গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ’র সমাধি: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
(একই ব্যবহারকারী দ্বারা সম্পাদিত একটি মধ্যবর্তী সংশোধন দেখানো হচ্ছে না)
২ নং লাইন: ২ নং লাইন:
'''গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ’র সমাধি'''  বাংলাদেশে সুলতানি আমলের টিকে থাকা একটি প্রাচীনতম সৌধ। প্রস্তর নির্মিত শবাধার সম্বলিত এ সমাধিসৌধ সোনারগাঁয়ের শাহ চিলাপুরে অবস্থিত এবং বাংলার ইলিয়াস শাহী বংশের তৃতীয় সুলতান [[গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ|গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ]]-এর সমাধি বলে কথিত। পুরাতন নগরীর দক্ষিণ উপকণ্ঠে পাঁচপীর দরগাহ থেকে প্রায় একশ ফুট পূর্বদিকে স্থানীয়ভাবে মগদিঘি নামে পরিচিত একটি মজা পুকুরের পাড়ে সমাধিসৌধটি অবস্থিত।
'''গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ’র সমাধি'''  বাংলাদেশে সুলতানি আমলের টিকে থাকা একটি প্রাচীনতম সৌধ। প্রস্তর নির্মিত শবাধার সম্বলিত এ সমাধিসৌধ সোনারগাঁয়ের শাহ চিলাপুরে অবস্থিত এবং বাংলার ইলিয়াস শাহী বংশের তৃতীয় সুলতান [[গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ|গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ]]-এর সমাধি বলে কথিত। পুরাতন নগরীর দক্ষিণ উপকণ্ঠে পাঁচপীর দরগাহ থেকে প্রায় একশ ফুট পূর্বদিকে স্থানীয়ভাবে মগদিঘি নামে পরিচিত একটি মজা পুকুরের পাড়ে সমাধিসৌধটি অবস্থিত।


[[Image:GhiyasuddinAzamShahTomb.jpg|thumb|400px|right|গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ’র সমাধি, সোনারগাঁও]]
পাথরের সুদৃশ্য কবর ফলকটি মূলত একখন্ড কালো পাথরের তৈরী এবং নৌকার তলার মতো এর উপরিভাগ অনুরূপ উপাদানে তৈরী একটি ফলকের উপর সংস্থাপিত। [[ওয়াইজ, জেমস|জৈমস ]][[ওয়াইজ, জেমস|ওয়াইজ]]-এর মতে, এটি পূর্বে প্রস্তরস্তম্ভ দ্বারা বেষ্টিত ছিল যা উপরস্থ আচ্ছাদনের ভার বহন করত। এটি পাথরের উপর খোদাই-কর্ম দ্বারা সুশোভিত ছিল। বর্তমানে এ অলংকরণ কেবল পূর্ব পার্শ্বে দৃশ্যমান। সমতল ফলকের কার্নিশটিতে পুঁতি অলংকরণের নিচে এক সারি বিলেট সজ্জা রয়েছে। এ নকশা আদিনা মসজিদের ‘বাদশা কা তকত’-এর পাথর খোদাইয়ের অনুরূপ। এ লাইনের নিচে রয়েছে সারিবদ্ধ প্যানেল যার প্রত্যেকটি ত্রিভাঁজি খিলান কুলুঙ্গি ও মধ্যভাগে ঝুলন্ত মোটিফ দ্বারা সজ্জিত। এটি দেখতে খিলানযুক্ত জানালার ছাদ হতে ঝুলন্ত সিকার নকশার মতো দেখায় এবং [[দানী, আহমদ হাসান|আহমদ হাসান দানী]] একে একটি প্রদীপের মোটিফ বলে বর্ণনা করেছেন। এ মোটিফের সঙ্গে পান্ডুয়ার [[আদিনা মসজিদ|আদিনা মসজিদ]] ও সোনারগাঁয়ের [[গোয়ালদি মসজিদ|গোয়ালদি মসজিদ]]-এর মোটিফের সাদৃশ্য রয়েছে। এর একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে যে, এখানে মোটিফগুলি দুটি শিকলে ঝোলানো, আর আদিনা মসজিদের মিহরাবে এটি একটি সম্মিলিত একক শিকলে ঝুলন্ত। পূর্বে সমাধিসৌধটির মাথার দিকে বেলে পাথরের একটি স্তম্ভে বসানো ছিল চেরাগদানি। নকশার ধরন এবং খোদাইকর্ম থেকে একে আদিনা মসজিদের সময়ের খুব কাছাকাছি বলে মনে হয়।
পাথরের সুদৃশ্য কবর ফলকটি মূলত একখন্ড কালো পাথরের তৈরী এবং নৌকার তলার মতো এর উপরিভাগ অনুরূপ উপাদানে তৈরী একটি ফলকের উপর সংস্থাপিত। [[ওয়াইজ, জেমস|জৈমস ]][[ওয়াইজ, জেমস|ওয়াইজ]]-এর মতে, এটি পূর্বে প্রস্তরস্তম্ভ দ্বারা বেষ্টিত ছিল যা উপরস্থ আচ্ছাদনের ভার বহন করত। এটি পাথরের উপর খোদাই-কর্ম দ্বারা সুশোভিত ছিল। বর্তমানে এ অলংকরণ কেবল পূর্ব পার্শ্বে দৃশ্যমান। সমতল ফলকের কার্নিশটিতে পুঁতি অলংকরণের নিচে এক সারি বিলেট সজ্জা রয়েছে। এ নকশা আদিনা মসজিদের ‘বাদশা কা তকত’-এর পাথর খোদাইয়ের অনুরূপ। এ লাইনের নিচে রয়েছে সারিবদ্ধ প্যানেল যার প্রত্যেকটি ত্রিভাঁজি খিলান কুলুঙ্গি ও মধ্যভাগে ঝুলন্ত মোটিফ দ্বারা সজ্জিত। এটি দেখতে খিলানযুক্ত জানালার ছাদ হতে ঝুলন্ত সিকার নকশার মতো দেখায় এবং [[দানী, আহমদ হাসান|আহমদ হাসান দানী]] একে একটি প্রদীপের মোটিফ বলে বর্ণনা করেছেন। এ মোটিফের সঙ্গে পান্ডুয়ার [[আদিনা মসজিদ|আদিনা মসজিদ]] ও সোনারগাঁয়ের [[গোয়ালদি মসজিদ|গোয়ালদি মসজিদ]]-এর মোটিফের সাদৃশ্য রয়েছে। এর একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে যে, এখানে মোটিফগুলি দুটি শিকলে ঝোলানো, আর আদিনা মসজিদের মিহরাবে এটি একটি সম্মিলিত একক শিকলে ঝুলন্ত। পূর্বে সমাধিসৌধটির মাথার দিকে বেলে পাথরের একটি স্তম্ভে বসানো ছিল চেরাগদানি। নকশার ধরন এবং খোদাইকর্ম থেকে একে আদিনা মসজিদের সময়ের খুব কাছাকাছি বলে মনে হয়।


সমাধিটিতে কোনো শিলালিপি নেই; তবে প্রতীয়মান হয় যে, এটাই আদিনা মসজিদের অলংকৃত নকশার অনুসরণে টিকে থাকা সর্বপ্রথম সৌধ। স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, এটি ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণকারী সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সমাধি। কাজেই সৌধটিকে পনেরো শতকের প্রথম দিকের বলে ধরে নেওয়া যায় যখন গিয়াসউদ্দীন বাংলার সুলতান ছিলেন। স্থাপত্যশিল্পের দিক থেকে সৌধটি এ সুলতানের সময়কালের, যেহেতু এতে তার পিতা  [[সিকান্দর শাহ|সিকান্দর শাহ]] কর্তৃক নির্মিত আদিনা মসজিদের অলংকরণ রীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
সমাধিটিতে কোনো শিলালিপি নেই; তবে প্রতীয়মান হয় যে, এটাই আদিনা মসজিদের অলংকৃত নকশার অনুসরণে টিকে থাকা সর্বপ্রথম সৌধ। স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, এটি ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণকারী সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সমাধি। কাজেই সৌধটিকে পনেরো শতকের প্রথম দিকের বলে ধরে নেওয়া যায় যখন গিয়াসউদ্দীন বাংলার সুলতান ছিলেন। স্থাপত্যশিল্পের দিক থেকে সৌধটি এ সুলতানের সময়কালের, যেহেতু এতে তার পিতা  [[সিকান্দর শাহ|সিকান্দর শাহ]] কর্তৃক নির্মিত আদিনা মসজিদের অলংকরণ রীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
[[Image:GhiyasuddinAzamShahTomb.jpg|thumb|right|গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ’র সমাধি, সোনারগাঁও]]


এ প্রস্তর নির্মিত সমাধিসৌধে শায়িত ব্যক্তির শনাক্তকরণ সম্পর্কে পন্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। স্থানীয় জনশ্রুতির ভিত্তিতে ড. দানী এটিকে গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সমাধি বলে মনে করেন। কিন্তু বুকানন লিখেছেন যে, তাকে হযরত পান্ডুয়ায় [[একলাখী সমাধিসৌধ|একলাখী সমাধিসৌধ]]-এ সমাহিত করা হয়েছিল। সাহিত্যিক উৎস থেকে জানা যায় যে, সুলতান সিকান্দর শাহ সোনারগাঁও থেকে প্রায় বিশ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত সুননগর গ্রামের নিকটে তার পুত্র গিয়াসউদ্দীনের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। স্থানটি সাবেক ঢাকা জেলার জাফরাবাদ মৌজার বর্তমান সনগার ও কাঁটাসুরের নিকটবর্তী হতে পারে। গিয়াসউদ্দীন এ বিয়োগান্ত ঘটনায় শোক ভারাক্রান্ত হলেও তার পারিষদবর্গের ওপর পিতার দাফনের দায়িত্ব ন্যস্ত করে সিংহাসনে তার উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি পান্ডুয়ার দিকে ধাবিত হন। এটাই অধিকতর সম্ভাব্য বলে মনে হয় যে, সিকান্দর শাহকে তড়িঘড়ি করে সোনারগাঁয়ে দাফন করা হয়েছিল। আদিনা মসজিদের পেছনে যে প্রকোষ্ঠটিকে সাধারণত সিকান্দর শাহের কবর বলে শনাক্ত করা হয় তা মোটেও কবরের মতো নয়। একসময় এটি একটি নয়গম্বুজ বিশিষ্ট প্রকোষ্ঠ ছিল; বর্তমানে গম্বুজগুলির কোনো অস্তিত্ব নেই। এ প্রকোষ্ঠে কোনো প্রস্তরনির্মিত কবর নেই। সকল সম্ভাব্য অবস্থায় এটা ছিল একটি বিশ্রামাগার এবং এমন একটি স্থান যেখান হতে সুলতানের অশ্ব পেছনের একটি দরজা দিয়ে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় পৌঁছাতে পারত। এপথে মসজিদের মধ্যে সুলতানের জন্য সুরক্ষিত বেষ্টনী ‘বাদশা-কা-তকত্’ এ যাওয়া যেত। এ বৈশিষ্ট্যটি [[ছোট সোনা মসজিদ|ছোট সোনা মসজিদ]] ও [[দরসবাড়ি মসজিদ|দরসবাড়ি মসজিদ]]-এর সঙ্গে অভিন্ন। বুকানন হ্যামিলটনের বর্ণনা এ মতকে সমর্থন করে। গোলাম হোসেন সেলিম  [[জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ|জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহ]]-এর সমাধি পান্ডুয়ায় বলে উল্লেখ করলেও বস্ত্তত তিনি এটিকে সুনির্দিষ্টভাবে একলাখী সমাধির সঙ্গে যুক্ত করেন নি। পক্ষান্তরে তিনি বলেছেন যে, পান্ডুয়ার যে সমাধিসৌধে জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহের পরিবারের সদস্যগণ অন্তিম শয্যায় শায়িত, তার উপরে একটি বিশাল বুরুজ ছিল। ‘বিশাল বুরুজ’ বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন তা সুস্পষ্ট নয়। সৈয়দ ইলাহি বখশ একলাখী সৌধের অভ্যন্তরে বড় আকারের কবরটিকে জালালউদ্দীনের এবং সবচেয়ে ছোট আকারেরটি তার পুত্রের এবং দুই কবরের মধ্যবর্তীটি জালালউদ্দীনের স্ত্রীর বলে শনাক্ত করেছেন।
এ প্রস্তর নির্মিত সমাধিসৌধে শায়িত ব্যক্তির শনাক্তকরণ সম্পর্কে পন্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। স্থানীয় জনশ্রুতির ভিত্তিতে ড. দানী এটিকে গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সমাধি বলে মনে করেন। কিন্তু বুকানন লিখেছেন যে, তাকে হযরত পান্ডুয়ায় [[একলাখী সমাধিসৌধ|একলাখী সমাধিসৌধ]]-এ সমাহিত করা হয়েছিল। সাহিত্যিক উৎস থেকে জানা যায় যে, সুলতান সিকান্দর শাহ সোনারগাঁও থেকে প্রায় বিশ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত সুননগর গ্রামের নিকটে তার পুত্র গিয়াসউদ্দীনের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। স্থানটি সাবেক ঢাকা জেলার জাফরাবাদ মৌজার বর্তমান সনগার ও কাঁটাসুরের নিকটবর্তী হতে পারে। গিয়াসউদ্দীন এ বিয়োগান্ত ঘটনায় শোক ভারাক্রান্ত হলেও তার পারিষদবর্গের ওপর পিতার দাফনের দায়িত্ব ন্যস্ত করে সিংহাসনে তার উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি পান্ডুয়ার দিকে ধাবিত হন। এটাই অধিকতর সম্ভাব্য বলে মনে হয় যে, সিকান্দর শাহকে তড়িঘড়ি করে সোনারগাঁয়ে দাফন করা হয়েছিল। আদিনা মসজিদের পেছনে যে প্রকোষ্ঠটিকে সাধারণত সিকান্দর শাহের কবর বলে শনাক্ত করা হয় তা মোটেও কবরের মতো নয়। একসময় এটি একটি নয়গম্বুজ বিশিষ্ট প্রকোষ্ঠ ছিল; বর্তমানে গম্বুজগুলির কোনো অস্তিত্ব নেই। এ প্রকোষ্ঠে কোনো প্রস্তরনির্মিত কবর নেই। সকল সম্ভাব্য অবস্থায় এটা ছিল একটি বিশ্রামাগার এবং এমন একটি স্থান যেখান হতে সুলতানের অশ্ব পেছনের একটি দরজা দিয়ে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় পৌঁছাতে পারত। এপথে মসজিদের মধ্যে সুলতানের জন্য সুরক্ষিত বেষ্টনী ‘বাদশা-কা-তকত্’ এ যাওয়া যেত। এ বৈশিষ্ট্যটি [[ছোট সোনা মসজিদ|ছোট সোনা মসজিদ]] ও [[দরসবাড়ি মসজিদ|দরসবাড়ি মসজিদ]]-এর সঙ্গে অভিন্ন। বুকানন হ্যামিলটনের বর্ণনা এ মতকে সমর্থন করে। গোলাম হোসেন সেলিম  [[জালালুদ্দীন মুহম্মদ শাহ|জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহ]]-এর সমাধি পান্ডুয়ায় বলে উল্লেখ করলেও বস্ত্তত তিনি এটিকে সুনির্দিষ্টভাবে একলাখী সমাধির সঙ্গে যুক্ত করেন নি। পক্ষান্তরে তিনি বলেছেন যে, পান্ডুয়ার যে সমাধিসৌধে জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহের পরিবারের সদস্যগণ অন্তিম শয্যায় শায়িত, তার উপরে একটি বিশাল বুরুজ ছিল। ‘বিশাল বুরুজ’ বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন তা সুস্পষ্ট নয়। সৈয়দ ইলাহি বখশ একলাখী সৌধের অভ্যন্তরে বড় আকারের কবরটিকে জালালউদ্দীনের এবং সবচেয়ে ছোট আকারেরটি তার পুত্রের এবং দুই কবরের মধ্যবর্তীটি জালালউদ্দীনের স্ত্রীর বলে শনাক্ত করেছেন।


ঐতিহাসিকদের মধ্যে একমাত্র বুকাননই কবর তিনটিকে গিয়াসউদ্দীন, জৈনউদ্দীন ও ওয়াজউদ্দীনের বলে ধারণা করেছেন। যেহেতু গিয়াসউদ্দীন পান্ডুয়ায় এবং সিকান্দর শাহ সোনারগাঁয়ে মৃত্যুবরণ করেন, সেহেতু এটাই যুক্তিসঙ্গতভাবে অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য যে, গিয়াসউদ্দীনকে পান্ডুয়ায় এবং সিকান্দর শাহকে সোনারগাঁয়ে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। একথা বলাই যথেষ্ট যে, গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ ছিলেন মহান নির্মাতা এবং স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মাবলম্বী কারিগরদের পৃষ্ঠপোষক আর একলাখী সমাধিসৌধটি ছিল দুই শিল্পরীতির সমন্বয়। বাংলার যে প্রচলিত পোড়ামাটির অলংকরণ শিল্পে হিন্দুরা দক্ষতা অর্জন করে, তা এ সমাধিসৌধে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রকৃতই এটি পোড়ামাটির অলংকরণ শিল্পের একটি জাদুঘর যেখানে তেরো ধরনের নকশা এর দেয়ালের উপরিভাগকে সুসজ্জিত করেছে। গিয়াসউদ্দীন তাঁর প্রথম জীবন সোনারগাঁয়ে এবং পরবর্তী সময়কাল গৌড়ে অতিবাহিত করেন। সবদিক বিবেচনায় এটিই স্বাভাবিক যে, সোনারগাঁয়ের বর্তমান সমাধিসৌধটি তিনি তাঁর পিতার জন্য নির্মাণ করেছিলেন এবং পান্ডুয়ার বিখ্যাত একলাখী সমাধিসৌধ তৈরি করেছিলেন নিজের শেষ শয্যার জন্য।  [হাবিবা খাতুন]
ঐতিহাসিকদের মধ্যে একমাত্র বুকাননই কবর তিনটিকে গিয়াসউদ্দীন, জৈনউদ্দীন ও ওয়াজউদ্দীনের বলে ধারণা করেছেন। যেহেতু গিয়াসউদ্দীন পান্ডুয়ায় এবং সিকান্দর শাহ সোনারগাঁয়ে মৃত্যুবরণ করেন, সেহেতু এটাই যুক্তিসঙ্গতভাবে অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য যে, গিয়াসউদ্দীনকে পান্ডুয়ায় এবং সিকান্দর শাহকে সোনারগাঁয়ে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। একথা বলাই যথেষ্ট যে, গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ ছিলেন মহান নির্মাতা এবং স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মাবলম্বী কারিগরদের পৃষ্ঠপোষক আর একলাখী সমাধিসৌধটি ছিল দুই শিল্পরীতির সমন্বয়। বাংলার যে প্রচলিত পোড়ামাটির অলংকরণ শিল্পে হিন্দুরা দক্ষতা অর্জন করে, তা এ সমাধিসৌধে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রকৃতই এটি পোড়ামাটির অলংকরণ শিল্পের একটি জাদুঘর যেখানে তেরো ধরনের নকশা এর দেয়ালের উপরিভাগকে সুসজ্জিত করেছে। গিয়াসউদ্দীন তাঁর প্রথম জীবন সোনারগাঁয়ে এবং পরবর্তী সময়কাল গৌড়ে অতিবাহিত করেন। সবদিক বিবেচনায় এটিই স্বাভাবিক যে, সোনারগাঁয়ের বর্তমান সমাধিসৌধটি তিনি তাঁর পিতার জন্য নির্মাণ করেছিলেন এবং পান্ডুয়ার বিখ্যাত একলাখী সমাধিসৌধ তৈরি করেছিলেন নিজের শেষ শয্যার জন্য।  [হাবিবা খাতুন]
'''গ্রন্থপঞ্জি''' James Wise, Journal of the Asiatic Society of Bengal, XLIII, Calcutta, 1874; Ghulam Husain Salim, Reaz-us Salatin, Calcutta,1904; JN Sarkar, History of Bengal, Vol- II, Dhaka, 1948; AH Dani, Muslim Architecture of Bengal, Dhaka 1961.


[[en:Ghiyasuddin Azam Shah’s Tomb]]
[[en:Ghiyasuddin Azam Shah’s Tomb]]

১০:০৬, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ’র সমাধি  বাংলাদেশে সুলতানি আমলের টিকে থাকা একটি প্রাচীনতম সৌধ। প্রস্তর নির্মিত শবাধার সম্বলিত এ সমাধিসৌধ সোনারগাঁয়ের শাহ চিলাপুরে অবস্থিত এবং বাংলার ইলিয়াস শাহী বংশের তৃতীয় সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ-এর সমাধি বলে কথিত। পুরাতন নগরীর দক্ষিণ উপকণ্ঠে পাঁচপীর দরগাহ থেকে প্রায় একশ ফুট পূর্বদিকে স্থানীয়ভাবে মগদিঘি নামে পরিচিত একটি মজা পুকুরের পাড়ে সমাধিসৌধটি অবস্থিত।

গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ’র সমাধি, সোনারগাঁও

পাথরের সুদৃশ্য কবর ফলকটি মূলত একখন্ড কালো পাথরের তৈরী এবং নৌকার তলার মতো এর উপরিভাগ অনুরূপ উপাদানে তৈরী একটি ফলকের উপর সংস্থাপিত। জৈমস ওয়াইজ-এর মতে, এটি পূর্বে প্রস্তরস্তম্ভ দ্বারা বেষ্টিত ছিল যা উপরস্থ আচ্ছাদনের ভার বহন করত। এটি পাথরের উপর খোদাই-কর্ম দ্বারা সুশোভিত ছিল। বর্তমানে এ অলংকরণ কেবল পূর্ব পার্শ্বে দৃশ্যমান। সমতল ফলকের কার্নিশটিতে পুঁতি অলংকরণের নিচে এক সারি বিলেট সজ্জা রয়েছে। এ নকশা আদিনা মসজিদের ‘বাদশা কা তকত’-এর পাথর খোদাইয়ের অনুরূপ। এ লাইনের নিচে রয়েছে সারিবদ্ধ প্যানেল যার প্রত্যেকটি ত্রিভাঁজি খিলান কুলুঙ্গি ও মধ্যভাগে ঝুলন্ত মোটিফ দ্বারা সজ্জিত। এটি দেখতে খিলানযুক্ত জানালার ছাদ হতে ঝুলন্ত সিকার নকশার মতো দেখায় এবং আহমদ হাসান দানী একে একটি প্রদীপের মোটিফ বলে বর্ণনা করেছেন। এ মোটিফের সঙ্গে পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ ও সোনারগাঁয়ের গোয়ালদি মসজিদ-এর মোটিফের সাদৃশ্য রয়েছে। এর একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে যে, এখানে মোটিফগুলি দুটি শিকলে ঝোলানো, আর আদিনা মসজিদের মিহরাবে এটি একটি সম্মিলিত একক শিকলে ঝুলন্ত। পূর্বে সমাধিসৌধটির মাথার দিকে বেলে পাথরের একটি স্তম্ভে বসানো ছিল চেরাগদানি। নকশার ধরন এবং খোদাইকর্ম থেকে একে আদিনা মসজিদের সময়ের খুব কাছাকাছি বলে মনে হয়।

সমাধিটিতে কোনো শিলালিপি নেই; তবে প্রতীয়মান হয় যে, এটাই আদিনা মসজিদের অলংকৃত নকশার অনুসরণে টিকে থাকা সর্বপ্রথম সৌধ। স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, এটি ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণকারী সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সমাধি। কাজেই সৌধটিকে পনেরো শতকের প্রথম দিকের বলে ধরে নেওয়া যায় যখন গিয়াসউদ্দীন বাংলার সুলতান ছিলেন। স্থাপত্যশিল্পের দিক থেকে সৌধটি এ সুলতানের সময়কালের, যেহেতু এতে তার পিতা  সিকান্দর শাহ কর্তৃক নির্মিত আদিনা মসজিদের অলংকরণ রীতি অনুসরণ করা হয়েছে।

এ প্রস্তর নির্মিত সমাধিসৌধে শায়িত ব্যক্তির শনাক্তকরণ সম্পর্কে পন্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। স্থানীয় জনশ্রুতির ভিত্তিতে ড. দানী এটিকে গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সমাধি বলে মনে করেন। কিন্তু বুকানন লিখেছেন যে, তাকে হযরত পান্ডুয়ায় একলাখী সমাধিসৌধ-এ সমাহিত করা হয়েছিল। সাহিত্যিক উৎস থেকে জানা যায় যে, সুলতান সিকান্দর শাহ সোনারগাঁও থেকে প্রায় বিশ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত সুননগর গ্রামের নিকটে তার পুত্র গিয়াসউদ্দীনের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। স্থানটি সাবেক ঢাকা জেলার জাফরাবাদ মৌজার বর্তমান সনগার ও কাঁটাসুরের নিকটবর্তী হতে পারে। গিয়াসউদ্দীন এ বিয়োগান্ত ঘটনায় শোক ভারাক্রান্ত হলেও তার পারিষদবর্গের ওপর পিতার দাফনের দায়িত্ব ন্যস্ত করে সিংহাসনে তার উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি পান্ডুয়ার দিকে ধাবিত হন। এটাই অধিকতর সম্ভাব্য বলে মনে হয় যে, সিকান্দর শাহকে তড়িঘড়ি করে সোনারগাঁয়ে দাফন করা হয়েছিল। আদিনা মসজিদের পেছনে যে প্রকোষ্ঠটিকে সাধারণত সিকান্দর শাহের কবর বলে শনাক্ত করা হয় তা মোটেও কবরের মতো নয়। একসময় এটি একটি নয়গম্বুজ বিশিষ্ট প্রকোষ্ঠ ছিল; বর্তমানে গম্বুজগুলির কোনো অস্তিত্ব নেই। এ প্রকোষ্ঠে কোনো প্রস্তরনির্মিত কবর নেই। সকল সম্ভাব্য অবস্থায় এটা ছিল একটি বিশ্রামাগার এবং এমন একটি স্থান যেখান হতে সুলতানের অশ্ব পেছনের একটি দরজা দিয়ে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় পৌঁছাতে পারত। এপথে মসজিদের মধ্যে সুলতানের জন্য সুরক্ষিত বেষ্টনী ‘বাদশা-কা-তকত্’ এ যাওয়া যেত। এ বৈশিষ্ট্যটি ছোট সোনা মসজিদদরসবাড়ি মসজিদ-এর সঙ্গে অভিন্ন। বুকানন হ্যামিলটনের বর্ণনা এ মতকে সমর্থন করে। গোলাম হোসেন সেলিম  জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহ-এর সমাধি পান্ডুয়ায় বলে উল্লেখ করলেও বস্ত্তত তিনি এটিকে সুনির্দিষ্টভাবে একলাখী সমাধির সঙ্গে যুক্ত করেন নি। পক্ষান্তরে তিনি বলেছেন যে, পান্ডুয়ার যে সমাধিসৌধে জালালউদ্দীন মুহম্মদ শাহের পরিবারের সদস্যগণ অন্তিম শয্যায় শায়িত, তার উপরে একটি বিশাল বুরুজ ছিল। ‘বিশাল বুরুজ’ বলতে তিনি কি বুঝিয়েছেন তা সুস্পষ্ট নয়। সৈয়দ ইলাহি বখশ একলাখী সৌধের অভ্যন্তরে বড় আকারের কবরটিকে জালালউদ্দীনের এবং সবচেয়ে ছোট আকারেরটি তার পুত্রের এবং দুই কবরের মধ্যবর্তীটি জালালউদ্দীনের স্ত্রীর বলে শনাক্ত করেছেন।

ঐতিহাসিকদের মধ্যে একমাত্র বুকাননই কবর তিনটিকে গিয়াসউদ্দীন, জৈনউদ্দীন ও ওয়াজউদ্দীনের বলে ধারণা করেছেন। যেহেতু গিয়াসউদ্দীন পান্ডুয়ায় এবং সিকান্দর শাহ সোনারগাঁয়ে মৃত্যুবরণ করেন, সেহেতু এটাই যুক্তিসঙ্গতভাবে অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য যে, গিয়াসউদ্দীনকে পান্ডুয়ায় এবং সিকান্দর শাহকে সোনারগাঁয়ে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। একথা বলাই যথেষ্ট যে, গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ ছিলেন মহান নির্মাতা এবং স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মাবলম্বী কারিগরদের পৃষ্ঠপোষক আর একলাখী সমাধিসৌধটি ছিল দুই শিল্পরীতির সমন্বয়। বাংলার যে প্রচলিত পোড়ামাটির অলংকরণ শিল্পে হিন্দুরা দক্ষতা অর্জন করে, তা এ সমাধিসৌধে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। প্রকৃতই এটি পোড়ামাটির অলংকরণ শিল্পের একটি জাদুঘর যেখানে তেরো ধরনের নকশা এর দেয়ালের উপরিভাগকে সুসজ্জিত করেছে। গিয়াসউদ্দীন তাঁর প্রথম জীবন সোনারগাঁয়ে এবং পরবর্তী সময়কাল গৌড়ে অতিবাহিত করেন। সবদিক বিবেচনায় এটিই স্বাভাবিক যে, সোনারগাঁয়ের বর্তমান সমাধিসৌধটি তিনি তাঁর পিতার জন্য নির্মাণ করেছিলেন এবং পান্ডুয়ার বিখ্যাত একলাখী সমাধিসৌধ তৈরি করেছিলেন নিজের শেষ শয্যার জন্য।  [হাবিবা খাতুন]

গ্রন্থপঞ্জি James Wise, Journal of the Asiatic Society of Bengal, XLIII, Calcutta, 1874; Ghulam Husain Salim, Reaz-us Salatin, Calcutta,1904; JN Sarkar, History of Bengal, Vol- II, Dhaka, 1948; AH Dani, Muslim Architecture of Bengal, Dhaka 1961.