃহত্তর অংশ শুকিয়ে ২৫.৯ থেকে ৩১.০৮ বর্গ কিমি আয়তনের এক জল গহবরে পরিণত হয়, যাকে বিলের ‘মূল অংশ’ বলা যেতে পারে। এ মূল অংশ অবশ্য অব্যাহত পানি সরবরাহ থেকে বঞ্চিত, বরং কিছুসংখ্যক অগভীর জলাশয়ের সমষ্টি যা পরস্পর অত্যন্ত অাঁকাবাঁকা কিছু খাল দ্বারা সংযুক্ত। এ মূল অংশকে ঘিরে দুটি এককেন্দ্রিক অসম ডিম্বাকার এলাকা আছে যেখানে আঞ্চলিকভাবে ‘ভাসমান ধান’ নামে পরিচিত সরু চালের ধান উৎপন্ন হয়। প্রথম বৃত্তটি, যা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সঙ্কীর্ণ, বর্ষা মৌসুমে ১.৫৩ থেকে ১.৮৩ মিটার গভীর পানিতে পূর্ণ থাকে। চলন বিলের পশ্চিম দিককে ‘বহিঃবৃত্ত’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় যেখানে বর্ষা মৌসুমে পানি বিলের অন্যান্য অংশ থেকে অনেক কম থাকে। দু বৃত্ত এলাকাই ডিসেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত পুরোপুরি শুকনো থাকে।
বর্তমানে চলন বিল দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর গঙ্গা থেকে পলি এসে পড়ার দরুন বিগত দেড়শ বছরে বিলটি দক্ষিণ দিক থেকে অন্ততপক্ষে ১৯.৩২ কিমি সরে এসেছে। বিলটিতে প্রবাহদানকারী নদীগুলি, যথা গুর, বড়াল ইত্যাদিও এটির আয়তন সংকোচনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে। বিলটির পানি নিষ্কাশন প্রণালী এবং পলি সঞ্চয়ের বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখার জন্য গণপূর্ত বিভাগ ১৯০৯ সালে একটি জরিপ চালিয়ে দেখেছে যে, চলন বিল তার পূর্বেকার আয়তন ১,০৮৫ বর্গ কিমি থেকে সঙ্কুচিত হয়ে ৩৬৮ বর্গ কিমি-এ দাঁড়িয়েছে। অবশিষ্ট জমি ব্যবহূত হয়েছে চাষাবাদ অথবা জনবসতির জন্য। এ হ্রাসপ্রাপ্ত এলাকারও মাত্র ৮৫ বর্গ কিমি-এ সারাবছর ধরে পানি থাকে। একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, বিলে পতিত নদীগুলি প্রতি বৎসর ৬৩ লক্ষ ঘনমিটার পলি বহন করে আনে এবং এর মধ্যে মাত্র ১৫ লক্ষ ঘনমিটার বিল থেকে বেরিয়ে আসে বিলের বিভিন্ন নিষ্কাশন প্রণালীর মাধ্যমে। অবশিষ্ট ৪৮ লক্ষ ঘনমিটার বাৎসরিক তলানি হিসেবে জমা হয়। এ পলি যদি সমস্ত বিল এলাকায় সমবণ্টিত হতো, তবে বিলটির তলদেশের অনুভূমিক উচ্চতা বছরে ১.২৭ সেমি হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। শুকনো মৌসুমে বিলটির পরিস্থিতি দেখার জন্য ১৯১০ সালে আরও একটি অনুসন্ধান চালানো হয় এবং দেখা যায় যে, বিলটির আয়তন আরও হ্রাস পেয়েছে। ১৯১৩ সালে তৃতীয় পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, মাত্র ৩১ থেকে ৩৯ বর্গ কিমি এলাকায় পুরো বছর জুড়ে পানি ছিল। সে সময় বিলটির কেন্দ্রীয় অংশের পাড় এলাকায় চাষবাস হতো এবং মূল বিলে এপ্রিল মাসে পানির গভীরতা ছিল মাত্র ২.৭৫ থেকে ৫.৪৯ মিটার। ১৯৫০ এর দশকে বিভিন্ন পুনরুদ্ধার কর্মসূচির দরুন চলন বিলের আয়তন পুনরায় কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৫.৯ বর্গ কিলোমিটারে। ১৯৮৭ সালে দেখা যায় যে, শুকনো মৌসুমে চলন বিল পরিণত হয় একটি জলশূন্য নিচু এলাকায়, যেখানে পানি বলতে শুধু মানুষের তৈরী কিছু ছোট ছোট পুকুর ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
একটি ব্যাপার সুস্পষ্ট যে, চলন বিল বেশ দ্রুত ভরাট হয়ে আসছে। জমি পুনরুদ্ধার হচ্ছে এবং বিলের ধার দিয়ে গড়ে উঠছে গ্রাম। কেবল কেন্দ্রের গভীরতম অংশটুকু ছাড়া শুকনো মৌসুমে সমস্ত ছোট-বড় বিল শুকিয়ে যায়। কেন্দ্রের বাইরে প্রান্তীয় এলাকাগুলিতে শুষ্ক মৌসুমে বোরো ও উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ করা হয়। বর্ষার সময় অগভীর প্রান্তীয় এলাকায় গভীর পানির আমন ধান চাষ করা হয়। উত্তরবঙ্গের মাছের চাহিদা পূরণে চলন বিল এখনও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
[মোহা. শামসুল আলম এবং মোঃ সাজ্জাদ হোসেন]