অবভূমি
অবভূমি ভূরূপতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভূ-পৃষ্ঠের তুলনামূলক অবনমিত অংশ। বিশেষ করে, উঁচু ভূমি দ্বারা পরিবেষ্টিত নিচু এলাকা যেখানে নিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য প্রাকৃতিক নির্গমণ পথ থাকে না এবং বর্ষার সময় গভীরভাবে প্লাবিত হয়। ভূ-গাঠনিক (tectonically) দৃষ্টিকোণ থেকে, অবভূমি হচ্ছে ভূত্বকের গঠনগত নিম্ন এলাকা যা ভূত্বকের অধোগতি বা অবনমনের ফলে, তথা শিলাস্তরের নিম্নমুখী ঘাতের ফলে সৃষ্টি হয়। অবভূমিগুলি পশ্চাৎ জলাভূমি (backswamp) হতে পারে অথবা পুরাতন কোনো নদীর পরিত্যক্ত গতিপথও হতে পারে যেখানে সঞ্চিত পানিরাশিকে একটি অববাহিকার মতো মনে হয়।
বাংলাদেশের সমতল প্লাবনভূমি এলাকায় প্রচুর সংখ্যক অবভূমি রয়েছে যার মধ্যে অনেকগুলিই বেশ বড় আকারের। এসকল অবনমিত ভূভাগ স্থানীয়ভাবে বিল অথবা হাওর নামে পরিচিত। এসকল হাওর ও বিল সবই প্রাকৃতিক ভৌত প্রক্রিয়ার ফলে গঠিত হয়েছে, তবে উৎপত্তিগত কারণ সবক্ষেত্রে একরকম নয়। এসকল প্রাকৃতিক ভৌত প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে কতিপয় ভূতাত্ত্বিক ও জলতাত্ত্বিক বিষয়। অবভূমিসমূহের অনেকগুলিরই উৎপত্তি হয়েছে নদীজ জলপ্রবাহগত প্রক্রিয়া (fluvial processes) থেকে, আবার বহুসংখ্যকের উৎপত্তি ঘটেছে ভূমি ডেবে যাওয়ার (earth subsidence) জন্য। বাংলাদেশের কয়েকটি বড় অবভূমির উদাহরণ হিসেবে নিম্নতর আত্রাই অববাহিকা, নিম্নতর পুনর্ভবা প্লাবনভূমি, আড়িয়াল বিল, গোপালগঞ্জ-খুলনা বিল (১,১৬০ বর্গ কিমি), বিল ডাকাতিয়া এবং সুরমা অববাহিকার নাম উল্লেখ করা যায়। সুরমা অববাহিকা হাওর অঞ্চল নামে অধিকতর পরিচিত এবং বেশকিছু বৃহদাকৃতির অবভূমি যেমন: হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, শনির হাওর প্রভৃতি নিয়ে এ হাওর অঞ্চল গঠিত।
দেশের উত্তরপূর্বাঞ্চল জুড়ে অবস্থিত সুরমা অববাহিকা বাংলাদেশের প্রধান গ্যাস উৎপাদনকারী অঞ্চল। প্রায় ১ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট এ অববাহিকা ওলিগোসিন ও প্লায়োসিন উপযুগের মধ্যে কোনো এক সময়ে অবনমিত হয়ে যাওয়া বঙ্গীয় অববাহিকার উত্তরপূর্বাঞ্চল জুড়ে বিরাজ করছে। সুরমা অববাহিকা দ্রুত অবনমিত হচ্ছে এবং কোনো কোনো স্থানে এ অবনমনের হার বিগত কয়েক শতকে প্রায় ১০.৫ মিটার। অন্য এক হিসেবে দেখা গিয়েছে যে, সুরমা অববাহিকার এ অবনমনের হার প্রতি বছর ২০ মিমি-এরও বেশি হতে পারে।
নিম্নতর আত্রাই অববাহিকা চলন বিল নামেই অধিকতর পরিচিত। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল এবং সমৃদ্ধতম জলাভূমিগুলির একটি। এ বিল মূলত বিভিন্ন খাল বা জলখাত দ্বারা পরস্পর সংযুক্ত অনেকগুলি ছোট ছোট বিলের সমষ্টি। বর্ষাকালে এগুলি সব একসঙ্গে একাকার হয়ে প্রায় ৩৬৮ বর্গ কিমি এলাকার একটি জলরাশিতে পরিণত হয়। বিলটি সংলগ্ন তিনটি জেলা রাজশাহী, পাবনা ও সিরাজগঞ্জের অংশবিশেষ জুড়ে অবস্থান করছে। বড় আকারের বিলগুলির বেশিরভাগই পাবনা জেলায় অবস্থিত। ব্রহ্মপুত্র নদ যখন তার প্রবাহপথ পরিবর্তন করে বর্তমান যমুনায় রূপ নেয়, সে সময়েই চলন বিলের সৃষ্টি। বর্তমানে চলন বিল দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর গঙ্গা থেকে পলি এসে পড়ার দরুন বিগত দেড়শ বছরে বিলটি দক্ষিণ দিক থেকে অন্ততপক্ষে ১৯.৩২ কিমি সরে এসেছে। এ জলাভূমির কিছু অংশকে বাঁধ দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বন্যামুক্ত এলাকায় উচ্চ ফলনশীল বোরো ধান আবাদ করা হয়। বরেন্দ্রভূমির উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত নিম্নতর পুনর্ভবা প্লাবনভূমি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র এলাকা নিয়ে গঠিত যার আয়তন মাত্র ১২৯ বর্গ কিমি। এ সমভূমি আকস্মিক বন্যা দ্বারা প্লাবিত হয় এবং কখনও কখনও আশেপাশের এলাকার নিষ্কাশিত পানিরাশি দ্বারা আগাম বন্যা সংঘটিত হয়ে থাকে। পদ্মা ও ধলেশ্বরী প্লাবনভূমির মধ্যবর্তী অঞ্চলে আড়িয়াল বিল অবস্থিত। এসকল অবভূমির মাটি প্রধানত গাঢ় ধূসর বর্ণের, অম্লধর্মী এবং ভারি কর্দম বৈশিষ্ট্যের। এসকল ভূমিতে উচ্চ ফলনশীল বোরো অথবা গভীর পানির ধান তথা ভাসমান বা জলি আমন ধান আবাদ করা হয়। গাঙ্গেয় বদ্বীপের মধ্যভাগে অবস্থিত গোপালগঞ্জ-খুলনা বিল এলাকা পিট অববাহিকা নামে খ্যাত। সমুদ্র সমতল থেকে এ বিল এলাকার উচ্চতা মাত্র ৩০ থেকে ৬০ সেমি। গোপালগঞ্জ-খুলনা বিল টেকটনিক প্রক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং ক্রমাগত অবনমনশীল। বর্ষা ঋতুতে এ বিল এলাকাসমূহ গভীরভাবে প্লাবিত হয় এবং দক্ষিণাংশটি মূলত লবণাক্ত। গোপালগঞ্জ-খুলনা বিলের খনিজপূর্ণ ঊর্ধ্বমৃত্তিকাসমৃদ্ধ এলাকায় গভীর পানির আমন ধান অথবা স্থানীয় বোরো ধান চাষ করা হয়ে থাকে।
খুলনা জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত বিল ডাকাতিয়া গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা বিধৌত বদ্বীপীয় সমভূমির অন্তর্গত। এটি খুলনা জেলার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার প্রশাসনিক সীমান্তের মধ্যে অবস্থিত। বিল ডাকাতিয়া ও এর সংলগ্ন অঞ্চলসমূহ জলাময় কাদা, পিট ও বদ্বীপীয় পলি অবক্ষেপ দ্বারা গঠিত। মোট এলাকা প্রায় ১৯,৪৩০ হেক্টর যার মধ্যে সর্বোচ্চ ৯,০০০ হেক্টর স্বাভাবিকভাবে পানির নিচে থাকে (বর্তমানে ০.৫ থেকে ২ মিটার পানির নিচে) যা মোট এলাকার প্রায় ৫০%। ভূ-গাঠনিকভাবে বিল ডাকাতিয়া ফরিদপুর খাতের একটি অংশ। এ এলাকার অবনমনের তথ্য ১৯২৭ সাল থেকেই বিদিত। অবনমনের হার বছরে প্রায় ১.৫ থেকে ২.৫ সেমি। বিল ডাকাতিয়া প্রধানত একটি পিট অববাহিকা এবং অন্যান্য স্থানের তুলনায় এখানে অবনমনের প্রক্রিয়াদি অধিকতর সক্রিয়। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা প্লাবনভূমি এলাকাতেও বহু অবভূমির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। বৃহদাকৃতির অবভূমিসমূহে সঞ্চিত পিট বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। [মোহা. শামসুল আলম]