প্রথা ও ঐতিহ্য: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
৩ নং লাইন: | ৩ নং লাইন: | ||
[[Image:PaddyHervesting.jpg|thumb|400px|right|হেমন্তে ধান কাটা]] | [[Image:PaddyHervesting.jpg|thumb|400px|right|হেমন্তে ধান কাটা]] | ||
গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিতে নতুন ধানের একটি প্রধান উৎসব হচ্ছে [[নবান্ন|নবান্ন]] এবং এটি আয়োজিত হয় অগ্রহায়ণ মাসে যখন প্রচুর ফসল ঘরে আসে। এ সময়টি দীর্ঘ গ্রীষ্ম এবং বন্যার প্রকোপমুক্ত শীতের প্রারম্ভকাল। পুরুষরা তখন মাঠ থেকে পাকাধান মাড়াইয়ের জন্য বাড়ি নিয়ে আসে। মেয়েরা নতুন চালের পিঠা বানিয়ে খেজুরের রস ও দুধে ভিজিয়ে সকলকে আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাঠে-ঘাটে বন্যার পানি কমতে থাকলে জেলেদের জালে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। চারদিকে তখন আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করে। স্বল্প শীতের এই মৌসুমে গ্রামে-গঞ্জে জমে ওঠে হাডুডু খেলা এবং ষাঁড়ের লড়াই। [[ক্রিকেট|ক্রিকেট]], ব্যাডমিন্টন এবং খোলা মাঠের আরও কিছু খেলাও তখন অনুষ্ঠিত হয়। | গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিতে নতুন ধানের একটি প্রধান উৎসব হচ্ছে [[নবান্ন|নবান্ন]] এবং এটি আয়োজিত হয় অগ্রহায়ণ মাসে যখন প্রচুর ফসল ঘরে আসে। এ সময়টি দীর্ঘ গ্রীষ্ম এবং বন্যার প্রকোপমুক্ত শীতের প্রারম্ভকাল। পুরুষরা তখন মাঠ থেকে পাকাধান মাড়াইয়ের জন্য বাড়ি নিয়ে আসে। মেয়েরা নতুন চালের পিঠা বানিয়ে খেজুরের রস ও দুধে ভিজিয়ে সকলকে আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাঠে-ঘাটে বন্যার পানি কমতে থাকলে জেলেদের জালে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। চারদিকে তখন আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করে। স্বল্প শীতের এই মৌসুমে গ্রামে-গঞ্জে জমে ওঠে হাডুডু খেলা এবং ষাঁড়ের লড়াই। [[ক্রিকেট|ক্রিকেট]], ব্যাডমিন্টন এবং খোলা মাঠের আরও কিছু খেলাও তখন অনুষ্ঠিত হয়। | ||
বাঙালির প্রিয় পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ দিনটি এপ্রিলের মাঝামাঝি পড়ে এবং সারা দেশে উৎসবের মাধ্যমে পালিত হয়। এই দিনটির শুরু হয় ইলিশ মাছ ও সবজি দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার মাধ্যমে অথবা চিড়া-গুড় ও দইয়ের নাস্তা দিয়ে। পুরুষ-নারী এবং শিশুরা নতুন কাপড় পরে বটের তলায় বা নদীর ধারে অনুষ্ঠিত মেলায় যায়। এসব মেলায় হরেক রকমের ব্যবহারিক জিনিসপত্র, বহু রকমের খাবার, মিষ্টি ও বাচ্চাদের খেলনা পাওয়া যায়। সকল শ্রেণির লোকদের আনন্দের জন্য থাকে নাগরদোলা, ঘোড়ায় চড়া, ভাগ্য পরীক্ষার খেলা, যাত্রা, পুতুলনাচ। সকল ব্যবসায়ী দিনটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে এবং এদিন তারা হালখাতা খোলে। সৌভাগ্যের চিহ্নস্বরূপ হিন্দুরা এসব খাতায় [[সিঁদুর|সিঁদুর]] মাখিয়ে দেয়। শহর এলাকায়ও পয়লা বৈশাখ জনপ্রিয়। ঢাকায় দিনটি বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে গান-বাজনা, শোভাযাত্রা এবং মেলার মাধ্যমে পালন করা হয়। কোন কোন মেলা এক সপ্তাহ ধরে চলে। প্রায়ই দেখা যায় এ দিনটির শেষে প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড় এবং প্রচুর বৃষ্টি হয়। এ ঝড়ে জান-মালের ক্ষতিও হয়, তবে তা গ্রীষ্মের দাবদাহ একেবারেই কমিয়ে আনে। | বাঙালির প্রিয় পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ দিনটি এপ্রিলের মাঝামাঝি পড়ে এবং সারা দেশে উৎসবের মাধ্যমে পালিত হয়। এই দিনটির শুরু হয় ইলিশ মাছ ও সবজি দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার মাধ্যমে অথবা চিড়া-গুড় ও দইয়ের নাস্তা দিয়ে। পুরুষ-নারী এবং শিশুরা নতুন কাপড় পরে বটের তলায় বা নদীর ধারে অনুষ্ঠিত মেলায় যায়। এসব মেলায় হরেক রকমের ব্যবহারিক জিনিসপত্র, বহু রকমের খাবার, মিষ্টি ও বাচ্চাদের খেলনা পাওয়া যায়। সকল শ্রেণির লোকদের আনন্দের জন্য থাকে নাগরদোলা, ঘোড়ায় চড়া, ভাগ্য পরীক্ষার খেলা, যাত্রা, পুতুলনাচ। সকল ব্যবসায়ী দিনটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে এবং এদিন তারা হালখাতা খোলে। সৌভাগ্যের চিহ্নস্বরূপ হিন্দুরা এসব খাতায় [[সিঁদুর|সিঁদুর]] মাখিয়ে দেয়। শহর এলাকায়ও পয়লা বৈশাখ জনপ্রিয়। ঢাকায় দিনটি বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে গান-বাজনা, শোভাযাত্রা এবং মেলার মাধ্যমে পালন করা হয়। কোন কোন মেলা এক সপ্তাহ ধরে চলে। প্রায়ই দেখা যায় এ দিনটির শেষে প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড় এবং প্রচুর বৃষ্টি হয়। এ ঝড়ে জান-মালের ক্ষতিও হয়, তবে তা গ্রীষ্মের দাবদাহ একেবারেই কমিয়ে আনে। | ||
[[Image:Paddy.jpg|thumb|400px|left|ধান শুকানো]] | |||
বাংলাদেশের সমাজে এখনও যৌথ পরিবারের প্রাধান্য বিদ্যমান। এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নারী ও বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ছোটদের প্রতি ভালবাসা ও স্নেহ-যত্ন প্রদর্শন। ছেলেমেয়ে বা আত্মীয়-স্বজনের পরিবারবর্গ বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা-যত্ন করে। তাদের দোয়ায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয় বলে সবাই বিশ্বাস করে। মুসলমানরা তাদের মুরুবিবদের ইসলামি কায়দায় ডান হাত উঁচু করে সালাম দেয় এবং হিন্দুরা করজোড়ে নমস্কার করে। খ্রিস্টানরা সুপ্রভাত বা শুভদিন বলে অভিবাদন করে। সন্তানের জন্ম হলে আত্মীয়-পরিজন এবং বন্ধুদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। শিশুর নামকরণের জন্য [[আকিকা|আকিকা]] বা [[অন্নপ্রাশন|অন্নপ্রাশন]] অনুষ্ঠান করে ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। | বাংলাদেশের সমাজে এখনও যৌথ পরিবারের প্রাধান্য বিদ্যমান। এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নারী ও বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ছোটদের প্রতি ভালবাসা ও স্নেহ-যত্ন প্রদর্শন। ছেলেমেয়ে বা আত্মীয়-স্বজনের পরিবারবর্গ বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা-যত্ন করে। তাদের দোয়ায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয় বলে সবাই বিশ্বাস করে। মুসলমানরা তাদের মুরুবিবদের ইসলামি কায়দায় ডান হাত উঁচু করে সালাম দেয় এবং হিন্দুরা করজোড়ে নমস্কার করে। খ্রিস্টানরা সুপ্রভাত বা শুভদিন বলে অভিবাদন করে। সন্তানের জন্ম হলে আত্মীয়-পরিজন এবং বন্ধুদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। শিশুর নামকরণের জন্য [[আকিকা|আকিকা]] বা [[অন্নপ্রাশন|অন্নপ্রাশন]] অনুষ্ঠান করে ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। | ||
নিমন্ত্রিতগণ শিশুর জন্য উপহার নিয়ে আসে। এ সময়ও ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। কু-দৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্য নবজাত শিশুর কপালে অবশ্যই একটি কাজলের টিপ দেওয়া হয়। শিশুকে বিপদমুক্ত রাখার জন্য কখনও কখনও তার গলায় তামার তাবিজ পরানো হয়। এ তাবিজের মধ্যে থাকে কুরআন-কিতাব বা পীর-দরবেশের বাণী। এগুলি হয়ত কুসংস্কার এবং এসেছে আদিবাসী সংস্কৃতি থেকে, কিন্তু জনগণ এখনও এসবে বিশ্বাস করে এবং গণক ও পীর-দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে রক্ষাকবচ বা বিপদ মুক্তির জন্য যায়। এসব পীর-সাধুরা প্রায়ই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অন্ধবিশ্বাসী লোকদের ঠকায়। | নিমন্ত্রিতগণ শিশুর জন্য উপহার নিয়ে আসে। এ সময়ও ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। কু-দৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্য নবজাত শিশুর কপালে অবশ্যই একটি কাজলের টিপ দেওয়া হয়। শিশুকে বিপদমুক্ত রাখার জন্য কখনও কখনও তার গলায় তামার তাবিজ পরানো হয়। এ তাবিজের মধ্যে থাকে কুরআন-কিতাব বা পীর-দরবেশের বাণী। এগুলি হয়ত কুসংস্কার এবং এসেছে আদিবাসী সংস্কৃতি থেকে, কিন্তু জনগণ এখনও এসবে বিশ্বাস করে এবং গণক ও পীর-দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে রক্ষাকবচ বা বিপদ মুক্তির জন্য যায়। এসব পীর-সাধুরা প্রায়ই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অন্ধবিশ্বাসী লোকদের ঠকায়। | ||
[[Image:DhekiFarmerFamily.jpg|thumb|400px|right|ঢেকিতে ধান ভানা]] | |||
যাত্রা অশুভ হয় যদি খালি কলস, ঝাঁটা বা বেজোড় শালিকপাখি দেখা যায়, কিংবা শোনা যায় কাকের ডাক অথবা সামনে দিয়ে যায় কালো বিড়াল বা শবযাত্রা। ধর্মপ্রচার, শিক্ষা-দীক্ষা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার সত্ত্বেও গ্রামাঞ্চলের মানুষ এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠী এখনও সর্ববস্ত্ততে প্রাণ আছে বলে বিশ্বাস করে। প্রকান্ড বটগাছের নিচে দিয়ে রাত্রে চলা-ফেরা করতে লোকেরা ভয় পায় কারণ তাদের ধারণা ঐসব গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে জ্বিন, ভূত এবং আরও অশুভ দৈত্য-দানব। জ্বিন ও ভূত-প্রেতে বিশ্বাস বেশ দৃঢ়মূল ও ব্যপক। বসন্ত বা কলেরা দেখা দিলে শীতলা ও ওলা দেবীর সন্তুষ্টির জন্য লোকজন মন্দির-মসজিদে গিয়ে ভেট দেয়। সাপে কামড়ালে প্রথাবশত লোকজন ওঝার কাছে যায়, কারণ তাদের বিশ্বাস ওঝারা সাপকে ডেকে এনে দংশিত ব্যক্তির দেহ থেকে বিষ নামিয়ে নিতে পারে। বাত রোগে আক্রান্ত গ্রামের লোকেরা নৌকাবাসী বেদেনীদের কাছে যায়। তাদের ধারণা, বেদেনীরা রোগীর দেহ থেকে বিষাক্ত রক্ত বের করে দিতে পারে। ভিক্ষুকদেরকে ছদ্মবেশী পীর-সাধু মনে করে টাকা পয়সা দেওয়া হয়। বাড়ির দরজায় আগত কোন ভিক্ষুককেই না খাইয়ে বা রাতের আশ্রয় না দিয়ে বিদায় করা হয় না। বিপদে এবং রোগে মানুষ সাধারণত মসজিদ-মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করে অথবা কোন ভিক্ষুক বা সাধু ব্যক্তির কাছে গিয়ে অর্থ-কড়ি দিয়ে মুক্তি কামনা করে। শিশুর জন্ম হলেও তারা এসব করে এবং তার জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণে বা পর্যায়ে যেমন পরীক্ষা, উচ্চশিক্ষা বা চাকুরির জন্য বিদেশ যাত্রা বা বিয়ে উৎসবের সময়ও তারা ঐ ধরনের লৌকিকতা পালন করে। নবজাত শিশু ছেলে হলে সৌভাগ্যের লক্ষণ মনে করা হয় কারণ সে পরিবারের জন্য উপার্জন করতে পারবে। কন্যা শিশু পরিবারের দায় বাড়ায়। লোকেরা প্রায়ই ইচ্ছাপূরণের জন্য দেব-দেবী, পীর-দরবেশ অথবা পবিত্র স্থানের জন্য মানত করে থাকে। মানত উপলক্ষে অনেক সময় গরিব-দুঃখী, এতিম ও আত্মীয়-স্বজনদের ভোজ দেওয়া হয়। প্রচন্ড খরা হলে মুসলমানরা দুপুরের দিকে জামাতে একটি বিশেষ [[নামায|নামায]] আদায় করে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে। মুসলমান এবং খ্রিস্টানরা মৃতদেহকে কবর দেয়, হিন্দুরা দাহ করে। কোন আত্মীয়ের মৃত্যু হলে মুসলমানরা চতুর্থ দিনে [[কুলখানি|কুলখানি]] করে এবং চল্লিশতম দিনে চেহলাম পালন করে। হিন্দুরা [[শ্রাদ্ধ|শ্রাদ্ধ]] করে এবং তখন মৃত ব্যক্তির ছেলেরা শোকের চিহ্নস্বরূপ মস্তক মুন্ডন করে। | যাত্রা অশুভ হয় যদি খালি কলস, ঝাঁটা বা বেজোড় শালিকপাখি দেখা যায়, কিংবা শোনা যায় কাকের ডাক অথবা সামনে দিয়ে যায় কালো বিড়াল বা শবযাত্রা। ধর্মপ্রচার, শিক্ষা-দীক্ষা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার সত্ত্বেও গ্রামাঞ্চলের মানুষ এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠী এখনও সর্ববস্ত্ততে প্রাণ আছে বলে বিশ্বাস করে। প্রকান্ড বটগাছের নিচে দিয়ে রাত্রে চলা-ফেরা করতে লোকেরা ভয় পায় কারণ তাদের ধারণা ঐসব গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে জ্বিন, ভূত এবং আরও অশুভ দৈত্য-দানব। জ্বিন ও ভূত-প্রেতে বিশ্বাস বেশ দৃঢ়মূল ও ব্যপক। বসন্ত বা কলেরা দেখা দিলে শীতলা ও ওলা দেবীর সন্তুষ্টির জন্য লোকজন মন্দির-মসজিদে গিয়ে ভেট দেয়। সাপে কামড়ালে প্রথাবশত লোকজন ওঝার কাছে যায়, কারণ তাদের বিশ্বাস ওঝারা সাপকে ডেকে এনে দংশিত ব্যক্তির দেহ থেকে বিষ নামিয়ে নিতে পারে। বাত রোগে আক্রান্ত গ্রামের লোকেরা নৌকাবাসী বেদেনীদের কাছে যায়। তাদের ধারণা, বেদেনীরা রোগীর দেহ থেকে বিষাক্ত রক্ত বের করে দিতে পারে। ভিক্ষুকদেরকে ছদ্মবেশী পীর-সাধু মনে করে টাকা পয়সা দেওয়া হয়। বাড়ির দরজায় আগত কোন ভিক্ষুককেই না খাইয়ে বা রাতের আশ্রয় না দিয়ে বিদায় করা হয় না। বিপদে এবং রোগে মানুষ সাধারণত মসজিদ-মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করে অথবা কোন ভিক্ষুক বা সাধু ব্যক্তির কাছে গিয়ে অর্থ-কড়ি দিয়ে মুক্তি কামনা করে। শিশুর জন্ম হলেও তারা এসব করে এবং তার জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণে বা পর্যায়ে যেমন পরীক্ষা, উচ্চশিক্ষা বা চাকুরির জন্য বিদেশ যাত্রা বা বিয়ে উৎসবের সময়ও তারা ঐ ধরনের লৌকিকতা পালন করে। নবজাত শিশু ছেলে হলে সৌভাগ্যের লক্ষণ মনে করা হয় কারণ সে পরিবারের জন্য উপার্জন করতে পারবে। কন্যা শিশু পরিবারের দায় বাড়ায়। লোকেরা প্রায়ই ইচ্ছাপূরণের জন্য দেব-দেবী, পীর-দরবেশ অথবা পবিত্র স্থানের জন্য মানত করে থাকে। মানত উপলক্ষে অনেক সময় গরিব-দুঃখী, এতিম ও আত্মীয়-স্বজনদের ভোজ দেওয়া হয়। প্রচন্ড খরা হলে মুসলমানরা দুপুরের দিকে জামাতে একটি বিশেষ [[নামায|নামায]] আদায় করে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে। মুসলমান এবং খ্রিস্টানরা মৃতদেহকে কবর দেয়, হিন্দুরা দাহ করে। কোন আত্মীয়ের মৃত্যু হলে মুসলমানরা চতুর্থ দিনে [[কুলখানি|কুলখানি]] করে এবং চল্লিশতম দিনে চেহলাম পালন করে। হিন্দুরা [[শ্রাদ্ধ|শ্রাদ্ধ]] করে এবং তখন মৃত ব্যক্তির ছেলেরা শোকের চিহ্নস্বরূপ মস্তক মুন্ডন করে। | ||
[[Image: | [[Image:PithaRural.jpg|thumb|400px|left|পিঠা তৈরি]] | ||
গ্রামবাংলায় সাধারণত শীত ও শুষ্ক মৌসুমে বিয়ের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কারণ, তখন খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে এবং বরযাত্রীদের চলাফেরা সহজতর হয়। শহরে সারা বছরই বিয়ের উৎসব হয়, তবে রমজান মাসে মুসলমানদের বিয়ে উৎসব কম হয়। কোন নিকট আত্মীয়ের মৃত্যু হলে বিয়ের তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়। অধিকাংশ বিয়েই এখনও পিতামাতা বা নিকট আত্মীয়রা নিজেরা বা ঘটকের মাধ্যমে ব্যবস্থা করে থাকে। ঘটকদের কাছে বিবাহযোগ্য বর-কনের একটি পূর্ণ তালিকা থাকে, এ তালিকায় উভয় পক্ষের পরিবারের পুরো ইতিহাস থাকে। ঘটকরা বিশেষ বুদ্ধি ও বাক্যকৌশল প্রয়োগ করে সত্য-মিথ্যার একটি সুন্দর আবহ সৃষ্টি করে অনেক সময় অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে এবং এর জন্য তারা অতি সামান্য দক্ষিণা পেয়ে থাকে। ঘটকরা হূদয়ের বন্ধন সৃষ্টি করে, কিন্তু অধিকাংশ লোক বিশ্বাস করে এ-বন্ধন সৃষ্টিকর্তা আগেই নির্ধারণ করে রাখেন। এসব বিয়ে-শাদীর একটা বিশেষ দিক হচ্ছে উভয় পরিবারের পক্ষ থেকে বহু আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। আত্মীয়-স্বজনরা বর-কনেকে উপহারাদি দিয়ে থাকে। অর্থানুকূল্য হলে এসব ভোজে অতিথিদের সংখ্যা ৫০ থেকে ৫০,০০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে। | |||
[[Image:BullockCort.jpg|thumb|400px|right|নাইয়র যাত্রা]] | |||
মুসলমানদের ভোজ মুগল বাদশাহদের খাদ্য তালিকা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেমন গরুর মাংসের কাবাব, মুরগির রোস্ট, খাসির মাংসের রেজালা, খাসির মাংস বা মুরগির বিরিয়ানি, দধি-মসল্লার বোরহানি, সালাদ এবং মিষ্টি হিসেবে জরদা বা পায়েস। হিন্দুদের ভোজে দেওয়া হয় ভাত, সবজি, মাছ, পাঁঠার মাংসের তরকারি এবং মিষ্ট দই। কোন কোন অঞ্চলে বিয়ের ভোজ কয়েক দিন ধরে চলে। বিয়ের আগে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করা হয়। উভয় পক্ষের দেন-দরবার শেষ হলে পান-চিনি করা হয়। বর-কনের ত্বক উজ্জ্বল করার জন্য কাঁচা হলুদ বেঁটে তা অনুষ্ঠান করে গায়ে মাখানো হয়। এ সময় উপহার বিনিময় হয়। যৌতুক বা কনেপণ হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সমাজেই প্রচলিত। উচ্চবর্ণের হিন্দু বর সাধারণত যৌতুক পেয়ে থাকে। উপযুক্ত বর এবং কনের সংখ্যা-স্বল্পতার কারণে নির্ধারিত হয় কোন পক্ষ যৌতুক দেবে এবং কোন পক্ষ পাবে বা যৌতুকের পরিমাণ কী হবে। প্রাচীন প্রথানুসারে বিয়ের মন্ডপে হিন্দু বর অবশ্যই হিন্দু কনের সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। কনেকে একজোড়া শাঁখার চুড়িও দেওয়া হয় তার সধবা জীবনে সর্বক্ষণ ব্যবহারের জন্য। সকল হিন্দু বিবাহিতা নারী রীতি অনুসারে দৈনিক সিঁথিতে সিঁদুর পরে, তবে বিধবা হলে আর সিঁদুর পরে না। মুসলমান বিবাহ কনের বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে হয়ে থাকে। মুসলমানদের বিয়ে পরিচালনা করেন একজন সরকার অনুমোদিত কাজি বা বিবাহ নিবন্ধক। উভয় পক্ষের সম্মতি নিয়ে তিনি বিবাহের শর্তাদি একটি চুক্তিনামায় লিপিবদ্ধ করেন এবং তাতে বর-কনে ও সাক্ষীদের স্বাক্ষর থাকে। পর্দানশীন কনের বিয়ের অনুমতি নেওয়া হয় একজন উকিল ও দুজন সাক্ষীর মাধ্যমে। চুক্তিনামায় উভয় পক্ষের তালাক দেওয়ার অধিকার উল্লেখিত থাকে। হিন্দু বিবাহে বর-কনের কুষ্ঠী দেখে এবং রাশির ভিত্তিতে গ্রহ-তারকার স্থান নির্ণয় করে তাদের বিয়ের দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করা হয়। একজন যোগ্য পুরোহিত মন্ত্র পড়ে বিবাহের আচারাদি সম্পন্ন করেন। পিতা বা অভিভাবক কন্যা সম্প্রদান করার পর বর-কনের গাঁট বন্ধন করা হয় এবং তারা একটি অগ্নিকুন্ডলী সাতবার প্রদক্ষিণ করে। বর-কনে অগ্নি সাক্ষী রেখে সারা জীবনের জন্য একে অপরকে সাতপাকে বেঁধে নেয়। খ্রিস্টানদের বিবাহ হয় গির্জায়। ক্যাথলিকদের বিবাহ বিচ্ছেদ ধর্মীয় রীতিবিরুদ্ধ; তবে প্রটেস্ট্যান্টগণ একে অপরকে তালাক দিতে পারে। সব সমাজেই বিবাহোত্তর ফুলশয্যার ব্যবস্থা করা হয়। ফুলশয্যার রাত্রে নবদম্পতির জন্য তাদের বিছানা নানা রং ও গন্ধের প্রচুর ফুল দিয়ে সাজানো হয় এবং চারদিকে রঙিন পর্দা ও ঝালর দেওয়া হয়। এই রাতটিকে নবদম্পতির জীবনের সবচেয়ে শুভরাত্রি বলা হয় যাতে তারা প্রেম, সখ্য এবং আনন্দের মধ্য দিয়ে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে পারে। | মুসলমানদের ভোজ মুগল বাদশাহদের খাদ্য তালিকা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেমন গরুর মাংসের কাবাব, মুরগির রোস্ট, খাসির মাংসের রেজালা, খাসির মাংস বা মুরগির বিরিয়ানি, দধি-মসল্লার বোরহানি, সালাদ এবং মিষ্টি হিসেবে জরদা বা পায়েস। হিন্দুদের ভোজে দেওয়া হয় ভাত, সবজি, মাছ, পাঁঠার মাংসের তরকারি এবং মিষ্ট দই। কোন কোন অঞ্চলে বিয়ের ভোজ কয়েক দিন ধরে চলে। বিয়ের আগে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করা হয়। উভয় পক্ষের দেন-দরবার শেষ হলে পান-চিনি করা হয়। বর-কনের ত্বক উজ্জ্বল করার জন্য কাঁচা হলুদ বেঁটে তা অনুষ্ঠান করে গায়ে মাখানো হয়। এ সময় উপহার বিনিময় হয়। যৌতুক বা কনেপণ হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সমাজেই প্রচলিত। উচ্চবর্ণের হিন্দু বর সাধারণত যৌতুক পেয়ে থাকে। উপযুক্ত বর এবং কনের সংখ্যা-স্বল্পতার কারণে নির্ধারিত হয় কোন পক্ষ যৌতুক দেবে এবং কোন পক্ষ পাবে বা যৌতুকের পরিমাণ কী হবে। প্রাচীন প্রথানুসারে বিয়ের মন্ডপে হিন্দু বর অবশ্যই হিন্দু কনের সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। কনেকে একজোড়া শাঁখার চুড়িও দেওয়া হয় তার সধবা জীবনে সর্বক্ষণ ব্যবহারের জন্য। সকল হিন্দু বিবাহিতা নারী রীতি অনুসারে দৈনিক সিঁথিতে সিঁদুর পরে, তবে বিধবা হলে আর সিঁদুর পরে না। মুসলমান বিবাহ কনের বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে হয়ে থাকে। মুসলমানদের বিয়ে পরিচালনা করেন একজন সরকার অনুমোদিত কাজি বা বিবাহ নিবন্ধক। উভয় পক্ষের সম্মতি নিয়ে তিনি বিবাহের শর্তাদি একটি চুক্তিনামায় লিপিবদ্ধ করেন এবং তাতে বর-কনে ও সাক্ষীদের স্বাক্ষর থাকে। পর্দানশীন কনের বিয়ের অনুমতি নেওয়া হয় একজন উকিল ও দুজন সাক্ষীর মাধ্যমে। চুক্তিনামায় উভয় পক্ষের তালাক দেওয়ার অধিকার উল্লেখিত থাকে। হিন্দু বিবাহে বর-কনের কুষ্ঠী দেখে এবং রাশির ভিত্তিতে গ্রহ-তারকার স্থান নির্ণয় করে তাদের বিয়ের দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করা হয়। একজন যোগ্য পুরোহিত মন্ত্র পড়ে বিবাহের আচারাদি সম্পন্ন করেন। পিতা বা অভিভাবক কন্যা সম্প্রদান করার পর বর-কনের গাঁট বন্ধন করা হয় এবং তারা একটি অগ্নিকুন্ডলী সাতবার প্রদক্ষিণ করে। বর-কনে অগ্নি সাক্ষী রেখে সারা জীবনের জন্য একে অপরকে সাতপাকে বেঁধে নেয়। খ্রিস্টানদের বিবাহ হয় গির্জায়। ক্যাথলিকদের বিবাহ বিচ্ছেদ ধর্মীয় রীতিবিরুদ্ধ; তবে প্রটেস্ট্যান্টগণ একে অপরকে তালাক দিতে পারে। সব সমাজেই বিবাহোত্তর ফুলশয্যার ব্যবস্থা করা হয়। ফুলশয্যার রাত্রে নবদম্পতির জন্য তাদের বিছানা নানা রং ও গন্ধের প্রচুর ফুল দিয়ে সাজানো হয় এবং চারদিকে রঙিন পর্দা ও ঝালর দেওয়া হয়। এই রাতটিকে নবদম্পতির জীবনের সবচেয়ে শুভরাত্রি বলা হয় যাতে তারা প্রেম, সখ্য এবং আনন্দের মধ্য দিয়ে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে পারে। | ||
[[Image:MarriageRural.jpg|thumb|400px|left|কনেগৃহে বরবরণ]] | |||
বিভিন্ন উৎসব ও দিবস উদযাপনের প্রথা ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে এদেশটি বিশিষ্টতার দাবি রাখে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮৫ শতাংশ মুসলমান এবং তাদের একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব হচ্ছে [[ঈদুল ফিত্র|ঈদুল ফিতর]]। একমাস রোজার পরে এ দিনটি আসে এবং তখন জাতীয় পর্যায়ে ছুটি পালন করা হয়। এ সময় প্রতিটি সচ্ছল পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে গরিবদের ফিৎরা দেওয়া হয়। পরিবারের সকল পুরুষ এবং ছেলেরা নতুন কাপড়-চোপড় পরে ঈদগাহ্ বা মসজিদে গিয়ে ঈদের নামায পড়ে। নামজের পরে তারা ছোটবড় নির্বিশেষে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে ঈদ মোবারক জানায়। এটি ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধের একটি উদাহরণ। | বিভিন্ন উৎসব ও দিবস উদযাপনের প্রথা ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে এদেশটি বিশিষ্টতার দাবি রাখে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮৫ শতাংশ মুসলমান এবং তাদের একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব হচ্ছে [[ঈদুল ফিত্র|ঈদুল ফিতর]]। একমাস রোজার পরে এ দিনটি আসে এবং তখন জাতীয় পর্যায়ে ছুটি পালন করা হয়। এ সময় প্রতিটি সচ্ছল পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে গরিবদের ফিৎরা দেওয়া হয়। পরিবারের সকল পুরুষ এবং ছেলেরা নতুন কাপড়-চোপড় পরে ঈদগাহ্ বা মসজিদে গিয়ে ঈদের নামায পড়ে। নামজের পরে তারা ছোটবড় নির্বিশেষে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে ঈদ মোবারক জানায়। এটি ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধের একটি উদাহরণ। | ||
ঘরে ফিরে তারা মিষ্টিমুখ করে। পরে দুপুর বেলায় আরও ভাল খাবারের ব্যবস্থা করা হয় এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে খাওয়া হয়। বিকেলে নতুন কাপড়-চোপড় পরে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে বেড়ানোর পালা শুরু হয়। দিবসটিকে উপলক্ষ করে রেডিও-টেলিভিশন এদিন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে এবং সংবাদপত্রগুলি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সরকারি দালানকোঠায় আলোকসজ্জা করা হয় এবং পুরো দেশটি উৎসবে মেতে ওঠে। মুসলমানদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উৎসব হচ্ছে [[ঈদুল আযহা|ঈদুল আযহা]]। ১০ জিলহজ্ব তারিখে মক্কায় হজ্জের সময় এটি পালন করা হয়। সবল স্বাস্থ্য ও পর্যাপ্ত অর্থের অধিকারী সকল মুসলমানের জন্য হজ্জ করা অবশ্য পালনীয়। সারা পৃথিবী থেকে প্রায় বিশ লক্ষ মুসলমান মক্কায় এই হজ্জ পালন করে থাকে। বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে প্রায় ১ লক্ষ মুসলমান প্রতিবছর হজ্জ পালন করে। ঈদুল আযহার দিন মুসলমান পুরুষ ও ছেলেরা সকাল বেলা ঈদগাহ্ ও মসজিদে গিয়ে ঈদের নামায পড়ে বাড়ি এসে গরু বা ছাগল কুরবানি দেয়। কুরবানির মাংসের সিংহভাগ গরিব-মিসকিন এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলি-বণ্টন করা হয়। রমজান মাসে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান সারাদিন উপোস করে এবং সূর্যাস্তের সময় শরবত, ভাজা-ভুজি এবং ফলাদি দিয়ে ইফতার করে। এ মাসটি সংযমের মাস এবং গরিবদের প্রতি সদয় হতে ও তাদের দানখয়রাতের শিক্ষা দেয়। ইসলামের বিধান অনুযায়ী বিত্তবান ধনীদেরকে যাকাত দিতে হয়। ২৭ রমজানের রাতকে শবে-কদর ধরা হয়। এটি সৌভাগ্যের রাত্রি হিসেবে বিবেচ্য। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এ সময় সারারাত ইবাদত করে। শবে-বরআত আর একটি সৌভাগ্যের রাত্রি। আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখে এ রাতটি আসে। এ রাতেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লার সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত করে। গৃহিণীরা এ সময় মিষ্টি, হালুয়া ও রুটি তৈরি করে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে। নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। এ দিনটি ছিল আরবি সালের ১২ রবিউল আওয়াল। এ উপলক্ষে ঈদ-এ-মীলাদুন্নবী পালন করা হয়। এটি একটি ছুটির দিন। রেডিও এবং টেলিভিশনে এ দিন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মহিমা বর্ণনা করা হয়। | ঘরে ফিরে তারা মিষ্টিমুখ করে। পরে দুপুর বেলায় আরও ভাল খাবারের ব্যবস্থা করা হয় এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে খাওয়া হয়। বিকেলে নতুন কাপড়-চোপড় পরে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে বেড়ানোর পালা শুরু হয়। দিবসটিকে উপলক্ষ করে রেডিও-টেলিভিশন এদিন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে এবং সংবাদপত্রগুলি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সরকারি দালানকোঠায় আলোকসজ্জা করা হয় এবং পুরো দেশটি উৎসবে মেতে ওঠে। মুসলমানদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উৎসব হচ্ছে [[ঈদুল আযহা|ঈদুল আযহা]]। ১০ জিলহজ্ব তারিখে মক্কায় হজ্জের সময় এটি পালন করা হয়। সবল স্বাস্থ্য ও পর্যাপ্ত অর্থের অধিকারী সকল মুসলমানের জন্য হজ্জ করা অবশ্য পালনীয়। সারা পৃথিবী থেকে প্রায় বিশ লক্ষ মুসলমান মক্কায় এই হজ্জ পালন করে থাকে। বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে প্রায় ১ লক্ষ মুসলমান প্রতিবছর হজ্জ পালন করে। ঈদুল আযহার দিন মুসলমান পুরুষ ও ছেলেরা সকাল বেলা ঈদগাহ্ ও মসজিদে গিয়ে ঈদের নামায পড়ে বাড়ি এসে গরু বা ছাগল কুরবানি দেয়। কুরবানির মাংসের সিংহভাগ গরিব-মিসকিন এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলি-বণ্টন করা হয়। রমজান মাসে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান সারাদিন উপোস করে এবং সূর্যাস্তের সময় শরবত, ভাজা-ভুজি এবং ফলাদি দিয়ে ইফতার করে। এ মাসটি সংযমের মাস এবং গরিবদের প্রতি সদয় হতে ও তাদের দানখয়রাতের শিক্ষা দেয়। ইসলামের বিধান অনুযায়ী বিত্তবান ধনীদেরকে যাকাত দিতে হয়। ২৭ রমজানের রাতকে শবে-কদর ধরা হয়। এটি সৌভাগ্যের রাত্রি হিসেবে বিবেচ্য। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এ সময় সারারাত ইবাদত করে। শবে-বরআত আর একটি সৌভাগ্যের রাত্রি। আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখে এ রাতটি আসে। এ রাতেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লার সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত করে। গৃহিণীরা এ সময় মিষ্টি, হালুয়া ও রুটি তৈরি করে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে। নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। এ দিনটি ছিল আরবি সালের ১২ রবিউল আওয়াল। এ উপলক্ষে ঈদ-এ-মীলাদুন্নবী পালন করা হয়। এটি একটি ছুটির দিন। রেডিও এবং টেলিভিশনে এ দিন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মহিমা বর্ণনা করা হয়। | ||
[[Image: | [[Image:MelaRural.jpg|thumb|400px|right|বৈশাখী মেলা]] | ||
হিন্দুদের অনেক পূজা-পার্বণ আছে। তার মধ্যে দুর্গাপূজা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। আশ্বিন মাসের চাঁদের প্রথম ১০ দিন দেবী দুর্গার মূর্তি বানিয়ে পূজা করা হয়। ছেলে-মেয়েরা মূ©র্র্তর সামনে নাচ-গান ও আরতি পরিবেশন করে এবং সকল শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করে। মাটির মূর্তিগুলি পটুয়ারা অতি যত্নের সাথে তৈরি করে থাকে। দুঃখভারাক্রান্ত চিত্তে দশম দিনে এ মূর্তি নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। রেডিও-টেলিভিশন এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। হিন্দুদের একটি বিশেষ প্রথা হচ্ছে প্রতিবছর গঙ্গায় বা গঙ্গার কোন শাখা নদীতে স্নান করা। এতে তাদের পাপ মোচন হয় বলে তাদের বিশ্বাস। নারায়ণগঞ্জের ব্রহ্মপুত্র নদীর [[লাঙ্গলবন্দ|লাঙ্গলবন্দ]] নামক স্থানে লক্ষ লক্ষ হিন্দুরা পুণ্যস্নান করে। | |||
সারা পৃথিবীর ন্যায় বাংলাদেশের খ্রিস্টানরাও যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন পালন করে থাকে। তখন তারা তাদের বাড়ি-ঘর সুন্দরভাবে সাজায়। বাড়ির সামনে একটি ক্রিসমাস গাছ অনেক ছোট ছোট রঙিন বাল্ব দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। তাদের ক্রিসমাস ভোজে বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়স্বজন যোগ দিয়ে থাকে। | সারা পৃথিবীর ন্যায় বাংলাদেশের খ্রিস্টানরাও যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন পালন করে থাকে। তখন তারা তাদের বাড়ি-ঘর সুন্দরভাবে সাজায়। বাড়ির সামনে একটি ক্রিসমাস গাছ অনেক ছোট ছোট রঙিন বাল্ব দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। তাদের ক্রিসমাস ভোজে বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়স্বজন যোগ দিয়ে থাকে। | ||
৪২ নং লাইন: | ৩৩ নং লাইন: | ||
দেবদূত সান্তাক্লজ সেজে বড়রা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের সুন্দর সুন্দর উপহার দিয়ে থাকে। সংবাদপত্র ও রেডিও-টেলিভিশন এ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ ও অনুষ্ঠান প্রচার করে। | দেবদূত সান্তাক্লজ সেজে বড়রা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের সুন্দর সুন্দর উপহার দিয়ে থাকে। সংবাদপত্র ও রেডিও-টেলিভিশন এ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ ও অনুষ্ঠান প্রচার করে। | ||
[[Image:KabadiGame.jpg|thumb|400px|left|হাডুডু খেলা]] | |||
গৌতম বুদ্ধের জীবন ও কর্ম নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অনেক উৎসব করে থাকে। তাদের প্রধান উৎসব হলো বৈশাখ মাসের বৌদ্ধ পূর্ণিমা। এদিনে বুদ্ধের জীবনের তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ সালে তাঁর জন্ম, খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৮ সালে তাঁর বোধি বা মহাজ্ঞান লাভ যার ফলে তিনি জগতে বুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ সালে ৮০ বছর বয়সে হিরণ্যবতী নদীর তীরবর্তী শালবনে তাঁর অন্তর্ধান ঘটে। বৌদ্ধ পূর্ণিমায় বৌদ্ধগণ ভগবান বুদ্ধের পূজা করে এবং পঞ্চশীল, অষ্টশীল, সূত্রপথ, সূত্রশ্রাবণ, সম্মিলিত আরাধনা এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থা করে। ধর্মীয় রীতি ছাড়াও সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থা করা হয়। অনেক বৌদ্ধ বিহারে তিনদিন ধরে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অনেকে বৌদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির অতি উন্নত নিদর্শন মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর এবং ময়নামতির বিখ্যাত বিহারগুলির ধ্বংসাবশেষ দেখতে যায়। এ দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হয়। এ উপলক্ষে রেডিও, টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে এবং সংবাদপত্র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। অনেক বিহার এবং প্রতিষ্ঠানাদি এ উপলক্ষে স্মারকপত্র, ম্যাগাজিন এবং বই প্রকাশ করে থাকে। অনেক গ্রামে এবং বিহারে মেলা বসে। চট্টগ্রামের বৌদ্ধপাড়া গ্রামে বোধিদ্রুম মেলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাহাড় এলাকার চা-বাগানে আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের দেব-দেবীর নামে অনেক উৎসব করে থাকে। এ ধরনের উৎসবে ও বিয়েতে তারা তাদের শিকার করা জন্তুর মাংস খায় এবং নিজেদের তৈরি মদ পান করে। [এনামুল হক] | গৌতম বুদ্ধের জীবন ও কর্ম নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অনেক উৎসব করে থাকে। তাদের প্রধান উৎসব হলো বৈশাখ মাসের বৌদ্ধ পূর্ণিমা। এদিনে বুদ্ধের জীবনের তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ সালে তাঁর জন্ম, খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৮ সালে তাঁর বোধি বা মহাজ্ঞান লাভ যার ফলে তিনি জগতে বুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ সালে ৮০ বছর বয়সে হিরণ্যবতী নদীর তীরবর্তী শালবনে তাঁর অন্তর্ধান ঘটে। বৌদ্ধ পূর্ণিমায় বৌদ্ধগণ ভগবান বুদ্ধের পূজা করে এবং পঞ্চশীল, অষ্টশীল, সূত্রপথ, সূত্রশ্রাবণ, সম্মিলিত আরাধনা এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থা করে। ধর্মীয় রীতি ছাড়াও সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থা করা হয়। অনেক বৌদ্ধ বিহারে তিনদিন ধরে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অনেকে বৌদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির অতি উন্নত নিদর্শন মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর এবং ময়নামতির বিখ্যাত বিহারগুলির ধ্বংসাবশেষ দেখতে যায়। এ দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হয়। এ উপলক্ষে রেডিও, টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে এবং সংবাদপত্র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। অনেক বিহার এবং প্রতিষ্ঠানাদি এ উপলক্ষে স্মারকপত্র, ম্যাগাজিন এবং বই প্রকাশ করে থাকে। অনেক গ্রামে এবং বিহারে মেলা বসে। চট্টগ্রামের বৌদ্ধপাড়া গ্রামে বোধিদ্রুম মেলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাহাড় এলাকার চা-বাগানে আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের দেব-দেবীর নামে অনেক উৎসব করে থাকে। এ ধরনের উৎসবে ও বিয়েতে তারা তাদের শিকার করা জন্তুর মাংস খায় এবং নিজেদের তৈরি মদ পান করে। [এনামুল হক] | ||
''আরও দেখুন'' জ্ঞাতিত্ব; | ''আরও দেখুন'' [[জ্ঞাতিত্ব|জ্ঞাতিত্ব]]; [[ট্যাবু|ট্যাবু]]। | ||
[[en:Customs and Traditions]] | [[en:Customs and Traditions]] |
০৫:১৩, ১২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
প্রথা ও ঐতিহ্য বাংলাদেশের প্রথা ও ঐতিহ্য বিচিত্র এবং আকর্ষণীয়। এর অনেকগুলি এসেছে প্রাগৈতিহাসিক স্তর থেকে। অনেক প্রথা যুগে যুগে বহন করে নিয়ে এসেছে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই উপমহাদেশে আগত শত শত আদিবাসী। এসব আদিবাসীরা আজও তাদের সংস্কৃতি নিয়ে বসবাস করছে বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে এবং পাহাড়-পর্বতে। এদের পূর্বপুরুষরা ছিল হয় নেগ্রিটো অথবা প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বা প্রোটো-মঙ্গোলয়েড কিংবা ককেশিয়াড। এদের পরে পশ্চিম এশিয়া থেকে আসে আর্যগণ। বাংলাদেশের বহুজাতিক জনগোষ্ঠী সৃষ্টির পেছনে রয়েছে দেশটির নদীবিধৌত ভূমির উর্বরতা, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এবং ধন-সম্পদের দুনিয়াজোড়া খ্যাতি। এসবের আকর্ষণে এসেছে বহু আদিবাসী, আগ্রাসী ভিনদেশি, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য ভাগ্যান্বেষী। বহু জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে সৃষ্ট বাঙালি জাতির এক প্রধান অংশ ছিল অনার্য। উর্বর জমি এবং খাল-বিল, নদ-নদীর প্রাচুর্যের ফলে কৃষি এবং মৎস্য আহরণ হয়ে দাঁড়ায় জনগণের উপার্জনের প্রধান উপায়। চাল, সবজি এবং মাছ তাদের প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠে। ফলে অনেক প্রথাই হয় কৃষিভিত্তিক।
গ্রাম বাংলার সংস্কৃতিতে নতুন ধানের একটি প্রধান উৎসব হচ্ছে নবান্ন এবং এটি আয়োজিত হয় অগ্রহায়ণ মাসে যখন প্রচুর ফসল ঘরে আসে। এ সময়টি দীর্ঘ গ্রীষ্ম এবং বন্যার প্রকোপমুক্ত শীতের প্রারম্ভকাল। পুরুষরা তখন মাঠ থেকে পাকাধান মাড়াইয়ের জন্য বাড়ি নিয়ে আসে। মেয়েরা নতুন চালের পিঠা বানিয়ে খেজুরের রস ও দুধে ভিজিয়ে সকলকে আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মাঠে-ঘাটে বন্যার পানি কমতে থাকলে জেলেদের জালে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। চারদিকে তখন আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করে। স্বল্প শীতের এই মৌসুমে গ্রামে-গঞ্জে জমে ওঠে হাডুডু খেলা এবং ষাঁড়ের লড়াই। ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন এবং খোলা মাঠের আরও কিছু খেলাও তখন অনুষ্ঠিত হয়।
বাঙালির প্রিয় পয়লা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ দিনটি এপ্রিলের মাঝামাঝি পড়ে এবং সারা দেশে উৎসবের মাধ্যমে পালিত হয়। এই দিনটির শুরু হয় ইলিশ মাছ ও সবজি দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার মাধ্যমে অথবা চিড়া-গুড় ও দইয়ের নাস্তা দিয়ে। পুরুষ-নারী এবং শিশুরা নতুন কাপড় পরে বটের তলায় বা নদীর ধারে অনুষ্ঠিত মেলায় যায়। এসব মেলায় হরেক রকমের ব্যবহারিক জিনিসপত্র, বহু রকমের খাবার, মিষ্টি ও বাচ্চাদের খেলনা পাওয়া যায়। সকল শ্রেণির লোকদের আনন্দের জন্য থাকে নাগরদোলা, ঘোড়ায় চড়া, ভাগ্য পরীক্ষার খেলা, যাত্রা, পুতুলনাচ। সকল ব্যবসায়ী দিনটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে এবং এদিন তারা হালখাতা খোলে। সৌভাগ্যের চিহ্নস্বরূপ হিন্দুরা এসব খাতায় সিঁদুর মাখিয়ে দেয়। শহর এলাকায়ও পয়লা বৈশাখ জনপ্রিয়। ঢাকায় দিনটি বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে গান-বাজনা, শোভাযাত্রা এবং মেলার মাধ্যমে পালন করা হয়। কোন কোন মেলা এক সপ্তাহ ধরে চলে। প্রায়ই দেখা যায় এ দিনটির শেষে প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড় এবং প্রচুর বৃষ্টি হয়। এ ঝড়ে জান-মালের ক্ষতিও হয়, তবে তা গ্রীষ্মের দাবদাহ একেবারেই কমিয়ে আনে।
বাংলাদেশের সমাজে এখনও যৌথ পরিবারের প্রাধান্য বিদ্যমান। এর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নারী ও বয়স্কদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ছোটদের প্রতি ভালবাসা ও স্নেহ-যত্ন প্রদর্শন। ছেলেমেয়ে বা আত্মীয়-স্বজনের পরিবারবর্গ বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা-যত্ন করে। তাদের দোয়ায় আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয় বলে সবাই বিশ্বাস করে। মুসলমানরা তাদের মুরুবিবদের ইসলামি কায়দায় ডান হাত উঁচু করে সালাম দেয় এবং হিন্দুরা করজোড়ে নমস্কার করে। খ্রিস্টানরা সুপ্রভাত বা শুভদিন বলে অভিবাদন করে। সন্তানের জন্ম হলে আত্মীয়-পরিজন এবং বন্ধুদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। শিশুর নামকরণের জন্য আকিকা বা অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান করে ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়।
নিমন্ত্রিতগণ শিশুর জন্য উপহার নিয়ে আসে। এ সময়ও ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। কু-দৃষ্টি থেকে বাঁচানোর জন্য নবজাত শিশুর কপালে অবশ্যই একটি কাজলের টিপ দেওয়া হয়। শিশুকে বিপদমুক্ত রাখার জন্য কখনও কখনও তার গলায় তামার তাবিজ পরানো হয়। এ তাবিজের মধ্যে থাকে কুরআন-কিতাব বা পীর-দরবেশের বাণী। এগুলি হয়ত কুসংস্কার এবং এসেছে আদিবাসী সংস্কৃতি থেকে, কিন্তু জনগণ এখনও এসবে বিশ্বাস করে এবং গণক ও পীর-দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসীদের কাছে রক্ষাকবচ বা বিপদ মুক্তির জন্য যায়। এসব পীর-সাধুরা প্রায়ই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে অন্ধবিশ্বাসী লোকদের ঠকায়।
যাত্রা অশুভ হয় যদি খালি কলস, ঝাঁটা বা বেজোড় শালিকপাখি দেখা যায়, কিংবা শোনা যায় কাকের ডাক অথবা সামনে দিয়ে যায় কালো বিড়াল বা শবযাত্রা। ধর্মপ্রচার, শিক্ষা-দীক্ষা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার সত্ত্বেও গ্রামাঞ্চলের মানুষ এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠী এখনও সর্ববস্ত্ততে প্রাণ আছে বলে বিশ্বাস করে। প্রকান্ড বটগাছের নিচে দিয়ে রাত্রে চলা-ফেরা করতে লোকেরা ভয় পায় কারণ তাদের ধারণা ঐসব গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে জ্বিন, ভূত এবং আরও অশুভ দৈত্য-দানব। জ্বিন ও ভূত-প্রেতে বিশ্বাস বেশ দৃঢ়মূল ও ব্যপক। বসন্ত বা কলেরা দেখা দিলে শীতলা ও ওলা দেবীর সন্তুষ্টির জন্য লোকজন মন্দির-মসজিদে গিয়ে ভেট দেয়। সাপে কামড়ালে প্রথাবশত লোকজন ওঝার কাছে যায়, কারণ তাদের বিশ্বাস ওঝারা সাপকে ডেকে এনে দংশিত ব্যক্তির দেহ থেকে বিষ নামিয়ে নিতে পারে। বাত রোগে আক্রান্ত গ্রামের লোকেরা নৌকাবাসী বেদেনীদের কাছে যায়। তাদের ধারণা, বেদেনীরা রোগীর দেহ থেকে বিষাক্ত রক্ত বের করে দিতে পারে। ভিক্ষুকদেরকে ছদ্মবেশী পীর-সাধু মনে করে টাকা পয়সা দেওয়া হয়। বাড়ির দরজায় আগত কোন ভিক্ষুককেই না খাইয়ে বা রাতের আশ্রয় না দিয়ে বিদায় করা হয় না। বিপদে এবং রোগে মানুষ সাধারণত মসজিদ-মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করে অথবা কোন ভিক্ষুক বা সাধু ব্যক্তির কাছে গিয়ে অর্থ-কড়ি দিয়ে মুক্তি কামনা করে। শিশুর জন্ম হলেও তারা এসব করে এবং তার জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণে বা পর্যায়ে যেমন পরীক্ষা, উচ্চশিক্ষা বা চাকুরির জন্য বিদেশ যাত্রা বা বিয়ে উৎসবের সময়ও তারা ঐ ধরনের লৌকিকতা পালন করে। নবজাত শিশু ছেলে হলে সৌভাগ্যের লক্ষণ মনে করা হয় কারণ সে পরিবারের জন্য উপার্জন করতে পারবে। কন্যা শিশু পরিবারের দায় বাড়ায়। লোকেরা প্রায়ই ইচ্ছাপূরণের জন্য দেব-দেবী, পীর-দরবেশ অথবা পবিত্র স্থানের জন্য মানত করে থাকে। মানত উপলক্ষে অনেক সময় গরিব-দুঃখী, এতিম ও আত্মীয়-স্বজনদের ভোজ দেওয়া হয়। প্রচন্ড খরা হলে মুসলমানরা দুপুরের দিকে জামাতে একটি বিশেষ নামায আদায় করে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে। মুসলমান এবং খ্রিস্টানরা মৃতদেহকে কবর দেয়, হিন্দুরা দাহ করে। কোন আত্মীয়ের মৃত্যু হলে মুসলমানরা চতুর্থ দিনে কুলখানি করে এবং চল্লিশতম দিনে চেহলাম পালন করে। হিন্দুরা শ্রাদ্ধ করে এবং তখন মৃত ব্যক্তির ছেলেরা শোকের চিহ্নস্বরূপ মস্তক মুন্ডন করে।
গ্রামবাংলায় সাধারণত শীত ও শুষ্ক মৌসুমে বিয়ের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। কারণ, তখন খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে এবং বরযাত্রীদের চলাফেরা সহজতর হয়। শহরে সারা বছরই বিয়ের উৎসব হয়, তবে রমজান মাসে মুসলমানদের বিয়ে উৎসব কম হয়। কোন নিকট আত্মীয়ের মৃত্যু হলে বিয়ের তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়। অধিকাংশ বিয়েই এখনও পিতামাতা বা নিকট আত্মীয়রা নিজেরা বা ঘটকের মাধ্যমে ব্যবস্থা করে থাকে। ঘটকদের কাছে বিবাহযোগ্য বর-কনের একটি পূর্ণ তালিকা থাকে, এ তালিকায় উভয় পক্ষের পরিবারের পুরো ইতিহাস থাকে। ঘটকরা বিশেষ বুদ্ধি ও বাক্যকৌশল প্রয়োগ করে সত্য-মিথ্যার একটি সুন্দর আবহ সৃষ্টি করে অনেক সময় অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে এবং এর জন্য তারা অতি সামান্য দক্ষিণা পেয়ে থাকে। ঘটকরা হূদয়ের বন্ধন সৃষ্টি করে, কিন্তু অধিকাংশ লোক বিশ্বাস করে এ-বন্ধন সৃষ্টিকর্তা আগেই নির্ধারণ করে রাখেন। এসব বিয়ে-শাদীর একটা বিশেষ দিক হচ্ছে উভয় পরিবারের পক্ষ থেকে বহু আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের ভোজনের ব্যবস্থা করা হয়। আত্মীয়-স্বজনরা বর-কনেকে উপহারাদি দিয়ে থাকে। অর্থানুকূল্য হলে এসব ভোজে অতিথিদের সংখ্যা ৫০ থেকে ৫০,০০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে।
মুসলমানদের ভোজ মুগল বাদশাহদের খাদ্য তালিকা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেমন গরুর মাংসের কাবাব, মুরগির রোস্ট, খাসির মাংসের রেজালা, খাসির মাংস বা মুরগির বিরিয়ানি, দধি-মসল্লার বোরহানি, সালাদ এবং মিষ্টি হিসেবে জরদা বা পায়েস। হিন্দুদের ভোজে দেওয়া হয় ভাত, সবজি, মাছ, পাঁঠার মাংসের তরকারি এবং মিষ্ট দই। কোন কোন অঞ্চলে বিয়ের ভোজ কয়েক দিন ধরে চলে। বিয়ের আগে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান করা হয়। উভয় পক্ষের দেন-দরবার শেষ হলে পান-চিনি করা হয়। বর-কনের ত্বক উজ্জ্বল করার জন্য কাঁচা হলুদ বেঁটে তা অনুষ্ঠান করে গায়ে মাখানো হয়। এ সময় উপহার বিনিময় হয়। যৌতুক বা কনেপণ হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সমাজেই প্রচলিত। উচ্চবর্ণের হিন্দু বর সাধারণত যৌতুক পেয়ে থাকে। উপযুক্ত বর এবং কনের সংখ্যা-স্বল্পতার কারণে নির্ধারিত হয় কোন পক্ষ যৌতুক দেবে এবং কোন পক্ষ পাবে বা যৌতুকের পরিমাণ কী হবে। প্রাচীন প্রথানুসারে বিয়ের মন্ডপে হিন্দু বর অবশ্যই হিন্দু কনের সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। কনেকে একজোড়া শাঁখার চুড়িও দেওয়া হয় তার সধবা জীবনে সর্বক্ষণ ব্যবহারের জন্য। সকল হিন্দু বিবাহিতা নারী রীতি অনুসারে দৈনিক সিঁথিতে সিঁদুর পরে, তবে বিধবা হলে আর সিঁদুর পরে না। মুসলমান বিবাহ কনের বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে হয়ে থাকে। মুসলমানদের বিয়ে পরিচালনা করেন একজন সরকার অনুমোদিত কাজি বা বিবাহ নিবন্ধক। উভয় পক্ষের সম্মতি নিয়ে তিনি বিবাহের শর্তাদি একটি চুক্তিনামায় লিপিবদ্ধ করেন এবং তাতে বর-কনে ও সাক্ষীদের স্বাক্ষর থাকে। পর্দানশীন কনের বিয়ের অনুমতি নেওয়া হয় একজন উকিল ও দুজন সাক্ষীর মাধ্যমে। চুক্তিনামায় উভয় পক্ষের তালাক দেওয়ার অধিকার উল্লেখিত থাকে। হিন্দু বিবাহে বর-কনের কুষ্ঠী দেখে এবং রাশির ভিত্তিতে গ্রহ-তারকার স্থান নির্ণয় করে তাদের বিয়ের দিনক্ষণ নির্দিষ্ট করা হয়। একজন যোগ্য পুরোহিত মন্ত্র পড়ে বিবাহের আচারাদি সম্পন্ন করেন। পিতা বা অভিভাবক কন্যা সম্প্রদান করার পর বর-কনের গাঁট বন্ধন করা হয় এবং তারা একটি অগ্নিকুন্ডলী সাতবার প্রদক্ষিণ করে। বর-কনে অগ্নি সাক্ষী রেখে সারা জীবনের জন্য একে অপরকে সাতপাকে বেঁধে নেয়। খ্রিস্টানদের বিবাহ হয় গির্জায়। ক্যাথলিকদের বিবাহ বিচ্ছেদ ধর্মীয় রীতিবিরুদ্ধ; তবে প্রটেস্ট্যান্টগণ একে অপরকে তালাক দিতে পারে। সব সমাজেই বিবাহোত্তর ফুলশয্যার ব্যবস্থা করা হয়। ফুলশয্যার রাত্রে নবদম্পতির জন্য তাদের বিছানা নানা রং ও গন্ধের প্রচুর ফুল দিয়ে সাজানো হয় এবং চারদিকে রঙিন পর্দা ও ঝালর দেওয়া হয়। এই রাতটিকে নবদম্পতির জীবনের সবচেয়ে শুভরাত্রি বলা হয় যাতে তারা প্রেম, সখ্য এবং আনন্দের মধ্য দিয়ে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে পারে।
বিভিন্ন উৎসব ও দিবস উদযাপনের প্রথা ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে এদেশটি বিশিষ্টতার দাবি রাখে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮৫ শতাংশ মুসলমান এবং তাদের একটি উল্লেখযোগ্য উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর। একমাস রোজার পরে এ দিনটি আসে এবং তখন জাতীয় পর্যায়ে ছুটি পালন করা হয়। এ সময় প্রতিটি সচ্ছল পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে গরিবদের ফিৎরা দেওয়া হয়। পরিবারের সকল পুরুষ এবং ছেলেরা নতুন কাপড়-চোপড় পরে ঈদগাহ্ বা মসজিদে গিয়ে ঈদের নামায পড়ে। নামজের পরে তারা ছোটবড় নির্বিশেষে একে অপরের সাথে কোলাকুলি করে ঈদ মোবারক জানায়। এটি ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধের একটি উদাহরণ।
ঘরে ফিরে তারা মিষ্টিমুখ করে। পরে দুপুর বেলায় আরও ভাল খাবারের ব্যবস্থা করা হয় এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে খাওয়া হয়। বিকেলে নতুন কাপড়-চোপড় পরে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের বাড়িতে বেড়ানোর পালা শুরু হয়। দিবসটিকে উপলক্ষ করে রেডিও-টেলিভিশন এদিন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে এবং সংবাদপত্রগুলি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সরকারি দালানকোঠায় আলোকসজ্জা করা হয় এবং পুরো দেশটি উৎসবে মেতে ওঠে। মুসলমানদের আরেকটি উল্লেখযোগ্য উৎসব হচ্ছে ঈদুল আযহা। ১০ জিলহজ্ব তারিখে মক্কায় হজ্জের সময় এটি পালন করা হয়। সবল স্বাস্থ্য ও পর্যাপ্ত অর্থের অধিকারী সকল মুসলমানের জন্য হজ্জ করা অবশ্য পালনীয়। সারা পৃথিবী থেকে প্রায় বিশ লক্ষ মুসলমান মক্কায় এই হজ্জ পালন করে থাকে। বাংলাদেশ থেকে বর্তমানে প্রায় ১ লক্ষ মুসলমান প্রতিবছর হজ্জ পালন করে। ঈদুল আযহার দিন মুসলমান পুরুষ ও ছেলেরা সকাল বেলা ঈদগাহ্ ও মসজিদে গিয়ে ঈদের নামায পড়ে বাড়ি এসে গরু বা ছাগল কুরবানি দেয়। কুরবানির মাংসের সিংহভাগ গরিব-মিসকিন এবং আত্মীয়স্বজনের মধ্যে বিলি-বণ্টন করা হয়। রমজান মাসে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান সারাদিন উপোস করে এবং সূর্যাস্তের সময় শরবত, ভাজা-ভুজি এবং ফলাদি দিয়ে ইফতার করে। এ মাসটি সংযমের মাস এবং গরিবদের প্রতি সদয় হতে ও তাদের দানখয়রাতের শিক্ষা দেয়। ইসলামের বিধান অনুযায়ী বিত্তবান ধনীদেরকে যাকাত দিতে হয়। ২৭ রমজানের রাতকে শবে-কদর ধরা হয়। এটি সৌভাগ্যের রাত্রি হিসেবে বিবেচ্য। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এ সময় সারারাত ইবাদত করে। শবে-বরআত আর একটি সৌভাগ্যের রাত্রি। আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখে এ রাতটি আসে। এ রাতেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা আল্লার সন্তুষ্টির জন্য ইবাদত করে। গৃহিণীরা এ সময় মিষ্টি, হালুয়া ও রুটি তৈরি করে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে। নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। এ দিনটি ছিল আরবি সালের ১২ রবিউল আওয়াল। এ উপলক্ষে ঈদ-এ-মীলাদুন্নবী পালন করা হয়। এটি একটি ছুটির দিন। রেডিও এবং টেলিভিশনে এ দিন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মহিমা বর্ণনা করা হয়।
হিন্দুদের অনেক পূজা-পার্বণ আছে। তার মধ্যে দুর্গাপূজা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। আশ্বিন মাসের চাঁদের প্রথম ১০ দিন দেবী দুর্গার মূর্তি বানিয়ে পূজা করা হয়। ছেলে-মেয়েরা মূ©র্র্তর সামনে নাচ-গান ও আরতি পরিবেশন করে এবং সকল শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করে। মাটির মূর্তিগুলি পটুয়ারা অতি যত্নের সাথে তৈরি করে থাকে। দুঃখভারাক্রান্ত চিত্তে দশম দিনে এ মূর্তি নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয়। রেডিও-টেলিভিশন এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে। হিন্দুদের একটি বিশেষ প্রথা হচ্ছে প্রতিবছর গঙ্গায় বা গঙ্গার কোন শাখা নদীতে স্নান করা। এতে তাদের পাপ মোচন হয় বলে তাদের বিশ্বাস। নারায়ণগঞ্জের ব্রহ্মপুত্র নদীর লাঙ্গলবন্দ নামক স্থানে লক্ষ লক্ষ হিন্দুরা পুণ্যস্নান করে।
সারা পৃথিবীর ন্যায় বাংলাদেশের খ্রিস্টানরাও যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন পালন করে থাকে। তখন তারা তাদের বাড়ি-ঘর সুন্দরভাবে সাজায়। বাড়ির সামনে একটি ক্রিসমাস গাছ অনেক ছোট ছোট রঙিন বাল্ব দিয়ে সুসজ্জিত করা হয়। তাদের ক্রিসমাস ভোজে বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়স্বজন যোগ দিয়ে থাকে।
দেবদূত সান্তাক্লজ সেজে বড়রা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের সুন্দর সুন্দর উপহার দিয়ে থাকে। সংবাদপত্র ও রেডিও-টেলিভিশন এ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ ও অনুষ্ঠান প্রচার করে।
গৌতম বুদ্ধের জীবন ও কর্ম নিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা অনেক উৎসব করে থাকে। তাদের প্রধান উৎসব হলো বৈশাখ মাসের বৌদ্ধ পূর্ণিমা। এদিনে বুদ্ধের জীবনের তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। খ্রিস্টপূর্ব ৬২৩ সালে তাঁর জন্ম, খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৮ সালে তাঁর বোধি বা মহাজ্ঞান লাভ যার ফলে তিনি জগতে বুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৩ সালে ৮০ বছর বয়সে হিরণ্যবতী নদীর তীরবর্তী শালবনে তাঁর অন্তর্ধান ঘটে। বৌদ্ধ পূর্ণিমায় বৌদ্ধগণ ভগবান বুদ্ধের পূজা করে এবং পঞ্চশীল, অষ্টশীল, সূত্রপথ, সূত্রশ্রাবণ, সম্মিলিত আরাধনা এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থা করে। ধর্মীয় রীতি ছাড়াও সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির ব্যবস্থা করা হয়। অনেক বৌদ্ধ বিহারে তিনদিন ধরে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। অনেকে বৌদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির অতি উন্নত নিদর্শন মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর এবং ময়নামতির বিখ্যাত বিহারগুলির ধ্বংসাবশেষ দেখতে যায়। এ দিনটি সরকারি ছুটি হিসেবে পালিত হয়। এ উপলক্ষে রেডিও, টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে এবং সংবাদপত্র বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। অনেক বিহার এবং প্রতিষ্ঠানাদি এ উপলক্ষে স্মারকপত্র, ম্যাগাজিন এবং বই প্রকাশ করে থাকে। অনেক গ্রামে এবং বিহারে মেলা বসে। চট্টগ্রামের বৌদ্ধপাড়া গ্রামে বোধিদ্রুম মেলা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পাহাড় এলাকার চা-বাগানে আদিবাসী জনগোষ্ঠী তাদের দেব-দেবীর নামে অনেক উৎসব করে থাকে। এ ধরনের উৎসবে ও বিয়েতে তারা তাদের শিকার করা জন্তুর মাংস খায় এবং নিজেদের তৈরি মদ পান করে। [এনামুল হক]