কচুরিপানা

কচুরিপানা (Water Hyacinth)  এক প্রকার ভাসমান  জলজ উদ্ভিদ Eichornia crassipes। মাঝে মাঝে অত্যধিক পরিমাণে জন্মায় ও নদীনালা ভরে তুলে নৌ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। এটি অবাধ ভাসমান গুল্ম, নিচে থেকে একথোকা লম্বা গুচ্ছমূল, ওপরে খর্বিত কান্ডে একথোকা পাতা। পাতার বোঁটা খাটো ও স্পঞ্জি। মঞ্জরি ১৫-২০ সেমি লম্বা, দন্ডে থাকে ১০-১২ দৃষ্টিনন্দন ফুল। বাংলাদেশে কচুরিপানা একটি  আগাছা, জন্মায় বদ্ধজলাশয়ে প্রায় সর্বত্র। বর্ষাকালে এ পানা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে এবং প্লাবনভূমিতে ব্যাপকভাবে ছড়ায়। ফুল ফোটে অক্টোবর-জানুয়ারিতে।

কচুরিপানা

শোনা যায়, উনিশ শতকের শেষার্ধে জনৈক পর্যটক কচুরিপানার অর্কিডসদৃশ ফুলে মুগ্ধ হয়ে ব্রাজিল থেকে এ উদ্ভিদ এদেশে আনেন। বাংলাদেশে এটি এত দ্রুত ছড়াতে থাকে যে ১৯২০-এর দশকের মধ্যেই দেশের সবগুলি জলাশয় কচুরিপানায় ভরে যায়। এতে নৌ চলাচলে বিঘ্ন ঘটে এবং নিচু জমিতে আমনজাতীয়  জলিধান ও  পাট চাষ কঠিন হয়ে ওঠে, ফলে বাংলার অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়।

এমতাবস্থায় সরকার বেঙ্গল জলপথ বিধি, বেঙ্গল পৌরসভা বিধি, বেঙ্গল স্থানীয় সরকার বিধি, বেঙ্গল গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসন বিধির সহায়তায় এ দুর্যোগ মোকাবিলার উদ্যোগ গ্রহণ করে, কিন্তু তেমন সুফল পাওয়া যায় নি। অবশেষে সরকার সর্বসাধারণের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কচুরিপানা উৎখাত শুরু করে। ১৯৩৬ সালে কার্যকর কচুরিপানা বিধি মোতাবেক সকলের জন্য তাদের নিজ জমি বা দখলি এলাকায় কচুরিপানা রাখা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং কচুরিপানা উৎখাত অভিযানে সকলের সহায়তা বাধ্যতামূলক করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলিতে প্রশাসকদের সেখানকার কচুরিপানা ধ্বংস কর্মসূচি পালন এবং প্রধানত স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়।

পরিচালিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান সকলের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতেও কচুরিপানা উৎখাতের অঙ্গীকার স্থান পায়। ফলে ১৯৩৭ সালে এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হলে কচুরিপানা উৎখাত কর্মসূচি জোরদার হয়ে ওঠে।

কচুরিপানা উৎখাত কর্মসূচির সাফল্যের আরও কিছু কারণ আছে। স্তূপীকৃত ও পচা কচুরিপানা ফসলের জন্য একটি চমৎকার  সার। এ স্তূপ ঠিকঠাক করে তাতে নানা শাকসবজিও ফলানো যায়। ফলে ভূমিহীন চাষীরা পানিতে ভাসমান কচুরিপানার স্তূপগুলিকে  কৃষি কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে।

১৯৪৭ সাল নাগাদ কচুরিপানার সমস্যাটি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং পরের দশকে দেশের অনেক নদীনালা আবার নাব্য হয়ে ওঠে। এখনও দেশের অনেক জায়গায়, বিশেষত বিল ও হাওরে কচুরিপানা আছে, কিন্তু তাতে নৌ চলাচল বা চাষাবাদে কোনো সমস্যা দেখা দেয় না। এটি এখন প্রধানত সার হিসেবেই অধিক ব্যবহূত হয় এবং বর্ষাকালে  বন্যা আক্রান্ত অঞ্চলে গবাদি পশুর খাদ্য যোগায়। এছাড়া হাওর অঞ্চল সংলগ্ন এলাকায় বাঁশ দিয়ে আটকে রেখে ঢেউয়ের আঘাত থেকে ভিটে-মাটি রক্ষায় ব্যবহূত হয়।  [মোস্তফা কামাল পাশা]

আরও দেখুন আগাছা; উদ্ভিদকুল; জলজ উদ্ভিদ