বিল ডাকাতিয়া

বিল ডাকাতিয়া (Beel Dakatia)  খুলনা জেলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এই বিল গাঙ্গেয় জোয়ারভাটা বিধৌত বদ্বীপীয় সমভূমির অন্তর্গত। এই অঞ্চলের ভূরূপতাত্ত্বিক, জলতাত্ত্বিক ও ভূ-গাঠনিক শর্তসমূহ উপেক্ষা করে সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধার করার (polder) ফলে বিগত ১৫ বছরের অধিককাল যাবৎ জলাবদ্ধতা ও জলনিষ্কাশন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে এখানে ফসল উৎপাদনে যেমন বিঘ্ন ঘটছে, তেমনি পরিবেশ দূষণ ঘটছে। স্থায়ী পোল্ডারিংয়ের আগে অবক্ষেপণ ও ঐ এলাকার অবনমনের মধ্যে একটি সমতা ছিল। এই সমতা বর্তমানে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় জোয়ারভাটা খাতে অতি দ্রুত অবক্ষেপণ, আর জোয়ারভাটা সমভূমিতে অতিসীমিত অবক্ষেপণ ও দ্রুত অবনমন পরিলক্ষিত হচ্ছে। খুলনা-যশোর অঞ্চলে, বিশেষ করে ১, ৩, ৪, ৫, ৬, ৮, ১৫, ২৪ ও ২৫ নম্বর পোল্ডারে জলাবদ্ধতা ঘটছে, যার মধ্যে ২৫ নম্বর পোল্ডারের সমস্যা খুবই মারাত্মক। এই পোল্ডারের জলাবদ্ধ অঞ্চলটি বিল ডাকাতিয়া নামে পরিচিত। এটি খুলনা জেলার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার প্রশাসনিক সীমান্তের ৮৯°২০´ পূর্ব থেকে ৪৮°৩৫´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২২৪৫ উত্তর থেকে ২৩°০০´ উত্তর অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত। পোল্ডারটির মোট এলাকা প্রায় ১৯,৪৩০ হেক্টর, যার মধ্যে সর্বোচ্চ ৯,০০০ হেক্টর স্বাভাবিকভাবে পানির নিচে থাকে (বর্তমানে ০.৫ থেকে ২ মিটার পানির নিচে), যা মোট এলাকার প্রায় ৫০%।  বিল ডাকাতিয়া অঞ্চলের আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভ্যাপসা গরম ও মৃদু শীত। উপরন্তু এই অঞ্চল ক্রান্তিমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, জোয়ারভাটা, জলমগ্নতা, ভারি বৃষ্টিপাত ও লবণাক্ততা দ্বারা পূর্ণ। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা সাধারণত ২৯° সেলসিয়াস থেকে ৪০° সেলসিয়াস  এবং ৭° সেলসিয়াস  থেকে ২৫° সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করে। এই এলাকায় বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১,৭৫০ মিমি। শুকনা মৌসুমে গড় আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ ৭৫%। স্বাভাবিক অবস্থায় অঞ্চলটি সোলমারি, হামকুরা, হরি, সাল্টা, ভাদ্র ও ভৈরব নদীর পানিতে সিঞ্চিত।

বিল ডাকাতিয়া ও এর সংলগ্ন অঞ্চলসমূহ জলাময় কাদা, পিট ও বদ্বীপীয় পলি অবক্ষেপ দ্বারা গঠিত। পিটময় কাদা, কাদাময় পিট ও পিট নিয়ে এখানকার অধিকাংশ অঞ্চল গঠিত। প্রকৃতপক্ষে সামান্য উঁচু এলাকাতেই এই পিটময় কাদা, কাদাময় পিট ও পিটের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। অন্যত্র জৈব সমৃদ্ধ ও মিহি বুননবিশিষ্ট পদার্থেরই আধিক্য বেশি। বিল ডাকাতিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক ইউনিট হচ্ছে: জোয়ারভাটা খাতের অবক্ষেপ, কান্দা অবক্ষেপ, আন্তঃজোয়ারভাটা সমভূমি অবক্ষেপ ও সহ-জোয়ারভাটা সমভূমি অবক্ষেপ।

সমুদ্র থেকে ভূমি উদ্ধারের পূর্বে বর্ষাকালীন বন্যা ও লবণাক্ত পানিতে ডুবে থাকার কারণে ঐ অঞ্চলে প্রতি দুই বা তিন বছরে নিয়মিতভাবে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হতো। সমস্যা থেকে উদ্ধারের উপায় হিসেবে সপ্তদশ শতাব্দী থেকে জমিদাররা আবাদি জমিকে প্রাকৃতিক দৈবদুর্বিপাক থেকে রক্ষার জন্য ঐ এলাকার চারপাশে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিচু বাঁধ ও কাঠের জলদ্বার নির্মাণ করতেন। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর ভূমি ব্যবস্থাপনা সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করে এবং অস্থায়ী পোল্ডারগুলোর অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের কারণে ফসল উৎপাদন ঘন ঘন ব্যাহত হতে থাকে। সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে ১৯৫৯ সালে সরকার স্থায়ী পোল্ডারিং কর্মসূচি গ্রহণ করে। বিল ডাকাতিয়া জলাবদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় জনগণ বিলটিকে জলমুক্ত করতে বিভিন্ন প্রয়াস চালান। অধিকাংশ প্রয়াসই সোলমারি ও হামকুরা নদী ও এর নির্গম প্রণালীসমূহের খনন ও পুনঃখনন সংক্রান্ত। কিন্তু পুনঃখননের পর শীঘ্রই আবার প্রণালীসমূহ বন্ধ হয়ে যায়। বিল ডাকাতিয়াকে জলমুক্ত করতে ক্ষুদ্র পাওয়ার পাম্প ব্যবহারেরও উদ্যোগ গৃহীত হয়। কিন্তু পরিশেষে তাও ব্যর্থ হয়। ১৯৮৯-৯২ মেয়াদকালে বিল ডাকাতিয়ার অভ্যন্তরভাগে অবক্ষেপণের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য স্থানীয় জনগণ একে একটি জোয়ারভাটা অববাহিকায় রূপান্তরের চেষ্টা চালায়। ১৯৯৫ সালে সরকার সোলমারি নদীতে খনন শুরু করে। ফলে বিল ডাকাতিয়া অঞ্চলের নয় হাজার হেক্টরের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জলমুক্ত হয়। তা সত্ত্বেও ৪ হাজার হেক্টর ভূমি স্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার হয়ে রয়েছে। সম্প্রতি সরকার খুলনা-যশোর জল নিষ্ক্রমণ পুনর্বাসন প্রকল্প (KJDRP) নামে যে কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, বিল ডাকাতিয়া তার আওতাভুক্ত একটি ক্ষুদ্র অংশ।

জোয়ারভাটা খাতসমূহে অবক্ষেপণ ও জোয়ারভাটা সমভূমির অবনমন সমস্যার মূল কারণসমূহের সঙ্গে সম্পর্কিত। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে ঐ এলাকার উজান অঞ্চলে বিভিন্ন নদীর প্রবাহ আকস্মিকভাবে কমে যাওয়া, বাঁধ ও জলনিয়ন্ত্রক খালসমূহের অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ এবং চিংড়ি ঘেরের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের দ্বারা যথেচ্ছভাবে পানিপ্রবাহের ভিন্নমুখীকরণ।

ভূ-গাঠনিকভাবে বিল ডাকাতিয়া ফরিদপুর খাতের একটি অংশ। এই এলাকার অবনমনের তথ্য ১৯২৭ সাল থেকেই বিদিত। অবনমনের হার বছরে প্রায় ১.৫ থেকে ২.৫ সেমি। বিল ডাকাতিয়া প্রধানত একটি পিট অববাহিকা এবং অন্যান্য স্থানের তুলনায় এখানে অবনমনের প্রক্রিয়াদি অধিকতর সক্রিয়। পোল্ডারিংয়ের আগে এই অবনমন জোয়ারভাটা সমভূমির অবক্ষেপণের দ্বারা পূরণ হয়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে সংলগ্ন নদী তলদেশে অবক্ষেপণ এবং একই সঙ্গে জোয়ারভাটা সমভূমির অবনমন বিল ডাকাতিয়া অঞ্চলের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী। ফলে নদী তলদেশসমূহ সংলগ্ন জোয়ারভাটা সমভূমির চেয়ে উঁচু হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতি দিনে দিনে আবাদি জমির উত্তরোত্তর নিমজ্জন ও স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করছে।

জলাবদ্ধতা একদিকে যেমন মারাত্মকভাবে পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলেছে, অন্যদিকে তেমনি বিল ডাকাতিয়া এলাকার জনগণের অমানবিক দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। মানুষ, কৃষি, অবকাঠামো, জলসম্পদ ইত্যাদি সবকিছুকেই এটা প্রভাবিত করছে। জলাবদ্ধতার কারণে এখন গ্রামগঞ্জ, রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট হয় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে, নয়ত পানিতে ডুবে গিয়েছে। ফলে বিল ডাকাতিয়া অঞ্চলের ৬টি গ্রাম অন্যান্য গ্রাম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দশটির মতো গ্রাম মূল ভূখন্ড থেকে কমবেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং প্রায় ৯ হাজার হেক্টর আবাদি জমিসহ সকল স্বাদুপানির পুকুর, এমনকি কয়েকটি নলকূপ পানিতে নিমজ্জিত হয়ে গেছে। পেটের অসুখ, আমাশয়, জ্বর, আন্ত্রিক ও চর্মরোগ এখানে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে। জলাবদ্ধতা, অধিক লবণাক্ততা ও অবক্ষেপণ এই অঞ্চল ও সংলগ্ন এলাকার উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের ওপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততার কারণে গাছ, পাখ-পাখালি ও গরু ছাগলের মতো গৃহপালিত পশুর অনুকূল পরিবেশও বিঘ্নিত হচ্ছে।

এখানে জলাবদ্ধতার আগে কৃষি-নির্ভর অর্থনীতি এবং একটি বর্ণাঢ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহ বিরাজ করত। সে সময় এই অঞ্চলে ৫৫% পরিবারই ছিল কৃষিজীবী, কিন্তু আজ তারা জেলেতে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ ইতোমধ্যেই অন্যত্র চলে গেছে।  [সিফাতুল কাদের চৌধুরী]