কৌলীন্য প্রথা: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য
NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) অ (Added Ennglish article link) |
সম্পাদনা সারাংশ নেই |
||
২৪ নং লাইন: | ২৪ নং লাইন: | ||
বাংলায় কৌলিন্য প্রথা কিছু নির্দিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, আঠারো এবং উনিশ শতকে এসে এর দীর্ঘস্থায়ী রূপ যেমন হয়ে পড়ে বিকৃত তেমনি দুর্বল। এটি সমাজের শুধু ব্যাধিতেই পরিণত হয় নি, বরং এটি বাংলার সমস্ত সামাজিক অবস্থাকে বিকৃত করে তোলে। বিদ্যাসাগরকে এ সামাজিক ব্যাধির সাথে অক্লান্ত সংগ্রাম করে যেতে হয়েছিল। [পি.কে ভট্টাচার্য্য ও কৃষ্ণেন্দু রায়] | বাংলায় কৌলিন্য প্রথা কিছু নির্দিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, আঠারো এবং উনিশ শতকে এসে এর দীর্ঘস্থায়ী রূপ যেমন হয়ে পড়ে বিকৃত তেমনি দুর্বল। এটি সমাজের শুধু ব্যাধিতেই পরিণত হয় নি, বরং এটি বাংলার সমস্ত সামাজিক অবস্থাকে বিকৃত করে তোলে। বিদ্যাসাগরকে এ সামাজিক ব্যাধির সাথে অক্লান্ত সংগ্রাম করে যেতে হয়েছিল। [পি.কে ভট্টাচার্য্য ও কৃষ্ণেন্দু রায়] | ||
'''গ্রন্থপঞ্জি''' অতুল সুর, বাংলার সামাজিক ইতিহাস, কলকাতা, ১৯৭৬; নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় জাতি বর্ণ প্রথা, কলকাতা, ১৯৮৭; রমেশচন্দ্র মজুমদার, বঙ্গীয় কুলশাস্ত্র, কলকাতা, ১৯৮৯; নগেন্দ্রনাথ বসু, বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ২ খন্ড, কলকাতা। | '''গ্রন্থপঞ্জি''' অতুল সুর, ''বাংলার সামাজিক ইতিহাস'', কলকাতা, ১৯৭৬; নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ''ভারতীয় জাতি বর্ণ প্রথা'', কলকাতা, ১৯৮৭; রমেশচন্দ্র মজুমদার, ''বঙ্গীয় কুলশাস্ত্র'', কলকাতা, ১৯৮৯; নগেন্দ্রনাথ বসু, ''বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস'', ২ খন্ড, কলকাতা। | ||
[[en:Kulinism]] | [[en:Kulinism]] |
০৮:৫৬, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ
কৌলীন্য প্রথা যে কোনো জাতি বা গোষ্ঠী বা বর্ণ বা সম্ভ্রান্ত বংশ যারা সামাজিক সম্মান ভোগ করে এবং ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের সামাজিক অবস্থান এবং ‘কুল’ পরিচিতি ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। এ আকাঙ্ক্ষার পরিচয় পাওয়া যায় রামায়ণএর (খ্রিস্টপূর্ব দু শতক থেকে দু খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) সময় থেকে। তাই কুলীন অর্থ হলো উত্তম পরিবার বা সম্ভ্রান্ত বংশজাত। বাচস্পতি মিশ্র-এর মতে, এটি চিহ্নিত হয় আচার (শুদ্ধতা), বিদ্যা (জ্ঞান), বিনয় (শৃঙ্খলাবোধ), প্রতিষ্ঠা (শুদ্ধতার খ্যাতি), তীর্থ-দর্শন (তীর্থযাত্রা), নিষ্ঠা (কর্তব্যনিষ্ঠা), তপস্যা (কঠোর ধ্যান), আবৃত্তি (সমবর্ণে বিবাহ) এবং দান (উদারহস্ত) দিয়ে। সাধারণত এধরনের গুণাবলি দেখা যেত ব্রাহ্মণ পরিবারে, যদিও কায়স্থ এবং বৈদ্যগণ এসব গুণ অর্জন করে তাদের সম্পদ, শিক্ষা, উত্তম ব্যবহার সংযোজিত করে কুলীন হিসেবে গণ্য হতো। এরূপ যোগ্য পরিবারের সাথে বৈবাহিক সূত্র স্থাপনের মাধ্যমে সাধিত হতো জাত্যৎকর্ষ এবং এর ফলে কোনো একটি বর্ণের ব্যক্তির জন্য কুলীন সমাজে প্রবেশের দ্বার উন্মোচিত হতো। সমাজে কৌলীন্য প্রথার উদ্ভব ঘটেছে সম্ভবত এ ভাবেই।
রাঢ় ও বরেন্দ্র এর ব্রাহ্মণদের মধ্যে কৌলীন্য প্রথা অধিক মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। তারা সম্ভবত কান্যকুব্জের পাঁচ ব্রাহ্মণ-রক্ষিতীশ, মেধতিথী, বিতরগ, সুধনিধি এবং সম্ভরি-এর উত্তরসূরি। বলা হয়ে থাকে যে, রাজা আদিশূর-এর নিমন্ত্রণে তাঁরা এখানে আসে। তবে উল্লেখ্য, আদিশূরের ঐতিহাসিকতা তর্কের উর্ধ্বে নয়। গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক এবং বর্মণ রাজা হরিবর্মণ উভয়েই যথাক্রমে শকদ্বীপী ও বৈদিক ব্রাহ্মণ নিয়ে এসেছিলেন বলে জানা যায়। বলা হয়ে থাকে, এ ব্রাহ্মণদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টির ফলস্বরূপ বাংলায় সামাজিক প্রথা হিসেবে কৌলিন্য প্রথার সূত্রপাত হয়েছে। সেন রাজা বল্লালসেনকেও কৌলিন্য প্রথার স্রষ্টা হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়, যদিও এ দাবির সমর্থনে সেন যুগের কোনো সাহিত্যিক ও উৎকীর্ণলিপি প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তৃতীয় বিগ্রহপালের বনগাঁ তাম্রশাসনে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তাঁর কর্মকর্তা ঘন্তিস-এর প্রো-পিতামহের মাধ্যমে তাঁর পূর্বপুরুষের সাথে কোলঞ্চ (কান্যকুব্জ) ব্রাহ্মণ কচ্ছ-এর যোগসূত্র ছিল। ফলে কৌলীন্য প্রথার উদ্ভব পাল শাসনামলে হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
ছয় ও সাত শতকের মধ্যে বৈদিক ব্রাহ্মণদের বিভিন্ন গোত্র, প্রবর এবং শাখা এবং শ্রৌত আচার-অনুষ্ঠান পালনকারী ব্রাহ্মণ ব্যাপক সংখ্যায় বাংলায় বসতি গড়ে তোলে। উত্তর ভারত থেকে আরও কিছু নতুন অভিবাসীর কারণে তাঁদের সংখ্যা নিয়মিত হারে বাড়তে থাকে, যার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রচুর লেখ তথ্যের মাধ্যম। আট থেকে বারো শতক পর্যন্ত সময়ে উৎকীর্ণ বহু লিপি থেকে জানা যায়, লাট (গুজরাট), মধ্যদেশ এবং স্বতন্ত্র কিছু লোকালয় যেমন ক্রোদঞ্চি বা ক্রোদঞ্চ (কোলঞ্চ), তরকরি (শ্রাবস্তি-র), মুক্তবস্ত্ত, হস্তিপদ, মৎস-বস, কুন্তির এবং চন্দবর থেকে আগত ব্যাপক সংখ্যক ব্রাহ্মণ বাংলায় বসতি স্থাপন করে। কালক্রমে বাংলায় ব্রাহ্মণরা রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র, বৈদিক এবং শকদ্বীপী প্রভৃতি শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে।
বাংলার ঘটকদের (বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনকারী) কুলজি গ্রন্থে ব্রাহ্মণ আমদানির কথা উল্লেখ রয়েছে। এ গ্রন্থগুলি বিভিন্ন নামে, যেমন কুলশাস্ত্র বা কুলগ্রন্থ বা কুলপঞ্জিকা হিসেবে পরিচিত। যদিও গ্রন্থগুলিকে একটি আলাদা শাস্ত্র হিসেবে গণ্য করা হয়, তথাপি প্রামাণিক ইতিহাসের উৎস হিসেবে পন্ডিতদের মধ্যে এগুলির প্রাচীনত্ব ও সত্যতা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বেশিরভাগ কুলশাস্ত্রে অবশ্য কনৌজ বা কোলঞ্চ থেকে আদিশূর কর্তৃক পাঁচ ব্রাহ্মণ আনার কথা উল্লিখিত আছে। রাঢ়ীয় হিসেবে পরিচিত রাঢ়ের ব্রাহ্মণ এবং বারেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বরেন্দ্রের ব্রাহ্মণ উভয়ই সে পাঁচ অভিবাসী ব্রাহ্মণকে তাদের পূর্বপুরুষ বলে দাবি করেন। সান্ডল্য নারায়ণ, বৎস্য ধরধর, কশ্যপ সুসেন, ভর্দ্বজ গৌতম এবং সবর্ন পরসর বেশিরভাগ কুলপঞ্জিকা-য় দাবি করা হয় এরাই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষ, এবং এরা রাঢ়ীয় পাঁচ পূর্বপুরুষের সন্তান বলে মনে হয়। কিছু কিছু অভিবাসী ব্রাহ্মণের সন্তানের উত্তর বাংলায় চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ দুটি সমগোত্রীয় আলাদা গোষ্ঠীর উত্থান অবশ্য আকস্মিক ছিল না, এর পেছনে বেশকিছু কারণ কাজ করেছে। কালক্রমে বাংলার দুটি অংশে আলাদা দুটি সামাজিক রীতি ও আচার গড়ে উঠেছে এবং সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আন্তঃগোত্রীয় বিবাহ উৎসাহ পায় নি।
ঠিক কখন এ দুটি দল আলাদা শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে তা বলা কঠিন, যদিও তাদের পূর্বপুরুষ ছিল এক। লক্ষ্মণসেন এর প্রধান বিচারপতি হলায়ুধের ব্রাহ্মণ-সর্বস্ব থেকে রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র দুটি আলাদা শ্রেণির অস্তিত্ব সম্পর্কে সর্বপ্রথম নির্দিষ্ট করে জানা যায়। তিনি উভয় গোষ্ঠীর বৈদিক শাস্ত্রের মূল অর্থ সংক্রান্ত অজ্ঞতাকে তিরস্কার করেছেন। পশ্চিম ও উত্তর বাংলায় মুসলিম আক্রমণের কারণে বহু ব্রাহ্মণ পূর্ব বাংলার জনপদগুলিতে অভিবাসী হয়ে যায়। বাংলার এ অঞ্চলে এরপরও প্রায় এক শতককালব্যাপী হিন্দু শাসন বজায় ছিল।
পাল রাজারা অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণু ছিলেন, এবং তাদের শাসনকালে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি তাদের খুব একটা উৎসাহ চোখে পড়ে না। মুঙ্গের ও আমগাছি তাম্রশাসনে উল্লেখিত চার বর্ণের সঠিক ক্রম রক্ষার জন্য ধর্মপাল ও দ্বিতীয় বিগ্রহপালের ভূমিকা ও ব্রাহ্মণ্য সমাজের প্রতি পালরাজাদের প্রশাসনিক নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্মণ বংশের সামলবর্মণ বৈদিক ব্রাহ্মণদের বাংলায় বসতি স্থাপনের জন্য নিয়ে আসেন। সেন বংশের বল্লাল সেনকেও কৌলিন্য প্রথার স্রষ্টা হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। বর্মণ ও সেন উভয় রাজবংশই বাংলার বাইরে থেকে ব্রাহ্মণ আমদানি এবং বাংলায় ব্রাহ্মণ-প্রাধান্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বর্মণ ও পাল উভয় রাজবংশই বাংলায় বহিরাগত এবং উভয় বংশই বাংলায় ব্রাহ্মণবাদের প্রসারে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কান্যকুব্জ থেকে পাঁচ ব্রাহ্মণের আগমনের গল্প দক্ষিণ ভারতে ইতোমধ্যেই প্রচলিত ছিল। সেন রাজবংশও দক্ষিণ ভারত থেকে এসেছিল এবং পূর্ব ভারতে তাদের রাজ্য স্থাপনের পর এ গল্পটা বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, কান্যকুব্জ থেকে ব্রাহ্মণদের নিয়ে আসা হয়েছিল।
তবে উল্লেখযোগ্য যে, সেনগণ ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষক এবং তাদের শাসন ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির উন্নয়নে বিরাট অবদান রেখেছিল। সমাজে ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা ও অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয় এবং প্রথম দিকে এর প্রয়োজন ছিল রাজার ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করতে, কেননা তাঁরা ছিল বাংলায় বহিরাগত। তবে এক পর্যায়ে ব্রাহ্মণদের ক্ষমতা শাসকদের কাছে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই, জনসাধারণ্যে ঘটা করে কৌলীন্যের দোহাই দিয়ে ব্রাহ্মণদের বিভক্তি এবং এর মাধ্যমে শাসক শ্রেণিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো একটি সম্ভাব্য গোষ্ঠীর ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, এটি ছিল ব্রাহ্মণ সমাজের প্রভাবশালী অংশের সমর্থন নিয়ে রাজকীয় শক্তিকে ক্ষমতাবান করার এক কার্যকর পদ্ধতি। রাঢ়ীয়কুল মঞ্জুরি-তে ব্রাহ্মণদের বিদ্রোহী রূপের প্রকাশ পাওয়া যায়, যেখানে একটি ব্রাহ্মণ (শ্রোত্রিয়) দলের নেতা বিকর্তন পরাক্রম সহকারে রাজার মুখোমুখি হয়েছে এবং ব্রাহ্মণদের যোগ্যতা বা অযোগ্যতার ব্যাপারে রাজার বিচার করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
রাঢ়ীয় কুলজি অনুসারে আদিশূর কর্তৃক নিয়ে আসা পাঁচ ব্রাহ্মণের সংখ্যা ক্ষিতিশূরের সময়ে ঊনষাটে এসে দাঁড়ায়। রাজা প্রত্যেককে বসবাসের জন্য একটি করে গ্রাম দান করেন, এর মাধ্যমেই রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের গাঞী-র উদ্ভব হয়। অন্যভাবে বলতে গেলে, প্রত্যেক ব্রাহ্মণ ও তাঁদের উত্তরপুরুষ যে গ্রামে বসবাস করত সে নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে। এটাই তাঁদের গাঞী (গ্রামের অধিবাসী) হয়ে ওঠে, এবং পরবর্তীকালে এটাই হয়ে যায় পারিবারিক নাম। উদাহরণ স্বরূপ, মুখতি গ্রামে বসবাসকারীর গাঞী ছিল মুখতি এবং তাদের পারিবারিক নাম মুখতি গ্রামের নামের সাথে উপাধ্যায় (শিক্ষক) সংযুক্ত করে মুখোপাধ্যায়। অন্যান্য আরও সুপরিচিত পদবি বন্দ্যোপাধ্যায় এবং চট্টোপাধ্যায় একইভাবে উদ্ভূত। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদেরও একশত গাঞী ছিল। স্বাভাবিকভাবে, কুলজি সমূহেও তাদের গাঞী সংখ্যা ও নামের বিভিন্ন রকম উল্লেখ পাওয়া যায়। ক্ষিতিশূরের পুত্র ধরশূর রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের ঊনষাট গাঞীকে মুখ্য-কুলীন, গৌণ-কুলীণ ও শ্রোত্রিয় তিনটি শাখায় ভাগ করে।
ধীরে ধীরে কৌলিন্য প্রথা বৈদ্য ও কায়স্থদেরও প্রভাবিত করে। বৈদ্যগণ রাঢ় বৈদ্য, বারেন্দ্র বৈদ্য ও সিলেটি বৈদ্য এ তিন ভাগে এবং কায়স্থগণ দক্ষিণ রাঢ় কায়স্থ, উত্তর রাঢ় কায়স্থ, বারেন্দ্র কায়স্থ, সিলেটি কায়স্থ এবং গোলাম কায়স্থ (দাস) ভাগে ভাগ হয়ে যায়। রাঢ় ব্রাহ্মণগণ কুলীন, সিদ্ধ-শ্রোত্রিয়, সদ্ধ-শ্রোত্রিয় এবং কস্থ-শ্রোত্রিয়-তে ভাগ হয়ে যায়। বিবাহের আইন অনুযায়ী একজন কুলীন পুরুষ তার নিজের শ্রেণির কোনো নারীকে অথবা তার শ্রেণির উচ্চ কোনো শ্রোত্রিয় শ্রেণির নারীকে বিবাহ করতে পারত। একজন সিদ্ধ-শ্রোত্রিয় পুরুষ তার নিজের শ্রেণির নারীকে বিবাহ করতে পারত। একজন সদ্ধ-শ্রোত্রিয় নারী তার নিজের শ্রেণির মধ্যে অথবা উচ্চ দু শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত পুরুষকে বিবাহ করতে পারত। এভাবেই কুলীন মর্যাদা বজায় রাখার লক্ষ্যে এসব রীতির উদ্ভব ঘটেছিল।
কৌলীন্য প্রথা ধীরে ধীরে সমাজপতি এবং ঘটক (পেশাজীবী ঘটক) কর্তৃক আদর্শায়িত হয়। এ উদ্দেশ্যে তারা কুলপঞ্জিকা গ্রন্থের সূত্রপাত করে। এ গ্রন্থগুলি মূলত তিন ভাগে বিভক্ত (ক) আদিকুলকারিকা এবং ডাক, (খ) কুলপঞ্জিকা, ধাকুরি, সমিকরণকণিকা ও কুলাকুল বিচার এবং (গ) কক্ষনির্ণয়, ভবনির্ণয়, ধাকুর ও আধুনিক কুলপঞ্জিকা। ভরত মল্লিক-এর চন্দ্রপভা কুলপঞ্জিকা (১৬৭৫ খিষ্টাব্দ) এবং কবিকণ্ঠহার-এর সদ্বৈদ্য কুলপঞ্জিকা (১৬৫৩ খিষ্টাব্দ) দুটি গুরুত্বপূর্ণ কুলগ্রন্থ।
কৌলীন্য প্রথা কুলীন ব্রাহ্মণদের মাঝে বহুবিবাহের প্রচলন ঘটায়। কুলীন মর্যাদা এবং সামাজিক অবস্থান টিকিয়ে রাখার নিমিত্তে কুলীন পুরুষদের সাথে শ্রোত্রিয় মহিলাদের বিয়ে দেওয়া হতো। ফলে একই শ্রেণির মধ্যে বিবাহযোগ্য শ্রোত্রিয় মহিলার অভাব দেখা দেয়। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে ঘটক ব্রাহ্মণ পণ নিয়ে তাদের বিয়ে শ্রোত্রিয় পুরুষের সাথে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করে। অন্যদিকে কুলীনদের মাঝে বিয়ের ব্যবস্থা একটি লাভজনক কর্মে পরিণত হয়। কুলীন মর্যাদা টিকিয়ে রাখতে একজন বয়স্ক পুরুষের সাথে অল্পবয়সী নারীকে যেমন বিয়ে দেওয়া হতো, তেমনি অল্প বয়স্ক একজন পুরুষের সাথে বিয়ে দেওয়া হতো বয়স্কা একজন মহিলার। তারপরও অনেক কুলীন নারী সারাজীবন অবিবাহিতই থেকে যেত। এ ঘৃণ্য প্রথা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। এমনকি, এখনও কিছু কিছু পরিবার বিয়ের মাধ্যমে এ কুলীন মর্যাদা বজায় রাখার চেষ্টা করে, যদিও এখন কৌলিন্য প্রথা তার আগের প্রাধান্য হারিয়ে ফেলেছে।
বাংলায় কৌলিন্য প্রথা কিছু নির্দিষ্ট সামাজিক-রাজনৈতিক লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, আঠারো এবং উনিশ শতকে এসে এর দীর্ঘস্থায়ী রূপ যেমন হয়ে পড়ে বিকৃত তেমনি দুর্বল। এটি সমাজের শুধু ব্যাধিতেই পরিণত হয় নি, বরং এটি বাংলার সমস্ত সামাজিক অবস্থাকে বিকৃত করে তোলে। বিদ্যাসাগরকে এ সামাজিক ব্যাধির সাথে অক্লান্ত সংগ্রাম করে যেতে হয়েছিল। [পি.কে ভট্টাচার্য্য ও কৃষ্ণেন্দু রায়]
গ্রন্থপঞ্জি অতুল সুর, বাংলার সামাজিক ইতিহাস, কলকাতা, ১৯৭৬; নগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় জাতি বর্ণ প্রথা, কলকাতা, ১৯৮৭; রমেশচন্দ্র মজুমদার, বঙ্গীয় কুলশাস্ত্র, কলকাতা, ১৯৮৯; নগেন্দ্রনাথ বসু, বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস, ২ খন্ড, কলকাতা।