বিক্রমপুর: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
৪ নং লাইন: ৪ নং লাইন:
মুগল আমলে পরগনা হিসেবে বিক্রমপুর নামটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ষোড়শ শতকে টোডরমলের রাজস্ব ব্যবস্থায় এর নাম দেখা যায়। তখন এ [[পরগনা|পরগনা]] থেকে রাজস্ব হিসেবে ৮৩,৩৭৬ টাকা প্রদান করা হতো। ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়ে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১,০৩,০০১ টাকা এবং ১৭৬৩ সাল নাগাদ তা আবার হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২৪,৫৬৮ টাকায়। এর কারণ, এর মধ্য থেকে রাজনগর ও বৈকুণ্ঠপুর নামক দুটি নতুন পরগনার আবির্ভাব। পদ্মার ধ্বংসাত্মক প্রকৃতিও এর জন্য কিছুটা দায়ী। বর্তমানে এমনকি সরকারিভাবেও এ নামটির অস্তিত্ব নেই। কিন্তু মুন্সিগঞ্জের এক বিস্তৃত অঞ্চলের অধিবাসীরা এখনও নিজেদেরকে বিক্রমপুরের বাসিন্দা হিসেবে উল্লেখ করতে গর্ব বোধ করে, যা অবশ্যই অঞ্চলটির অতীতের গৌরব থেকে উদ্ভূত।
মুগল আমলে পরগনা হিসেবে বিক্রমপুর নামটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ষোড়শ শতকে টোডরমলের রাজস্ব ব্যবস্থায় এর নাম দেখা যায়। তখন এ [[পরগনা|পরগনা]] থেকে রাজস্ব হিসেবে ৮৩,৩৭৬ টাকা প্রদান করা হতো। ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়ে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১,০৩,০০১ টাকা এবং ১৭৬৩ সাল নাগাদ তা আবার হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২৪,৫৬৮ টাকায়। এর কারণ, এর মধ্য থেকে রাজনগর ও বৈকুণ্ঠপুর নামক দুটি নতুন পরগনার আবির্ভাব। পদ্মার ধ্বংসাত্মক প্রকৃতিও এর জন্য কিছুটা দায়ী। বর্তমানে এমনকি সরকারিভাবেও এ নামটির অস্তিত্ব নেই। কিন্তু মুন্সিগঞ্জের এক বিস্তৃত অঞ্চলের অধিবাসীরা এখনও নিজেদেরকে বিক্রমপুরের বাসিন্দা হিসেবে উল্লেখ করতে গর্ব বোধ করে, যা অবশ্যই অঞ্চলটির অতীতের গৌরব থেকে উদ্ভূত।


[[Image:Vikramapura.jpg|thumb|400px|right]]
প্রাচীনকালে নিঃসন্দেহে বিক্রমপুর [[বঙ্গ|বঙ্গ]] জনপদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল। অঞ্চলটি খ্রিস্টীয় দশ শতকের শুরু থেকে তেরো শতকের প্রথম পর্যন্ত চন্দ্র, বর্মন ও সেন রাজাদের রাজধানী ছিল। বিক্রমপুরের উল্লেখ ‘স খলু শ্রী বিক্রমপুর সমাবাসিত শ্রীমজ্জয়স্কন্ধবারাত’ (বিজয় অথবা রাজধানীর রাজকীয় স্থান যা বিক্রমপুরে অবস্থিত)-রূপে শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনে সর্বপ্রথম দেখা যায় এবং পরবর্তী বর্মন ও সেন রাজবংশের শাসনামলে বিক্রমপুরের এ মর্যাদা অব্যাহত ছিল। এমনকি সেনদের শাসনামলে, যাঁরা বলতে গেলে প্রায় সমগ্র বঙ্গের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন, বিক্রমপুর তাঁদের রাজধানী রূপে বলবৎ ছিল এবং নদীয়ায় মুসলমান আক্রমণকারী [[বখতিয়ার খলজী|বখতিয়ার খলজী]]র হাতে পরাজিত হওয়ার পর [[লক্ষ্মণসেন|লক্ষ্মণসেন]] এ অঞ্চলে এসেছিলেন। তাঁর দুই পুত্র বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন স্বল্পকালের জন্য এ অঞ্চল শাসন করেছিলেন। বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেনের তাম্রশাসনগুলিতে রাজধানী রূপে বিক্রমপুরের উল্লেখ না থাকলেও তাঁরা যে ভূমি দান করেছিলেন তার অবস্থান ছিল বিক্রমপুর ভাগে। এতে এ অঞ্চলের ওপর তাঁদের কর্তৃত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিক্রমপুরের খ্যাতি ১২৮০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এসময় দনুজমাধব দশরথদেব কিংবা জিয়াউদ্দীন বরনীর [[দনুজ রায়, রাজা|দনুজ রায়]] সুবর্ণ গ্রামের (সোনারগাঁও) সন্নিকটে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন। তখন থেকে সমগ্র সুলতানি আমলে এ অঞ্চলটি বিস্মৃতির পাতায় থেকে যায়। এরপর মুগল যুগে রাজস্ব তালিকায় শুধু পরগনা হিসেবে এর নামের উল্লেখ পুনরায় দেখা যায়। মুগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্রমপুরের জমিদার [[চাঁদ রায়|চাঁদ রায়]] ও [[কেদার রায়|কেদার রায়]]এর (বাংলার [[বারো ভূঁইয়া|বারো ভূঁইয়া]]দের উল্লেখযোগ্য দুজন) বীরোচিত প্রতিরোধ বিক্রমপুরকে কিছুটা স্বল্পস্থায়ী গৌরব প্রদান করে।''' '''
প্রাচীনকালে নিঃসন্দেহে বিক্রমপুর [[বঙ্গ|বঙ্গ]] জনপদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল। অঞ্চলটি খ্রিস্টীয় দশ শতকের শুরু থেকে তেরো শতকের প্রথম পর্যন্ত চন্দ্র, বর্মন ও সেন রাজাদের রাজধানী ছিল। বিক্রমপুরের উল্লেখ ‘স খলু শ্রী বিক্রমপুর সমাবাসিত শ্রীমজ্জয়স্কন্ধবারাত’ (বিজয় অথবা রাজধানীর রাজকীয় স্থান যা বিক্রমপুরে অবস্থিত)-রূপে শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনে সর্বপ্রথম দেখা যায় এবং পরবর্তী বর্মন ও সেন রাজবংশের শাসনামলে বিক্রমপুরের এ মর্যাদা অব্যাহত ছিল। এমনকি সেনদের শাসনামলে, যাঁরা বলতে গেলে প্রায় সমগ্র বঙ্গের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন, বিক্রমপুর তাঁদের রাজধানী রূপে বলবৎ ছিল এবং নদীয়ায় মুসলমান আক্রমণকারী [[বখতিয়ার খলজী|বখতিয়ার খলজী]]র হাতে পরাজিত হওয়ার পর [[লক্ষ্মণসেন|লক্ষ্মণসেন]] এ অঞ্চলে এসেছিলেন। তাঁর দুই পুত্র বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন স্বল্পকালের জন্য এ অঞ্চল শাসন করেছিলেন। বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেনের তাম্রশাসনগুলিতে রাজধানী রূপে বিক্রমপুরের উল্লেখ না থাকলেও তাঁরা যে ভূমি দান করেছিলেন তার অবস্থান ছিল বিক্রমপুর ভাগে। এতে এ অঞ্চলের ওপর তাঁদের কর্তৃত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিক্রমপুরের খ্যাতি ১২৮০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এসময় দনুজমাধব দশরথদেব কিংবা জিয়াউদ্দীন বরনীর [[দনুজ রায়, রাজা|দনুজ রায়]] সুবর্ণ গ্রামের (সোনারগাঁও) সন্নিকটে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন। তখন থেকে সমগ্র সুলতানি আমলে এ অঞ্চলটি বিস্মৃতির পাতায় থেকে যায়। এরপর মুগল যুগে রাজস্ব তালিকায় শুধু পরগনা হিসেবে এর নামের উল্লেখ পুনরায় দেখা যায়। মুগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্রমপুরের জমিদার [[চাঁদ রায়|চাঁদ রায়]] ও [[কেদার রায়|কেদার রায়]]এর (বাংলার [[বারো ভূঁইয়া|বারো ভূঁইয়া]]দের উল্লেখযোগ্য দুজন) বীরোচিত প্রতিরোধ বিক্রমপুরকে কিছুটা স্বল্পস্থায়ী গৌরব প্রদান করে।''' '''


বর্তমানে বিক্রমপুর মুন্সিগঞ্জ জেলার এক বিস্তৃত অঞ্চল এবং কোন এক সময়ে তা পদ্মা অতিক্রম করে ফরিদপুরের কিয়দংশের ওপর বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু একথা বলতেই হয় যে, উক্ত নামের অঞ্চলের প্রকৃত সীমা নির্ধারণ করা খুবই কষ্ট সাধ্য। অঞ্চলটির ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যাবলির ওপর ভিত্তি করে নির্ভুলতার কোন দাবি না করে সীমানা নির্ধারণের একটি চেষ্টা চালানো যায়। [[থাকবস্ত জরিপ|থাকবস্ত জরিপ]] মানচিত্রে (১৮৪৫-১৮৭৭ সাল) কীর্তিনাশার (মেঘনার সঙ্গে মিলিত হওয়ার ঠিক পূর্ববর্তী পদ্মা) কোন উল্লেখ নেই। পশ্চিমে পদ্মা, উত্তর ও পূর্বে ধলেশ্বরী এবং দক্ষিণে আড়িয়াল ও মেঘনার সংযোগস্থলের মধ্যবর্তী অঞ্চল নিয়ে বিক্রমপুর গঠিত। জনৈক স্থানীয় কবি লালা রামগতি তাঁর মায়াতিমিরচন্দ্রিকা-তে উল্লেখ করেন যে, বিক্রমপুর নামক সুন্দর রাজ্যে অনেক ব্রাহ্মণ পন্ডিত ছিলেন এবং এ বিক্রমপুর পূর্বে ব্রহ্মপুত্র মহাতীর্থ এবং পশ্চিমে পদ্মাবতীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ছোট নদী কালীগঙ্গা (১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের জেমস রেনেলের মানচিত্রে দৃষ্ট) প্রবাহিত এবং এর উত্তর তীরে ইদ্রাকপুর (মুন্সিগঞ্জ), ফিরিঙ্গিবাজার, আব্দুল্লাপুর, মীরগঞ্জ, সিরাজদিখা, সেকেরনগর, হাসারা, ষোলঘর, বাড়ৈখালি, থাওদিয়া, বালিগাঁও, রাজাবাড়ি প্রভৃতি ও দক্ষিণে মুলফতগঞ্জ, করাতিকল, জপসা, কান্দাপাড়া, শ্যামসুন্দর, খিলগাঁও, সারেঙ্গা, চিকন্দী, গঙ্গানগর, রাধানগর, রাজনগর, ঘাগরিয়া, লড়িকল প্রভৃতি সমৃদ্ধিশালী গ্রামসমূহ প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। সতের শতকে পদ্মা এ অঞ্চলের ব্যাপক ধ্বংস সাধন করে এবং চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের মহৎ কীর্তিগুলি গ্রাস করে কীর্তিনাশা অর্থাৎ পুরাকীর্তির বিনাশক নামে আখ্যায়িত হয়। পদ্মা এ অঞ্চলের মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত। ফলে অঞ্চলটি দুটি ভাগে বিভক্ত-যথা, উত্তর বিক্রমপুর এবং দক্ষিণ বিক্রমপুর। প্রায় দুশ বছর পূর্বে বিক্রমপুর পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ মাইল এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ৮ থেকে ১০ মাইল বিস্তৃত ছিল।
বর্তমানে বিক্রমপুর মুন্সিগঞ্জ জেলার এক বিস্তৃত অঞ্চল এবং কোন এক সময়ে তা পদ্মা অতিক্রম করে ফরিদপুরের কিয়দংশের ওপর বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু একথা বলতেই হয় যে, উক্ত নামের অঞ্চলের প্রকৃত সীমা নির্ধারণ করা খুবই কষ্ট সাধ্য। অঞ্চলটির ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যাবলির ওপর ভিত্তি করে নির্ভুলতার কোন দাবি না করে সীমানা নির্ধারণের একটি চেষ্টা চালানো যায়। [[থাকবস্ত জরিপ|থাকবস্ত জরিপ]] মানচিত্রে (১৮৪৫-১৮৭৭ সাল) কীর্তিনাশার (মেঘনার সঙ্গে মিলিত হওয়ার ঠিক পূর্ববর্তী পদ্মা) কোন উল্লেখ নেই। পশ্চিমে পদ্মা, উত্তর ও পূর্বে ধলেশ্বরী এবং দক্ষিণে আড়িয়াল ও মেঘনার সংযোগস্থলের মধ্যবর্তী অঞ্চল নিয়ে বিক্রমপুর গঠিত। জনৈক স্থানীয় কবি লালা রামগতি তাঁর মায়াতিমিরচন্দ্রিকা-তে উল্লেখ করেন যে, বিক্রমপুর নামক সুন্দর রাজ্যে অনেক ব্রাহ্মণ পন্ডিত ছিলেন এবং এ বিক্রমপুর পূর্বে ব্রহ্মপুত্র মহাতীর্থ এবং পশ্চিমে পদ্মাবতীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ছোট নদী কালীগঙ্গা (১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের জেমস রেনেলের মানচিত্রে দৃষ্ট) প্রবাহিত এবং এর উত্তর তীরে ইদ্রাকপুর (মুন্সিগঞ্জ), ফিরিঙ্গিবাজার, আব্দুল্লাপুর, মীরগঞ্জ, সিরাজদিখা, সেকেরনগর, হাসারা, ষোলঘর, বাড়ৈখালি, থাওদিয়া, বালিগাঁও, রাজাবাড়ি প্রভৃতি ও দক্ষিণে মুলফতগঞ্জ, করাতিকল, জপসা, কান্দাপাড়া, শ্যামসুন্দর, খিলগাঁও, সারেঙ্গা, চিকন্দী, গঙ্গানগর, রাধানগর, রাজনগর, ঘাগরিয়া, লড়িকল প্রভৃতি সমৃদ্ধিশালী গ্রামসমূহ প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। সতের শতকে পদ্মা এ অঞ্চলের ব্যাপক ধ্বংস সাধন করে এবং চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের মহৎ কীর্তিগুলি গ্রাস করে কীর্তিনাশা অর্থাৎ পুরাকীর্তির বিনাশক নামে আখ্যায়িত হয়। পদ্মা এ অঞ্চলের মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত। ফলে অঞ্চলটি দুটি ভাগে বিভক্ত-যথা, উত্তর বিক্রমপুর এবং দক্ষিণ বিক্রমপুর। প্রায় দুশ বছর পূর্বে বিক্রমপুর পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ মাইল এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ৮ থেকে ১০ মাইল বিস্তৃত ছিল।
[[Image:Vikramapura.jpg|thumb|400px|right|বিক্রমপুর]]


বিক্রমপুর শহরের অবস্থানকে মুন্সিগঞ্জের আধুনিক শহর থেকে অনতিদূরে রামপাল অঞ্চলের সঙ্গে শনাক্ত করা হয়েছে। অঞ্চলটির প্রত্মতাত্ত্বিক নিরীক্ষণের ভিত্তিতে অনুমেয় যে, প্রাচীন রাজধানীটি প্রায় ১৫ বর্গ মাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং সেখানে প্রায় ১৭/১৮টি গ্রাম ছিল। এ অঞ্চলের উত্তর দিকে ইছামতি নদী প্রবাহিত এবং প্রাচীন নদীর স্রোতোধারার সমান্তরালে পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত বেশ উঁচু পাঁচিলের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্ট হয়। পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্রের প্রাচীন স্রোত প্রবাহিত। পশ্চিম ও দক্ষিণে দুটি প্রশস্ত পরিখা রয়েছে যা বর্তমানে যথাক্রমে মিরকাদিম খাল ও মাকুহাটি খাল নামে পরিচিত। ২০০ ফুট প্রশস্ত পরিখা দ্বারা বেষ্টিত মাটির দুর্গে অবস্থিত বল্লালবাড়ি রাজপ্রাসাদটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। রামপালের চারপাশে প্রাক-মুসলিম যুগের অনেক পুকুর দেখা যায়। তবে স্থাপত্যের দিক দিয়ে বিভিন্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া সেযুগের অন্য কোন ইমারত কদাচিৎ নজরে পড়ে। ১৯২৯ সালে এন.কে ভট্টশালী প্রায় ৩০টি ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করেন। তিনি ধীপুর ও সোনারং নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরস্থলের কথা উল্লেখ করেন। রাখাল দাস ব্যানার্জীও রঘুরামপুরের সন্নিকটে কিছু কাঠামো দেখেন। পার্শ্ববর্তী বজ্রযোগিনী গ্রাম ছিল প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ পন্ডিত [[দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, অতীশ|অতীশ দীপঙ্কর]]এর জন্মস্থান। সমগ্র অঞ্চলটিতে অতি মূল্যবান প্রাচীন নিদর্শনসমূহ দেখা যায় যেমন, মূল্যবান ধাতুতে নির্মিত নিখুঁত কারুকার্যপূর্ণ (হিন্দু ও বৌদ্ধ) ভাস্কর্যসমূহ। এ অঞ্চল (চুরাইন) থেকে প্রাপ্ত একটি রূপার বিষ্ণুমূর্তি বর্তমানে ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। দীর্ঘ কাষ্ঠখন্ড নির্মিত অপ্সরা আকৃতির (সুরসুন্দরী) এগারো শতকের একটি স্তম্ভ (বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত) সমগ্র উপমহাদেশে এক অদ্বিতীয় নিদর্শন হিসেবে বিবেচ্য। ভাস্কর্য অলঙ্করণসহ আরও দুটি কাঠের স্তম্ভ বিখ্যাত রামপাল দিঘি (২২০০ ফুট  ৮৪০ ফুট) থেকে পাওয়া গেছে। যদিও রামপালের চতুর্দিকের বর্তমান প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য প্রাচীন কালের মহানগরীর অস্তিত্বের কোন ইঙ্গিত প্রদান করে না, তথাপি প্রাচীন নিদর্শন ও লোককাহিনীসমূহ প্রাচীন শহরের অতীতের গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। চারদিকের নদীর গতিধারাও এক সময়ের সমৃদ্ধিময় শহরের বিলুপ্তির কারণ হতে পারে। রামপালে মধ্যযুগীয় একটি মসজিদ ও  [[বাবা আদম শহীদ|বাবা আদম শহীদ]] এর সমাধির ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে একমাত্র দর্শনীয় ঐতিহাসিক নিদর্শনরূপে দাঁড়িয়ে আছে।
বিক্রমপুর শহরের অবস্থানকে মুন্সিগঞ্জের আধুনিক শহর থেকে অনতিদূরে রামপাল অঞ্চলের সঙ্গে শনাক্ত করা হয়েছে। অঞ্চলটির প্রত্মতাত্ত্বিক নিরীক্ষণের ভিত্তিতে অনুমেয় যে, প্রাচীন রাজধানীটি প্রায় ১৫ বর্গ মাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং সেখানে প্রায় ১৭/১৮টি গ্রাম ছিল। এ অঞ্চলের উত্তর দিকে ইছামতি নদী প্রবাহিত এবং প্রাচীন নদীর স্রোতোধারার সমান্তরালে পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত বেশ উঁচু পাঁচিলের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্ট হয়। পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্রের প্রাচীন স্রোত প্রবাহিত। পশ্চিম ও দক্ষিণে দুটি প্রশস্ত পরিখা রয়েছে যা বর্তমানে যথাক্রমে মিরকাদিম খাল ও মাকুহাটি খাল নামে পরিচিত। ২০০ ফুট প্রশস্ত পরিখা দ্বারা বেষ্টিত মাটির দুর্গে অবস্থিত বল্লালবাড়ি রাজপ্রাসাদটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। রামপালের চারপাশে প্রাক-মুসলিম যুগের অনেক পুকুর দেখা যায়। তবে স্থাপত্যের দিক দিয়ে বিভিন্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া সেযুগের অন্য কোন ইমারত কদাচিৎ নজরে পড়ে। ১৯২৯ সালে এন.কে ভট্টশালী প্রায় ৩০টি ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করেন। তিনি ধীপুর ও সোনারং নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরস্থলের কথা উল্লেখ করেন। রাখাল দাস ব্যানার্জীও রঘুরামপুরের সন্নিকটে কিছু কাঠামো দেখেন। পার্শ্ববর্তী বজ্রযোগিনী গ্রাম ছিল প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ পন্ডিত [[দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, অতীশ|অতীশ দীপঙ্কর]]এর জন্মস্থান। সমগ্র অঞ্চলটিতে অতি মূল্যবান প্রাচীন নিদর্শনসমূহ দেখা যায় যেমন, মূল্যবান ধাতুতে নির্মিত নিখুঁত কারুকার্যপূর্ণ (হিন্দু ও বৌদ্ধ) ভাস্কর্যসমূহ। এ অঞ্চল (চুরাইন) থেকে প্রাপ্ত একটি রূপার বিষ্ণুমূর্তি বর্তমানে ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। দীর্ঘ কাষ্ঠখন্ড নির্মিত অপ্সরা আকৃতির (সুরসুন্দরী) এগারো শতকের একটি স্তম্ভ (বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত) সমগ্র উপমহাদেশে এক অদ্বিতীয় নিদর্শন হিসেবে বিবেচ্য। ভাস্কর্য অলঙ্করণসহ আরও দুটি কাঠের স্তম্ভ বিখ্যাত রামপাল দিঘি (২২০০ ফুট  ৮৪০ ফুট) থেকে পাওয়া গেছে। যদিও রামপালের চতুর্দিকের বর্তমান প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য প্রাচীন কালের মহানগরীর অস্তিত্বের কোন ইঙ্গিত প্রদান করে না, তথাপি প্রাচীন নিদর্শন ও লোককাহিনীসমূহ প্রাচীন শহরের অতীতের গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। চারদিকের নদীর গতিধারাও এক সময়ের সমৃদ্ধিময় শহরের বিলুপ্তির কারণ হতে পারে। রামপালে মধ্যযুগীয় একটি মসজিদ ও  [[বাবা আদম শহীদ|বাবা আদম শহীদ]] এর সমাধির ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে একমাত্র দর্শনীয় ঐতিহাসিক নিদর্শনরূপে দাঁড়িয়ে আছে।

০৫:৩৯, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

বিক্রমপুর প্রাচীন বঙ্গের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার একটি অঞ্চল হিসেবে শুধু বিক্রমপুর নামটি বেঁচে আছে। দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের প্রাচীন রাজ্যের রাজধানী বিক্রমপুর শহরের ধ্বংসাবশেষ বিলীন হয়ে গেছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এর অবস্থান সম্পর্কে শুধু ধারণা করা যায়।

মুগল আমলে পরগনা হিসেবে বিক্রমপুর নামটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ষোড়শ শতকে টোডরমলের রাজস্ব ব্যবস্থায় এর নাম দেখা যায়। তখন এ পরগনা থেকে রাজস্ব হিসেবে ৮৩,৩৭৬ টাকা প্রদান করা হতো। ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়ে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১,০৩,০০১ টাকা এবং ১৭৬৩ সাল নাগাদ তা আবার হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ২৪,৫৬৮ টাকায়। এর কারণ, এর মধ্য থেকে রাজনগর ও বৈকুণ্ঠপুর নামক দুটি নতুন পরগনার আবির্ভাব। পদ্মার ধ্বংসাত্মক প্রকৃতিও এর জন্য কিছুটা দায়ী। বর্তমানে এমনকি সরকারিভাবেও এ নামটির অস্তিত্ব নেই। কিন্তু মুন্সিগঞ্জের এক বিস্তৃত অঞ্চলের অধিবাসীরা এখনও নিজেদেরকে বিক্রমপুরের বাসিন্দা হিসেবে উল্লেখ করতে গর্ব বোধ করে, যা অবশ্যই অঞ্চলটির অতীতের গৌরব থেকে উদ্ভূত।

প্রাচীনকালে নিঃসন্দেহে বিক্রমপুর বঙ্গ জনপদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল। অঞ্চলটি খ্রিস্টীয় দশ শতকের শুরু থেকে তেরো শতকের প্রথম পর্যন্ত চন্দ্র, বর্মন ও সেন রাজাদের রাজধানী ছিল। বিক্রমপুরের উল্লেখ ‘স খলু শ্রী বিক্রমপুর সমাবাসিত শ্রীমজ্জয়স্কন্ধবারাত’ (বিজয় অথবা রাজধানীর রাজকীয় স্থান যা বিক্রমপুরে অবস্থিত)-রূপে শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনে সর্বপ্রথম দেখা যায় এবং পরবর্তী বর্মন ও সেন রাজবংশের শাসনামলে বিক্রমপুরের এ মর্যাদা অব্যাহত ছিল। এমনকি সেনদের শাসনামলে, যাঁরা বলতে গেলে প্রায় সমগ্র বঙ্গের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন, বিক্রমপুর তাঁদের রাজধানী রূপে বলবৎ ছিল এবং নদীয়ায় মুসলমান আক্রমণকারী বখতিয়ার খলজীর হাতে পরাজিত হওয়ার পর লক্ষ্মণসেন এ অঞ্চলে এসেছিলেন। তাঁর দুই পুত্র বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন স্বল্পকালের জন্য এ অঞ্চল শাসন করেছিলেন। বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেনের তাম্রশাসনগুলিতে রাজধানী রূপে বিক্রমপুরের উল্লেখ না থাকলেও তাঁরা যে ভূমি দান করেছিলেন তার অবস্থান ছিল বিক্রমপুর ভাগে। এতে এ অঞ্চলের ওপর তাঁদের কর্তৃত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিক্রমপুরের খ্যাতি ১২৮০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এসময় দনুজমাধব দশরথদেব কিংবা জিয়াউদ্দীন বরনীর দনুজ রায় সুবর্ণ গ্রামের (সোনারগাঁও) সন্নিকটে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন। তখন থেকে সমগ্র সুলতানি আমলে এ অঞ্চলটি বিস্মৃতির পাতায় থেকে যায়। এরপর মুগল যুগে রাজস্ব তালিকায় শুধু পরগনা হিসেবে এর নামের উল্লেখ পুনরায় দেখা যায়। মুগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায়কেদার রায়এর (বাংলার বারো ভূঁইয়াদের উল্লেখযোগ্য দুজন) বীরোচিত প্রতিরোধ বিক্রমপুরকে কিছুটা স্বল্পস্থায়ী গৌরব প্রদান করে।

বর্তমানে বিক্রমপুর মুন্সিগঞ্জ জেলার এক বিস্তৃত অঞ্চল এবং কোন এক সময়ে তা পদ্মা অতিক্রম করে ফরিদপুরের কিয়দংশের ওপর বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু একথা বলতেই হয় যে, উক্ত নামের অঞ্চলের প্রকৃত সীমা নির্ধারণ করা খুবই কষ্ট সাধ্য। অঞ্চলটির ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যাবলির ওপর ভিত্তি করে নির্ভুলতার কোন দাবি না করে সীমানা নির্ধারণের একটি চেষ্টা চালানো যায়। থাকবস্ত জরিপ মানচিত্রে (১৮৪৫-১৮৭৭ সাল) কীর্তিনাশার (মেঘনার সঙ্গে মিলিত হওয়ার ঠিক পূর্ববর্তী পদ্মা) কোন উল্লেখ নেই। পশ্চিমে পদ্মা, উত্তর ও পূর্বে ধলেশ্বরী এবং দক্ষিণে আড়িয়াল ও মেঘনার সংযোগস্থলের মধ্যবর্তী অঞ্চল নিয়ে বিক্রমপুর গঠিত। জনৈক স্থানীয় কবি লালা রামগতি তাঁর মায়াতিমিরচন্দ্রিকা-তে উল্লেখ করেন যে, বিক্রমপুর নামক সুন্দর রাজ্যে অনেক ব্রাহ্মণ পন্ডিত ছিলেন এবং এ বিক্রমপুর পূর্বে ব্রহ্মপুত্র মহাতীর্থ এবং পশ্চিমে পদ্মাবতীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এ অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ছোট নদী কালীগঙ্গা (১৭৮১ খ্রিস্টাব্দের জেমস রেনেলের মানচিত্রে দৃষ্ট) প্রবাহিত এবং এর উত্তর তীরে ইদ্রাকপুর (মুন্সিগঞ্জ), ফিরিঙ্গিবাজার, আব্দুল্লাপুর, মীরগঞ্জ, সিরাজদিখা, সেকেরনগর, হাসারা, ষোলঘর, বাড়ৈখালি, থাওদিয়া, বালিগাঁও, রাজাবাড়ি প্রভৃতি ও দক্ষিণে মুলফতগঞ্জ, করাতিকল, জপসা, কান্দাপাড়া, শ্যামসুন্দর, খিলগাঁও, সারেঙ্গা, চিকন্দী, গঙ্গানগর, রাধানগর, রাজনগর, ঘাগরিয়া, লড়িকল প্রভৃতি সমৃদ্ধিশালী গ্রামসমূহ প্রতিষ্ঠালাভ করেছে। সতের শতকে পদ্মা এ অঞ্চলের ব্যাপক ধ্বংস সাধন করে এবং চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের মহৎ কীর্তিগুলি গ্রাস করে কীর্তিনাশা অর্থাৎ পুরাকীর্তির বিনাশক নামে আখ্যায়িত হয়। পদ্মা এ অঞ্চলের মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত। ফলে অঞ্চলটি দুটি ভাগে বিভক্ত-যথা, উত্তর বিক্রমপুর এবং দক্ষিণ বিক্রমপুর। প্রায় দুশ বছর পূর্বে বিক্রমপুর পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ মাইল এবং উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রায় ৮ থেকে ১০ মাইল বিস্তৃত ছিল।

বিক্রমপুর শহরের অবস্থানকে মুন্সিগঞ্জের আধুনিক শহর থেকে অনতিদূরে রামপাল অঞ্চলের সঙ্গে শনাক্ত করা হয়েছে। অঞ্চলটির প্রত্মতাত্ত্বিক নিরীক্ষণের ভিত্তিতে অনুমেয় যে, প্রাচীন রাজধানীটি প্রায় ১৫ বর্গ মাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং সেখানে প্রায় ১৭/১৮টি গ্রাম ছিল। এ অঞ্চলের উত্তর দিকে ইছামতি নদী প্রবাহিত এবং প্রাচীন নদীর স্রোতোধারার সমান্তরালে পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত বেশ উঁচু পাঁচিলের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্ট হয়। পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্রের প্রাচীন স্রোত প্রবাহিত। পশ্চিম ও দক্ষিণে দুটি প্রশস্ত পরিখা রয়েছে যা বর্তমানে যথাক্রমে মিরকাদিম খাল ও মাকুহাটি খাল নামে পরিচিত। ২০০ ফুট প্রশস্ত পরিখা দ্বারা বেষ্টিত মাটির দুর্গে অবস্থিত বল্লালবাড়ি রাজপ্রাসাদটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। রামপালের চারপাশে প্রাক-মুসলিম যুগের অনেক পুকুর দেখা যায়। তবে স্থাপত্যের দিক দিয়ে বিভিন্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া সেযুগের অন্য কোন ইমারত কদাচিৎ নজরে পড়ে। ১৯২৯ সালে এন.কে ভট্টশালী প্রায় ৩০টি ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করেন। তিনি ধীপুর ও সোনারং নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরস্থলের কথা উল্লেখ করেন। রাখাল দাস ব্যানার্জীও রঘুরামপুরের সন্নিকটে কিছু কাঠামো দেখেন। পার্শ্ববর্তী বজ্রযোগিনী গ্রাম ছিল প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ পন্ডিত অতীশ দীপঙ্করএর জন্মস্থান। সমগ্র অঞ্চলটিতে অতি মূল্যবান প্রাচীন নিদর্শনসমূহ দেখা যায় যেমন, মূল্যবান ধাতুতে নির্মিত নিখুঁত কারুকার্যপূর্ণ (হিন্দু ও বৌদ্ধ) ভাস্কর্যসমূহ। এ অঞ্চল (চুরাইন) থেকে প্রাপ্ত একটি রূপার বিষ্ণুমূর্তি বর্তমানে ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। দীর্ঘ কাষ্ঠখন্ড নির্মিত অপ্সরা আকৃতির (সুরসুন্দরী) এগারো শতকের একটি স্তম্ভ (বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত) সমগ্র উপমহাদেশে এক অদ্বিতীয় নিদর্শন হিসেবে বিবেচ্য। ভাস্কর্য অলঙ্করণসহ আরও দুটি কাঠের স্তম্ভ বিখ্যাত রামপাল দিঘি (২২০০ ফুট  ৮৪০ ফুট) থেকে পাওয়া গেছে। যদিও রামপালের চতুর্দিকের বর্তমান প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য প্রাচীন কালের মহানগরীর অস্তিত্বের কোন ইঙ্গিত প্রদান করে না, তথাপি প্রাচীন নিদর্শন ও লোককাহিনীসমূহ প্রাচীন শহরের অতীতের গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। চারদিকের নদীর গতিধারাও এক সময়ের সমৃদ্ধিময় শহরের বিলুপ্তির কারণ হতে পারে। রামপালে মধ্যযুগীয় একটি মসজিদ ও  বাবা আদম শহীদ এর সমাধির ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে একমাত্র দর্শনীয় ঐতিহাসিক নিদর্শনরূপে দাঁড়িয়ে আছে।

রামপাল গ্রামের সঙ্গে উক্ত নামের বিখ্যাত পাল রাজার কোন সম্পর্ক রয়েছে কিনা তা নির্ণয় করা কঠিন। লিপি উৎকীর্ণ সংক্রান্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে, বর্মন রাজা ভোজবর্মন বা সামলবর্মন হাতি ও রথ প্রদানের মাধ্যমে পাল রাজা রামপালের বন্ধুত্ব লাভ করেন। এমন হতে পারে যে, রামপাল বিক্রমপুরে গিয়েছিলেন এবং প্রাসাদের নিকটবর্তী যেস্থানে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে বরণ করা হয়েছিল, সে এলাকা তাঁর নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছিল। এটা অবাস্তব যে, রামপাল বিক্রমপুর অঞ্চল তাঁর শাসনাধীনে রেখেছিলেন। জনশ্রুতি আছে যে, রামপালের নাম স্থানীয় জনৈক ব্যবসায়ীর নামানুসারে করা হয়েছিল। রামপাল নামে সমধিক পরিচিত রামানন্দ পাল  বল্লালসেনএর শাসনকালে রাজপরিবারের মুদি ছিলেন এবং তিনি অনেক ধনসম্পদের অধিকারী হন। রাজপ্রাসাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসতি স্থাপন করে তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিরূপে স্বীকৃতি লাভ করেন। যখন বল্লালসেন তাঁর দিঘি খনন করেন তখন তা রামপালের বাসস্থান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। এরূপ একটি জনশ্রুতি আছে যে, ‘বল্লাল কাটায় দিঘি নামে রামপাল’ (বল্লাল কর্তৃক   দিঘিটি উৎখনন করা হয়, কিন্তু তা রামপালের নামে পরিচিতি লাভ করে)।  [আবদুল মমিন চৌধুরী]

গ্রন্থপঞ্জি  Dilip K Chakrabarti, Ancient Bangladesh, Dhaka, 1992; যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, বিক্রমপুরের ইতিহাস, তৃতীয় সংস্করণ, কলকাতা, ১৪০৫ বাংলা সন (১৯৯৮)।