হারেম

হারেম আরবি শব্দ, যার আভিধানিক অর্থ নিষিদ্ধ বা অলঙ্ঘনীয় সীমারেখা। রাজপ্রাসাদের যে আলাদা অংশে শাসকের মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা, নারী কর্মচারী, উপপত্নী প্রমুখ বাস করতেন তা হারেম, হারিম বা হেরেম নামে অভিহিত হতো। বহিরাগতদের হারেমে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।

মুগল আমলে হারেম প্রথা পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকাশ লাভ করে।  আইন-ই-আকবরী এবং  আকবরনামার লেখক  আবুল ফজল হারেমের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। মুগল আমলে শাহী পরিবারের নারীাদের আবাসস্থলগুলি (female apartments) ‘মহল’ নামে পরিচিত ছিল। আবুল ফজল একে ‘শাবিস্তান-ই-খাস’ নামে অভিহিত করেছেন। রাজপ্রাসাদের এক বিশাল অংশ জুড়ে নারীদের বাস ছিল। তাঁদের প্রত্যেকের আলাদা মহল ছিল। এছাড়া আরও তিনটি প্রাসাদে সম্রাটের উপপত্নীগণ বাস করতেন। এগুলিকে বলা হতো ‘লেথেবার’ (রবিবার), ‘মঙ্গল’ (মঙ্গলবার) এবং ‘জেনিসার’ (শনিবার) মহল। এই নির্ধারিত দিনগুলিতে সম্রাট নির্দিষ্ট প্রাসাদে যেতেন। এছাড়া সম্রাটের বিদেশী উপপত্নীদের জন্য ‘বাঙালি মহল’ নামে একটি পৃথক মহল ছিল।

মুগল সম্রাজ্ঞীদের ব্যক্তিগত ঘরগুলি ছিল বেশ সমৃদ্ধ। মহলসমূহে তাঁরা আড়ম্বরপূর্ণ ও বিলাসবহুল জীবনযাপন করতেন। নারীগণ মহলের বাইরে দেখতে পেলেও কেউ তাঁদের দেখতে পেত না। তাঁদের ভবনগুলির জাঁকজমক ও সৌন্দর্য নির্ধারিত হতো তাঁদের স্ব স্ব মর্যাদা ও আয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে। চতুর্দিকে ঝর্ণা ও বাগানঘেরা এ ভবনগুলির প্রতিটিতে ছিল প্রবহমান জলের আধার ও আরামদায়ক বিশ্রামস্থল।

হারেমের ব্যবস্থাপনা ছিল সুসংগঠিত। এর  দারোগা ও তত্ত্বাবধায়করূপে নিয়োগ পেতেন সচ্চরিত্র মহিলাগণ। তারা হারেমের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব পালন করতেন। এর শৃঙ্খলা এবং নিয়মানুবর্তিতা রক্ষার দায়িত্বে থাকতেন মহিলা দারোগা। ‘তহবিলদার’ বা কোষাধ্যক্ষের নিকট থেকে উচ্চ মাসোহারাভোগী এ সকল মহিলা তাদের স্ব স্ব বেতন নিতেন। হারেমের সর্বোচ্চ পদাধিকারী মহিলা কর্মচারী ছিলেন ‘মহলদার’। এরা সম্রাটের গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করতেন। মহলদারের হস্তক্ষেপের কারণে প্রায়শই রাজকুমারদের সাথে তার তিক্ততা সৃষ্টি হতো। মহলদারের তীক্ষ্ণ নজরদারী রাজকুমারগণ পছন্দ করতেন না।

হারেমের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল বেশ সুদৃঢ়। সম্রাটের ভবনের নিকট বিশ্বস্ত নারীরক্ষীগণ নিয়োজিত থাকত। হারেমের বহির্প্রান্তে খোজাগণ (eunuch) এবং তাদের থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে একদল অনুগত রাজপুত বাহিনী প্রহরায় নিয়োজিত থাকত। হারেমে প্রবেশ করা ছিল দুঃসাধ্য। সূর্যাস্তের সময় হারেমের দ্বার বন্ধ হয়ে যেত এবং আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। প্রত্যেক মহিলারক্ষী হারেমের সকল কর্মকান্ড সম্পর্কে ‘নাজির’কে অবহিত করতে বাধ্য ছিলেন। হারেমের সব ক্রিয়াকলাপের লিখিত বিবরণ সম্রাটের নিকট প্রেরিত হতো। সাম্রাজ্যের কোন অভিজাতের স্ত্রী যদি হারেম দর্শনে অভিলাষী হতেন তাহলে তাকে প্রথমে হারেমের কর্মচারীদের অবহিত করতে হতো। কর্মচারীগণ প্রাসাদ কর্মকর্তাদের কাছে এরূপ আকাঙ্ক্ষার কথা জানাত। এরপর যদি তিনি হারেমে প্রবেশের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হতেন তবেই তাকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হতো। হারেমের নিরাপত্তারক্ষী খোজাগণ ‘নাজির’ নামেও অভিহিত হতো। প্রত্যেক রাজকুমারীর একজন করে নাজির থাকত যার উপর তিনি গভীর আস্থা স্থাপন করতেন। সম্রাট বা নওয়াব প্রাসাদের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়ানোর সময় ‘কানিজ’ (নারী কর্মচারী)-দের দল তাঁর অনুগমন করত।

১৭১২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট প্রথম শাহ আলমের মৃত্যুর পর প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারণে মুগল সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে এবং বাংলা, হায়দ্রাবাদ ও লক্ষ্ণৌতে স্বাধীন প্রাদেশিক রাজবংশের উদ্ভব হয়। বাংলার স্বাধীন নওয়াবগণ মুগল ঐতিহ্য অনুসারে হারেম প্রথা প্রবর্তন করেন। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীতে নওয়াব  সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পরও হারেম ব্যবস্থা অপরিবর্তিত ছিল।  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মকর্তা ও ইংরেজ বণিকগণ নওয়াবদের মতো হারেম রীতি অনুসরণ করে। তাদের হারেমে  আর্মেনীয়পর্তুগিজ, বাঙালি, এমনকি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নারীদের সমাবেশ ঘটতো।

সাধারণত বাংলার নওয়াবগণ দুই বা ততোধিক বিয়ে করতেন। সর্বজ্যেষ্ঠা বেগম ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং বিশেষ সম্মানের অধিকারী। হারেমের সমগ্র ব্যবস্থাপনা নওয়াবের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো। নির্দিষ্ট দিনে নওয়াব নির্দিষ্ট পত্নীর সেবা গ্রহণ করতেন। ‘কানিজ’গণ নওয়াবদের জন্য সবরকম আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করত। বাইরে গমনের সময় শুধু নওয়াবের প্রিয় পত্নী তাঁর সঙ্গী হতে পারতেন। অন্য পত্নীগণ খোজাদের তত্ত্বাবধানে থাকতেন। হারেমের নারীদের পোশাক ছিল অতি মূল্যবান, তারা দামী খাদ্য গ্রহণ করতেন এবং সর্ব প্রকার পার্থিব সুখ উপভোগ করতেন। নওয়াবদের সুদৃষ্টি লাভের জন্য তারা প্রায়ই পরস্পরের প্রতি বিদ্বিষ্ট মনোভাব পোষণ করতেন। নওয়াব ব্যতীত অন্য কোন পুরুষ যাতে কোন বেগমের দর্শনলাভ না করে সেজন্য প্রত্যেক বেগমের প্রহরায় খোজা ও বাঙালি ক্রীতদাসীদের নিয়োজিত করা হতো। অন্যান্য সম্ভ্রান্ত মহিলারাও (আমীর পত্নী) বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্থ ছিলেন।

বাংলার নওয়াবদের প্রত্যেক পত্নী প্রাসাদের পৃথক পৃথক ভবনে বাস করতেন। তাঁদেরকে নির্দিষ্ট অঙ্কের মাসিক ভাতা দেওয়া হতো। তাঁদের সেবায় বহু দাস-দাসী নিয়োজিত থাকত। নওয়াবের উপর প্রভাবের ভিত্তিতে একজন বেগমের শানশওকত নির্ভর করত। বেগমদের ভবনগুলি সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। প্রাচীরের অভ্যন্তরে সুদৃশ্য বাগানে বেগমগণ আনন্দময় সময় কাটাতেন। মুগলদের মতো বাংলার নওয়াবদেরও উপপত্নী থাকতেন। সঙ্গীতের আসরে তারা নওয়াবকে আফিম ও উত্তেজক পানীয় গ্রহণে উৎসাহিত করতেন। প্রত্যেক উপপত্নী নিজস্ব ভবনে বাস করতেন।

বাংলার নওয়াবদের মধ্যে অবশ্য ব্যতিক্রমও ছিল।  আলীবর্দী খান ছিলেন ধর্মভীরু; তাঁর সমসাময়িক ইউরোপীয়গণ তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন। তিনি মদ্য ও নারীতে আসক্ত ছিলেন না। পূর্বাহ্নে খবর না দিয়ে তিনি কখনও হারেমে যেতেন না। পরাজিত ও নিহত বিদ্রোহীদের স্ত্রী-কন্যাগণ আলীবর্দীর হারেমে আশ্রয় পেতেন। তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার এবং হারেমের অভ্যন্তরে তাদের জন্য ভবন নির্দিষ্ট করা হতো। যখনই তিনি উপহার হিসেবে কোন ফল বা কোন বিশেষ উপঢৌকন পেতেন তখনই তিনি তার বেগমের মাধ্যমে অন্তঃপুরের নারীদের জন্য তা পাঠিয়ে দিতেন। সমসাময়িক সমাজ ও রাজনীতিতে বাংলার নওয়াবদের হারেমের কোন কোন মহিলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। এদের মধ্যে  ঘসেটি বেগম,  লুৎফুন্নেসা বেগম ও  মুন্নী বেগম এর নাম উল্লেখযোগ্য।  [শাহরিয়ার জেড.আর ইকবাল]

গ্রন্থপঞ্জি  Abul Fazl Ain-i-Akbari, Vol. I (Translated by H Blochman), 2nd ed, Calcutta, 1939; Jadunath Sarker, The History of Bengal, Vol. 11, Dhaka, 1948; Shahryar Iqbal, Mughol Shomaj O Rajnitite Nari (in Bangla), Dhaka, 1995.