খাদ্য সংরক্ষণ
খাদ্য সংরক্ষণ (Food Preservation) ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যদ্রব্য বিভিন্ন রোগজীবাণুর আক্রমণ ও ক্ষতি থেকে সংরক্ষণ করার পদ্ধতি। কার্যকর খাদ্য সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য খাদ্যবস্ত্ততে যথাসম্ভব মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন রাখা ও পুষ্টিমান বজায় রাখা।
বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ ও পচন রোধের জন্য এখনও সনাতন পদ্ধতি ও কলাকৌশল ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য লবণ, ধোঁয়া, চিনি, সিরকা ইত্যাদির ব্যবহার এবং শুকিয়ে খাদ্য উপাদান সংরক্ষণ। আধুনিক খাদ্য সংরক্ষণ ব্যাপকতর পদ্ধতি প্রয়োগ করে এখন বহু ধরনের খাদ্যসামগ্রী সংরক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
খাদ্য সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার প্রধান উপায়গুলির মধ্যে রয়েছে রোদে শুকানো, তাপের ব্যবহার, অতি ঠান্ডায় খাদ্য মজুদকরণ, বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরণ প্রয়োগ। রোদে শুকিয়ে খাদ্যবস্ত্ত সংরক্ষণের পদ্ধতি অতি প্রাচীন এবং বাংলাদেশে মাছ, ফল, শস্য, শাকসবজি, মাংস ইত্যাদি সংরক্ষণে এর ব্যবহার ব্যাপক। মাছ ও মাংস শুকিয়ে সংরক্ষণ করার পদ্ধতি খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকে ব্যবহূত হয়ে আসছে বলে ধারণা করা হয়।
প্রায় এক শত বছর আগেও শুকনা শাকসবজি বিক্রি হতো। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ, সোনাদিয়া ও অনেক উপকূলীয় এলাকায় নিয়মিতভাবে শুকিয়ে মাছ সংরক্ষণ করা হয়। প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ মাছ স্থানীয় ব্যবহার ও রপ্তানির জন্য শুঁটকি করা হয়। ফলের মধ্যে আম ও বরই শুকিয়ে রাখার ঐতিহ্য এখনও বিদ্যমান।
খাদ্য সংরক্ষণে হিমায়িতকরণ পদ্ধতি সাধারণত শহরেই সীমাবদ্ধ। এটি খাদ্য সংরক্ষণের অন্যতম সুবিধাজনক উপায় হলেও এ পদ্ধতিতে অণুজীব ধ্বংস হয় না বা তাদের বৃদ্ধিও সম্পূর্ণ রোধ করা যায় না। বসতবাড়িতে প্রাত্যহিক ব্যবহারের জন্য সাধারণত শাকসবজি, মাংস, দুধ, মাছ, ডিম, মাখন এবং অন্যান্য পচনশীল দ্রব্যাদি ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়। বেশি ঠান্ডায় (১৮ সে অথবা এর কম) পচনক্রিয়া বহুলাংশে থেমে গেলেও রান্না না করা খাদ্যে উৎসেচকের ক্রিয়া কিছুটা অব্যাহত থাকে। আলু সংরক্ষণের জন্য বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৩০০টি বেসরকারি এবং ২১টি সরকারি হিমাগার রয়েছে। কেবল মুন্সিগঞ্জ জেলাতেই আছে প্রায় ৮০টি হিমাগার। বিভিন্ন জাতের আলু সংরক্ষণে এগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
উচ্চ তাপ ব্যবহারের মাধ্যমে টিনজাত করে খাদ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি ব্যয়বহুল হলেও অণুজীব ও উৎসেচকের প্রভাব এখানে থাকে না। ব্যাকটেরিয়ার দূষণ থেকে সংরক্ষণের জন্য খাদ্যবস্ত্তর পাত্র মজবুতভাবে সীল করে দেওয়া হয়। দেশের কতকগুলি প্রতিষ্ঠান এ পদ্ধতিতে এখন মাছ, মাংস, শাকসবজি, ফলমূল, কোমল পানীয় ইত্যাদি সংরক্ষণ ও বাজারজাত করছে। ভিনেগার বা সিরকার অন্যতম উপাদান এসিটিক এসিড ব্যবহারের মাধ্যমে অণুজীব বৃদ্ধিরোধের অন্যতম সাধারণ পদ্ধতি আচার তৈরি। ভিনেগার, সরিষার তেল এবং কিছু মসলার সহযোগে বিভিন্ন ধরনের আচার পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এদেশে তৈরি হয়।
বহু শতক ধরে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহূত হয়ে আসছে। সচরাচর ব্যবহূত দ্রব্যাদির মধ্যে রয়েছে সোডিয়াম ক্লোরাইড, সোডিয়াম ও পটাসিয়াম নাইট্রেট, সোডিয়াম সেলিসাইলেট, বেনজোয়িক এসিড, অ্যাসকরবিক এসিড, ভিনেগার, অ্যালকোহল ইত্যাদি। জ্যাম, জেলি এবং মোরববা তৈরিতে বাংলাদেশে অতি ঘন চিনির দ্রবণ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়।
খাদ্য সংরক্ষণে লবণের ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত। বাংলাদেশে লবণ দ্বারা সংরক্ষণের পাশাপাশি এর সঙ্গে রোদ, তাপ এবং ধোঁয়াও ব্যবহার করা হয়। ইলিশ মাছ সংরক্ষণের জন্য এদেশে প্রধানত খাবার লবণ ব্যবহূত হয়। [এস.এম হুমায়ুন কবির এবং রেজাউর রহমান]
বিকিরণের সাহায্যে সংরক্ষণ নিরাপদ মাত্রা ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মুক্তকরণ পদ্ধতি প্রয়োগ করার মাধ্যমে খাদ্যসামগ্রী নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থা কীটপতঙ্গ ও অণুজীবের আক্রমণ ও বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে এবং এভাবে সংরক্ষিত খাদ্যসামগ্রীর ব্যবহারযোগ্যতার সময় বাড়ায়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (FAO) এক আনুমানিক হিসাবে দেখানো হয়েছে যে, সমগ্র বিশ্বের খাদ্যশস্যের প্রায় এক পঞ্চমাংশ কীটপতঙ্গ, অণুজীব এবং অন্যান্য বালাই দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উচ্চ তাপমাত্রা এবং বেশি আর্দ্রতা বিরাজ করে এমন অনেক উন্নয়নশীল দেশে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০% এর কাছাকাছি পৌঁছায়। বিকিরণ প্রক্রিয়া ব্যবহার করার মাধ্যমে কিছু কিছু খাদ্যের পুষ্টিমান উন্নত করা যেতে পারে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় যে, সয়াবিনের ময়দায় নিহিত উচ্চমাত্রার আমিষ উপাদান যা পাউরুটিতে মিশানো হয় সেটি প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায় যখন বিকিরণ প্রয়োগ করা গমের ময়দার সঙ্গে তা ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের খাদ্য ও বিকিরণ জীববিদ্যা প্রতিষ্ঠানে (institute of Food and Radiation Biology/IFRB) বিভিন্ন প্রকার ডাল, আলু, পিঁয়াজ, মাছ, শুঁটকি মাছ, হাঁস-মুরগির মাংস এবং শাকসবজির জীবনকাল বৃদ্ধির ওপর গবেষণা করা হয়। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ইতোমধ্যে বিকিরণ প্রয়োগকৃত ১৩টি খাদ্যবস্ত্ত মানুষের খাওয়ার জন্য উপযুক্ত ঘোষণা করে নিঃশর্ত অনুমতিপত্র প্রদান করেছে, যেগুলির মধ্যে রয়েছে আলু, পিঁয়াজ, গমের ময়দা, মসলা, মুরগির মাংস, মাছ এবং মাছের তৈরি খাবার (শীতল এবং হিমায়িত), হিমায়িত চিংড়ি, ব্যাঙের পা, চাল এবং চাল থেকে উৎপন্ন দ্রব্যাদি, বিভিন্ন রকমের ডাল, পেঁপে এবং আম।
খাদ্যদ্রব্য এবং কৃষিজাত পণ্য জীবাণুমুক্তকরণ এবং এগুলির মান উন্নয়নের জন্য খাদ্য বিকিরণ প্রয়োগকরণ প্রযুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের খাদ্য এবং বিকিরণ জীববিদ্যা প্রতিষ্ঠান দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতীয় সংস্থা। খাদ্যে বিকিরণ প্রয়োগকরণের ওপর গবেষণা প্রধানত খাদ্য এবং বিকিরণ জীববিদ্যা প্রতিষ্ঠানে স্থাপিত একটি উপযুক্ত গামা রেডিয়েশন উৎসের সাহায্যে পরিচালিত হয়। খাদ্য বিকিরণ প্রয়োগকরণ এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত সামগ্রী জীবাণুমুক্তকরণের উদ্দেশ্যে বেক্সিমকো এবং বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের যৌথ উদ্যোগে চট্টগ্রামে প্রদর্শনী এবং একই সঙ্গে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য গামাটেক লিমিটেড (Gammatech Ltd) নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
[এম জাহিদুর রহমান মজুমদার এবং মইনউদ্দিন আহমেদ]
আরও দেখুন খাদ্যসামগ্রী; খাদ্যশস্য গুদামজাতকরণ।