দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ (South Talpatti Island) সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার অন্তর্ভূক্ত বঙ্গোপসাগরের অগভীর সামুদ্রিক মহীসোপান (continental shelf) এলাকায় জেগে ওঠা একটি উপকূলবর্তী দ্বীপ। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা এবং পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগণা জেলার বশীরহাট থানার মধ্যকার হাড়িয়াভাঙ্গা নদী দ্বারা চিহ্নিত সীমান্ত রেখা বরাবর দক্ষিণে হাড়িয়াভাঙ্গা মোহনায় অগভীর সমুদ্রে এ ক্ষুদ্র দ্বীপটি গড়ে উঠেছে। এটির ভৌগোলিক অবস্থান ২১°৩৭´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°১২´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। দ্বীপটি মূলত গঙ্গা-পদ্মা নদীপ্রণালী-এর বিভিন্ন শাখা নদীর পলল অবক্ষেপণের ফলে গড়ে উঠেছে। দ্বীপটির আকৃতি প্রায় গোলাকার এবং ভাটার সময় সমুদ্রের পানি নেমে গেলে এটিকে দেখতে অনেকটা অর্ধচন্দ্রাকৃতির মতো মনে হয়। হাড়িয়াভাঙ্গা মোহনা থেকে দ্বীপটির দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মূল স্রোতধারা দ্বীপটির পশ্চিম পাশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দক্ষিণ তালপট্টির সরাসরি উত্তরে বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড তালপট্টি এবং দক্ষিণে উন্মুক্ত বঙ্গোপসাগর। দ্বীপটির বর্তমান আয়তন প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার। জোয়ারভাটার উঠানামায় দ্বীপটির জেগে থাকা ভূ-ভাগের আয়তন প্রায় ৭ বর্গ কিমি থেকে ১৪ বর্গ কিমি পর্যন্ত হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় গাঙ্গেয় বদ্বীপাঞ্চলের দক্ষিণ ভাগে আঘাত হানার ঠিক পর পরই দ্বীপটি প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমানা নির্ধারিত হয়েছে রেডক্লিফ রোয়েদাদের ভিত্তিতে। রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী নদী বিভাজিত সীমান্তের ক্ষেত্রে ‘নদীর মূল স্রোতধারার মধ্যরেখা নীতি’ (Mid-channel flow principle)-কে দুই দেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক সীমানা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ‘নদীর মূল স্রোতধারার মধ্যরেখা নীতি’ (Thalweg doctrine) অনুযায়ী বাংলাদেশ ও ভারতের স্থানীয় সীমানা-বিভাজক হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মূল স্রোতধারার মধ্যরেখা সুস্পষ্টভাবেই দক্ষিণ তালপট্টির পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসকল বিষয় বিবেচনা করে খুলনা জেলা প্রশাসন এবং জরিপ বিভাগ দ্বীপটিকে নিজ প্রশাসনিক সীমানায় অন্তর্ভূক্ত করে দলিলপত্রে দ্বীপটিকে দক্ষিণ তালপট্টি নামে নথিভুক্ত করে। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার (পূর্বতন বৃহত্তর খুলনা জেলা) শ্যামনগর উপজেলাধীন তালপট্টির দক্ষিণে অবস্থানের কারণে এ দ্বীপটির নামকরণ করা হয়েছে দক্ষিণ তালপট্টি।
১৯৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে দ্বীপটির অভ্যুদয় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দৃষ্টিগোচর হয়। ভারত নতুন জেগে ওঠা দ্বীপটিকে ‘নিউমুর দ্বীপ’ (The New Moore Island) নামে চিহ্নিত করে। সে সময় পশ্চিমবঙ্গে দ্বীপটিকে কখনও ‘নিউমুর’ আবার কখনও ‘পূর্বাশা’ নামে অভিহিত করা হতো। ভারত সরকারও দ্বীপটিকে নিজ রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভূক্ত বলে দাবী করে থাকে।
১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ই.আর.টি.এস (ERTS) ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে সর্বপ্রথম দ্বীপটির দূর-অনুধাবন (Remote Sensing) চিত্র গ্রহণ করা হয় এবং সে সময়ে দ্বীপটির গড় আয়তন ছিল ২,৫০০ বর্গ মিটার। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সংগৃহীত নানা দূর-অনুধাবন চিত্র ও জরিপ থেকে দেখা যায় যে, ক্রমান্বয়ে দ্বীপটির আয়তন বেড়েই চলেছে এবং বর্তমানে মোট জেগে ওঠা ভূমির গড় পরিসর প্রায় ১০,০০০ বর্গ মিটার। বর্তমানে হাড়িয়াভাঙ্গা মোহনার কাছে দ্বীপটির উত্তর এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বেশ কিছু মগ্ন-চড়া (submerged shoals) দেখা যাচ্ছে। অতি সাম্প্রতিক ভূ-উপগ্রহ চিত্র দক্ষিণ তালপট্টির চতুস্পার্শ্বের স্বল্প-গভীর সামুদ্রিক পানিতে প্রায় জেগে ওঠা বিশাল ডুবন্ত ভূখন্ডের উপস্থিতি রেকর্ড করছে। এ উপাত্ত থেকে ধারণা করা যায় যে, আগামী দুই-এক দশকের মধ্যেই দক্ষিণ তালপট্টির মোট আয়তন কমপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ বর্গ কিমি ছাড়িয়ে যাবে।
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৩.৫ কিমি দীর্ঘ এবং পূর্ব-পশ্চিমে সর্বোচ্চ প্রায় ৩ কিমি বিস্তৃত। দ্বীপটির উত্তর এবং দক্ষিণ-পূর্বাংশে নতুন জেগে ওঠা ভূমির বিস্তার বেশি। হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মূল স্রোতধারার প্রভাবে দ্বীপটির পশ্চিম পার্শ্বে পলিসঞ্চয়ন কম হচ্ছে। দ্বীপটির সর্বোচ্চ স্থানের উচ্চতা সমুদ্র-সমতল থেকে মাত্র ১.৩ মিটার। উত্তরাংশের উচ্চতা ক্রমশ হ্রাস পেয়ে মধ্যভাগ থেকে উত্তরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত একটি অগভীর উপহ্রদ (Lagoon) সৃষ্টি হয়েছে। উপহ্রদটির উত্তরাংশ উন্মুক্ত এবং পূর্ব ও পশ্চিমভাগ সংকীর্ণ ভূ-বাহুর বেষ্টনী দিয়ে আবদ্ধ। শুধুমাত্র জোয়ার ছাড়া অন্য সময় এ উপহ্রদটি প্রায় শুকনা থাকে। হ্রদটির তলদেশ কর্দমাক্ত।
দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপের চতুষ্পার্শ্বের দশ কিলোমিটার বিস্তার পর্যন্ত উপকূলীয় সমুদ্রের গড় গভীরতা মাত্র ৩ থেকে ৫.৫ মিটার। দ্বীপটি থেকে সোজা প্রায় ৪৩ কিমি দক্ষিণে গভীর সামুদ্রিক খাত সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড (Swatch of No Ground)-এর অবস্থান। দ্বীপটির পশ্চিম দিক ছাড়া প্রায় তিন দিকেই অসংখ্য অগভীর ডুবন্ত চড়ার অভ্যুদয় ও বিস্তার ঘটছে। দ্বীপটির ভূরূপতাত্ত্বিক বিস্তারের প্রবণতা মূলত উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে প্রলম্বিত।
দ্বীপটি ও এর চারপাশের ভূরূপতাত্ত্বিক অবস্থা এবং সংলগ্ন হাড়িয়াভাঙ্গা ও রায়মঙ্গল নদী দুটির জলতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া থেকে অনুমিত হয় যে, অদূর ভবিষ্যতে এটি উত্তরে অবস্থিত বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড তালপট্টির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। দূর-অনুধাবন ও বিমান চিত্র বিশ্লেষণে দক্ষিণ-তালপট্টির উত্তরে একটি লম্বা মগ্ন-চড়ার অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। উপকূলীয় ভূরূপতত্ত্বের নিরিখে দেখা যায় যে, দক্ষিণ-তালপট্টি এবং এর উত্তরের এ নতুন গড়ে ওঠা মগ্ন ভূ-ভাগ অগভীর ডুবন্ত পললসঞ্চিত ভূখন্ডের দ্বারা উত্তরের মূল ভূখন্ড তালপট্টির সঙ্গে সংযুক্ত। ভাটার সময় এ ডুবন্ত পলল রেখার গড় গভীরতা থাকে মাত্র ২ থেকে ২.৫ মিটার।
হাড়িয়াভাঙ্গা ও রায়মঙ্গল নদীদ্বয় দ্বারা প্রভাবিত দক্ষিণ তালপট্টির দক্ষিণাংশের ভূ-গঠনে বঙ্গোপসাগরের প্রভাব প্রকট। দ্বীপটির দক্ষিণভাগে প্রধানত বালি-কর্দম মিশ্রিত তটভূমি এবং উত্তর ও পূর্বাংশে পলি-কর্দম এবং কর্দমজাত সমভূমি দেখা যায়। গত বেশ কয়েক বছর যাবত দ্বীপটির দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্বাংশে উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বনভূমি (coastal mangrove forest) গড়ে উঠেছে।
দক্ষিণ তালপট্টিসহ উত্তরে বঙ্গোপসাগরের অন্যান্য সকল উপকূলীয় ভূখন্ডেই ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস প্রায়শই আঘাত হানে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপে ভূমিক্ষয় এবং অবক্ষেপণ উভয় ধরনের ভূরূপতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে থাকে। আবার কখনও কখনও বড় ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও জোয়ার বা বানের ফলে দ্বীপটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে সমুদ্রের পানির নিচে তলিয়ে যায়।
দক্ষিণ তালপট্টির ক্ষুদ্র পরিসরে নিম্নলিখিত ভূমিরূপ পরিদৃষ্ট হয়: ক. জোয়ারভাটাজাত প্লাবন সমভূমি, খ. জোয়ারভাটাজাত উপহ্রদ ও জলাভূমি, গ. নদীবাহিত পললজাত মগ্নচড়া, ঘ. নদীবাহিত কর্দমজাত নিম্নভূমি, ঙ. পূর্বাঞ্চলের নদীক্ষয়জাত সোপানতট, এবং চ. দক্ষিণ-পূর্বাংশের বালুকা-বেলাভূমি। দ্বীপটির গঠনে নদীবাহিত পলি এবং কাদার ভূমিকা মূখ্য। অপেক্ষাকৃত মোটা দানাদার বালুকারাশির সঞ্চয় দ্বীপটির দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশে বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। [মাসুদ হাসান চৌধুরী]
গ্রন্থপঞ্জি M Franda, Bangladesh: The First Decade, South Asian Publishers, Delhi, 1982; CJ Gulati, Bangladesh: Liberation to Fundamentalism, Commonwealth Publishers, New Delhi, 1988; MA Islam, ‘The Ganges-Brahmaputra River Delta’, Journal of the University of Sheffield Geological Society 7(3), Sheffield, 1978; TK Mallik, ‘Self Sediments of the Ganges Deltas with Special Emphasis on the Mineralogy of the Western Part, Bay of Bengal’, Marine Geology 22(1), Amsterdam; শহীদুল্লাহ মৃধা, বঙ্গোপসাগর: মানুষ ও সমুদ্র, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৫।