কর

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৪:৪৪, ৩ আগস্ট ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

কর  সরকারি রাজস্বের একটি প্রধান উৎস, যা দ্বারা দেশের রাজস্ব ও উন্নয়নমূলক ব্যয় নির্বাহ করা হয় এবং যার মাধ্যমে দেশে আয়ের পুনর্বণ্টন, মূল্যের স্থিতিশীলতা রক্ষা, ক্ষতিকর ভোগ নিরুৎসাহিতকরণ ইত্যাদি আর্থ-সামাজিক উদ্দেশ্য সাধিত হয়। করারোপ সরকারি অর্থসংস্থানের অন্যান্য উৎস, যেমন টাকার নোট ও মুদ্রা ছাপানো, পণ্যদ্রব্য ও সেবার বিনিময়ে মূল্যগ্রহণ এবং ঋণগ্রহণের অনুপূরক হিসেবে কাজ করে থাকে। ল্যাটিন শব্দ ‘ট্যাক্সার’ ব্যুৎপত্তিগতভাবে ইংরেজি ‘ট্যাক্স’ শব্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যার অর্থ মূল্য আদায় করা। অভিধানে কর শব্দের অর্থ হলো রাষ্ট্র কর্তৃক বাধ্যতামূলকভাবে আদায়কৃত আর্থিক অবদান। কর কোনো অর্থদন্ড নয়, তবে এ হলো পূর্বনির্ধারিত পদ্ধতিতে বেসরকারি খাত থেকে সরকারি খাতে বাধ্যতামূলক স্থানান্তরিত সম্পদ।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২(১) অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা অনুসারে, করারোপ বলতে সাধারণ, স্থানীয় বা বিশেষ যে কোনো কর, অভিকর, শুল্ক বা প্রবেশকর-এর আরোপ বোঝায়। অভিকর  স্থানীয় সরকার কর্তৃক আরোপিত হয়, শুল্ক ধার্য করা হয় দ্রব্য বা সেবার ওপর, এবং প্রবেশকর কোনো দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য প্রদেয় কর। সংবিধানের ৮৩ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সংসদের কোনো আইনের সাহায্য বা কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো কর আরোপ বা সংগ্রহ করা যাবে না। অর্থবিলের মাধ্যমে কোনো করের আরোপ, নিয়ন্ত্রণ, রদবদল, মওকুফ বা রহিতকরণ করা হয়, তবে কোনো কর হ্রাসকরণ বা বিলোপসাধন ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে অর্থবিল রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত সংসদে পেশ করা যায় না।

বাংলাদেশ উত্তরাধিকারসূত্রে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থা থেকে তার করারোপ পদ্ধতি পেয়েছে। তবে এ পদ্ধতি সাধারণভাবে স্বীকৃত করনীতিসমূহের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়াও আশানুরূপ কর আদায়, কর-ফাঁকি রোধ ও রাজস্ব হ্রাসের ছিদ্রপথ বন্ধ করতে কর প্রশাসনকে যুক্তিসঙ্গত কারণে অনেক নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। কর প্রশাসনের দক্ষ জনশক্তি তৈরির জন্য সরকারের দুটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, প্রত্যক্ষ করের প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকায় বিসিএস (কর) একাডেমী এবং পরোক্ষ করের প্রশিক্ষণের জন্য চট্টগ্রামে শুল্ক, আবগারি ও মূল্য সংযোজন কর প্রশিক্ষণ একাডেমী।  জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ কর কর্তৃপক্ষ এবং মোট করের ৯৫% বা মোট রাজস্বের ৭৭% এ বোর্ড আদায় করে থাকে (২০০৯-১০)। মোট করের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-সম্পৃক্ত অংশে রয়েছে  বহিঃশুল্কমূল্য সংযোজন কর (মূসক), সম্পূরক শুল্ক,  আবগারি শুল্ক, আয়কর, বিদেশ ভ্রমণ কর, বিদ্যুৎ শুল্ক, সম্পদ কর (১৯৯৯-২০০০ থেকে আয়করের সারচার্জ হিসেবে আদায় করা হচ্ছে), টার্নওভার কর, বিমান টিকেট কর,  বিজ্ঞাপন কর, দান কর এবং কতিপয় অন্যান্য অগুরুত্বপূর্ণ কর। এনবিআর-বহির্ভূত অন্যান্য কর (২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট করের ৫% বা মোট রাজস্বের ৪%)-এর মধ্যে রয়েছে মাদক শুল্ক (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্তৃক আদায়কৃত), ভূমি রাজস্ব (ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে তহসিল অফিসের মাধ্যমে আদায়কৃত), নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প শুল্ক (অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আদায়কৃত), নিবন্ধন ফিস (আইন, বিচার ও সংসদ-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন পরিদপ্তর কর্তৃক আদায়কৃত), এবং যানবাহন কর (যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আদায়কৃত)।

পূর্বেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর আদায় করেছে। উদাহরণস্বরূপ- সম্পদ কর। সম্পদ কর ১৯৬৩ মোতাবেক ১৯৯৮-৯৯ করবর্ষ পর্যন্ত পরবর্তীকালে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ মোতাবেক আয়করের অংশ হিসেবে সারচার্য (অধিভার) ২০০১-০২ পর্যন্ত বলবৎ ছিল, মৃতের সম্পত্তির উপর কর (মৃতের সম্পত্তির উপর কর আইন ১৯৫০ মোতাবেক ১৯৮১-৮২ করবর্ষ পর্যন্ত), বিক্রয় কর (বিক্রয় কর আইন ১৯৫১ মোতাবেক ১৯৮১-৮২ করবর্ষ পর্যন্ত পরবর্তীকালে বিক্রয় কর অধ্যাদেশ ১৯৮২ মোতাবেক ১৯৯০-৯১ করবর্ষ পর্যন্ত), নগরীয় স্থাবর সম্পত্তি কর (নগরীয় স্থাবর সম্পত্তি কর আইন ১৯৫৭ মোতাবেক ১৯৮২-৮৩ করবর্ষ পর্যন্ত) নির্ধারিত পণ্য ও সেবার টার্নওভার কর (মোট বিক্রয় মূল্যের উপর কর) (বিজনেস টার্নওভার ট্যাক্স অধ্যাদেশ ১৯৮২ মোতাবেক ১৯৮২-৮৩ থেকে ১৯৯০-৯১ করবর্ষ পর্যন্ত), অবকাঠামো উন্নয়ন সারচার্য (অধিভার)(অর্থ আইন ১৯৯৭ মোতাবেক ১৯৯৭-৯৮ থেকে ২০০৬-০৭ অর্থবছর পর্যন্ত), বিমান টিকেট কর (এটিটি) ১৯৮৬-৮৭ থেকে ২০০৩-০৪ অর্থবছর এবং আবগারী শুল্ক (২০০৩-০৪ পর্যন্ত)।

বাংলাদেশে কর থেকে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ খুবই কম যা দেশে কর-জিডিপি অনুপাত থেকে বোঝা যায়। উক্ত অনুপাত ১৯৭২-৭৩ সালে ছিল মাত্র ৩.৪%। ১৯৯২-৯৩ সালে (মূসক প্রবর্তনের দ্বিতীয় বৎসরে) তা ৯% ছাড়িয়ে যায় এবং ১৯৯৮-৯৯ সাল পর্যন্ত তা ৯%-এর কাছাকাছি ছিল। তবে কখনই তা ১০% ছাড়িয়ে যায়নি (২০০৭-০৮ অর্থবছরে তা ছিল ৯.২)। ২০০৮-০৯ এবং ২০০৯-১০ সালের সংশোধিত বাজেটে কর-জিডিপি অনুপাতের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় যথাক্রমে ৯% এবং ৯.৩%। ২০০৯-১০ সনের বাজেটে মোট ব্যয় ও মোট রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় যথাক্রমে ১১৩,৮১৯ কোটি টাকা এবং ৭৯,৪৬১ কোটি টাকা, ফলে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়ায় ৩৪,৩৫৮ কোটি টাকা। মোট রাজস্বের মধ্যে কর রাজস্ব ধরা হয় ৬৩,৯৫৩ কোটি টাকা (যা পরবর্তী বৎসরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১৫% বেশি) এবং কর-বহির্ভূত রাজস্ব ধরা হয় ১৫,৫০৬ কোটি টাকা (যা পরর্ববর্তী বৎসরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ১৪% বেশি)। এ হিসাবে কর-রাজস্ব ছিল মোট ব্যয়ের ৫৬%।

বাংলাদেশের কর কাঠামো প্রত্যক্ষ কর (আয়কর, দান কর, ভূমিউন্নয়ন কর, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, নিবন্ধন, অস্থাবর সম্পত্তি কর, ইত্যাদি) এবং পরোক্ষ কর (বহিঃশুল্ক, মূসক, সম্পূরক শুল্ক, আবগারি শুল্ক, বিদেশ ভ্রমণ কর, বিদ্যুৎ শুল্ক, টার্নওভার কর, বিমান টিকেট কর, বিজ্ঞাপন কর, মাদক শুল্ক, যানবাহন কর, ইত্যাদি) নিয়ে গঠিত। যেহেতু ২০০৮-০৯ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ করের হিস্যা মোট করের মাত্র ২৭.৯%-এর মতো, তাই কর কাঠামো সাধারণ মানুষের ওপর কর-বোঝা সৃষ্টিকারী পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল যা অধিক গতিশীল। প্রত্যক্ষ করের প্রায় ৮৭.৫% আসে আয়কর থেকে, ৯.৮% নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প থেকে, ২.৬% ভূমি রাজস্ব ও অন্যান্য ক্ষুদ্র কর থেকে। অন্যদিকে, ২০০৮-০৯ সনে পরোক্ষ কর, যা মোট করের প্রায় ৭২.১%, প্রধানত আমদানি-নির্ভর। পরোক্ষ করের প্রায় ৫৩.৩% শুল্ক কর্তৃপক্ষ আমদানি পর্যায়ে সংগ্রহ করে থাকে, এর মধ্যে বহিঃশুল্ক পরোক্ষ করের ২৩.৯% (যা মোট করের ১৭.২%), মূসক ২৩.৪% (যা মোট পরোক্ষ করের ১৬.৯%) এবং সম্পূরক শুল্ক ৬.৩%। পরোক্ষ করের অবশিষ্টাংশ (যা মোট করের প্রায় ৩৩.৭%) আসে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন, ভোগ বা লেনদেন থেকে, যেমন মূসক (১৯.৩%), সম্পূরক শুল্ক (১২.১%), আবগারি শুল্ক (০.৪%), বিদেশ ভ্রমণ কর (০.৮%), যানবাহন কর (১.০%), মাদক শুল্ক (০.১%), টার্নওভার কর (০.০১%)। সরকারি রাজস্বের প্রায় ১৯.৭% আসে অন্যান্য কর-বহির্ভূত রাজস্ব থেকে, যেমন কর্পোরেশনসমূহের উদ্বৃত্ত, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, রেলওয়ে, ডাক বিভাগ, জুডিশিয়াল ষ্ট্যাম্প, তার ও টেলিফোন ইত্যাদি খাতে আয়।

উপমহাদেশে ভূমি বা তার উৎপাদনের সাথে সম্পর্কযুক্ত কর প্রাচীনকাল থেকে সুবিদিত। বৈদিক যুগের (খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৫০০ অব্দ) প্রথম দিকে রাজশক্তি সুগঠিত ছিল না এবং করারোপ ছিল সাময়িক ও ঐচ্ছিক। বলি শব্দটির উদ্ভব হয়েছে দেবতাদের কৃপা লাভের জন্য স্বেচ্ছায় কিছু উৎসর্গ করার অর্থে, যা পরবর্তী সময়ে স্বেচ্ছায় রাজাকে কমবেশি প্রদত্ত উপহার ও কর বোঝাতে ব্যবহূত হতো। বৈদিক যুগের শেষদিকে করারোপের প্রকৃতি বদলে যায় এবং রাজাকে ‘প্রজাদের খাদক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সম্ভবত রাজা ও তার অনুচরদেরকে জনসাধারণ কর্তৃক খাদ্যপণ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা প্রথা থেকে এ ধারণা উদ্ভূত হয়েছে। কৌটিল্যীয় অর্থশাস্ত্র (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩২১-৩০০ অব্দ) অনুসারে সর্বোচ্চ সমাহর্তা (রাজস্ব কর্মকর্তা) সাতটি স্থান পর্যবেক্ষণ করতেন এবং সেখান থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করতেন। এ সাতটি স্থান হলো দুর্গবেষ্টিত নগরী, গ্রামাঞ্চল, খনি, সেচ, বন, পশুপালন এবং বাণিজ্যপথ। এগুলির মধ্যে গ্রামাঞ্চলে ভূমির ওপর প্রযোজ্য কতিপয় করের, যেমন স্বত্ব (রাজভূমিজাত পণ্য থেকে সংগৃহীত রাজস্ব), ভাগ (ব্যক্তিগত ভূমিজাত পণ্যের এক-ষষ্ঠাংশ), বলি (উপহার বা চাহিদা হিসেবে রাজপ্রাপ্তি), কর (ফল ও বৃক্ষ থেকে রাজাকে প্রদত্ত পর্যাবৃত্ত কর), ইত্যাদি। ভারতের মুসলিম শাসনামলে (১২০৬-১৭৫৭) প্রাচীন কালের ভূমির ওপর করারোপের পদ্ধতির তেমন পরিবর্তন হয়নি, তবে করের পরিমাণ কখনও উৎপাদিত পণ্যের এক-তৃতীয়াংশে, কখনওবা অর্ধাংশে বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনামলেও (১৭৫৭-১৯৪৭) ভারতীয় প্রশাসনিক ব্যয় নির্বাহের জন্য ভারতের সনাতনী ভূমিকর ব্যবস্থা বলবৎ রাখা হয়। ব্রিটিশরা  জমিদার সৃষ্টি করে তাদের মাধ্যমে প্রত্যেক প্রজার কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করে। সাধারণত উৎপাদিত পণ্যের ভিত্তিতে কর নির্ধারণ করা হতো, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর আদায় ছিল দমনমূলক এবং অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদিত পণ্যের অর্ধেকেরও বেশি কর হিসেবে আদায় করা হতো। ১৭৯৩ সালের  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের মাধ্যমে বাংলায় জমিদারদের জন্য কর নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ১১ ভাগের ১ ভাগ। ১৯৫২ সালে জমিদারি প্রথা বাতিল হলেও বাংলাদেশের বর্তমান ভূমি রাজস্ব পদ্ধতি সৃষ্টি হয়েছে পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ থেকে। স্বাধীনতার পূর্বে কৃষি জমি থেকে সরকারের রাজস্ব চাহিদা ছিল একর প্রতি ৬.৪৭ টাকা, এর মধ্যে ৩.৭৫ টাকা ভূমি রাজস্ব এবং ২.৭২ টাকা অন্যান্য কর (উন্নয়ন ও ত্রাণ কর এবং স্থানীয় অভিকর)। ১৯৭২ সনে সরকার রাষ্ট্রপতির আদেশবলে ২৫ বিঘা (৮.৩৩ একর) পর্যন্ত ভূমি রাজস্ব মওকুফ করে দিলে, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকদের অন্যান্য কর হিসেবে একর প্রতি ২.৭২ টাকা এবং ২৫ বিঘার অধিক জমির মালিকদের পূর্বের মতো একর প্রতি মোট ৬.৪৭ টাকা ভূমি রাজস্ব ও অন্যান্য কর বাবদ দিতে হতো। ১৯৭৬ সালে ভূমি উন্নয়ন কর অধ্যাদেশ জারি করে ভূমির ওপর প্রযোজ্য সব ধরনের করকে একীভূত করে ভূমি উন্নয়ন কর নাম দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পরপর ভূমি রাজস্ব ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। তখনকার আদায়কারী অফিসসমূহের উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং কর-ভিত্তির ব্যাপক হ্রাসকরণের ফলে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। ১৯৭২-৭৩ সনে ভূমি রাজস্ব ছিল মাত্র ২.৫ কোটি টাকা (মোট করের ১.৫%)। এরপর টাকার অঙ্কে ভূমি রাজস্ব ক্রমেই বেড়েছে। ১৯৯৭-৯৮ সালে ভূমি রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ১৬১.৪ কোটি টাকা (মোট করের ১.১%) এবং ২০০১-০২ সনের মূল বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ২৩৩ কোটি টাকা (মোট করের ১.১%) এবং ২০০৯-১০ অর্থবছরে ভূমিকরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৯০ কোটি টাকা (মোট করের মাত্র ০.৮%)।

হস্তান্তরিত সম্পত্তির মূল্যের ওপর প্রযোজ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর হলো নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, যা ১৮৯৯ সালের স্ট্যাম্প আইনের মাধ্যমে আরোপ করা হয়। বর্তমানে প্রচলিত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প শুল্ক ১৯৯৮ সালের অর্থ আইনের প্রথম তফশিলে প্রদত্ত হার মোতাবেক আরোপ করা হয়। এ হার বর্তমানে সর্বনিম্ন ৪ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০,০০০ টাকা এবং মূল্যভিত্তিক হার হিসেবে প্রতিদান মূল্যের ০.০৭% থেকে ১.৫%। জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প বর্তমানে আদালত ফি আইন ১৮৭০ অনুসারে ধার্য করা হয়, যদিও আদালত ফি আরোপ প্রক্রিয়াটি প্রবর্তিত হয়েছে ১৭৯৫ সনের বঙ্গীয় প্রবিধান নং ৩৮ জারির মাধ্যমে।

বর্তমান শুল্কায়ন পদ্ধতির উদ্ভব হয়েছে সমুদ্র শুল্ক আইন ১৮৭৮ প্রণয়নের মাধ্যমে। ভূমি শুল্ক আইন ১৯২৪ সালে প্রবর্তন করা হয় স্থলপথে পণ্য ও যাত্রীদের চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য। বহিঃশুল্ক আরোপ ও এ-সংক্রান্ত বিষয়সমূহ সমন্বিত করে বহিঃশুল্ক আইন ১৯৬৯ জারি করা হয়, যা বাংলাদেশে ১৯৭০ সালে জানুয়ারি থেকে কার্যকর ছিল।

দেশে উৎপাদিত পণ্য ও লবণের ওপর আবগারি শুল্ক ধার্যের জন্য ১৯৪৪ সালে জারীকৃত আবগারি ও লবণ আইনের মাধ্যমে বর্তমানে আবগারি শুল্ক আরোপ করা হয়। ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে মূসক চালুর আগে আবগারি শুল্ক ছিল রাজস্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস (মোট রাজস্বের প্রায় ২২%), কিন্তু ১৯৯১-৯২ সালে আবগারি শুল্কযোগ্য ৯৯টি আইটেমের মধ্যে ৭৪টি আইটেম মূসকের আওতায় নেওয়া হয়। ১৯৪৪ সালের আবগারি ও লবণ আইনের প্রথম তফশিলের অন্তর্ভুক্ত দ্রব্য ও সেবার ওপরে উক্ত তফশিলে উল্লেখিত হারে আবগারি শুল্ক আরোপ করা হয়। ২০০৪ সালে উক্ত আইনের প্রথম তফশিলের প্রথম অংশ বাতিল করা হয়। ফলে ২০০৪-০৫ অর্থবৎসর থেকে কোন প্রচলিত দ্রব্যের উপর আবগারি শুল্ক প্রযোজ্য থাকলো না। এখন কেবল দুটো সেবাখাতে সীমিত আকারে আবগারি শুল্ক প্রযোজ্য। ব্যাংকে আমানত সংরক্ষণের মাধ্যমে দেয়া সেবা; অভ্যন্তরীণ রুটে এককালীন বিমানে ভ্রমণে টিকিট প্রদানের মাধ্যমে প্রদত্ত সেবা। সকল ধরনের উৎপাদিত মদের ওপর  মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০-এর দ্বিতীয় তফশিলে উল্লেখিত হারে মাদক শুল্ক আরোপ করা হয় এবং এক্ষেত্রে মূসক বা আবগারি শুল্ক প্রযোজ্য নয়।

বিক্রয় কর ভারতের পূর্বতন কেন্দ্রীয় প্রদেশসমূহে প্রথম চালু করা হয় ১৯৩৮ সালে। বাংলায় বিক্রয় কর প্রথম আরোপ করা হয় ১৯৪১ সালে। ১৯৪৮ সালে বিক্রয় করকে সাধারণ বিক্রয় কর আইন ১৯৪৮-এর আওতায় কেন্দ্রীয় কর হিসেবে রূপান্তর করা হয়। উক্ত আইন বাতিল করে নতুন বিক্রয় কর আইন ১৯৫১ সালের জুলাই থেকে কার্যকর করা হয়। বিক্রয় কর অধ্যাদেশ ১৯৮২ জারি করা পর্যন্ত ১৯৫১ সালের আইনটি চালু ছিল। উক্ত বিক্রয় কর অধ্যাদেশ ১৯৮২ ও কারবারি টার্নওভার কর অধ্যাদেশ ১৯৮২ বাতিল করে ১৯৯১ সনের ১ জুলাই থেকে তিনটি কর আদায়ের জন্য মূসক, সম্পূরক শুল্ক ও টার্নওভার কর চালু করা হয়। বর্তমানে মূসক-নিবন্ধিত ব্যক্তি, যাদের বার্ষিক টার্নওভার (মোট বিক্রয়) ২০ লক্ষ টাকা বা তার বেশি, তাদের কাছ থেকে করযোগ্য পণ্য ও সেবার আমদানি এবং উৎপাদন ও বণ্টন প্রক্রিয়ার সকল স্তরে মূল্য সংযোজনের ওপর ১৫% হারে মূসক আদায় করা হয়। করযোগ্য পণ্য ও সেবার বার্ষিক টার্নওভার ২০ লক্ষ টাকার কম হলে মোট টার্নওভারের ওপর ৪% হারে টার্নওভার কর আদায় করা হয়। বিলাস দ্রব্য, অত্যাবশ্যকীয় নয় এমন দ্রব্য এবং সামাজিকভাবে অনভিপ্রেত পণ্য ও সেবার ওপর ২০০৯-১০ সালে ২০%, ৩০%, ৪৫%, ৬০%, ১০০%, ২৫০%, ৩৫০%, এবং সেবা খাতের উপরে তিন ধরণের কর (১০%, ২৫% এবং ৩৫%) হারে সম্পূরক শুল্ক ধার্য করা হয়। রপ্তানির ওপর শূন্য-হারের মূসক প্রযোজ্য, অর্থাৎ রপ্তানির ওপর কোনো মূসক নেই, এমনকি রপ্তানি-পূর্ব স্তরসমূহে কোনো মূসক দেওয়া থাকলে তা ফেরৎ দেওয়া হয়। এছাড়া কর্তৃপক্ষ ১ অক্টোবর ২০০৪ থেকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আমদানীকৃত পণ্যের উপর অগ্রীম বাণিজ্য শুল্ক (এটিভি) আদায় করছে (২০১০ সালে এই হার ২.২৫%)।

উপমহাদেশে ১৮৫৭ সনের সিপাহি বিদ্রোহজনিত ব্যয় ঘাটতি পূরণের জন্য ১৮৬০ সালে ব্রিটিশরা প্রথম আয়কর চালু করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আয়কর আইন ১৯২২-এর অধীনে আয়কর ধার্য করা হয়। উক্ত আইন ১৯২১ সালে নিয়োজিত সর্বভারতীয় আয়কর কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রণীত হয়েছিল। বর্তমানে আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর অধীনে আয়কর আরোপ করা হয়। ১৯৭৯ সালের এপ্রিলে প্রদত্ত কর তদন্ত কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে উক্ত অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। আয়কর দাতাদের বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়: ব্যক্তি, অংশীদারি কারবার, অবিভক্ত হিন্দু পরিবার, ব্যক্তি সংঘ, কোম্পানি, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং অন্যান্য আইনের দ্বারা সৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিস্বত্ব। কর এবং করযোগ্য আয়ের আওতা করদাতার আবাসিক মর্যাদা (নিবাসী ও অনিবাসী) ভেদে আলাদা হতে পারে। করদাতারা ‘কর বিবরণ’ স্বনির্ধারণী অথবা সাধারণ পদ্ধতিতে (২০০৭-০৮ সালে নির্ধারিত মূল্যে) জমা দিতে পারে। বর্গীকৃত আয়কর বিবরণে করদাতাকে তার দেশিয় আয় ৯টি খাতে এবং বিদেশি আয়কে ১টি খাতে দেখাতে হয়। তবে কর্পোরেট নির্ধারণীর ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই পৃথকভাবে আবেদন করতে হবে এবং আয় ছয়টি খাতে দেখাতে হবে। আয়কর আরোপের কর-ভিত্তি হলো ‘মোট আয়’, যা ষষ্ঠ তফশিলের ক-অংশের বেশ কয়েকটি আয় বাদ দিয়ে নির্ণয় করা হয়। ব্যক্তি (অনিবাসী বাংলাদেশিসহ), অংশীদারি কারবার, অবিভক্ত হিন্দু পরিবার, ব্যক্তি সংঘ এবং অন্যান্য করদাতাদের (কোম্পানি, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং অনিবাসী বিদেশি ব্যতীত) ক্ষেত্রে ‘কর বিবরণ’ দাখিল করার জন্য একটি আয়সীমা রয়েছে। ২০০৮-০৯ কর বর্ষ থেকে যার পরিমাণ বার্ষিক মোট আয় ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ উক্ত আয়সীমা পর্যন্ত ‘কর বিবরণ’ দাখিল করার প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে প্রাথমিক আয়সীমা থেকে অব্যাহতি পেয়ে উচ্চতর সীমায় করপ্রদানের সুযোগ পাবেন কেবল মহিলা, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীরা। ২০০৯-১০ করবর্ষে করপ্রদান থেকে অব্যাহতির সীমা মহিলা এবং ৬৫ বছরের উর্ধ্বে করদাতাদের জন্য ১ লক্ষ ৮০ হাজার এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য ২ লক্ষ টাকা। এই গ্রুপের করদাতার যদি বাৎসরিক আয় ন্যূনতম করযোগ্য আয়সীমার কম থাকে তাহলে তিনি কর প্রদান থেকে অব্যাহতি পাবেন। তবে তিনি যদি কর প্রদানকারী হিসেবে চিহ্নিত নম্বরের (টিন) অধিকারী এবং ইতিমধ্যেই কর প্রদানযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন তাহলে কর রিটার্ন দাখিল করতে বাধ্য থাকবেন। যদি বাৎসরিক আয় উল্লেখিত করযোগ্য আয়ের বেশি হয় তাহলে ন্যূনতম ২০০০ টাকা কর প্রদান করবেন। ২০০৮-০৯ করবর্ষ থেকে করদাতার জন্য একটি প্রগতিশীল স্তরবিশিষ্ট করহার প্রযোজ্য যা হলো প্রথম বাৎসরিক আয়সীমা ২ লক্ষ ৭৫ হাজার ১০%, পরবর্তী ৩ লক্ষ ২৫ হাজারের জন্য ১৫%, ৩ লক্ষ ৭৫ হাজারের জন্য ২০% এবং অবশিষ্ট আয়ের জন্য ২৫%। করদাতারা কিছু নির্ধারিত বিনিয়োগ বা অনুদানের উপরে ১০% হারে কর-রেয়াত পেয়ে থাকে। তবে উক্ত বিনিয়োগ বা অনুদানের পরিমাণ ১০ লক্ষ টাকার বেশি হবে না এবং তা কোনো অবস্থাতেই মোট আয়ের ২৫%-এর বেশি হবে না। তবে নিয়োগ কর্তার দেখা কোনো স্বীকৃত ভবিষ্যনিধিতে অনুদান এবং স্বীকৃত কোনো ভবিষ্যনিধির পূঞ্জিভূত ব্যালান্সের করযোগ্য সুদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে না। তাছাড়া ব্যক্তি করদাতাকেই ‘কর নিবরণ’-এর সাথে সাথে সম্পদ ও দায় (আই.টি-১০বি) এবং জীবন যাপনের উপর বিস্তারিত বিবিরণ (আই টি-১০বি বি) দাখিল করতে বাধ্য হবে। অপরাপর বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি অবশ্যই কর বিবরণ দাখিল করবে।

২০০৯-১০ কর বৎসর থেকে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে আয়করের হার হলো লভ্যাংশ আয়ের ওপর ২০%, প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তর থেকে মূলধনী লাভের উপর ১০%, অন্যান্য মূলধনী দ্রব্য হস্তান্তর থেকে প্রাপ্ত মূলধনী লাভের উপর ১৫%। ব্যাংক, ইনসুরেন্স এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের বিশেষ করের হার হলো ৪২.৫%; মোবাইল কোম্পানী যদি স্টক এক্সচেঞ্জভুক্ত হয় তবে ৩৫% শেয়ার বাজারে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করে ১০% শেয়ার হস্তান্তর সাপেক্ষ্যে। নতুবা ৪৫% যদি সিকিউরিটি ও এক্সচেঞ্জ কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত ১০% লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয় এবং তা নির্ধারিত সময়ে যথারীতি প্রদান করা হয়। এবং অন্যান্য নিবন্ধিকৃত কোম্পানীর ক্ষেত্রে ৩৭.৫%। অনিবাসী ব্যক্তি করদাতাদের (বাংলাদেশি বাদে) ক্ষেত্রে মোট আয়ের ওপর করের হার ২৫%। অনেক ক্ষেত্রে আয় প্রদানকারী বা বিল-পরিশোধকারী ব্যক্তি উৎসে আয়কর কর্তন বা সংগ্রহ করে থাকে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান, পর্যটন শিল্প বা ভৌত অবকাঠামোগত সংস্থানকে (এগুলির ‘সম্প্রসারিত এককসহ) কতগুলি শর্ত পালন সাপেক্ষে ২০১১ সাল পর্যন্ত কর অবকাশ ৪ থেকে ৬ বছরের জন্য (ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের জন্য ৪ বছর পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩টি জেলা এই আওতার বাইরে), অপরাপর অঞ্চলের জন্য ৬ বছর কর রেয়াত প্রদান করা হয়। এ কর অবকাশ ত্বরিত অবচয়-এর বিকল্প হিসেবে দেওয়া হয়। কতগুলি শর্তপালন সাপেক্ষে ৫ বৎসরের জন্য নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালকেও কর অবকাশ প্রদান করা হয়। সাধারণভাবে, রপ্তানি আয়ের অর্ধেক কর নির্ধারণ যোগ্য নয় এবং কর ভিত্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় না। কিন্তু রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান আরও কিছু বিশেষ সুবিধা পায়, যেমন অগ্রবর্তী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কর অবকাশ প্রদান এবং কর অবকাশ-কাল শেষ হওয়ার পরও রপ্তানি আয়ের অর্ধেককে কর নির্ধারণ যোগ্য গণ্য না করা। বাংলাদেশ সরকার বিদেশি সরকার কিংবা ঐদেশের কোন কোম্পানি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চাইলে চুক্তি অনুযায়ী তারাও কর অবকাশ পাবেন। মৎস্য খামার, হাঁস-মুরগির খামার, হাঁস-মুরগির জন্য দানাদার খাবার উৎপাদন, বীজ উৎপাদন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বীজ বিপণন, গবাদি পশুর খামার, দুগ্ধ এবং দুগ্ধজাত দ্রব্যের খামার, ব্যাঙ উৎপাদন খামার, উদ্যান খামার প্রকল্প,  তুঁত গাছের চাষ,  রেশম গুটিপোকা পালনের খামার, মাশরুম উৎপাদন খামার এবং ফুল ও লতাপাতার চাষ থেকে উদ্ভূত আয়ও ২০১১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কর অবকাশ পাচ্ছে। ২০০৯ সালের জুলাই থেকে বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি উদ্যেক্তাদের উৎপাদিত করতে ১৫ বৎসর পর্যন্ত কর রেয়াত দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। (তবে এসব কোম্পানিকে ২০১২ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে)। এছাড়াও এই ধরণের কোম্পানিতে কর্মরত বিদেশিদের আয়ের উপর, কোম্পানির প্রযুক্তিগত ব্যয়ের উপর এবং কোম্পানির যন্ত্রাদি ক্ষয়ের উপর কর ৩ বৎসর পর্যন্ত রেয়াত করা হয়। শিল্পায়নকে উৎসাহিত করতে ১৯৫৯-৬০ সাল থেকে (১৯৭২-৭৩ ও ১৯৭৩-৭৪ সাল বাদে) কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে কর অবকাশের বিকল্প হিসেবে গৃহীত কর্মসূচিতে শিল্পকারখানার জন্য (জুলাই ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত) কর হ্রাসের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেই মোতাবেক ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে (বান্দরবন, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পাহাড়ি জেলা ব্যতিত) প্রথম ৫ বছরের জন্য ৫% থেকে ১৫% এবং অন্যান্য অঞ্চলের জন্য প্রথম ৬ বছর ৫% থেকে ১০%।

১৯৬৩ সাল থেকে (১৯৮৫-৮৬ থেকে ১৯৮৯-৯০ সাল পর্যন্ত বাদে) আয়কর কর্তৃপক্ষ দান কর আদায় করছে। এ কর বর্তমানে দান কর আইন ১৯৯০-এর অধীনে দাতা কর্তৃক প্রদেয়। তবে করযোগ্য দান শুধু দেশিয় সম্পদের মাধ্যমে হতে হবে এবং স্বামী-স্ত্রী, রক্তের সম্পর্কের পারিবারিক সদস্য ও নির্ভরশীল আত্মীয়, সরকার স্বীকৃত শিক্ষা, ধর্মীয়, দাতব্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং আরও কিছু নির্ধারিত ব্যক্তিকে দান করা হলে তা করযোগ্য নয়। আয়করের মতো, করযোগ্য দানের ক্ষেত্রেও একটি ক্রমবর্ধমান স্তরবিশিষ্ট করহার প্রযোজ্য, যা হলো করযোগ্য দানের প্রথম ৫ লক্ষ টাকার ওপর ৫%, পরবর্তী ১০ লক্ষ টাকার ১০%, পরবর্তী ২০ লক্ষ টাকার ১৫% এবং পরবর্তী অবশিষ্ট করযোগ্য দানের ওপর ২০%।

বিদেশ ভ্রমণ কর ১৯৮০-৮১ সালে চালু করা হয়েছে। বিমানে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিমানসংস্থাগুলি বিমান টিকেটের মাধ্যমে উক্ত কর সংগ্রহ করে। ২০০৪ সাল থেকে ভ্রমণ কর আদায় করা হয়ে থাকে। ২০০৩ সালের ভ্রমণ কর আইন অনুযায়ী প্রত্যেক বাংলাদেশীর জন্য এক্ষেত্রে করহার হলো: উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দূরপ্রাচ্যের কোনো দেশের জন্য ২৫,০০ টাকা, সার্কভুক্ত দেশের জন্য ৮০০ টাকা এবং অন্যান্য দেশের জন্য ১,৮০০ টাকা। স্থলপথে বিদেশ ভ্রমণের জন্য এ হার প্রতি বাংলাদেশীর জন্য ৩০০ টাকা এবং সমুদ্রপথে বিদেশ ভ্রমণের জন্য ৫০০ টাকা। ২০০৪ সালের জুন থেকে আন্তর্জাতিক বিমানের বিমান টিকেট ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রতি বিমান টিকেটের জন্য ২০০ টাকা কর দিতে হয়।

পরোক্ষ করের ওপর অতি নির্ভরশীলতার জন্য বাংলাদেশ অসম কর ভার বন্টনে আক্রান্ত। কৃষিখাত থেকে খুবই কম কর আদায় হয়। ক্ষুদ্র কৃষক ও ভূমিহীনদের সংখ্যার ব্যাপকতা এবং কৃষিখাতকে কর অবকাশসহ অন্যান্য আয়কর সুবিধা দানের কারণে শুধু কৃষি আয়ের করদাতারা বাড়তি ৪০,০০০ টাকা পর্যন্ত কর নির্ধারনের যোগ্য নয় এমন আয়ের সুবিধা পায়। কার্যকর করহার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে অধিকতর আনুক্রমিক হারে বৃদ্ধি পায়; এটা ঘটে অঞ্চলভিত্তিক দুর্বহ করের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণে। গ্রামাঞ্চলে কৃষিখাতের আনুপাতিক ভূমি কর এবং শহরাঞ্চলে বর্ধিষ্ণু হারে আরোপিত আয়করই সবধরনের করের মধ্যে বেশি গুরুভার। সময় অতিক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে মাথাপিছু কর ১৯৭২-৭৩ সালের মাত্র ২৩ টাকা থেকে ১৯৯৫-৯৬ সনে প্রায় ১,০০০ টাকা, ২০০০-০১ সালে তা হয়েছে ১,৫০০ টাকা, ২০০৭-০৮ সালে ৩,৫০০ টাকা এবং ২০০৯-১০ সালে ৪,৪০০ টাকা।

বাংলাদেশে স্থানীয় পর্যায়ে খুবই সীমিত সম্পদ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। স্থানীয় সরকারের সম্পদের উৎস দুটি: ক. কর আদায় ও কর-বহির্ভূত বিভিন্ন উৎস থেকে ফি ও উপশুল্ক আদায় এবং হাট, বাজার, সায়রাত মহল ও পুকুরের আয় এবং খ. কেন্দ্রীয় সরকারের মঞ্জুরি। স্থানীয় সরকারসমূহ মূলত কেন্দ্রীয় সরকারের মঞ্জুরির ওপর নির্ভরশীল। পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন ছাড়া অন্যরা অল্প কয়েকটি উৎস থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করে থাকে। জেলা পরিষদের প্রধান রাজস্ব উৎস হলো অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর কর। ১৯৮৬-৮৭ সাল থেকে পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকার অস্থাবর সম্পত্তির প্রতিদানমূল্যের ১% এবং অন্যান্য এলাকার ক্ষেত্রে ০.৫% হারে উক্ত কর আদায় করা হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ প্রধানত চৌকিদারি কর আদায় করে, এ কর দ্বারা কর্মিবর্গের মজুরি ও বেতন ব্যয় নির্বাহ করা হয়। পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ধরনের রাজস্বের মধ্যে রয়েছে ভূমি ও দালানের বার্ষিক মূল্যের ওপর কর (যাকে সচরাচর পৌরকর বলে), পেশা, ব্যবসা ও জীবিকার ওপর কর, বিজ্ঞাপন কর, মোটরযান ও নৌকা ছাড়া অন্যান্য যানবাহনের ওপর কর এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শন, নাট্য মঞ্চায়ন ও থিয়েটার প্রদশ©র্নর ওপর কর, ইত্যাদি (ভোগের জন্য অথবা পৌরকর্পোরেশনের ব্যবহার বা বিক্রির জন্য আমদানি পণ্যের উপর কর ১৯৮২ সালে রহিত করা হয়েছে)। পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব উৎস থেকে তাদের মোট আয়ের তিন-চতুর্থাংশ সংগৃহীত হয়। অবশ্য কর খেলাপ ও ফাঁকির কারণে কর সংগ্রহ যথাপরিমাণ হয় না। [এম হবিবুল্লাহ এবং স্বপন কুমার বালা]