রাজশাহী রাজ

রাজশাহী রাজ  আঠারো শতকের বাংলার নেতৃস্থানীয় জমিদারি। ৩৩,৬৭০ বর্গ কিমি আয়তন বিশিষ্ট এ জমিদারি ছিল বাংলায় দ্বিতীয় বৃহত্তম। বাংলার দীউয়ান বা সুবাহদার মুর্শিদকুলী খানের সময় (১৭০৪-১৭২৭) এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর দৃঢ় শাসন ও কঠোর নিয়মানুবর্তী রাজস্বনীতির ফলে অনেক বনেদি জমিদার ত্রুটিপূর্ণ জমিদারি শাসন এবং যথাসময়ে সরকারি রাজস্ব প্রেরণে ব্যর্থতার জন্য তাদের জমিদারি হারায়। অবাধ্যতা ও বিদ্রোহের কারণেও অনেক জমিদার ক্ষমতাচ্যুত হন। নওয়াব মুর্শিদকুলী খান এসকল জমিদারি তাঁর অভিজ্ঞ কর্মচারী এবং প্রিয় ও বিশ্বস্ত অনুচরদের মধ্যে নতুন করে ইজারা দেন। স্থলাভিষিক্তকরণের এ প্রক্রিয়ায় সর্বাপেক্ষা লাভবান হয় রাজশাহী জমিদারি (নাটোর রাজ)। বৃহৎ জমিদারি সৃষ্টি ছিল নওয়াব অনুসৃত রাজস্বনীতির অপর উদ্দেশ্য। এ নীতি দ্বারাও এ পরিবার লাভবান হয়।

রাজশাহী রাজপরিবারের আদিপুরুষ জনৈক কামদেব রায়। যিনি ছিলেন পুঠিয়া রাজপরিবারের অধীনে লস্করপুর পরগনার অন্তর্গত বরাইহাটির তহসিলদার। কামদেবের তিন পুত্র রামজীবন, রঘুনন্দন ও বিষ্ণুরাম। এ তিন ভাইয়ের মধ্যে রঘুনন্দন ছিলেন সর্বাপেক্ষা সম্ভাবনাময় ও উদ্যমী। রঘুনন্দনের উত্থানের পেছনে পুঠিয়ার জমিদার দর্পনারায়ণ এবং মুর্শিদকুলী খানের বিশেষ অবদান ছিল।

রাজশাহী রাজবাড়ি

দর্পনারায়ণ তাঁর ওয়াকিল (Wakil) হিসেবে রঘুনন্দনকে বাংলার রাজধানী  জাহাঙ্গীরনগরে (ঢাকা) নিযুক্ত করেন। মুর্শিদকুলী খানের সঙ্গে সুবাহদার  আজিম-উস-শান এর কলহে রঘুনন্দন মুর্শিদকুলী খানের পক্ষাবলম্বন করে তাঁর বিশ্বাসভাজন হন। বাংলার দীউয়ানি সদর দফতর যখন মুর্শিদাবাদে   স্থানান্তরিত হয়, তখনও তাঁর প্রভুর (দর্পনারায়ণের) প্রতিনিধি হিসেবে সমমানের ক্ষমতা সহকারে ওয়াকিল হিসেবে তিনি সেখানে নিয়োগলাভ করেন। রঘুনন্দন তাঁর কর্মদক্ষতায় শীঘ্রই মুর্শিদাবাদের সদর কানুনগোর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয় ও আইনশাস্ত্রে রঘুনন্দনের গভীর জ্ঞানের জন্যসদর কানুনগো তাঁকে সহকারীঅর্থাৎ নায়েব কানুনগো নিযুক্ত করেন। এ সময় তিনি মুর্শিদকুলী খানের আরও সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান এবং তাঁর বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করেন।

মুর্শিদকুলী খানের বিশ্বাসভাজন হিসেবে রঘুনন্দন ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ভাই রামজীবনের নামে রাজশাহী জমিদারির একাংশ লাভ করেন। বানুগাছির পূর্বতন জমিদার তাঁর অপটুতার কারণে ক্রমাগত রাজস্ব বাকি ফেলায় বানুগাছিও এ পরিবারের সম্পত্তির সঙ্গে যুক্ত হয়। তারপর ক্রমান্বয়ে যুক্ত হয় ভাটুরিয়া পরগনা ও নিজ-রাজশাহী যথাক্রমে ১৭১১ ও ১৭১৩ খ্রিস্টাব্দে। এর কিছুদিন পরেই নলদী পরগনাও রামজীবনের অধীনে ন্যস্ত করা হয়।  ভূষণার জমিদার সীতারাম বিদ্রোহী হয়ে পার্শতবর্তী ছোট ছোট জমিদারদের ওপর অত্যাচার শুরু করলে এবং সদরে রাজস্ব পাঠানো বন্ধ করলে মুর্শিদকুলী খান তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণ করেন ও তাঁকে দমন করেন। এ অভিযানে নাটোর জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা রামজীবন ও তাঁর দীউয়ান দয়ারাম সহযোগিতা করেন। তাঁদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মুর্শিদকুলী ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে পরগনা ইব্রাহিমপুরসহ সমগ্র ভূষণা রামজীবনকে প্রদান করেন। বস্ত্তত, সীতারামের জমিদারির ধ্বংসসাধন ও নাটোর পরিবারের উত্থান পরস্পর সম্পর্কিত।

বিদ্রোহী আফগান দলপতিদের দমন করে নওয়াব তাঁর প্রিয়পাত্র রামজীবনকে টাকি সরুবপুরের জমিদারি বন্দোবস্ত দেন (১৭১৮)। ইতোমধ্যে রামজীবন তাঁর দক্ষ জমিদারি পরিচালনা ও নিয়মিত রাজস্ব প্রদান করে নওয়াবের বিশ্বাস অর্জন করেন। এভাবে একের পর এক (জমিদারি) সংযোজনের ফলে রাজশাহী জমিদারি এর প্রতিষ্ঠাতাদের জীবনকালেই বিশাল আকার ধারণ করে। এটি বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারিতে পরিণত হয় এবং বর্ধমানের পরেই স্থান লাভ করে। লোকমুখে প্রচারিত হয় যে, এ জমিদারির আয় ৫২ লক্ষ টাকা।

যদিও রঘুনন্দনকে রাজশাহী জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়, কিন্তু এর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাঁর বড় ভাই রামজীবন। তাঁর যোগ্যতা ও সুশৃঙ্খল পরিচালনা এবং সর্বোপরি নওয়াবের সঙ্গে সুসম্পর্কের কারণে রাজশাহী জমিদারি দ্রুত উন্নতি লাভ করেছিল। এ বিষয়ে রামজীবনের দীউয়ান দয়ারামের কৃতিত্বও ছিল উল্লেখযোগ্য।

১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে রঘুনন্দনের মৃত্যু হয়। রঘুনন্দনের কোন উত্তরাধিকারী ছিল না। তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পর ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে রামজীবনও ইহলোক ত্যাগ করেন। রামজীবন অবশ্য মৃত্যুর বেশ পূর্বেই রামকান্তকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সমুদয় জমিদারি রামকান্তের নামে উইল করে যান। এভাবে রামকান্ত ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ১৮ বছর বয়সে রাজশাহী জমিদারির অধিকারী হন। কিন্তু তিনি জমিদারি পরিচালনায় অনভিজ্ঞ ছিলেন। অধিকাংশ সময় তিনি ধর্মীয় কাজে লিপ্ত থাকতেন। ফলে রাজকার্যে অবহেলা হতো। তাঁর বিচক্ষণ স্ত্রী রাণী ভবানী এবং অভিজ্ঞ দীউয়ান দয়ারাম দক্ষতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেন। রামজীবনের ছোট ভাই বিষ্ণুরামের পুত্র দেবীরামের চক্রান্তে রামকান্ত কিছু দিনের জন্য জমিদারিচ্যুত হন। কিন্তু বিশ্বস্ত দীউয়ান দয়ারামের চেষ্টায় এবং পরামর্শে নওয়াব আলীবর্দী খান রামকান্তকে শেষ পর্যন্ত তাঁর জমিদারি প্রত্যর্পণ করেন। ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে রামকান্তের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি রাণী ভবানীকে দত্তকপুত্র গ্রহণের অনুমতি দিয়ে যান।

রামকান্তের পর রাণী ভবানী রাজশাহী জমিদারির সমুদয় কর্তৃত্বের অধিকারী হন এবং এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেন। বিশ্বস্ত দীউয়ান দয়ারাম সবসময় তাঁকে সাহায্য ও পরামর্শ প্রদান করতেন। তিনি মুর্শিদাবাদের নওয়াবের সঙ্গে অত্যন্ত সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে দীউয়ানি লাভের সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজশাহী জমিদারিকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ দেখতে পান এবং রাণী ভবানীকে জমিদারি পদে বহাল রাখেন। রাণী ভবানী জমিদারি পরিচালনায় সামাজিক ও জনহিতকর কাজের জন্য তাঁর জমিদারির বিরাট আয় জনসেবায় এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানের পেছনে ব্যয় করতেন। তিনি নিজে কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করতেন। ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দের আমিনি কমিশনের রিপোর্টে রাজশাহী জমিদারির এক বিরাট আয় ব্রাহ্মণদের সেবার জন্য ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি হিসেবে পাওয়া যায়। তিনি বেনারসে একটি শিবমন্দির স্থাপন  করেন।

আঠারো শতকের শেষ দশকগুলিতে উপনিবেশিক রাজ্য গড়ে ওঠার সময় মাত্র ১২টি জমিদার পরিবার বাংলার ভূ-সম্পত্তির অর্ধাংশ নিয়ন্ত্রণ করত। উপনিবেশিক রাজ্য এ সকল বড় জমিদারকে নিজের অস্তিত্বের প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করত। কাজেই ওই সকল বড় জমিদারিকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব না হলেও দুর্বল করে ফেলার উদ্দেশ্যে সূর্যাস্ত আইনের কড়াকড়ি প্রয়োগ বাস্তবায়িত হয়েছিল।

১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে রাণী ভবানী তাঁর চল্লিশ বছর বয়স্ক দত্তকপুত্র রামকৃষ্ণকে জমিদারি হস্তান্তর করেন। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে ২২,৫২,২০০ টাকা জমার বিনিময়ে তাঁর সাথে দশসনা বন্দোবস্ত হয়। দশসনা বন্দোবস্তের পর থেকে রাজশাহী জমিদারি তিনটি ক্ষতিকর সমস্যার মুখোমুখি হয়। উচ্চহারে রাজস্ব নির্ধারণ, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং কর্মচারীদের (আমলা) ষড়যন্ত্র। দশসনা বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকেই জমিদারিতে ভাঙন শুরু হয়। পরবর্তী শতক শুরু হওয়ার আগেই অল্প কয়েকটি পরগনা ছাড়া গোটা জমিদারি নতুন নতুন মালিকদের নিকট হস্তান্তরিত হয়। পরিবারের হাতে রাখা পরগনাগুলির রাজস্ব ১৮০০ সালে ৩৪,০০০ টাকার বেশি ছিল না।

জমিদারির সম্পদ যেহেতু কোন দিনই পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খতিয়ে দেখা হয়নি, সেহেতু জমিদারির ওপর ধার্যকৃত রাজস্ব সঠিক ছিল কিনা তা স্পষ্ট করে বলা কঠিন। বিভিন্ন খাতে সকল কর্তন বাদ দিয়ে দশসনা বন্দোবস্তে রাজস্ব নির্ধারিত হয় ২০,১৭,২০০ সিক্কা টাকা। এর সাথে রসদ (বৃদ্ধি) যুক্ত হয় ২,২৫০০০ সিক্কা টাকা। সুতরাং জমিদারির স্থায়ী রাজস্ব নির্ধারণ করা হয় ২২,৫২,০০০ সিক্কা টাকা। ১৭৭৮-৭৯ থেকে ১৭৮৮-৮৯ পর্যন্ত বার্ষিক গড়পড়তা রাজস্ব আদায় ছিল ২১,২৪,৪০০ সিক্কা টাকা। সরকারকে দেয় রাজস্ব এবং প্রজাদের কাছ থেকে বাস্তব আদায় এ দুয়ের মধ্যে যে ফারাক (১,২৭,৬০০ সিক্কা টাকা) তা আরও বেড়ে যায়, সিক্কা টাকায় রাজস্ব প্রদানের বিধান অনুযায়ী বাট্টার যে প্রচলন ছিল, বিনা ক্ষতিপূরণে তা প্রত্যাহারের ফলে। বাট্টা থেকে রাজার বার্ষিক আয় হতো প্রায় ১ লক্ষ টাকা। দশসনা বন্দোবস্তে এমন কোন ইঙ্গিত ছিল না যে, পরবর্তীকালে বিনা ক্ষতিপূরণে আবার এর প্রচলন হবে। এভাবে পূর্বতন আদায় এবং ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের নির্ধারিত রাজস্বের মধ্যেকার পার্থক্যের সাথে বাট্টাজনিত ঘাটতি যোগ করলে দেখা যায় যে, দশসনা বন্দোবস্তের ফলে প্রায় দু’লক্ষ টাকার বাড়তি বোঝা রাজার উপর চাপানো হয়।

প্রথমদিকে রাজা রামকৃষ্ণ এ বন্দোবস্ত গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবং এ আইন প্রয়োগের জন্য সরকার কর্তৃক আরোপিত সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতা এবং আইনি বাধ্যবাধকতা প্রত্যাখ্যান করার চেষ্টা করেন। কিন্তু অবশেষে আপত্তিসহ তিনি এ ব্যবস্থা মেনে নেন। তিনি কাউন্সিলকে লেখেন যে, শুধু সরকারের অধিকতর অসন্তুষ্টি পরিহার করতেই তিনি বন্দোবস্ত গ্রহণ করেছেন।

এ অবস্থায় দশসনা চুক্তি গ্রহণ করার এক বছরের মধ্যেই রাজাকে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা জমার দুটি বড় পরগনা হারাতে হয়। এতেও তাঁর দুর্দশার অবসান হয়নি। ফি বছর বকেয়ার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছিল। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে সরকারের নিকট তাঁর মোট বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫,৩৯,০৫৪ সিক্কা টাকা। তাঁর অসুবিধাসমূহের কথা উল্লেখ করে রাজা তাঁর প্রদেয় রাজস্বের ন্যায্য হার অপেক্ষা অতিরিক্ত ধার্য রহিতকরণ এবং তজ্জনিত বকেয়া মওকুফের জন্য কাউন্সিলকে লেখেন। কিন্তু তাঁর আবেদনসমূহ ক্রমাগত বাতিল হতে থাকে।

সরকারি রাজস্ব বকেয়ার পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকায় তাঁর অসুবিধাসমূহ বিবৃত করে রামকৃষ্ণের পুনঃপুন আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর জমিদারির ঘটনাবলি সম্পর্কে কাউন্সিলে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হয়। এ ব্যাপারে কালেক্টর রাজার পক্ষে রিপোর্ট প্রদান করে উল্লেখ করেন যে, তাঁর জমিদারির ওপর ধার্যকৃত অতিরিক্ত রাজস্বের পরিমাণ তাঁর ওপর আরোপিত রসদের কমপক্ষে অর্ধেকের সমান এবং রাজস্ব বাকি পড়ার জন্য রাজার অযোগ্যতাকে দায়ী করা হয়। বস্ত্তত, সরকার এ বৃহৎ জমিদারির অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে ছোট ছোট এবং সহজে নিয়ন্ত্রণযোগ্য জমিদারি সৃষ্টি করতে কৃৎসংকল্প ছিল।

জমিদারির পরিণতি ছিল অত্যন্ত করুণ। সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয়ে ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে রাজা বিশ্বনাথ জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শীঘ্রই সরকারি রাজস্ব বাকি পড়ে এবং তা পরিশোধ করার জন্য তাঁকে মহলের পর মহল বিক্রি করতে হয়। ১৮০০ সালের মধ্যে বিশাল রাজশাহী জমিদারি এর সকল মর্যাদা ও গুরুত্ব হারায়। চরম আর্থিক অনটনের কবলে পড়লে জমিদারের অতীত গৌরব ও মর্যাদা এবং বর্তমান দুরবস্থার কথা বিবেচনা করে সরকার তাঁকে ১৮০৫ সাল থেকে ৮০০ টাকা মাসিক বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করে। বর্ধমান রাজের পরেই বাংলার দ্বিতীয় বৃহত্তম জমিদারি ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দের পরবর্তী দশ বছরের মধ্যে তার অস্তিত্ব প্রায় হারিয়ে ফেলে।

জমিদারি ধ্বংস হওয়ার পেছনে অধিক রাজস্ব নির্ধারণই শুধু একমাত্র কারণ ছিল না। এ ব্যাপারে রাজার ব্যক্তিচরিত্রও যথেষ্ট দায়ী ছিল। বৈষ্ণব মতবাদে বিশ্বাসী রাজা রামকৃষ্ণ জমিদারি সেরেস্তার কাজকর্ম ভুলে প্রায় সারাক্ষণ ধর্মকর্ম ও দান-ধ্যানে নিজেকে ব্যাপৃত রাখতেন। ধ্যান, তপস্যা জাতীয় ধর্মীয় কাজকর্ম সেরে সামান্য যে সময় তিনি পেতেন তাও ব্যয় করতেন জনপ্রিয় বৈষ্ণব সঙ্গীত রচনা করে। এ সমস্ত কারণে তিনি বাংলার ‘রাজা সন্ন্যাসী’ খেতাব পান। জমিদারি ব্যবস্থাপনায় রাজার চরম উদাসীনতা তাঁকে পরিপূর্ণভাবে আমলাদের উপর নির্ভরশীল করে তোলে। কালক্রমে এরা এত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে যে, রাজা তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। জমিদারি আমলাতন্ত্রের সদস্যগণ একজোট হয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

রাজা বিশ্বনাথ অবশ্য বেনামি খরিদ করে চরম ভরাডুবি থেকে জমিদারিকে আংশিক রক্ষা করতে প্রয়াস পান। এভাবে তিনি নলদী ও সাতোর পরগনাদ্বয় তাঁর চাকর-বাকরদের নামে কিনে নেন। এ পরগনা দুটি থেকে মোট আয় হতো প্রায় ২ লাখ টাকা। কিন্তু দেনার দায়ে অবশেষে এ দুটিও তাঁকে বিক্রি করে দিতে হয়। রাণী ভবানী নিজ নামে তিনটি গ্রাম কিনেছিলেন। এগুলি ছিল হদা হুরের পাড়া, তরফ দক্ষিণ জোয়ার এবং মুর্শিদাবাদ জেলার হুদা বড়ানগর। এগুলির মোট জমা ছিল ৩৩,৭০৬ সিক্কা টাকা। রাণী ভবানীর ক্রয়ের সঙ্গে এ সকল বেনামি ক্রয় মিলিত হয়ে এই ইতিহাস প্রসিদ্ধ পরিবারটিকে চরম দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করে। ১৮১৯ সালে সব মিলিয়ে জমিদারির সদর জমা দাঁড়ায় ৮৮,০০৬ টাকা।

প্রায় সমগ্র আঠারো শতক জুড়ে রাজশাহী রাজপরিবারের উত্থান ঘটে, তবে এর পতনও শুরু হয় শতক শেষ হওয়ার আগেই। পরবর্তী শতকে পরিবারটি কোনক্রমে এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। অবশেষে ১৯৫০ সালের ইস্ট বেঙ্গল এস্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট (East Bengal State Acquisition and Tenancy Act) অনুযায়ী এই জমিদারি বিলুপ্ত হয়।  [এ.বি.এম মাহমুদ এবং সিরাজুল ইসলাম]