শাহ মুহম্মদ মসজিদ
শাহ মুহম্মদ মসজিদ সাদি মসজিদ (১৬৫২) থেকে আধা কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলাধীন এগারোসিন্ধুর এ অবস্থিত। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ধারাবাহিক সংস্কারের ফলে মসজিদটি বর্তমানে বেশ ভাল অবস্থায় বিদ্যমান।
পূর্ব দিকে একটি প্রবেশপথসহ নিচু প্রাচীর ঘেরা সামান্য উঁচু একটি প্লাটফর্মের উপর মসজিদটি স্থাপিত। প্রবেশপথটি দোচালা ছাদ বিশিষ্ট একটি আয়তাকার কাঠামো। মূল মসজিদটি বর্গাকার এবং ভেতরের দিক দিয়ে এর প্রতি পার্শ্বের মাপ ৫.৭৯ মিটার। বহির্ভাগে চার কোণের অষ্টভুজাকার বুরুজগুলি মসজিদকে অধিকতর সৌন্দর্যমন্ডিত করেছে। প্রতিটি বুরুজই মসজিদের ছাদ ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা উপরে উঠে গেছে। এগুলির শীর্ষ ছত্রীসহ নিরেট ছোট গম্বুজে সমাপ্ত হয়েছে। আদিতে এগুলি কলস চূড়ায় শোভিত ছিল, যার অস্তিত্ব দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটি বুরুজে এখনও বিদ্যমান। মসজিদের পূর্ব ফাসাদে তিনটি খিলানপথ রয়েছে, যেগুলির সম্মুখভাগ খাঁজযুক্ত। উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে একটি করে খিলানপথ রয়েছে। পশ্চিম দেওয়ালে রয়েছে তিনটি মিহরাব। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অর্ধ-অষ্টভুজাকার এবং পার্শ্ববর্তীগুলি আয়তাকার। কেন্দ্রীয় মিহরাব ও কেন্দ্রীয় খিলানপথ যথাক্রমে তাদের পার্শ্ববর্তী মিহরাব ও খিলানপথ অপেক্ষা বড়। মসজিদের সম্মুখভাগের তিনটি খিলানপথ ও কেন্দ্রীয় মিহরাবের সামনে রয়েছে চারটি ফ্রন্টন (fronton)। এগুলির প্রত্যেকটির দুপাশে রয়েছে আলঙ্কারিক ক্ষুদ্র মিনার (turrets)। বহির্ভাগের মিনারগুলি প্যারাপেট ছাড়িয়ে উপরে উঠে গেছে। মসজিদের প্যারাপেট ও কার্নিসগুলি প্রচলিত মুগল রীতিতে অনুভূমিক।
মসজিদটির ছাদ অষ্টভুজাকার ড্রামের উপর স্থাপিত বিশাল এক গম্বুজ দ্বারা আচ্ছাদিত। গম্বুজ শীর্ষ বিস্তৃত পদ্ম ও কলস চুড়া শোভিত। ড্রামটির ভার দেওয়ালের মাঝামাঝি থেকে উত্থিত খিলান গুচ্ছ ও ক্ষুদ্র অর্ধ-গম্বুজ স্কুইঞ্চের উপর ন্যস্ত।
মসজিদের প্রবেশপথের দোচালা ইমারতটি বর্তমানে সম্পূর্ণ পলেস্তারা করা। তবে মসজিদটি পলেস্তারা ও পোড়ামাটির ফলকের সম্মিলিত মিশ্রণে সজ্জিত। মসজিদের পূর্ব ফাসাদের উভয় প্রান্তে রয়েছে খিলানসারি প্যানেলের অনুভূমিক সারি, যা লতা-পাতা মোটিফ অলঙ্কৃত পোড়ামাটির নকশা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। পূর্ব দিকের তিনটি প্রবেশপথ আদিতে পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল, যা এখনও জির্ণাবস্থায় কেন্দ্রীয় খিলানপথে সংরক্ষিত আছে। বাকি তিনটি দেওয়ালের বহির্ভাগ বর্গাকার ও আয়তাকার প্যানেলের অগভীর নকশায় সজ্জিত। চার কোণের টাওয়ারগুলি উত্থিত বন্ধনী দ্বারা বিভক্ত এবং এদের চূড়ার পলকাটা ছত্রীবদ্ধ খিলান মোটিফ দ্বারা অলঙ্কৃত। অভিক্ষিপ্ত ফ্রন্টনের ক্ষুদ্র মিনারগুলি কলকী আকৃতির পেডেস্টাল যুক্ত। প্যারাপেট ও অষ্টভুজাকার ড্রাম বদ্ধ মেরলোন ফ্রিজ নকশায় সজ্জিত।
সবগুলি মিহরাবই পোড়ামাটির ফলক দ্বারা সুসজ্জিত। মিহরাবগুলি খিলানকৃত এবং এদের সম্মুখভাগ বহু খাঁজ বিশিষ্ট। মিহরাব খিলানের ভার বহণকারী দেওয়াল অভ্যন্তরস্ত স্তম্ভগুলি (pilaster) পাপড়ি নকশার ফ্রিজ সম্বলিত আলঙ্কারিক বন্ধনী দ্বারা সজ্জিত। এই খিলানগুলির দোচালা ছাদ বর্তমানে নকশাহীন সমতল হলেও আদিতে নিশ্চই পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল। মিহরাব কুলুঙ্গিগুলি ছাঁচ বন্ধনী দ্বারা সারিবদ্ধ প্যানেলে বিভক্ত। প্যানেলগুলি লতাপাতা নকশায় শোভিত।
সমস্ত মিহরাব কাঠামোটি একটি আয়তাকার ফ্রেমের মধ্যে ন্যস্ত। ফ্রেমটি পরষ্পর ছেদ করা প্যাঁচানো স্ক্রল নকশায় সজ্জিত, যা ফুলসহ লুপের সৃষ্টি করেছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবের আয়তাকার ফ্রেমের শীর্ষে ফুলসহ ছোট ছোট গাছের নকশায় সজ্জিত এক সারি খিলান কুলুঙ্গি রয়েছে।
গম্বুজের ড্রামের ভার বহনকারী স্কুইঞ্চ ও খিলান গুচ্ছগুলি অসাধারণ খাঁজকৃত নকশায় সজ্জিত। অষ্টভুজাকার ড্রাম ও গম্বুজ অভ্যন্তর উত্থিত বন্ধনী দ্বারা পৃথকীকৃত, যা সারিবদ্ধ মেরলোন ও খিলান কুলুঙ্গি শীর্ষায়িত। গম্বুজের অভ্যন্তরীণ শীর্ষ স্তরীকৃত বিশাল রোসেট দ্বারা অলঙ্কৃত।
মসজিদটি অলঙ্কৃত ক্ষুদ্র মিনার সমৃদ্ধ অভিক্ষিপ্ত চার অক্ষীয় ফ্রন্টনের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি করতে পারে। এই রীতিটি সম্ভবত পারস্যের প্রভাবে প্রভাবিত উত্তর ভারতের ফতেহপুর সিক্রি, আগ্রা ও দিল্লির মুগল রীতির চার অক্ষীয় ইওয়ান রীতির প্রবেশপথ থেকে গৃহীত। আর এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও ভূমি নকশার কারণে এটি ঢাকার আল্লাকুরী মসজিদের (আনু. ১৬৮০ খ্রি) সাথে তুলনীয়। তাই শৈলীগত দিক বিবেচনায় এগারোসিন্ধুরের শাহ মুহম্মদ মসজিদটিকে ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের সময়কার ধরা যেতে পারে। [এম.এ বারি]