গঙ্গা নির্ভর এলাকা: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

সম্পাদনা সারাংশ নেই
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
২ নং লাইন: ২ নং লাইন:
'''গঙ্গা নির্ভর এলাকা''' (জি.ডি.এ)  গঙ্গা নদী দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত এলাকা। এ অঞ্চলের সীমারেখা নির্ধারণে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, বর্তমানকালের অর্থনৈতিক, পরিবেশ ও প্রতিবেশিক প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাধারণভাবে দেশের সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল গঙ্গা নির্ভর এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তবে  ভোলা দ্বীপ এ এলাকা বহির্ভূত এবং এর সঙ্গে আরও সংযুক্ত রয়েছে  [[গঙ্গা নদী|গঙ্গা]] ও  পদ্মা নদীর বাম তীরবর্তী দীর্ঘ সংকীর্ণভূমি যা এ দুটি নদীর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। পানি সম্পদ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পানির উৎস, সরবরাহ, প্রবাহ প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। গঙ্গা নির্ভর এলাকার অবস্থান মূলত দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল এবং দক্ষিণ-কেন্দ্রীয় অঞ্চল। এ দুইটি অঞ্চল মিলে গঠিত হয়েছে দক্ষিণপশ্চিম এলাকা। এক্ষেত্রে উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ক্ষুদ্র অংশসমূহ ভারসাম্য বিধান করছে।
'''গঙ্গা নির্ভর এলাকা''' (জি.ডি.এ)  গঙ্গা নদী দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত এলাকা। এ অঞ্চলের সীমারেখা নির্ধারণে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, বর্তমানকালের অর্থনৈতিক, পরিবেশ ও প্রতিবেশিক প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাধারণভাবে দেশের সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল গঙ্গা নির্ভর এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তবে  ভোলা দ্বীপ এ এলাকা বহির্ভূত এবং এর সঙ্গে আরও সংযুক্ত রয়েছে  [[গঙ্গা নদী|গঙ্গা]] ও  পদ্মা নদীর বাম তীরবর্তী দীর্ঘ সংকীর্ণভূমি যা এ দুটি নদীর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। পানি সম্পদ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পানির উৎস, সরবরাহ, প্রবাহ প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। গঙ্গা নির্ভর এলাকার অবস্থান মূলত দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল এবং দক্ষিণ-কেন্দ্রীয় অঞ্চল। এ দুইটি অঞ্চল মিলে গঠিত হয়েছে দক্ষিণপশ্চিম এলাকা। এক্ষেত্রে উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ক্ষুদ্র অংশসমূহ ভারসাম্য বিধান করছে।


[[Image:GangesDependentArea.jpg|thumb|400px|right]
[[Image:GangesDependentArea.jpg|thumb|400px|right]]
নদী, ভূমি এবং জোয়ারভাটা পরস্পর নির্ভরশীল। গঙ্গা নির্ভর এলাকার অর্ধেক অঞ্চলের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন মিটার উচ্চতার নিচে এবং উপকূলে জোয়ারভাটার পরিসর প্রায় তিন মিটার। সমুদ্রের লোনা পানি এবং দেশের অভ্যন্তরভূমি থেকে নিষ্কাশিত নদীর স্বাদুপানির মধ্যে সক্রিয় ভারসাম্য রক্ষা করছে জোয়ারভাটার আহ্নিক এবং পাক্ষিক ধরনটি। এ অঞ্চলের কেন্দ্রভূমিতে এ জোয়ারভাটা বিস্তৃত এবং সম্পন্ন হতে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। ব্যাপক বৃষ্টির সময় স্বাদুপানির সীমারেখাটি সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি থাকে, তবে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর লোনা পানির আগ্রাসন বৃদ্ধি পেতে থাকে। শুষ্ক মাসগুলি জুড়ে তা ক্রমশ আরও অভ্যন্তরভূমিতে প্রবেশ করে যতক্ষণ না শুষ্ক মৌসুমের শীর্ণ জলধারাগুলির অগ্রগতি প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এ অগ্রগমনের পিছনে সুন্দরবনের মতো ঈষৎলোনা পানির অঞ্চলসমূহ বিশেষ ভূমিকা পালন করে, যা অবশ্য লবণাক্ত পানির আওতার মধ্যে তবে লবণাক্ততার মাত্রা উপকূলের মতো তীব্র নয়। লোনা পানির প্রকোপ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয় স্বাদুপানির আর্দ্রভূমি অঞ্চল। মানুষ এ অঞ্চলের প্রতিটি প্রতিবেশিক অবস্থাকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে।
নদী, ভূমি এবং জোয়ারভাটা পরস্পর নির্ভরশীল। গঙ্গা নির্ভর এলাকার অর্ধেক অঞ্চলের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন মিটার উচ্চতার নিচে এবং উপকূলে জোয়ারভাটার পরিসর প্রায় তিন মিটার। সমুদ্রের লোনা পানি এবং দেশের অভ্যন্তরভূমি থেকে নিষ্কাশিত নদীর স্বাদুপানির মধ্যে সক্রিয় ভারসাম্য রক্ষা করছে জোয়ারভাটার আহ্নিক এবং পাক্ষিক ধরনটি। এ অঞ্চলের কেন্দ্রভূমিতে এ জোয়ারভাটা বিস্তৃত এবং সম্পন্ন হতে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। ব্যাপক বৃষ্টির সময় স্বাদুপানির সীমারেখাটি সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি থাকে, তবে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর লোনা পানির আগ্রাসন বৃদ্ধি পেতে থাকে। শুষ্ক মাসগুলি জুড়ে তা ক্রমশ আরও অভ্যন্তরভূমিতে প্রবেশ করে যতক্ষণ না শুষ্ক মৌসুমের শীর্ণ জলধারাগুলির অগ্রগতি প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এ অগ্রগমনের পিছনে সুন্দরবনের মতো ঈষৎলোনা পানির অঞ্চলসমূহ বিশেষ ভূমিকা পালন করে, যা অবশ্য লবণাক্ত পানির আওতার মধ্যে তবে লবণাক্ততার মাত্রা উপকূলের মতো তীব্র নয়। লোনা পানির প্রকোপ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয় স্বাদুপানির আর্দ্রভূমি অঞ্চল। মানুষ এ অঞ্চলের প্রতিটি প্রতিবেশিক অবস্থাকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে।



১০:৪২, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

গঙ্গা নির্ভর এলাকা (জি.ডি.এ)  গঙ্গা নদী দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত এলাকা। এ অঞ্চলের সীমারেখা নির্ধারণে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, বর্তমানকালের অর্থনৈতিক, পরিবেশ ও প্রতিবেশিক প্রতিক্রিয়া এবং সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সাধারণভাবে দেশের সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল গঙ্গা নির্ভর এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। তবে  ভোলা দ্বীপ এ এলাকা বহির্ভূত এবং এর সঙ্গে আরও সংযুক্ত রয়েছে  গঙ্গা ও  পদ্মা নদীর বাম তীরবর্তী দীর্ঘ সংকীর্ণভূমি যা এ দুটি নদীর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। পানি সম্পদ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পানির উৎস, সরবরাহ, প্রবাহ প্রভৃতির উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছে। গঙ্গা নির্ভর এলাকার অবস্থান মূলত দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল এবং দক্ষিণ-কেন্দ্রীয় অঞ্চল। এ দুইটি অঞ্চল মিলে গঠিত হয়েছে দক্ষিণপশ্চিম এলাকা। এক্ষেত্রে উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ক্ষুদ্র অংশসমূহ ভারসাম্য বিধান করছে।

নদী, ভূমি এবং জোয়ারভাটা পরস্পর নির্ভরশীল। গঙ্গা নির্ভর এলাকার অর্ধেক অঞ্চলের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন মিটার উচ্চতার নিচে এবং উপকূলে জোয়ারভাটার পরিসর প্রায় তিন মিটার। সমুদ্রের লোনা পানি এবং দেশের অভ্যন্তরভূমি থেকে নিষ্কাশিত নদীর স্বাদুপানির মধ্যে সক্রিয় ভারসাম্য রক্ষা করছে জোয়ারভাটার আহ্নিক এবং পাক্ষিক ধরনটি। এ অঞ্চলের কেন্দ্রভূমিতে এ জোয়ারভাটা বিস্তৃত এবং সম্পন্ন হতে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে। ব্যাপক বৃষ্টির সময় স্বাদুপানির সীমারেখাটি সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি থাকে, তবে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর লোনা পানির আগ্রাসন বৃদ্ধি পেতে থাকে। শুষ্ক মাসগুলি জুড়ে তা ক্রমশ আরও অভ্যন্তরভূমিতে প্রবেশ করে যতক্ষণ না শুষ্ক মৌসুমের শীর্ণ জলধারাগুলির অগ্রগতি প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এ অগ্রগমনের পিছনে সুন্দরবনের মতো ঈষৎলোনা পানির অঞ্চলসমূহ বিশেষ ভূমিকা পালন করে, যা অবশ্য লবণাক্ত পানির আওতার মধ্যে তবে লবণাক্ততার মাত্রা উপকূলের মতো তীব্র নয়। লোনা পানির প্রকোপ কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয় স্বাদুপানির আর্দ্রভূমি অঞ্চল। মানুষ এ অঞ্চলের প্রতিটি প্রতিবেশিক অবস্থাকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে।

গঙ্গা নির্ভর এলাকা সাধারণভাবে পরিমিতি ঢালবিশিষ্ট নিম্নভূমি অঞ্চল এবং অল্প কিছু স্থানে উচ্চভূমিও রয়েছে যাদের উচ্চতা  সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪ মিটারেরও বেশি। ভূমির এ প্রবণতা উপকূলরেখা থেকে ২৫০ কিলোমিটার অভ্যন্তরেও দেখা যায়। এ এলাকার উত্তরাংশ সুষম ঢালু  ভূসংস্থান দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। যশোর থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত ভূরেখা বরাবর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ মিটার উচ্চতায় ১ : ৭৫০০ অনুপাত ঢালে এ ভূসংস্থানের অবনমন ঘটেছে। এ রেখার দক্ষিণ ও পূর্বের ভূসংস্থান অধিক মাত্রায় সমতল এবং এখানে  বিল ও অবভূমির সংখ্যা বেশি। জোয়ারভাটার বিস্তৃতি সীমা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬ মিটার সমোন্নতি রেখা বরাবর বিদ্যমান। সমুদ্র উপকূলে জোয়ারের গড় উচ্চতা ২.৭ মিটার এবং পূর্বদিকের তুলনায় পশ্চিমে এ উচ্চতা অধিক থাকে।

বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতোই দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় বহুবিধ কারণে  বন্যা ও প্লাবন সংঘটিত হয়ে থাকে। ১৯৮৭ সালের ব্যাপক বন্যা ২ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষকে গৃহহীন করেছিল এবং ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় দেশের দু-তৃতীয়াংশ এলাকা নিমজ্জিত হয়েছিল, ধ্বংস হয়েছিল প্রায় ২০০ কোটি ডলার মূল্যের সম্পদ। এ দুটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ ছিল ভিন্নতর। ১৯৮৭ সালের বন্যা হয়েছিল মূলত নিষ্কাশন ব্যবস্থার বদ্ধতার জন্য, অন্যদিকে ১৯৮৮ সালের বন্যা হয়েছিল মূলত প্রধান প্রধান নদীগুলির পানি তীর ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য, যা প্রায় ৬,৫০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল এবং এর বেশিরভাগই দক্ষিণ-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।

নদীপ্রণালী  স্থানীয় অধিক বৃষ্টিপাত এবং গঙ্গা মোহনার পূর্বাভিমুখী স্থানান্তরের ফলে গঙ্গা নির্ভর এলাকার নদীপ্রণালী বিকশিত হয়েছে। কেবল দুটি নদী তাৎপর্যপূর্ণভাবে গঙ্গা-পদ্মা নদীপ্রণালীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রয়েছে  দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত  গড়াই-মধুমতি নদী এবং দক্ষিণ-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত  আড়িয়াল খাঁ নদী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্রতর শাখা নদীসমূহ গঙ্গা থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছে এবং বর্তমানে গড়াই-মধুমতি নদীরও একই পরিণতি বরণ করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

১৯৭৬ সালের পর থেকে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার প্রবাহ অর্ধেক-এ হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে গড়াই নদীর মুখে সর্বনিম্ন পানির উচ্চতা ২ মিটারের মতো হ্রাস পেয়েছে এবং নদী তলদেশ ১.৫ মিটারের মতো উঁচু হয়ে উঠেছে যা শুষ্ক মৌসুমে গড়াই নদীতে পানি প্রবাহে মারাত্মক বাধার সৃষ্টি করছে। এ অবস্থায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পে পানির সুষ্ঠু সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে জমে ওঠা প্রচুর  পলি গড়াই-গঙ্গার সংযোগস্থলকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়ার দরুন শুষ্ক মৌসুমে গড়াই নদীর প্রবাহে উল্লেখযোগ্য অবনমন লক্ষ্য করা যায়।

বদ্বীপভূমির পরিবৃদ্ধি এবং মানবসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ নদনদীসমূহ ভূপ্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গে ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক ভূরূপতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে যে গড়াই-মধুমতি, কপোতাক্ষ এবং ইছামতি নদীতে প্রচুর পরিমাণে, শিবসা-পশুর নদীপ্রণালীতে মাঝারি পর্যায়ের এবং বলেশ্বর নদীতে ধীর গতিতে পলি সঞ্চয়ন ঘটছে। এ পলি সঞ্চয়ন নদনদীর প্রবাহ ক্ষমতাকে হ্রাস করে নৌচলাচলকে বাধাগ্রস্ত করছে এবং সেইসঙ্গে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ বৃদ্ধি করছে।

উপকূলীয় এলাকা  গঙ্গা-পদ্মার বদ্বীপ অঞ্চল এবং অসংখ্য দ্বীপসহ লোয়ার মেঘনা মোহনা অঞ্চল এ এলাকার অন্তর্ভুক্ত। পশ্চিম অংশ জুড়ে উপকূলীয় রেখার সামান্য পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু পূর্বদিকে দ্বীপসমূহের তটরেখা সমুদ্রের দিকে বৃদ্ধি পেয়েছে।  সুন্দরবন এবং বৃক্ষরোপিত নতুন পরিবর্ধিত ভূমি ব্যতীত, উপকূলীয় ও মোহনা এলাকাকে চাষাবাদের জন্য পরিষ্কার করা হয়েছে এবং সেখানে ঘন জনবসতি গড়ে উঠেছে। কৃষিকাজের জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণে উপকূলীয় ভেড়িবাঁধ প্রকল্প বা সি.ই.পি (Coastal Embankment Project-CEP)-এর অধীনে ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে একাধারে অনেকগুলি  ভেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। উপকূলীয় ভেড়িবাঁধ প্রকল্পাধীন পোল্ডারগুলি বন্যা, লবণাক্ততা অনুপ্রবেশ এবং মৃত্তিকা ক্ষরণ (soil leaching) থেকে নিরাপত্তা বিধানের মাধ্যমে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধির উপায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে সফলতা আসলেও নদীখাতসমূহের নিয়ন্ত্রণ এবং জোয়ার সৃষ্ট বন্যা এখানে পলি সঞ্চয়নজনিত সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা নদীসমূহের নিষ্কাশনপ্রণালী ও কাঠামোতে আবদ্ধতার সৃষ্টি করেছে। এ প্রক্রিয়াসমূহের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নদীখাতে পলি জমা, নাব্যতা হ্রাস, দুর্বলতর নিষ্কাশন প্রণালীর উদ্ভব এবং সর্বোপরি এলাকার নদী ও খালগুলি বিলীন হওয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। পূর্বে এ এলাকার নদী ও খালগুলি ছিল বিভিন্ন প্রকার  মাছ ও চিংড়ির গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল। তাৎক্ষনিক ভাবে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে দেখা যাচ্ছে যে এ নদীখাত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর বেশ কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়াও ফেলছে।

পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা  বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে গঙ্গা নির্ভর এলাকার  পানি সম্পদ বিশেষ গবেষণার বিষয়বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে গবেষণার আওতা ছিল গঙ্গা করিডোর এবং এর সংলগ্নভূমি। পরবর্তীতে এ আওতা সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকা জুড়ে অর্থাৎ সমগ্র গঙ্গা নির্ভর এলাকায় সম্প্রসারিত হয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফ.এ.ও)-এর সেচ শাখা ১৯৫২ সালে এবং টিপেটস, এবেট, মাককার্থি অ্যান্ড স্ট্রাটন বা টি.এ.এম.এস (Tippetts, Abbett, McCarthy and Stratton  TAMS) কোম্পানি ১৯৬৩ সালে হার্ডিঞ্জ সেতু-এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গঙ্গা নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের খরচ, নকশা এবং প্রাথমিক স্থান নির্ধারণের লক্ষ্যে অনুসন্ধান ও সমীক্ষাকার্য পরিচালনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রকল্পগুলির নকশাকর্ম সম্পাদন হলেও শেষ পর্যন্ত কোনো প্রকৌশল কাঠামো নির্মিত হয় নি।

ব্যাপক পরিসরে সেচকার্যের প্রাথমিক পরিকল্পনাসমূহে গঙ্গায়  বাঁধ দিয়ে পানিকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করার মাধ্যমে সেচকার্যে পানি সরবরাহের বিষয়টি সবিশেষ গুরুত্ব পায়। নতুন এ সরবরাহ ব্যবস্থায় সেচ কার্যের জন্য প্রয়োজনীয় পানির পরিপূরণ ঘটানো যায়, তবে এক্ষেত্রে সেচকার্যে ব্যবহূত পানির প্রবাহ এবং এ অঞ্চলে পানি নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক প্রবাহের প্রভাবের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি স্পষ্ট হয় না। এ অঞ্চলে বিদ্যমান পানি প্রবাহে আকস্মিক ও নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে ১৯৭৫ সালে ভারত কতৃক গঙ্গা নদীর উপর  ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ পানি প্রত্যাহার কার্যক্রম শুরু করার মধ্য দিয়ে। এর ফলে পানির অব্যাহত সরবরাহের অনিশ্চয়তা দেখা দেয় এবং দেশের অভ্যন্তরে গঙ্গার উপর  ব্যারেজ নির্মাণের সকল পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। অন্যান্য গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ পরিবেশের প্রতি অনেক কম সংবেদনশীল। এসকল উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ হচ্ছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং নিষ্কাশন প্রকল্পসমূহ, ক্ষুদ্র পর্যায়ে সেচ কার্যক্রমের মাধ্যমে স্বাদুপানিকে সহজপ্রাপ্য করা যেতে পারে এমন কিছু প্রকল্প, আর রয়েছে উপকূল রক্ষা প্রকল্পসমূহ। স্বাদুপানির ভারসাম্য পুনুরুদ্ধারে প্রয়োজন, ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার কার্যক্রম সূত্রপাতের পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়া।

গঙ্গা নদীর ডান তীরে অবস্থিত এক লক্ষ ২৫ হাজার হেক্টর সেচযোগ্য জমিতে সম্পুরক সেচ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্য নিয়ে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের (জি-কে প্রজেক্ট) প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্বের কাজ যথাক্রমে ১৯৫৫-৭০ এবং ১৯৭০-৮৩ সময়কালে বাস্তবায়ন করা হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার একটি বিরাট অংশ জোয়ারভাটা দ্বারা প্রভাবিত যা শুষ্ক মৌসুমে স্থলভাগের দিকে ১৮০ কিমি পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করে থাকে। এ এলাকার বিস্তৃত নিম্নাঞ্চলকে জোয়ারসৃষ্ট বন্যা প্রতিরোধের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৬০ সালে উপকূলীয় ভেড়িবাঁধ প্রকল্পের বিশাল কর্মযজ্ঞ হাতে নেওয়া হয়। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ৩,৭০০ কিমি দীর্ঘ নতুন নির্মিত ও সংস্কারকৃত ভেড়িবাঁধের মাধ্যমে ৮ লক্ষ ৬০ হাজার হেক্টর জমি পোল্ডার এলাকার আওতাভুক্ত করা হয়। উপকুলীয় ভেড়িবাঁধসমূহ নির্মাণের ফলে তীরভূমি এলাকাগুলি জোয়ার দ্বারা কম প্লাবিত হতে থাকে। কিন্তু সে সঙ্গে ভাটার টানে সরে আসা পানির স্রোত জোয়ারের সময় বয়ে নিয়ে যাওয়া পলি যথাযথ ভাবে অপসারণ ঘটাতেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে নদীখাতগুলি ক্রমাগত ভরাট হয়ে আসছে।

পোল্ডার নির্মাণ এবং সেইসঙ্গে নদনদীসমূহের পলিভরাট প্রক্রিয়া স্থানভেদে নিষ্কাশন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে, সাতক্ষীরা থেকে খুলনার পশ্চিমাঞ্চল এবং বাগেরহাটের উত্তরাংশে এ সমস্যা তীব্রতর। পোল্ডার নির্মাণের ফলাফল হিসেবে জোয়ারভাটার প্রভাব ভূভাগের অধিকতর অভ্যন্তরে বিস্তৃত হয়েছে যা পলি সঞ্চয়নকে আরও বৃদ্ধি করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে শুষ্ক এবং আর্দ্র উভয় মৌসুমে গঙ্গার প্রবাহের ক্রম হ্রাস নদীর পলিবহন ক্ষমতাকে ধীরে ধীরে কমিয়ে দিয়েছে।

বিগত ৫০ বছর যাবত, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপকগণ সেচ, নিষ্কাশন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বন্যা প্রতিরোধ ব্যবস্থাদি গ্রহণের মাধ্যমে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে ভূমি ও পানি সম্পদ উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছেন। অবকাঠামোগত ব্যবস্থাদির মধ্যে রয়েছে বৃহৎ ও ক্ষুদ্র পরিসরে ভূগর্ভস্থ এবং অন্যান্য উৎস থেকে পানি উত্তোলনের মাধ্যমে সেচ, ভেড়িবাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পোল্ডার স্লুইস নির্মাণ ও ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ। এ ব্যবস্থার আওতায় নতুন নতুন নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং  খাল ও নদীর পুনঃখননের মাধ্যমে সামগ্রিক নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রভৃতি কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। অবকাঠামোগত ব্যবস্থা ছাড়াও আরও কিছু ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে যার মধ্যে পায়ে চালানো পাম্প, ডিজেল অথবা বিদ্যুতচালিত ছোট পাম্প ব্যবহারের মাধ্যমে ক্ষুদ্র পরিসরে সেচকার্য উৎসাহিত করা, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় সতর্কীকরণ ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধনকারী বন্যা থেকে জীবন ও সম্পদকে রক্ষা করতে ভেড়িবাঁধ নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি, তবে তা যেন ভূমিকে বার্ষিক স্বাভাবিক প্লাবন প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত না করে।

পরিবহণ  দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত গড়াই-মধুমতির মতো প্রধান নদীসমূহের সমান্তরালে গড়ে উঠেছে। শুষ্কমৌসুমে ক্রমহ্রাসমান পানিপ্রবাহ পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী ফেরি চলাচলকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সম্ভাবনাময় নৌপরিবহণ ব্যবস্থার উত্তরোত্তর ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ায় এতদঞ্চলে সড়ক ও রেল পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরী। এ সকল কারণে এশীয় ভূঅবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের (Asian Land Infrastructure Development-ALID) মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ে নির্মাণের কথা বিবেচিত হচ্ছে যা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্য দিয়ে ঢাকার সঙ্গে কলকাতা এবং নেপালের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মংলা ও ঢাকার যোগাযোগ স্থাপন করবে।

গঙ্গা নির্ভর এলাকার নদীগুলিতে পর্যাপ্ত প্রবাহ না থাকায় এ এলাকার নৌপরিবহণ ব্যবস্থা উত্তরোত্তর ক্রমাবনতিশীল পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে। তবুও বর্তমানে নৌপরিবহণ সুবিধা রয়েছে এমন অঞ্চলে নতুন সড়ক নির্মাণ একদিকে যেমন প্রচুর অর্থের ব্যয় সাধন করবে, তেমনি এতে কৃষিজমিরও বিনাশ সাধন ঘটবে। গঙ্গা থেকে নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রবাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে গড়াই-মধুমতি নদীতে নৌপরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি করা সম্ভব। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে নেপালের পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের মধ্যে পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে মংলা বন্দরের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির আশা করা হচ্ছে। নেপাল সরকার ইতোমধ্যে মংলা বন্দর ব্যবহার করার ক্ষেত্রে এবং এ লক্ষ্যে গঙ্গার উত্তর-পশ্চিম থেকে মংলা বন্দরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী একটি নৌচলাচলপথ নির্মাণের ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। মংলা বন্দরের পুনরুজ্জীবন হবে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অর্থনীতিতে পুনর্শক্তি সঞ্চারের চাবিকাঠি। সাম্প্রতিককালে এ বন্দরে পলি জমে বন্দরের কার্যকারিতা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এ সমস্যা দূর করে মংলা বন্দরকে পূর্ণমাত্রায় সচল রাখা গেলে সমগ্র অঞ্চলের উৎপাদনশীলতা এবং অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে।

সেচ  সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ক্ষুদ্রায়তন সেচ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৃহদায়তন সেচের আওতায় গঙ্গা নির্ভর এলাকার সর্বমোট সেচকৃত এলাকার পরিমাণ ১৯৭৩-এর পাঁচ লক্ষ হেক্টর থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৯৬-এ এসে ৩৩ লক্ষ ৭০ হাজার হেক্টরে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এ এলাকা দেশের মোট সেচের আওতাভুক্ত জমির শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি এবং মোট চাষাবাদকৃত এলাকার শতকরা ৪২ ভাগ।

ভূগর্ভস্থ পানি সেচ  সম্ভাব্য স্থানসমূহে অগভীর নলকূপ একটি সুবিধাজনক ও লাভজনক সেচকৌশল হিসেবে বিবেচিত। জাতীয় পানি নীতি অনুসারে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল এবং দক্ষিণ-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ৩,৩৬,৫০০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদকৃত বোরোশস্যের সেচকার্যের জন্য সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির সার্বিক উন্নয়ন ছিল পর্যাপ্ত। ১৯৯৬-৯৭ সালের কৃষিশুমারির তথ্যে দেখা যায় যে পাঁচ লক্ষ এক হাজার হেক্টর জমি ভূগর্ভস্থ পানিসেচের আওতাধীন ছিল। কিন্তু সেচকার্যে ভূগর্ভস্থ পানির ক্রমবর্ধমান উত্তোলন ভূগর্ভস্থ জলস্তরকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। ভূগর্ভস্থ জলস্তরের এ নিম্নগমন হার নিম্নতম সীমায় পানির অবস্থানকালীন সময়ে বছরে ১২ সেমি এবং এর ফলে পানির উত্তোলন ব্যয় ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে গ্রামীণ পানি সরবরাহে ব্যবহূত হস্তচালিত নলকূপের পরিবর্তে ব্যয়বহুল তারা পাম্প ব্যবহার করা প্রয়োজন হচ্ছে।

ভূপৃষ্ঠস্থ পানি সেচ  প্রাথমিক পর্যায়ে সাফল্য অর্জিত হলেও স্বল্প উত্তোলন ক্ষমতাসম্পন্ন সেচ পাম্পগুলি স্বল্প ব্যয়সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও বর্ধিত সেচ চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। তাই বর্তমানে স্বল্প উত্তোলন ক্ষমতাসম্পন্ন সেচ পাম্পগুলির পাশাপাশি সম্ভাব্য স্থানসমূহে কৃষিজমিতে ভূপৃষ্ঠস্থ পানি দ্বারা সেচকার্য পরিচালনা করা হচ্ছে।  গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প এবং বরিশাল সেচ প্রকল্প (বি.আই.পি)-এর মতো বৃহদায়তনের সেচ প্রকল্পসমূহ বিভিন্ন কারণে লক্ষ্য অর্জনে সীমিত পর্যায়ের সাফল্য লাভ করেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে গঙ্গার নিম্ন-প্রবাহের ফলশ্রুতিতে গড়াই নদীর মুখে বিশাল আকৃতির বেশকিছু বালুচর গড়ে উঠেছে যেগুলি শুষ্ক মৌসুমে নদীটিকে গঙ্গা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকলে আর্দ্র মৌসুমেও গড়াই নদী গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বিপর্যয়কর পরিণতির সম্মুখীন হবে এতদঞ্চল। শুষ্ক মৌসুমে গড়াই নদীর প্রবাহ পুনরুদ্ধারে গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তির সুবিধা কাজে লাগানোর লক্ষ্যে সরকার গড়াই পুনরুদ্ধার প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

উৎপাদন নিবিড়করণ  দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের কৃষকরা তিন মৌসুমের ধানচাষের ক্ষেত্রেই স্থানীয় প্রজাতির বদলে উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এর ফলে এতদঞ্চলে আমনের ফলন ৮ শতাংশ থেকে ৩৮ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে, আউসের ফলন বৃদ্ধি পেয়েছে ১২ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে এবং বেরোর ফলন ৫৮ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯০ শতাংশে। এলাকার উপযোগিতা, প্রয়োজনীয়তা এবং বন্যামুক্ত ভূমির অবস্থান এ কার্যক্রম বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। তবে ভোক্তাদের মধ্যে সনাতন প্রজাতিগুলির প্রতি এখনও প্রবল আগ্রহ রয়েছে এবং অধিক উপাদেয় বিধায় এসব প্রজাতির বাজার অবস্থানও ভাল।

মৎস্যসম্পদ বৎসরের সকল মৌসুমেই তবে বিশেষভাবে বর্ষা মৌসুমে ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দ্বারা অবাধে ধৃত হওয়ায় নদনদীর মৎস্যসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশিয় প্রজাতির মাছগুলি নদীসমূহের মৌসুমি প্রবাহ ও স্বাদু পানির ভারসাম্যে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম এবং প্রকৃতিগতভাবে দু দলে বিভক্ত প্রথমত যারা নদীতে ডিম ছাড়ে (প্রধানত রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি কার্পজাতীয় মাছ) এবং অপর দলটি হলো যেসব মাছ প্লাবনভূমির জলাশয়গুলিতেই ডিম ছাড়ে। যে সকল মাছ নদীতে ডিম ছাড়ে এদের পোনাগুলি আবার খাদ্যগ্রহণের জন্য প্লাবনভূমিতে আসে।

শুষ্ক মৌসুমে পানির সীমা নিচে নেমে যাওয়ার ফলে এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কিছু প্রজাতির মাছ দূর উজান অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে এবং এভাবেই নদী ও বিলের বিস্তৃত অঞ্চল থেকে মাছ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং পদ্ধতিগত ব্যবস্থাপনার অভাবের যৌথ প্রভাবে গঙ্গা নির্ভর এলাকায় প্রাকৃতিক উৎস থেকে মৎস্য আহরণ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে, যা দরিদ্র জনগণ ও জেলেদের জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে নিয়ে আসছে।

গঙ্গা নির্ভর এলাকার পুকুরগুলিতে শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততা বৃদ্ধি মাছের চাষকে বাধাগ্রস্ত করছে। পুকুরের টিকে থাকার বিষয়টি নির্ভর করে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর থেকে উচ্চতা ও মৃত্তিকার ধরনের ওপর এবং সেইসঙ্গে পুকুরে অতিরিক্ত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকার ওপর। একদিকে নদীর পানির লবণাক্ততা যেমন মৎস্য চাষের জন্য ক্ষতিকর, আবার ভূগর্ভস্থ লবণাক্ত পানির সংস্পর্শে আসলেও পুকুর মৎস্য চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার ব্যাপারটিও পুকুরে মৎস্য চাষের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাসপ্রাপ্ত হলে পুকুরের তলদেশে পানি চোয়ানোর মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং পুকুর ক্রমশ শুকিয়ে যেতে থাকে।

চিংড়ি শিল্প  এ এলাকায় চাষকৃত বাগদা চিংড়ি বর্তমানে একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বার্ষিক জাতীয় রপ্তানি আয়ে এ শিল্পের অবদান ৩৩০ মার্কিন মিলিয়ন ডলার। ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৮,০০০ টন এবং ২০০২ সালে এর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০,০০০ টন। এ শিল্পকে নির্ভর করতে হয় সুন্দরবন এবং তার আশেপাশের এলাকায় জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা চিংড়ি পোনা সরবরাহের উপর। এসব পোনা জাল দিয়ে ধরে অভ্যন্তর ভূমির ঈষৎ-লবণাক্ত চিংড়ি ঘের এবং পুকুরে চাষ করা হয়।

পরিবেশ  শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার হ্রাসপ্রাপ্ত প্রবাহের কারণে আকস্মিক জোয়ারভাটার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটে এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে যথেষ্ট পরিমাণ স্বাদু পানির প্রবাহের মাধ্যমে লবণাক্ততার উত্তরাভিমুখী অনুপ্রবেশ প্রতিহত করা সম্ভব এবং এ প্রক্রিয়া কার্যকর করতে গড়াই-মধুমতি ও আড়িয়াল খাঁ নদীর মতো প্রধান নদনদীর মধ্য দিয়ে এতদঞ্চলে তা পরিব্যাপ্ত করতে হবে।

শুষ্ক মৌসুমে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ প্রতিহতকরণ সফল হতে পারে গড়াই নদীর ১৯৭৪ সালপূর্ব প্রবাহ পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে। এটি সম্ভব হলে এ অঞ্চলের জলজ জীব, মৎস্যসম্পদ, জনস্বাস্থ্য ও কৃষির উপর ক্ষতিকর প্রভাব অনেকাংশে হ্রাস পাবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবন অঞ্চলের স্বাভাবিক লবণাক্ততাও পুনরুদ্ধার হবে। ফলে এ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের সুন্দরী গাছসহ সেখানে বসবাসকারী বন্যপ্রাণীর প্রজাতিসমূহের অবস্থা উন্নততর হবে।

পানীয় জলের জন্য নলকূপ সরবরাহের অর্জিত সাফল্য সত্ত্বেও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে খাবার পানি সরবরাহের ভবিষ্যত সংকটাপন্ন। ভূগর্ভস্থ পানিতে  আর্সেনিক দূষণ, কিছু কিছু এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণাক্ততা ইত্যাদি সমস্যা গঙ্গা নির্ভর এলাকায় প্রকট হয়ে উঠেছে। বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনুযায়ী ২০১৭ সালের মধ্যে এ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা ৪ থেকে সাড়ে ৪ কোটিতে পৌঁছাবে। বর্তমান জনসংখ্যা এবং সম্ভাব্য এ বিশাল জনগোষ্ঠীর পানীয় জলের প্রয়োজন পূরণে বিকল্প উৎসসমূহের যথাযথ ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।

গঙ্গা নির্ভর এলাকা বা জি.ডি.এ সমগ্র দেশের ভূ-প্রকৃতি, জলসংস্থান, ভূসংস্থান, অর্থনীতি, প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ এবং প্রাণীজগতের বিবেচনায় এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। জাতীয় উন্নয়নে এর অবদান অব্যাহত রাখতে হলে এ এলাকাকে যথাযথ উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় আনা প্রয়োজন।  [মাসুদ হাসান চৌধুরী]