সমুদ্রসীমার অঞ্চলসমূহ

সমুদ্রসীমার অঞ্চলসমূহ (Maritime Zones) সমুদ্রসীমার অঞ্চল বলতে বোঝায় মহাসাগর বা সমুদ্রের সেসকল অংশ যার উপর সার্বভৌম রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক কর্তৃপক্ষ তাদের কর্তৃত্ব দাবি করতে পারে। আন্তর্জাতিক আইন এবং রাষ্ট্রীয় আইনের বিধান অনুসারে এ সকল অঞ্চল নির্ধারিত হয়ে থাকে। সমুদ্রসীমার অঞ্চলকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন রাষ্ট্রীয় জলসীমা, আঞ্চলিক বা উপকূলবর্তী সমুদ্রাঞ্চল, নিকটস্থ বা ভৌগোলিক সীমানা সংলগ্ন অঞ্চল, রাষ্ট্রের মালিকানাধীন স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (EEZ), মহীসোপান, এবং জলসীমার অন্তর্গত মুক্তসাগর। সাধারণত, সমুদ্রসীমার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল একটি দেশের সমুদ্র তটরেখা থেকে ২২.২ কিমি/১২ নটিকাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে। সংলগ্ন অঞ্চল ২৪ নটিকাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হয় যেখানে উপকূলীয় সার্বভৌম রাষ্ট্র তাদের নিজস্ব প্রথা, শুল্ক আইন, অভিবাসন আইন, এবং স্বাস্থ্যসংক্রান্ত আইন প্রয়োগ করতে পারে। রাষ্ট্রসমূহ স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল (EEZ) এর ২০০ নটিকাল মাইল পর্যন্ত তাদের মৎস্য শিকার সংক্রান্ত অধিকার এবং প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ অনুসন্ধান ও আহরণ সংক্রান্ত অধিকার প্রয়োগ করতে পারে। মহীসোপান বলতে বোঝায় রাষ্ট্রীয় সমুদ্রের বাইরে কিন্তু তৎসংলগ্ন জলরাশির তলদেশ ও তার অন্তর্ভূমি যা ২০০ মিটার জলের গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত বা তার বাইরে যে এলাকায় কারিগরি উৎকর্ষতা দ্বারা সম্পদ আহরণ সম্ভব এমন অংশ। তবে মহাদেশীয় প্রান্তের ২০০ নটিকাল মাইলের অধিক প্রাকৃতিক প্রসারের ক্ষেত্রে মহীসোপান সর্বোচ্চ ৩৫০ নটিকাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। মুক্ত সাগর বলতে বোঝায় এমন সমুদ্রাঞ্চল যা একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চল অর্থাৎ ২০০ নটিকাল মাইল পরবর্তী বিস্তীর্ণ ও গভীর জলরাশি। মুক্ত সাগরে সকল উপকূলীয় ও স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র সীমিত আকারে কিছু অধিকার প্রয়োগ করতে পারে, যেমন ক) নৌচালনার স্বাধীনতা, খ) উপরস্থ বায়ুমণ্ডলে বিমান চলাচলের স্বাধীনতা, গ) সাবমেরিন কেবল এবং পাইপলাইন স্থাপনের স্বাধীনতা, ঘ) কৃত্রিম দ্বীপ এবং আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা অনুমোদিত অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের স্বাধীনতা, ঙ) মৎস্য শিকারের স্বাধীনতা এবং চ) বৈজ্ঞানিক গবেষণা স্বাধীনতা।

বাংলাদেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের বিধানাবলি দ্বারা সমুদ্রসীমার অঞ্চল নির্ধারিত হয়ে থাকে। জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সংক্রান্ত সনদ ১৯৮২ (যেটি সমুদ্র আইন সংক্রান্ত আইন্তর্জাতিক আইনের প্রধান দলিল)। এর পূর্বে বাংলাদেশ তার রাষ্ট্রীয় জলসীমা এবং সমুদ্রসীমার অঞ্চল আইন ১৯৭৪ প্রণয়ন করেছিল। ১৯৭৪ সালের এই আইনে আন্তর্জাতিক আইন মোতাবেক সমুদ্রসীমার বিভিন্ন অঞ্চলকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে ও সীমারেখা নির্ধারিত করা হয়েছে। এই আইনের অধীনে গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রতিটি অঞ্চলের সীমারেখা চিহ্নিত হয়। এভাবে নির্ধারিত সমুদ্রাঞ্চল জাতিসংঘ সনদের সাথে সংগতিপূর্ণ। বাংলাদেশ এই সনদের একটি স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র।

বাংলাদেশ আঞ্চলিক সমুদ্রাঞ্চল ও একচেটিয়া অঞ্চল নির্ধারণে যথাক্রমে ১২ নটিকাল মাইল ও ২০০ নটিকাল মাইল নীতি অনুসরণ করে। ২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে (ITLOS) মায়ানমারের বিরুদ্ধে রায়ে নজিরবিহীন বিজয় লাভের ফলে এখন বাংলাদেশ চাইলে ২০০ নটিকাল মাইলের অধিক মহীসোপান দাবি করতে পারে। এই রায়ের মাধ্যমে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মায়ানমারের সকল রকম দাবি নস্যাতের মাধ্যমে বাংলাদেশের চূড়ান্ত আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় রেখা বাঁকা, খাঁজকাটা ও অস্থিতিশীল। উপকূলীয় সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের প্রমত্তা নদী পদ্মা, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও সেগুলোর শাখানদী বাহিত বিপুল পরিমাণ পলি, কাদা ও নুড়ি জমা হওয়ায় মগ্ন চড়া দেখা দিচ্ছে। ফলত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ এমন যে, সেখানে স্থলভাগ বা সাগরের দিকে কোন স্থায়ী জলরেখা নেই এবং উপকূলীয় সমুদ্র এতটা অগভীর যে তা বড় বড় জাহাজ চলাচলের অনুপযুক্ত। অধিকন্তু কাদাভরা তীরের মধ্য দিয়ে বহতা নাব্য জলপথগুলো অবিরত পরিবর্তিত হওয়ায় তটাঞ্চলের পরিস্থিতির ভৌত জরিপ, বিশেষত যৌথ-জরিপ দ্বারা পানির গভীরতা পরিমাপ প্রয়োজন।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয় সমুদ্রের মতো সামুদ্রিক এলাকা পরিমাপে সমুদ্রপৃষ্ঠের ১০ ফ্যাদম (৬০ ফুট) গভীরতার প্রস্তাব দিয়েছে যার মাধ্যমেই রাষ্ট্রীয় জলসীমা, সংলগ্ন অঞ্চল, একচেটিয়া অঞ্চল এবং মহীসোপান নির্ধারিত হবে। তবে, বাংলাদেশের উপকূলীয় সমুদ্র ক্রমাগত পরিবর্তনশীল হওয়ার কারণে গভীরতার মাপকাঠিতেও স্থায়ীভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠ চিহ্নিতকরণ সম্ভব না। এজন্য মাঝে মাঝেই জরিপ আবশ্যক। এরই সূত্র ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ দেখা দেয়। অতঃপর ২০১৪ সালের ৭ জুলাই নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত পার্মানেন্ট কোর্ট অফ আরবিট্রেশনের সালিশে মীমাংসা হয়। এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তে ২৫,৬০২ বর্গ কিমি বিবাদী অঞ্চলের মধ্যে ১৯,৪৬৭ বর্গ কিমি অঞ্চল বাংলাদেশকে প্রদান করা হয়েছে। তবে, এই সিদ্ধান্তেই আবার ভারতকে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী হাড়িভাঙ্গা নদী এবং (বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ) রাইমঙ্গল নদীর মোহনায় জেগে ওঠা দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ-এর উপর সার্বভৌম অধিকার দেয়া হয়েছে। [এম হাবিবুর রহমান]