ভার্থেমা, লুডভিকো ডি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
৭ নং লাইন: | ৭ নং লাইন: | ||
ভার্থেমা ৬ ডিসেম্বর তুঙ্গাভদ্রার তীরে বিজয়নগরে পৌঁছেন। বিজয়নগর সম্পর্কে তিনি যে বর্ণনা দিয়েছেন তা বেশ চমকপ্রদ। শহরের পরিধি ছিল সাত মাইল এবং তিনটি প্রাচীর দ্বারা শহরটি বেষ্টিত ছিল। ‘পাগান’ ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তিনি সবসময়ে চল্লিশহাজার অশ্বারোহী সৈন্য প্রস্ত্তত রাখতেন। | ভার্থেমা ৬ ডিসেম্বর তুঙ্গাভদ্রার তীরে বিজয়নগরে পৌঁছেন। বিজয়নগর সম্পর্কে তিনি যে বর্ণনা দিয়েছেন তা বেশ চমকপ্রদ। শহরের পরিধি ছিল সাত মাইল এবং তিনটি প্রাচীর দ্বারা শহরটি বেষ্টিত ছিল। ‘পাগান’ ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তিনি সবসময়ে চল্লিশহাজার অশ্বারোহী সৈন্য প্রস্ত্তত রাখতেন। | ||
[[Image:VarthemaLudvicoDi.jpg|thumb|right|300px|লুডভিকো ডি ভার্থেমার গ্রন্থের প্রচ্ছদ]] | |||
বিজয়নগরে ঘোড়া বিক্রি হতো, এমনকি মাত্র এক স্বর্ণ মুদ্রায় (৮০০ পারদাই)। ভার্থেমার কাছে বিজয়নগরকে মনে হয়েছে মিলান শহরের মতো। এখানে রাজাকে রাজস্ব দিতে হতো প্রত্যেকদিন ১২,০০০ পারদাই। | বিজয়নগরে ঘোড়া বিক্রি হতো, এমনকি মাত্র এক স্বর্ণ মুদ্রায় (৮০০ পারদাই)। ভার্থেমার কাছে বিজয়নগরকে মনে হয়েছে মিলান শহরের মতো। এখানে রাজাকে রাজস্ব দিতে হতো প্রত্যেকদিন ১২,০০০ পারদাই। | ||
০৪:২৩, ১ মার্চ ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
ভার্থেমা, লুডভিকো ডি (১৪৭০-১৫১৭) বোলোগনার অধিবাসী এবং সম্ভবত একজন চিকিৎসকের সন্তান। তিনি ১৫০২ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে স্থলপথে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পর্তুগিজ সরকার কর্তৃক নাইট উপাধি প্রাপ্ত লুডভিকো ডি ভার্থেমা কোচিনে পর্তুগিজ বাণিজ্যের দালাল হিসেবে কাজ করেন এবং ভারতে পর্তুগিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের প্রচেষ্টা এবং সেই সাথে ভারতে বসবাসরত জনগণের রেওয়াজ-রীতি সম্পর্কে এক বিস্তারিত বিবরণ রেখে গেছেন।
ভার্থেমা ভারতে আসার পথে কায়রো, বৈরুত, দামেস্ক ও মক্কা ভ্রমণ করেন। মক্কাতে তিনি খ্রিস্টান গুপ্তচর হিসেবে বন্দি হন। আরবি ভাষায় পারদর্শিতা ও মুসলিম চালচলন প্রদর্শন করে ভার্থেমা আফ্রিকার উত্তর-পশ্চিম উপকূলের দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। সেখান থেকে তিনি দিউগামী এক জাহাজে উঠে পড়েন। পথে তিনি হরমুজে যাত্রা বিরতি করেন এবং সেখান থেকে জাহাজযোগে ক্যাম্বের উদ্দেশ্যে রওনা হন। ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর তিনি ক্যাম্বে পৌঁছেন। সেখানে তিনি সুতি এবং সেই সাথে রেশম-সুতি মিক্সড বস্ত্রের বিশাল উৎপাদন লক্ষ্য করেন। এখান থেকে এই সমস্ত বস্ত্র বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। তিনি বেশ অবাক হয়ে উল্লেখ করেছেন যে, সুলতান মুহম্মদ বেগারা খানের এত বড় গোঁফ ছিল যে, তিনি সেটি মাথার পিছনে বেঁধে রাখতেন। অধিবাসীরা কখনও প্রাণী হত্যা করত না এবং তারা না ছিল হিন্দু না মুসলমান।
ভার্থেমা এরপর চোল, দভোল, গোয়া ও বিজাপুর যান। বিজাপুরে তিনি একটি সুন্দর প্রাসাদ প্রত্যক্ষ করেন। সেখানে তিনি একজন উদার রাজারও সাক্ষাৎ পান, যিনি তখন বিজয়নগরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। এরপর তিনি বিজয়নগরের একটি বন্দর সদাশিবগড় যান এবং সেখান থেকে অঞ্জদিব দ্বীপে যান। ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দের ১৮ নভেম্বরের দিকে তিনি তৎকালীন বিজয়নগরের অধীন বন্দর হোনাভার পৌঁছেন। তিনি ম্যাঙ্গালোর বন্দরের কথাও উল্লেখ করেন, যেখান থেকে ৫০/৬০টি জাহাজে চাল বোঝাই করা হতো। পর্তুগিজদের নির্মিত ক্যানানোর বন্দরের প্রতি তার ভালোলাগার কথাও তিনি বলেছেন। এই বন্দরে পর্তুগিজরা ঘোড়া আনত বিজয়নগরে বিক্রি করার জন্য। এই শহরে তিনি বহু মুসলিম বণিক দেখেন।
ভার্থেমা ৬ ডিসেম্বর তুঙ্গাভদ্রার তীরে বিজয়নগরে পৌঁছেন। বিজয়নগর সম্পর্কে তিনি যে বর্ণনা দিয়েছেন তা বেশ চমকপ্রদ। শহরের পরিধি ছিল সাত মাইল এবং তিনটি প্রাচীর দ্বারা শহরটি বেষ্টিত ছিল। ‘পাগান’ ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং তিনি সবসময়ে চল্লিশহাজার অশ্বারোহী সৈন্য প্রস্ত্তত রাখতেন।
বিজয়নগরে ঘোড়া বিক্রি হতো, এমনকি মাত্র এক স্বর্ণ মুদ্রায় (৮০০ পারদাই)। ভার্থেমার কাছে বিজয়নগরকে মনে হয়েছে মিলান শহরের মতো। এখানে রাজাকে রাজস্ব দিতে হতো প্রত্যেকদিন ১২,০০০ পারদাই।
এরপর তিনি ধর্মপতনম যান। এই বন্দরটি মূলত মুসলমান বণিকেরাই ব্যবহার করত। ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি তিনি কালিকট পৌঁছেন। তাঁর বিবরণে কালিকটের বর্ণনাই ছিল দীর্ঘতম। এখানে ‘সমুদ্রের ঢেউ ঘরের প্রাচীরে হিল্লোল তোলে’। বন্দরটি ছিল শহরের এক মাইল দক্ষিণে। একটি ছোট নদী কালিকটের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে। শহরের কোন প্রতিরক্ষা প্রাচীর ছিল না এবং ঘর-বাড়ি এক মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সমগ্র অঞ্চল ছয় মাইলের বেশি হবে না। গরিব জনগণের বাড়ি-ঘর বলতে ছিল খড়ের ছাওয়া কুঁড়েঘর। ভার্থেমা কালিকটের ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় কার্যকলাপ এবং জাহাজ নির্মাণের বর্ণনা দেন। পর্তুগিজদের আগমনের সময়ে দেশীয়দের এ ধরনের উদ্যোগের ওপর এ বর্ণনা ছিল বিরল। আধা মাইল পরিধির উপর স্থাপিত হলেও রাজার প্রাসাদটি ভার্থেমাকে আকৃষ্ট করতে পারে নি। প্রাসাদের মেঝেগুলিতে ছিল গোবরের প্রলেপ। রাজার নাম ছিল জামোরিন। তিনি ছিলেন ভারতের ধনীদের একজন। এখানকার প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য হলো গোলমরিচ ও আদা। উৎপাদিত ফলের মধ্যে ছিল কাঁঠাল, আম, নারকেল ও কলা। এখানে উন্নতমানের তেল ও মদ উৎপন্ন হতো। মহিলারা একাধিক স্বামী গ্রহণ করতে পারতেন। বণিকদের মধ্যে বহুস্ত্রী রাখাই ছিল প্রচলিত রীতি। বেশিরভাগ বণিকই ছিলেন হিন্দু।
কালিকটে বাঁধ দিয়ে আটকানো নদীর মধ্য দিয়ে ভ্রমণ করে ভার্থেমা নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টান অধ্যুষিত কল্যাণকুলাম শহরে পৌঁছেন। সেখান থেকে তিনি তেনাসেরিম (বর্তমানে মারগুই) হয়ে নেগাপটনম ও সিংহল পৌঁছেন। সে সময়ে তেনাসেরিমের হিন্দু রাজা বিজয়নগর ও বাংলার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। সেখানে বেশ কিছু সংখ্যক মুসলিম বণিক আলাদা একটি এলাকায় বসবাস করত। মারগুই থেকে এগারো দিনের যাত্রা শেষে ১৩ মার্চ ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দে ভার্থেমা বেঙ্গালা পৌঁছেন। সাধারণভাবে এই বেঙ্গালাকে সপ্তগ্রামের সাথে শনাক্ত করা হয়। এখানে সুলতান (আলাউদ্দীন হোসেন শাহ) মুসলিম পদাতিক বাহিনী প্রস্ত্তত রেখেছিলেন। তিনি তখন বিজয়নগরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। এখানকার ধনী বণিকগণ বছরে পঞ্চাশটির মতো জাহাজ সুতি ও রেশম বস্ত্রে বোঝাই করত। এই সমস্ত মালামাল, যার মধ্যে কিছু ছিল মসলিন, তুরস্ক, সিরিয়া, পারস্য, আরব, ইথিওপিয়া ও সমগ্র ভারতে রপ্তানি হতো। আমদানি দ্রব্যের মধ্যে ছিল বিভিন্ন রত্ন। ভার্থেমা লক্ষ্য করেছেন যে, নেসটোরিয়ান খ্রিস্টানরা এই রত্ন ব্যবসায় জড়িত ছিলেন। তারা জুতা পরতেন না। ভার্থেমার বক্তব্য অনুসারে সপ্তগ্রাম হলো বসবাসের জন্য দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ স্থান। এখান থেকেই তিনি পেগুর উদ্দেশ্যে জাহাজে উঠেন।
১৫০৫ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল পেগু পৌঁছে ভার্থেমা মালাক্কা, সুমাত্রা, বন্ড, মোলুকাস দ্বীপপুঞ্জ, জাভা ঘুরে পুনরায় ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ কালিকট পৌঁছেন। এ সময় কালিকট ও পর্তুগিজদের মধ্যে নৌযুদ্ধ চলছিল। ভার্থেমা এ যুদ্ধের বিবরণ দেন। তিনি ১৫০৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর কোচিন ত্যাগ করেন এবং মোজাম্বিক ও লিসবন হয়ে ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে রোমে প্রত্যাবর্তন করেন।
Itinerario de Ludouico de Varthema Bolognese নামে তাঁর গ্রন্থটি রোম থেকে ইটালিয়ান ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে এবং অল্পদিনের মধ্যেই বেশ কয়েকবার পুনর্মুদ্রন করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ল্যাটিন ও জার্মান ভাষায় এই বই প্রথম প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৫১১ ও ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে। স্পেনিশ, ফরাসি ও ওলন্দাজ ভাষায় এটি প্রথম মুদ্রিত হয় যথাক্রমে ১৫২০, ১৫৫৬ ও ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে রিচার্ড ইডেন এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ১৮৬৩ সালে জন উইনটার জোনস ১৫১০ খ্রিস্টাব্দের ইটালিয়ান মুদ্রণ থেকে বইটি ‘The Travels of Ludovico di Varthema in Egypt Syria, Arabia, Deserta and Arabia Felix, Persia, India and Ethiopia, AD 1503 to 1508’ নামে ইংরেজি অনুবাদ করেন। এ সময়ের মধ্যে আরও অনেক ভাষায় এর মুদ্রণ সম্পন্ন হয়েছিল। ভার্থেমার বিবরণের সত্যতা প্রথমবারের মতো বিতর্কের মাঝে আসে গার্সিয়া দ্য ওরটা-র ধারণায় এবং তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন দেন হেনরী ইউল ও অন্যান্য আরও কয়েকজন পন্ডিত। ভার্থেমার বিবরণকে আপাত দৃষ্টিতে ন্যায়সঙ্গত মনে করা হয়ে থাকে, যদিও ভার্থেমা তাঁর অভিযানকে প্রায় সময়েই গল্প আকারে বর্ণনা করার পক্ষে তাঁর প্রবণতা প্রকাশ করেছেন।
ভার্থেমার বিবরণের গুরুত্ব এখানে যে, তিনি এদেশের মানুষের আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, এখানকার উৎপাদিত পণ্যদ্রব্য এবং ভারতে পর্তুগিজদের প্রাধান্য স্থাপনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেন। তিনি যে বিবরণে রেখে গেছেন তা থেকে বেশ কিছু সংখ্যক নেস্টোরিয়ান খ্রিস্টানের উপস্থিতি ও মুসলমান বণিকের বলিষ্ঠ বাণিজ্যিক তৎপরতা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। ঐ আমলের জাহাজ ও নৌকা সম্পর্কে যে সকল বিবরণ রয়েছে সেগুলির মধ্যে তাঁর প্রদত্ত বিবরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। [অনিরুদ্ধ রায়]
গ্রন্থপঞ্জি JH Jones (tr.), The Itinerary of Ludvico Di Varthema of Bologna, with a discourse by RC Temple, AES, 1997 (Indian ed, reprint of 1863 ed.); EF Oaten, European Travellers in India, Indian ed, Lucknow, 1973, reprinted from 1909 ed.