সাধু ভাষা
সাধু ভাষা বাংলা লেখ্য গদ্যের অপেক্ষাকৃত প্রাচীন রূপ; এর নবীন ও বর্তমানে বহুল প্রচলিত রূপটি হলো চলিত। সাধু ভাষা অনেকটা ধ্রুপদী বৈশিষ্ট্যের এবং চলিত ভাষা সর্বসাধারণের জীবন-ঘনিষ্ঠ। ভাষার এই দ্বিধারিক প্রপঞ্চকে বলা হয় দ্বি-ভাষারীতি।
সাধু ভাষার বাক্যরীতি অনেকটা সুনির্ধারিত। এ ভাষায় তৎসম শব্দের প্রয়োগ বেশি। এতে সর্বনাম, ক্রিয়াপদ প্রভৃতির রূপ মৌখিক ভাষার রূপ অপেক্ষা পূর্ণতর। চলিত ভাষা সর্বদাই নতুন নতুন ধ্বনি-পরিবর্তন করে। কিন্তু সাধু ভাষায় শব্দের রূপান্তর খুব বেশি দেখা যায় না। যেমন, চলিত ভাষায় স্বরসঙ্গতি ও অভিশ্রুতির প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়, কিন্তু সাধু ভাষায় তেমনটা দেখা যায় না। চলিত ভাষা অপেক্ষাকৃত চটুল এবং সাধু ভাষা গম্ভীর; তবে ব্যঙ্গরচনা বা রম্যরচনায় চলিত ভাষার মতো সাধু ভাষারও সফল ব্যবহার হতে পারে। অন্যদিকে সাধু ভাষায় আছে এক রকম স্বাভাবিক আভিজাত্য ও ঋজুতা।
উনিশ শতকে বাংলা গদ্যের প্রসারকালে সাধু ভাষার দুটি রূপ দেখা গিয়েছিল : বিদ্যাসাগরী ও বঙ্কিমী। প্রথমটিতে খ্যাত ছিলেন বাংলা গদ্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং সেই সঙ্গে অক্ষয়কুমার দত্ত। তাঁদের ভাষা বিশুদ্ধ সংস্কৃত শব্দবহুল, যাতে অসংস্কৃত শব্দ পরিহারের প্রয়াস দেখা যায়। কিন্তু দ্বিতীয় রূপের প্রধান পুরুষ বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষা সংস্কৃত শব্দবহুল হলেও তা অপেক্ষাকৃত সহজ এবং সে ভাষায় অসংস্কৃত শব্দের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল না। বঙ্কিমী সাধু ভাষায়ই হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, দীনেশচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মীর মশাররফ হোসেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী প্রমুখ সাহিত্যিকের গ্রন্থাবলি রচিত হয়; এছাড়া সমসাময়িক সাহিত্যেও কমবেশি এ ভাষা ব্যবহূত হয়েছে। এভাবে এক সময় সাধু ভাষা বাংলার আদর্শ লেখ্য ভাষা (Srandard written language) হয়ে ওঠে। সমগ্র বঙ্গদেশে তখন গদ্য-লেখায় ও চিঠি-পত্রাদিতে প্রায়শ এই ভাষা ব্যবহূত হতো; সরকারি কাজকর্ম, বিশেষত আইন-সংশিষ্ট দস্তাবেজে এর প্রয়োগ ছিল সর্বাধিক। বর্তমানে দৈনন্দিন কাজকর্ম এবং সাহিত্যে এ ভাষার প্রয়োগ নেই বললেই চলে।
বিদ্যাসাগরী ও বঙ্কিমী সাধু ভাষার দুটি উদাহরণ হলো: ‘এই পরম রমণীয় স্থানে কিয়ৎক্ষণ সঞ্চরণ করিয়া, রাজকুমার অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইলেন এবং সমীপবর্তী বকুলবৃক্ষের স্কন্ধে অশ্ববন্ধন ও সরোবরে অবগাহনপূর্বক, স্নান করিলেন; অনন্তর, অনতিদূরবর্তী দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দিরে প্রবেশপূর্বক দর্শন, পূজা, ও প্রণাম করিয়া কিয়ৎক্ষণ পরে বহির্গত হইলেন।’ (বেতালপঞ্চবিংশতি) এবং ‘অনেক দিন আনন্দোত্থিত সঙ্গীত শুনি নাই, অনেক দিন আনন্দ অনুভব করি নাই। যৌবনে যখন পৃথিবী সুন্দর ছিল, যখন প্রতি পুষ্পে পুষ্পে সুগন্ধ পাইতাম, প্রতি পত্রমর্মরে মধুর শব্দ শুনিতাম, প্রতি নক্ষত্রে চিত্রা-রোহিণীর শোভা দেখিতাম, প্রতি মনুষ্য-মুখে সরলতা দেখিতাম, তখন আনন্দ ছিল। পৃথিবী এখনো তাই আছে, কিন্তু এ হূদয় আর তাই নাই।’ (কৃষ্ণকান্তের উইল)। [মহাম্মদ দানীউল হক]