লোকক্রীড়া
লোকক্রীড়া দেশীয়ভাবে উদ্ভূত এবং প্রধানত পলীর লোকদের নিজস্ব উদ্ভাবিত ক্রীড়া। শরীরচর্চা, চিত্তবিনোদন, অবসরযাপন ইত্যাদি কারণে লোকক্রীড়ার চর্চা বহু প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। কোনো কোনো ক্রীড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয়। তবে লোকক্রীড়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কেবল শরীরচর্চা, চিত্তবিনোদন ও অবসরযাপনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, অনেক খেলার মধ্যে জাদু, যৌনতা, ধর্ম, সংস্কার ইত্যাদিও যুক্ত আছে। বাংলার লোকক্রীড়াকে স্থল, জল ও অন্তরীক্ষ এই তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ভূমির ওপর সম্পন্ন যাবতীয় খেলা স্থলের খেলা; সাঁতার কাটা, নৌকা বাইচ ইত্যাদি জলের খেলা; আর ঘুড়ি ওড়ানো, কবুতর ওড়ানো ইত্যাদি অন্তরীক্ষের খেলা।
স্থলভাগের খেলা অ্যাঙ্গা-অ্যাঙ্গা ছেলেমেয়ে উভয়েরই দলবদ্ধ খেলা। এক্ষেত্রে প্রথমে একটি বড় বৃত্ত অাঁকা হয়। একজন খেলোয়াড় এই বৃত্তের বাইরে থাকে; সে হয় ‘বাঘ’, আর অন্যরা বৃত্তের ভেতরে অবস্থান গ্রহণ করে এবং তারা হয় ‘ছাগল’। বাঘ বৃত্তের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় আর ছড়া কেটে কেটে ভেতরে অবস্থানকারীদের ভোলানোর চেষ্টা করে। যশোরে প্রচলিত এরূপ একটি ছড়া হলো: ‘বাঘ (ক্রন্দনের সুরে)- অ্যাঙ্গা অ্যাঙ্গা। ছাগদল- (সমস্বরে) কাঁদ ক্যা? বাঘ গরু হারাইছে। ছাগদল- কি গরু? বাঘ- নাঙ্গা গরু। ছাগদল- শিঙ্গি কি? বাঘ কুষ্টার অাঁশ। ছাগদল- একটা গান গাওছিন।’ বাঘ তখন নাচের ভঙ্গিতে ঘুরে ঘুরে গান গায়: ‘এতি চোর বেতি চোর, এতি চোর বেতি চোর, চলে আয় আমার সিয়ানা চোর।’ গান শেষ করেই বাঘ লাফ দিয়ে বৃত্ত থেকে একটা ছাগল ধরে টানতে থাকে; অন্যরা বাধা দেয়। বাঘ তাকে ঘরের বাইরে নিতে পারলে সে বাঘের দলভুক্ত হয়। শেষপর্যন্ত যে ঘরে থাকে সে পরবর্তী খেলায় বাঘ হওয়ার সুযোগ পায়।
এ খেলায় অরণ্যজীবনের ছায়াপাত ঘটেছে, কারণ এক সময় পশুশিকারী অরণ্যচারী মানুষদের ব্যাঘ্রাদি হিংস্রপ্রাণীর সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হতো। এছাড়া বাঘ ও ছাগল টোটেমভুক্ত দুই মানবগোষ্ঠীর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ও পরাজিত গোত্রকে দাস-শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত করার প্রসঙ্গটিও এক্ষেত্রে থাকতে পারে।
এক্কাদোক্কা প্রধানত মেয়েদের খেলা এবং দেশের সব অঞ্চলেই প্রচলিত। অঞ্চলবিশেষে এটি ‘সাতখোলা’ ও ‘চিরিয়া’ নামেও পরিচিত। বাড়ির উঠান বা খোলা জায়গায় মাটির ওপর দাগ কেটে একটি আয়তাকার ঘর করা হয়। ঘরের ভেতরে আড়াআড়িভাবে সরল রেখা টেনে ছয়টি খোপ করা করা হয়। কোথাও কোথাও চার ও ছয় নম্বর ঘর খাড়া রেখা দ্বারা দুভাগ করা হয়। চার নম্বব ঘরটি হচ্ছে বিশ্রামঘর। নিচ থেকে ঘরগুলির নাম হচ্ছে যথাক্রমে এক্কা, দোক্কা, তেক্কা, চৌক্কা, পক্কা ও লাষ্ঠি। ভাঙা হাঁড়ি বা কলসির গোলাকার টুকরা হচ্ছে খেলার উপকরণ; এটি চাড়া, ঘুঁটি, ডিগা, খোপলা ইত্যাদি নামেও পরিচিত।
এ খেলাটি একাই খেলা যায়, তবে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে দুই বা ততোধিক অংশগ্রহণকারী প্রয়োজন। খেলার সময় এক এক করে প্রতিটি ঘরে চাড়া ছুঁড়ে এবং এক পায়ে লাফ দিয়ে দাগ পার হয়ে ওই চাড়া পায়ের আঙুলের টোকা দিয়ে বাইরে নিয়ে আসা হয়। চাড়া কোনো দাগের ওপর থেমে গেলে বা দুই পাশের রেখা অতিক্রম করে গেলে সে দান হারায়। তখন দ্বিতীয়জন দান পায়। যে সফলভাবে সব ঘর পার হয়ে আসতে পারে তারই জিত হয়।
অঞ্চলভেদে এ খেলার কিছু রীতিভেদ আছে। যেমন চাড়াটি কপালে রেখে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ঘরগুলি অতিক্রম করা, দাগে পা পড়লে দান হারানো, কোথাও শেষ ঘরটি পার হওয়ার সময় পেছন ফিরে না দেখে চাড়াটি ছুঁড়ে মারা ইত্যাদি।
কড়িখেলা চার-পাঁচজনের দলবদ্ধ বা একক খেলা। সমান আকারের ছোট চারটি কড়ি এর উপকরণ। প্রথমে একজন চাল শুরু করে। সে কড়িগুলি হাতের মুঠোয় নিয়ে এমনভাবে মাটির ওপর গড়িয়ে ফেলে যাতে সেগুলি পরস্পরের গা ছুঁয়ে বা বেশিদূরে ছড়িয়ে না পড়ে। পরে তর্জনীর টোকা দিয়ে জোড়ায় জোড়ায় কড়িগুলি মারতে হয়। সফল হলে সে দুই পয়েন্ট পায়, আর বিফল হলে দান হারায়। এছাড়া দুটি বা ততোধিক কড়ি পড়ে জোড়া লেগে গেলেও সে দান হারায়। তখন অন্যজন খেলার সুযোগ পায়। এভাবে পালাক্রমে কড়িখেলা অনুষ্ঠিত হয়।
কড়িখেলার কয়েকটি বিশেষ নিয়ম হলো এই যে, চালের সময় কড়িগুলি উপুড় হয়ে পড়লে ওই খেলোয়াড় এক পয়েন্ট পায়, আর যদি চিৎ হয়ে পড়ে তাহলে সকলে দ্রুত সেগুলি তুলে চুম্বন করার চেষ্টা করে। যে সফল হয় সে প্রতিটি কড়ির জন্য এক পয়েন্ট পায়। এভাবে খেলে যে প্রথম বিশ পয়েন্ট পায় সে জয়ী হয়, আর যে ব্যর্থ হয় তার হার হয়। এ পর্যন্ত হচ্ছে কড়ি খেলার প্রথম পর্ব; দ্বিতীয় পর্ব হচ্ছে ‘জোড়-বিজোড়’ ধরা। এক্ষেত্রে মুঠ করা হাতে জোড়, না বিজোড় সংখ্যার কড়ি আছে তা পরাজিত খেলোয়াড়কে জিজ্ঞেস করা হয়। বলতে পারলে কড়ি তার দখলে যায়, না পারলে জয়ী খেলোয়াড় পয়েন্ট পায়। এভাবে হাত খালি হওয়া পর্যন্ত সে যত পয়েন্ট পায়, পরাজিত খেলোয়াড়কে তত কিল মারার সুযোগ পায়। সাধারণত মেয়েরা কড়ি খেলে থাকে। এতে আনন্দ, কৌতুক ও অবসরযাপনের সুযোগ আছে।
কানামাছি বাংলার সব অঞ্চলেই প্রচলিত। উঠানের খোলা জায়গায় ছোট ছেলে-মেয়েরা আলাদাভাবে বা একত্রে এ খেলা খেলে থাকে। এ খেলায় প্রথমে কাপড় দিয়ে একজনের চোখ বাঁধা হয়; সে হয় ‘কানা’। অন্যরা ‘মাছি’র মতো চারদিক থেকে ঘিরে তার গায়ে মৃদু টোকা দেয়, আর মুখে ছড়া বলে: ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ।’ চোখবাঁধা অবস্থায় সে তাদের একজনকে ধরার চেষ্টা করে। এ সময় সেও ছড়া কাটে: ‘আন্ধা গোন্ধা ভাই, আমার দোষ নাই।’ সে যদি কাউকে ধরতে পারে তাহলে পরবর্তী খেলায় তাকে কানা সাজতে হয়। কানামাছি খেলার এটাই নিয়ম। খেলাটি সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং ছড়া আবৃত্তির সঙ্গে ক্রীড়াভিনয়ে এর প্রকৃত আনন্দ ও আকর্ষণ নিহিত।
কানামাছি খেলাটি ‘ব্লাইন্ড বি’ নামে ইউরোপেও প্রচলিত। দাস-প্রথায় অপরাধীর অন্যতম শাস্তি ছিল চক্ষু তুলে অঙ্গহানি করা; পরে তাকে শারীরিকভাবে উত্যক্ত করা হতো। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, কানামাছি খেলার উদ্ভবে অতীতের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার ছায়াপাত ঘটে থাকতে পারে। ল্যাংচা অনুরূপ আরেকটি খেলা যেখানে একজনকে এক পা গুটিয়ে অপর পায়ের সাহায্যে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলার সঙ্গীদের ধরতে হয়। পাশ্চাত্যে এটি ‘লেম্ম্যান’ নামে প্রচলিত। এ খেলায়ও পা কেটে অপরাধীকে শাস্তি প্রদানের অতীত প্রথার ছায়াপাত আছে।
গাইগোদানি সাধারণত রাখাল বালকেরা মাঠে গরু-ছাগল চরানোর অবসরে খেলে থাকে। নিজ নিজ পাচন এ খেলার উপকরণ; আর ভেজা এঁটেল মাটি হচ্ছে উপযুক্ত স্থান। চার-পাঁচজন বালক একত্রে এ খেলা খেলতে পারে। টসে যে হারে সে তার লাঠি মাটির ওপর ছুঁড়ে শক্ত করে পুঁতে দেয়। অন্য একজন নিজের লাঠি এমনভাবে পোঁতার চেষ্টা করে যাতে আগের লাঠি আঘাত খেয়ে মাটিতে পড়ে যায় বা দুটি লাঠি পরস্পর গা ছুঁয়ে দাঁড়ায়। এতে সফল হলে লাঠিখানা তার দখলে আসে, আর ব্যর্থ হলে প্রথম বালক অনুরূপভাবে খেলে দ্বিতীয়জনের লাঠিখানা আয়ত্তে আনার চেষ্টা করে। যে জয়ী হয় সে দুখানা লাঠি নিয়ে তৃতীয় বালকের সঙ্গে খেলে তারটি দখলে আনে। এভাবে সবখানা লাঠি একজনের আয়ত্তে এসে গেলে সে একে একে লাঠিগুলি দূরে ছুঁড়ে দেয়; শেষ লাঠি ছোঁড়ার সঙ্গে সঙ্গে বালকেরা নিজ নিজ লাঠির খোঁজে ছুটে যায়। এই ফাঁকে বিজয়ী বালক নিজের লাঠি সুবিধামতো জায়গায় লুকিয়ে রাখে। অন্য বালকেরা তা খুঁজে বের করে এবং নিজ লাঠিদ্বারা স্পর্শ করে। যে সবশেষে স্পর্শ করে সে লাঠিখানা বয়ে এনে মালিকের কাছে দেয় এবং তাকেই ‘গাই’ অর্থাৎ পরাজিত বালক হিসেবে নিজের লাঠি পুঁতে আগের মতো খেলা শুরু করতে হয়। এ খেলাটি ময়মনসিংহে ‘ফলাখাউট’ নামে পরিচিত। খেলাটিতে অপরের সম্পদ হরণ এবং তা আয়ত্তে রাখার প্রবণতা দেখা যায়। মুক্ত মাঠে দৌড়াদৌড়ির এ খেলায় ব্যায়ামের উপকারিতাও পাওয়া যায়।
গুলিখেলা সম্ভবত সবদেশেই প্রচলিত। এটি মার্বেল খেলা নামেও পরিচিত। ব্রিটিশ আমলে এদেশে কাঁচের গুলি বা মার্বেলের আমদানি হয়। তার আগে মাটির গুলি আগুনে পুড়িয়ে তার সাহায্যে খেলা হতো। গ্রামাঞ্চলে এখনও মাটির গুলির প্রচলন আছে।
খোলা উঠান বা মাঠে ছোট একটা গর্ত করে সাত-আট হাত দূরে দাগ কেটে সীমানা নির্ধারণ করা হয়। পরে দুই বা ততোধিক বালক মিলে গুলি খেলে। যে দান পায় সে সকলের গুলি নিয়ে দাগ থেকে ছুঁড়ে গর্তে ফেলার চেষ্টা করে। যেগুলি গর্তে পড়ে সে সরাসরি সেগুলির দখল পায়; আর যেগুলি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে সেগুলির যেকোনো একটি
প্রতিপক্ষের নির্দেশমতো নিজের অপর একটি গুলি দিয়ে আঘাত করে। সফল হলে সে গুলিটিও তার দখলে আসে। আর মারার সময় যদি নিজের গুলিটি অন্য কোনো গুলিকে স্পর্শ করে তাহলে শাস্তিস্বরূপ তাকে একটি গুলি দিয়ে দিতে হয়। দ্বিতীয়জন অবশিষ্ট গুলি নিয়ে একই পদ্ধতিতে খেলতে থাকে। গুলি ছোঁড়ায় ও আঘাত করায় যে যত দক্ষ, এ খেলায় সে তত ভালো করে।
গোলাপ-টগর অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের একটি দলবদ্ধ খেলা। সমান সংখ্যক সদস্য নিয়ে দুই দলের মধ্যে এ খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। দলের প্রধানদ্বয়কে বলা হয় রাজা। পনেরো-বিশ হাত দূরত্বে দলদুটি মুখোমুখী অবস্থান করে। খেলার শুরুতে এক দলের রাজা ফুল-ফলের নামে নিজদলের সব সদস্যের প্রতীকী নাম রাখে। পরে সে বিপক্ষ দলের যেকোনো একজনের চোখ হাত দিয়ে বন্ধ করে ‘আয় রে আমার গোলাপ ফুল’, ‘আয় রে আমার টগর ফুল’ ইত্যাদি নামে ডাকে। সে তখন অতি সন্তর্পণে এসে বালকটির কপালে মৃদু টোকা দিয়ে নিজ অবস্থানে ফিরে যায়।
পরে চোখ খুলে দিলে উক্ত খেলোয়াড়, যে টোকা দিয়েছে তাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে। সফল হলে সে সামনের দিকে লাফ দিয়ে এগিয়ে যায়, না পারলে যে টোকা দিয়েছে সে-ই এগিয়ে যায়। এবার বিপক্ষের রাজা একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। এভাবে লাফ দিয়ে মধ্যবর্তী সীমানা অতিক্রম করে প্রতিপক্ষের জমি দখল না করা পর্যন্ত খেলা চলতে থাকে। যে দল সফল হয় সেই দলের রাজাকে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা হাতের দোলায় পদ্মাসনে করে সীমানা পারাপার করে। কোথাও নিয়ম আছে, বিজয়ী দলের রাজা ব্যতীত অন্য সবাই বিপক্ষের নিজ নিজ জুটির পিঠে চড়ে সীমানা পারাপারের সুযোগ পায়। এ খেলায় যুদ্ধ, ভূমিদখল ও বন্দিকে দাসরূপে ব্যবহার করার মধ্যে প্রাচীনকালের গোষ্ঠীচেতনার ছায়াপাত ঘটেছে। অঞ্চলভেদে এটি ‘বউরানী’, ‘চড়নখেলা’ (মুর্শিদাবাদ), ‘টুকাটুকি’ (ময়মনসিংহ) ইত্যাদি নামে অভিহিত।
গোল্লাছুট সাধারণত খোলা মাঠ বা বাগানে খেলা হয়। প্রথমে একটি ছোট গর্ত করে সেখানে একটি কাঠি পুতে রাখা হয়। একে বলে গোল্লা এবং এটি হচ্ছে কেন্দ্রীয় সীমানা। পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরের কোনো গাছ বা ইট-পাথরকে বাইরের সীমানারূপে চিহ্নিত করা হয়। গোল্লা থেকে ছুটে গিয়ে বাইরের সীমানার গাছ-পাথরকে স্পর্শ করাই এ খেলার মূল লক্ষ্য। আর এ থেকেই খেলার নাম হয়েছে গোল্লাছুট । পাঁচ-সাতজনের দুই দলের সমান সংখ্যক খেলোয়াড় নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়।
গোল্লাছুট খেলায় একজন প্রধান থাকে, তাকে বলা হয় ‘গোদা’। সে গোল্ল ছুঁয়ে দাঁড়ায়, অন্যরা তার ও নিজেদের হাত পরস্পর ধরে ঘুরতে থাকে। বিপক্ষ খেলোয়াড়রা সুবিধামতো স্থানে দাঁড়িয়ে ওঁৎ পেতে থাকে। ঘুরতে ঘুরতে কারো হাত ছুটে গেলে সে দৌড়ে গিয়ে গাছ ছোঁয়ার চেষ্টা করে। ছোঁয়ার আগে বিপক্ষের কেউ তাকে ছুঁয়ে দিলে সে ‘মারা’ যায়, অর্থাৎ এবারের খেলা থেকে সে বাদ পড়ে। গোল্লা ছেড়ে শেষ পর্যায়ে গোদাকেও দৌড়াতে হয়। যে কয়জন সফল হয় তারা গর্ত থেকে জোড় পায়ে সীমানার দিকে লাফ দিয়ে এগিয়ে যায়। সব লাফ মিলিয়ে সীমানা ছুঁতে পারলে এক ‘পাটি’ হয়। এভাবে পর্যায়ক্রমে দুই পক্ষের খেলা চলতে থাকে। খেলাটি এক সময় ঢাকা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, বরিশাল ও খুলনা জেলায় বহুলভাবে প্রচলিত ছিল।
ঘুঁটিখেলা সাধারণত মেয়েদের খেলা। পাথরের পাঁচটি গোল টুকরা নিয়ে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এগুলির মধ্যে ঈষৎ বড় ঘুঁটিকে ‘ডাগ’ বলে। কড়ি খেলার মতো শুরুতে ঘুঁটিগুলি মাটির ওপর ছড়িয়ে ফেলতে হয়। জোড়া লাগলে দান হারাতে হয়। ঠিকমতো পড়লে ডাগ তুলে ওপরে ছুঁড়ে মাটিতে পড়ার আগে দ্রুত এক বা ততোধিক ঘুঁটি কুড়িয়ে সেটি লুফে নিতে হয়। ডাগ মাটিতে পড়ে গেলে সে দান হারায়। এরূপ লোফালুফির নানা জটিল প্রক্রিয়ায় এটি খেলতে হয়। প্রক্রিয়াগুলি যে আগে শেষ করে সে ‘পাকে’ অর্থাৎ জয়ী হয়। শেষ পর্যন্ত যার হার হয় তাকে জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে কিল খেতে হয়। মনোযোগ ও হাতের ক্ষিপ্রতার ওপর এ খেলার জয়-পরাজয় নির্ভর করে। বর্ষা-বাদলের দিনে ঘুঁটিখেলা মেয়েদের অবসরযাপন ও বিনোদনের সুযোগ এনে দেয়।
চিক্কা হচ্ছে শক্তির খেলা, তাই সাধারণত তরুণরা এ খেলায় অংশ নেয়। পাঁচ-সাতজনের দুই দলের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক এ খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। খোলা জায়গায় মাটির ওপর লম্বা দাগ কেটে তার ওপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে এক দল অবস্থান নেয়; অপর দল সামনের খোলা জায়গায় মুখোমুখী দাঁড়ায়। প্রথম দলের খেলোয়াড় হাত বাড়িয়ে দ্বিতীয় দলের খেলোয়াড়দের চ্যালেঞ্জ দেয়; একে ‘হেতেল’ দেওয়া বলে। তাকে টেনে বা ঠেলে দাগ থেকে সরাতে পারলে সে ‘মারা’ যায়। এভাবে একে একে সবাইকে দাগ থেকে সরাতে পারলে তারা পয়েন্ট ও খেলার দান পায়। অপরপক্ষে যারা দাগের ওপর থাকে তারা নিজেদের জায়গায় অটল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বীর পায়ে পা লাগিয়ে ছুঁতে চেষ্টা করে; একে বলে ‘ল্যাং মারা’। সফল হলে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড় মারা যায়। এভাবে বাইরের সবাইকে ল্যাং মারতে পারলে তারা ‘চিকা’ বা পয়েন্ট পায় এবং দানও বহাল থাকে। এ পদ্ধতিতে খেলার পুনরাবর্তন হয়। নিঃসন্দেহে এটি একটি শক্তির খেলা এবং এতে আহত হওয়ারও ঝুঁকি থাকে। এটি একটি ছদ্ম দ্বন্দ্বযুদ্ধ এবং এতে বলপ্রয়োগ দ্বারা ভূমিদখলের প্রতিচ্ছায়া আছে।
চুঙ্গাখেলা হচ্ছে আতসবাজির খেলা। চট্টগ্রামে এর প্রচলন আছে। শবে বরাতের রাতে মাঠে-ময়দানে চুঙ্গা খেলা হয়। দিন কতক আগে থেকেই এর প্রস্ত্ততি চলে। এতে দুই দল পরস্পরের দিকে নানা ধরনের বাজি ছুঁড়ে মেরে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। বাজিগুলির কোনোটি উঁচু হয়ে যায়, কোনোটি মাটি বরাবর সোজা যায়, আবার কোনোটি এঁকেবেঁকে যায়। এসব শরীরে লেগে জ্বালা-পোড়ার সম্ভাবনাও থাকে। এজন্য সাধারণত অপেক্ষাকৃত বয়স্করা এ খেলায় অংশ নিয়ে থাকে। বাজি ফোটার শব্দ, আলোর ঝলকানি. খেলোয়াড়দের হৈ-হুল্লোড়, দর্শকদের গুঞ্জরণ ইত্যাদি মিলে গভীর রাত পর্যন্ত মাঠ থাকে ধ্বনিমুখর ও আলোকোজ্জ্বল। গোলা-বারুদ নিয়ে কামান-বন্দুকের যুদ্ধের মতো এটিও একটি ছদ্ম যুদ্ধবিশেষ। একদল কর্তৃক অপর দলকে মাঠ থেকে হটিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। ব্যয়সাপেক্ষ এ খেলাটি বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়।
ছড়ার খেলা আবৃত্তি-প্রধান, সেসঙ্গে সামান্য ক্রিয়াও যুক্ত থাকে। ছড়ার খেলা অনেক রকম। তার মধ্যে ইকড়ি মিকড়ি একটি প্রধান খেলা। এ খেলায় কতক ছেলেমেয়ে গোল হয়ে মাটিতে দুহাত পেতে বসে; তাদের মধ্যে একজন হয় প্রধান। সে এক হাত পেতে অপর হাত দিয়ে ‘ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি/ চামের বেটা লক্ষীন্দর/ সেজে এল দামোদর/...’ এ ছড়াটি আবৃত্তি করে এবং প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করার সময় একেকটি হাত স্পর্শ করে। ছড়ার শেষ শব্দটি শোনার জন্য সবাই আগ্রহভরে অপেক্ষা করে, কারণ ওই শব্দে যার হাত স্পর্শ করা হবে সে ওই হাত তুলে মুঠ করে বা কোলের কাছে রাখবে। শেষ হাত তোলা পর্যন্ত ছড়াটি পুনঃপুন আবৃত্তি করা হয়। এটি ‘হাত তোলা খেলা’ নামেও পরিচিত।
এলাটিং বেলাটিং খেলায় মেয়েরা দুদলে বিভক্ত হয়ে মাটিতে অঙ্কিত একটি রেখার দুদিকে মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। শুরুতে একদল দাগের দিকে দুকদম এগিয়ে ছড়ার প্রথম চরণ ‘এলাটিং বেলাটিং’ বলে আবার পেছনে সরে আগের জায়গায় দাঁড়ায়। দ্বিতীয় দল অনুরূপভাবে এগিয়ে এসে ‘কি খবর আইল’ বলে পাল্টা চরণ বলে। এভাবে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে খেলাটি চলতে থাকে। শেষ চরণটি (নিয়ে যাও বালিকাকে) শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় পক্ষের একটি বালিকাকে ধরে টানাটানি শুরু করে। তাকে ধরে রাখতে বা টেনে নিতে পারলে প্রথমবার খেলা শেষ হয়। এ খেলায় অতীতে দাসরূপে নারীবিক্রি বা নারী অপহরণের চিত্র দেখা যায়।
ওপেনটি বায়স্কোপ সাধারণত মেয়েরা খেলে। দুটি মেয়ে সামান্য দূরত্বে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পরস্পরের হাত উঁচু করে ধরে; অন্যরা সারি বেঁধে ওই হাতের নিচ দিয়ে চক্রাকারে ঘোরে আর সবাই মিলে ‘ওপেনটি বায়স্কোপ’ ছড়াটি আবৃত্তি করে। ছড়ার শেষ পঙ্ক্তির (আমার নাম জাদুমণি/ যেতে হবে অনেকখানি) শেষ শব্দটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে ওই দুটি মেয়ে নিকটতম কোনো মেয়েকে ধরে ফেললে সবাই মিলে তাকে ওপরে তুলে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে। এভাবেই এ খেলা শেষ হয়।
ছি-ছত্তর শিশুদের অভিনয়ধর্মী খেলা। দশ-পনেরোজন ছেলেমেয়ে পরস্পরের হাত ধরে বৃত্তাকারে দাঁড়ায় এবং একজন থাকে বৃত্তের মাঝখানে। রংপুর এলাকায় তাকে বলা হয় ‘চিল’ এবং অন্যদের ‘মোরগ’। চিল ভেতরে থেকে হাতের শেকল ভেঙ্গে পালাবার চেষ্টা করে। প্রথমে সে বলপ্রয়োগ করে এবং বীরত্বের ভাব দেখিয়ে ছড়া বলে। ‘ছি ছাই ঘোড়া দাবাই/ ঘোড়া না ঘুড়ি, চাবুক ছুড়ি/ চাবুক দিয়া মারলাম বাড়ি/ ধূলা উঠে কারি কারি’ এরূপ ছড়া বলতে বলতে সুযোগমতো সে দৌড় দেয়। তখন মোরগরা তাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। তারাও মন ভুলানো ছড়া বলে: ‘ছি ছত্তর কচুর বই/ চ্যাংড়া প্যাংড়ার নানা হই/ টাকের উপর আয়না/ পুঁটি মাছ খায় না/ টাকের উপর গোস্ত/ ছোঁয়া দিলে দোস্ত।’ যে প্রথমে তাকে ছুঁতে পারে সে-ই পরবর্তী খেলায় চিলের ভূমিকা পালন করে। চিল-মোরগের নাম-ভূমিকার এই খেলাটিতে বন্দির পলায়ন ও তাকে ধড়-পাকড়ের অভিনয় আছে। খেলাটি প্রকারভেদে হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে মেচ্দের মধ্যে ‘চিল্লা-দাওমা’ নামে প্রচলিত। ‘চিল্লা’ অর্থ চিল, ‘দাওমা’ অর্থ মোরগ-ছানা। নৃতাত্ত্বিকগণ মনে করেন, চিল ও মোরগ নামের দুই টোটেম গোত্রের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বন্দি তথা দাস সংগ্রহের প্রথা থেকে এ খেলাটির উদ্ভব ঘটেছে।
দে পাখাল রাখাল বালকদের মধ্যে প্রশ্নোত্তরবাচক একটি ছড়ার খেলা। একটি বালকের কোমর ধরে প্রশ্ন করা হয় এবং সে প্রতিবার মাথা উঁচু করে তার জবাব দেয়। যশোর থেকে সংগৃহীত এরূপ একটি ছড়া হলো: ‘টেকে রে/ কি রে। কনে গিইলি?/ শ্বশুর বাড়ি। কি দেখে এলি?/ শোলির পোনা। ধরলি নে কেন?/ ছাবাল কোলে। তোর ছাবালের নাম কি?/ আপাং দুলাল। তোর নাম কি?/ বুড়ো গোপাল। দে পাখাল\’ শেষ বাক্য বলার সঙ্গে সঙ্গে অপর বালকেরা তাকে ধরে ঘূর্ণির মতো ঘোরায়। এ থেকে এর অপর নাম হয়েছে ‘ঘূর্ণি খেলা’। নিছক অবসরযাপনই এসব খেলার উদ্দেশ্য।
ডাংগুলি বাংলার সর্বাঞ্চলীয় একটি জনপ্রিয় খেলা। প্রধানত কম বয়সের ছেলেরা এটি খেলে থাকে; মেয়েরা ডাংগুলি খেলে না। দুই থেকে পাঁচ-ছয়জন করে দুই দলে বিভক্ত হয়ে এটি খেলতে পারে। দেড় হাত লম্বা একটি লাঠি এবং এক বিঘত পরিমাণ একটি শক্ত কাঠি খেলার উপকরণ। প্রথমটিকে ‘ডান্ডা’ ও দ্বিতীয়টিকে ‘গুলি’ বা ‘ফুত্তি’ বলা হয়। প্রথমে খোলা মাঠে একটি ছোট গর্ত করা হয়। যারা দান পায় তাদের একজন গর্তের ওপর গুলি রেখে ডান্ডা মেরে সেটিকে দূরে ফেলার চেষ্টা করে। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা চারদিকে দাঁড়িয়ে থেকে সেটিকে লুফে নিতে চায়। তারা সফল হলে ওই খেলোয়াড় আউট হয়, আর ধরতে না পারলে গর্তের ওপর রাখা ডান্ডা লক্ষ করে ছুঁড়ে মারতে হয়। ছোঁয়া গেলে সে দান হারায়, আর তা না হলে সে ডান্ডা দিয়ে তুলে গুলিকে আবার দূরে পাঠায়। পরে গুলি থেকে গর্ত পর্যন্ত ডান্ডা দিয়ে মাপতে থাকে। সাত পর্যন্ত মাপের আঞ্চলিক নাম হলো: বাড়ি, দুড়ি, তেড়ি, চাঘল, চাম্পা, ঝেঁক, মেক।
এরূপ সাত মাপে এক ‘ফুল’ বা ‘গুট’ এবং সাত ফুলে এক ‘লাল’ হয়। ভাঙা ফুলের ক্ষেত্রে যেখানে শেষ হয়, পরের খেলা সেখান থেকে শুরু হয়। বাড়ি, দুড়ি ইত্যাদি প্রতিটি মারের পৃথক পৃথক পদ্ধতি আছে। আউট না হওয়া পর্যন্ত একজন খেলোয়াড় খেলতে পারে; আউট হলে দলের দ্বিতীয় একজন একই পদ্ধতিতে খেলবে। এভাবে সবাই আউট হয়ে গেলে বিপক্ষ দল দান পেয়ে খেলা শুরু করে। বস্ত্তত এ খেলাটি বর্তমান যুগের ক্রিকেটের গ্রাম্য সংস্করণ এবং ব্যাট ও বল ডান্ডা ও গুলির সমতুল্য। এ ক্ষেত্রেও ক্যাচ ধরে বা ডান্ডায় আঘাত করে আউট করার বিধান আছে। খেলাটি অঞ্চলভেদে ‘ডাংবাড়ি’, ‘গুটবাড়ি’, ‘ট্যামডাং’, ‘ভ্যাটাডান্ডা’ ইত্যাদি নামে পরিচিত।
দাড়িয়াবান্দা গ্রামবাংলার একটি জনপ্রিয় খেলা। খোলা জায়গায় দাগ কেটে ঘর তৈরি করে এ খেলাটি খেলা হয়। এটি দুই পক্ষের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক একটি খেলা। প্রতি দলে পাঁচ-সাতজন বা তার কমবেশি খেলোয়াড় থাকতে পারে। খেলোয়াড়ের সংখ্যা অনুযায়ী ছকের ঘরের সংখ্যা কমবেশি হয়। ঘরগুলির মধ্যে একটি ‘গাদিঘর’ ও একটি ‘লবণঘর’ থাকে। খেলার শুরুতে গাদিঘরে একদলের এবং প্রতি ঘরের সঙ্গে অঙ্কিত আলম্বরেখায় ও মাঝ বরাবর অঙ্কিত উলম্বরেখায় অপর দলের সদস্যরা পৃথক পৃথকভাবে অবস্থান নেয়। গাদিঘর থেকে বের হয়ে প্রতিটি খেলোয়াড় বিপক্ষ খেলোয়াড়ের ছোঁয়া বাঁচিয়ে ঘরগুলি ঘুরে গাদিঘরে ফিরে আসতে চেষ্টা করে। যেকোনো একজন সফল হলে দলের জিত ও পয়েন্ট হয়। অপরপক্ষে কোনো একজন ছোঁয়া পড়লে ওই দল পয়েন্ট ছাড়াই ‘দান’ হারায়।
বিপক্ষের দল একইভাবে খেলাটি পুনরায় শুরু করে। এভাবে খেলা অনেকক্ষণ ধরে চলে এবং শেষে পয়েন্টের ভিত্তিতে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। বিজয়ী দল প্রতি পয়েন্টে একটি করে ঘরের দখল পায়। সবকটি ঘর জিতে গেলে এক ‘পাটি’ হয়।
গাদিঘরের পাশের লবণঘরটি আকারে একটু ছোট হয়; প্রতিপক্ষ খুব সতর্কতার সঙ্গে এটি রক্ষা করার চেষ্টা করে। এ ঘরের গুরুত্ব থেকে কোনো কোনো অঞ্চলে খেলাটি ‘নুনদাঁড়ি’ নামেও পরিচিত। গাদিঘরের গুরুত্ব থেকে মুর্শিদাবাদে এটি ‘গাদিখেলা’ নামে পরিচিত। এ খেলায় অন্যকে পরাজিত করে ভূমিদখলের চেষ্টার মধ্যে সামন্ত যুগের চেতনা প্রতিফলিত বলে মনে করা হয়। সামন্ত প্রভুরা অপরের ভূমি জোরপূর্বক দখল করে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করতেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, লবণ চুরি করা ও চোর ধরার সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকেও খেলাটি উদ্ভূত হয়ে থাকবে, কারণ চোর নুনঘর থেকে নুন চুরি করে গাদিঘরে জমা করে রাখে, আর পাহারাদার তা রোধ করার চেষ্টা করে।
ধাঁধা একটি বুদ্ধিবৃত্তিক খেলা। এ খেলায় দলের মধ্যে যে বয়স্ক সে অন্যদের বিভিন্ন রকমের ধাঁধা জিজ্ঞেস করে এবং তারা সেগুলির উত্তর দেয়। কেউ না পারলে উত্তরটি সে নিজেই বলে দেয়। এতে ছেলে-মেয়েদের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও বিনোদন উভয়ই হয়ে থাকে।
নুনতা একটি দলবদ্ধ খেলা। মাটির ওপর বৃত্ত এঁকে খেলার ঘর তৈরি করা হয় এবং একজন তার মালিক হয়। খেলার শুরুতে সে থাকে ঘরের বাইরে এবং অন্যরা থাকে ভেতরে। বৃত্তের বাইরে ঘুরতে ঘুরতে মালিক ‘নুনতা’ গায়। প্রথমবার নুনতা বললে অন্যরা সমস্বরে বলে ‘এক’; এভাবে সাতবার বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সবাই বাইরে ছুটে পালায়; মালিক ফাঁকা পেয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে এবং শ্বাস বন্ধ করে শ্রুতিগ্রাহ্য কোনো ধ্বনি বা ছড়া বলে তাদের ধরার চেষ্টা করে। যে প্রথমে ধরা পড়ে, মালিক তাকে টেনে ঘরে এনে নিজের দলভুক্ত করে। সে তখন নুনতা গেয়ে মালিককে সাহায্য করে। এভাবে একে একে সবাইকে সে দলভুক্ত করে; ছোঁয়া বাঁচিয়ে সবশেষে যে বাইরে থাকে, পরের বার সে-ই ঘরের মালিক হয়। এভাবে চক্রাবর্তনে খেলাটি চলতে থাকে।
নুনতা আঞ্চলিক খেলা; যশোর-খুলনায় এটি ‘কুতকুতে খেলা’ নামে পরিচিত। সেখানে নুনতার স্থলে ‘কুতরে’ বলে ডাক দেওয়া হয়, অন্যরা একরে, দুইরে ... বলে উত্তর দেয়। এ খেলায় বিপদের কোনো ঝুঁকি নেই; তাই অল্প বয়সের মেয়েরাও এটি খেলতে পারে। নুনতা খেলায় ‘লবণ’ নামক টোটেম গোত্রের এবং দাস-শ্রমের ছায়াপাত আছে বলে নৃতাত্ত্বিকরা মনে করেন।
পশুপাখির খেলা গ্রামবাংলায় পশু-পাখি নিয়ে নানারকম খেলা দেখানো হয়; বানরের খেলা সেসবের একটি। এক শ্রেণির বাজিকর গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে এ খেলা দেখায়। এ উদ্দেশ্যে বানরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বানর বাজিকরের নির্দেশমতো নাচানাচি ও ডিগবাজি করে খেলা দেখায়; এমনকি নানারূপ অভিনয়ও করে থাকে।
ভালুকের খেলা কিছুকাল আগে পর্যন্তও প্রচলিত ছিল। বর্তমানে তা বিশেষ একটা দেখা যায় না। ভালুককে প্রশিক্ষণ দিয়ে এ খেলা দেখানো হয়। খেলার এক পর্যায়ে মালিক নিজেই ভালুকের সঙ্গে লড়াই করে। অনেক সময় ভালুকের নখরের আঘাতে তার দেহ ক্ষত-বিক্ষত হয়। ভালুকের মুখ বাঁধা থাকে বলে সে কামড়াতে পারে না। অর্থের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা এরূপ খেলা দেখায়।
মোরগের লড়াই এক সময় খুবই জনপ্রিয় একটি খেলা ছিল। বিশেষ যত্নসহকারে লড়াইয়ের মোরগ পোষা হতো। অনেক সময় এ লড়াই হতো মর্মান্তিক, কারণ মোরগদুটি ঠোঁট ও নখের অাঁচড়ে পরস্পরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করতো। বিজয়ী মোরগের মালিককে পুরস্কৃতও করা হতো।
ষাঁড়ের লড়াই এক সময় একটি জনপ্রিয় ও মর্যাদাপূর্ণ খেলা ছিল। এখনও নেত্রকোনায় প্রতিবছর ষাঁড়ের লড়াই হয়। গৃহস্থরা লড়াইয়ের ষাঁড় যত্ন করে পালন করে। নির্ধারিত দিনে প্রতিযোগীরা নিজ নিজ ষাঁড় নিয়ে ময়দানে উপস্থিত হয় এবং কুস্তি খেলার মতো একে একে ষাঁড়ের লড়াই হয়। যে ষাঁড় জয়ী হয় তার মালিককে পুরস্কৃত করা হয়।
সাপের খেলা দেখিয়ে এখনও অনেক সাপুড়ে জীবিকা নির্বাহ করে। এ খেলাটি গ্রামাঞ্চলেই বেশি দেখা যায়। সাপুড়ের ঝুড়িতে নানা প্রকার সাপ থাকে। তারা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে তুবড়ি বাজিয়ে সাপের খেলা দেখায়। দর্শকরা খুশি হয়ে তাদের টাকা-পয়সা দান করে।
এছাড়া সার্কাস দলে হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ ইত্যাদি পশুরও খেলা দেখানো হয়। এতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী-পুরুষরাও অনেক উন্নতমানের ক্রীড়াকৌশল প্রদর্শন করে। সার্কাসকে বর্তমানে সরাসরি লোকক্রীড়ার অন্তর্ভুক্ত করা না গেলেও লোকক্রীড়ার অনেককিছু এতে সাঙ্গীকৃত হয়েছে, যেমন সঙ, তারের ওপর বাজিখেলা ইত্যাদি।
পুতুলখেলা একচেটিয়া মেয়েদের খেলা। কোমলমতি বালিকারা পুতুল নিয়ে খেলে থাকে। কাঠের বা কাপড়ের নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে, বর-কনে নানা ধরনের পুতুলকে কাপড় ও গয়না দিয়ে সাজানো হয়। সাধারণত রান্না-বান্না, সন্তান লালন-পালন, মেয়ে পুতুলের সঙ্গে ছেলে পুতুলের বিয়ে, মেয়ে বিদায় ইত্যাদি সংসারজীবনের নানা বিষয়ের অভিনয় করে পুতুলখেলা হয়। কাজী নজরুল ইসলামের পুতুলের বিয়ে নামক একটি নাটিকায় এরূপ পুতুলখেলার বিস্তৃত বর্ণনা আছে।
পুতুলখেলায় সংসারজীবনের এই অভিনয়ের মধ্য দিয়ে মেয়েরা নিজেদের অজ্ঞাতেই অনাগত জীবনের অভ্যাস করে থাকে। এটি মেয়েদের খুব প্রিয় খেলা এবং বাংলার সব অঞ্চলেই প্রচলিত।
বলীখেলা প্রকৃতপক্ষে কুস্তির লড়াই। দুজন কুস্তিগির খালি হাতে গায়ের শক্তি ও হাত-পায়ের কৌশলে লড়াই করে; লক্ষ্য, প্রতিপক্ষকে মাটিতে চিৎ করে ফেলে দেওয়া।
কুস্তির লড়াই মল্লযুদ্ধ নামে বর্বরযুগের দাস-প্রথা থেকে উদ্ভূত। এ সূত্রে এটি কমবেশি বিশ্বের সব দেশেই প্রচলিত। কিছুকাল পূর্বেও জমিদাররা নিরাপত্তার জন্য পেশাদার পালোয়ান ও লাঠিয়াল বাহিনী রাখত।
বলীখেলা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী একটি আঞ্চলিক খেলা। এটি এক সময় চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বর্তমানে অনেকটা সঙ্কুচিত হয়ে ‘জববারের বলীখেলা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে অনুরূপ খেলা ‘লড়না’ নামে প্রচলিত। চৈত্র মাসে শুকনা মৌসুমে মাঠে বা আমবাগানে নির্ধারিত স্থানে লড়না অনুষ্ঠিত হয়। ছোট থেকে বড় বিভিন্ন বয়সের জুটির মধ্যে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়।
বাঘবন্দী এক ধরণের যুদ্ধের খেলা। এতে দাবা খেলার মতো আত্মরক্ষা ও আক্রমণের প্রতি লক্ষ্য রেখে গুটির চাল দিতে হয়। মাটির ওপর দাগ কেটে বাঘবন্দীর ছক তৈরি করা হয়। আয়তাকার একটি ছকের অভ্যন্তরে আলম্ব ও উল্লম্বভাবে ষোলোটি সমান সংখ্যক ঘর করা হয়। ছকের দাগগুলি হয় সব সরল রেখা। এই ছকের চারটি মূল কেন্দ্রে পাঁচটি করে মোট বিশটি গুটি বসানো হয়। এগুলিকে বলা হয় ‘বকরি’। ‘বাঘ’ নামে অপেক্ষাকৃত বড় দুটি গুটি অন্য যেকোনো স্থানে বসানো হয়। পরে দুপক্ষের একজন বাঘ, অপরজন বকরি গুটির চাল দেয়। বকরির চেষ্টা হলো বাঘের গতি রোধ করা, আর বাঘের চেষ্টা হলো চালের সুযোগ নিয়ে একটি একটি করে বকরি শিকার করা। সরলরেখা বরাবর লাফ দিয়ে ফাঁকা ঘরে পৌঁছাতে পারলে একটি বকরি মারা পড়ে। ফাঁকা ঘর না পেলে বাঘ লাফ দিতে পারে না অর্থাৎ তার চাল বন্ধ হয়ে যায়। বাঘের চাল বন্ধ হলে বকরির জয়, আর সব বকরি শিকার করলে বাঘের জয় হয়। তাই ভেবেচিন্তে খুব সতর্কতার সঙ্গে গুটির চাল দিতে হয়, নতুবা পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। বাঘবন্দী খেলায় বাঘ ও ছাগল নামের কোনো টোটেম জনজাতির জীবন-মরণ লড়াইয়ের প্রভাব থাকতে পারে।
বৌছি খেলায় দুটি ঘরের দরকার হয়; একটি ঘর চৌকা, অন্যটি বৃত্তাকার। মাটির ওপর দাগ কেটে বিশ-পঁচিশ হাত দূরত্বে ঘর দুটি করা হয়। দুটি দলের প্রতিটিতে আট-দশজন করে সদস্য থাকে। টসে জিতে একটি দলের একজন ‘বুড়ি’ সেজে বৃত্তাকার ঘরে অবস্থান নেয় এবং অন্যরা থাকে চৌকা ঘরে। বিপক্ষের সমসংখ্যক খেলোয়াড়রা তখন দুই ঘরের বাইরে সুবিধামতো স্থানে দাঁড়িয়ে বুড়িকে পাহারা দেয়।
যারা ঘর পায় তাদের একজন খেলোয়াড় দম নিয়ে বিপক্ষের খেলোয়াড়দের তাড়া করে; লক্ষ্য হলো বুড়িকে তাদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে নিজেদের ঘরে আনা, বা কাউকে ছুঁয়ে নিজেই ঘরে ফেরা। কাউকে ছুঁতে সফল হলে ওই খেলোয়াড় মারা পড়ে এবং সাময়িকভাবে খেলার সুযোগ হারায়। বুড়ি দৌড় দিয়ে নিরাপদে ঘরে পৌঁছতে পারলে তাদের এক পয়েন্ট হয়, আর বুড়ি ছোঁয়া গেলে তার দল ঘর হারায় এবং প্রতিপক্ষ দান পায়। এভাবেই বৌছি খেলা চলতে থাকে। খেলার সময় সঙ্গীদের সাহস জোগানোর উদ্দেশ্যে ছড়া কেটে বোল দেওয়া হয়। অঞ্চলভেদে এটি ‘বুড়িকপাটি’, ‘বৌ-বসান্তি’, ‘বুড়ির চু’ ইত্যাদি নামে পরিচিত।
বৌছি বাংলাদেশের সর্বাঞ্চলীয় খেলা। কিশোর-কিশোরীরা এ খেলা খেলে থাকে। প্রতিপক্ষের অবরোধ ভেদ করে বুড়িকে ঘরে আনার মধ্যে প্রাচীন কালের বিয়ের কনেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে ঘরে আনার প্রতিচ্ছবি থাকতে পারে।
মোগলপাঠান এর অপর নাম ‘ষোলোঘুঁটি’; ষোলোটি করে ঘুঁটি (গুটি) নিয়ে দুজনের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলকভাবে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়। বাঘবন্দি খেলার ছকের দুই প্রান্তে অতিরিক্ত দুটি ত্রিভুজ আকৃতির কাঠামো থাকে। খেলোয়াড়দ্বয় নিজ নিজ সীমানায় এক এক করে ঘুঁটি সাজায়। পরে একজন একটি ঘুঁটি সুবিধামতো সামনের ঘরে ঠেলে দিয়ে খেলা শুরু করে। লক্ষ্য হলো প্রতিপক্ষের ঘুঁটি মারা। কেবল লাফ দিয়ে চালের সুযোগ পেলে ঘুঁটি মারা পড়ে। ঘুঁটি মেরে একপক্ষের ঘর শূন্য করতে পারলে বা তার চাল রোধ করতে পারলে খেলার জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়।
দাবার মতো এটিও বুদ্ধির খেলা; এতে ছদ্ম যুদ্ধের কৌশল প্রচ্ছন্ন আছে। একে দাবা খেলার গ্রাম্য সংস্করণও বলা যায়। দাবায় হাতি, ঘোড়া, নৌকা ইত্যাদি নামের ষোলোটি ঘুঁটি থাকে। খেলাটির মোগল-পাঠান নাম প্রমাণ করে যে, এতে ষোলো শতকে এদেশের ওই দুই বিরোধী শক্তির যুদ্ধের ছায়াপাত ঘটেছে।
রাজার কোটাল খেলাটি অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা দলবদ্ধভাবে খেলে থাকে। দলের মধ্যে একজন হয় মোড়ল এবং আর একজন কোটাল। মোড়ল অন্য খেলোয়াড়দের নিয়ে গোল হয়ে বসে নিজের ও পরস্পরের বুড়ো আঙুল মুঠ করে ধরে। কোটাল তাদের চারপাশে ঘুরতে থাকে। পরে মোড়ল ও কোটালের মধ্যে ছড়ার মাধ্যমে সংলাপ হয়: ‘কানটার পিছে কে ঘুরে? রাজার কোটাল।/ কিসের জন্যে? এক ছড়ি কলার জন্যে।/ কাল যে নিয়া গেছিলা? ঘোড়ায় মুতে দিয়াছে।/ ধুয়ে ধুয়ে খাও নি? ছি! হক! থু!!/ তবে এক ছড়ি নিয়া যাও।’ পরে কোটাল কলার কাঁদি কাটার অভিনয় করে একজন খেলোয়াড়কে নিয়ে যায় এবং পুনরায় ঘুরতে থাকে; এ সময় আবার পূর্বের ন্যায় ছড়া কাটা হয়। এভাবে কোটাল সব খেলোয়াড়কে নিয়ে গেলে প্রথম রাউন্ডের খেলা শেষ হয়। এভাবে যতক্ষণ খুশি এ খেলা চলতে থাকে।
স্পষ্টত এটি একটি অভিনয়। যখন রাজপ্রথা প্রচলিত ছিল তখন রাজার লোক কোটাল এসে নানাভাবে কৃষকের ঘরের ফলমূল ইত্যাদি নিয়ে যেত। তখনকার সমাজজীবনের সেসব তিক্ত অভিজ্ঞতাই এ খেলার মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে।
রুমালচুরি ছোট ছেলেমেয়েদের একটি দলবদ্ধ খেলা। প্রথমে দলের একজন ‘চোর’ হয়, অন্যরা কেন্দ্রের দিকে মুখ করে গোল হয়ে বসে। চোর হাতে রুমাল নিয়ে চারদিক ঘুরতে ঘুরতে সুবিধামতো একজনের পেছনে অলক্ষ্যে সেটি রেখে দেয়। সে টের না পেলে চোর ঠিক এক পাক ঘুরে এসে তার পিঠে কিল-চাপড় মারে। পূর্বে টের পেয়ে বা পরে মার খেয়ে সে রুমালখানা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং চোরের ভূমিকা পালন করে। তার শূন্য জায়গায় আগের খেলোয়াড় বসে পড়ে। কিশোরগঞ্জে এটি ‘মুড়াখেলা’ নামে পরিচিত। এতে বিপদের কোনো ঝুঁকি নেই। কোমলমতি বালক-বালিকারা এ খেলার মাধ্যমে নির্মল আনন্দ উপভোগ করে।
লাঠিখেলা শক্তি ও কৌশলের খেলা। মানুষ আত্মরক্ষা, শিকার ও যুদ্ধের জন্য বহু প্রাচীনকাল থেকেই লাঠির ব্যবহার করে আসছে। বাংলাদেশে কিছুকাল আগে পর্যন্ত জমিদাররা যোদ্ধা হিসেবে লাঠিয়াল রাখত। চরাঞ্চলের মানুষ এখনও লাঠির জোরে চর দখল করে। মুহরমের উৎসব শুরু হলে লাঠিয়ালরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিভিন্ন ভঙ্গিতে লাঠিখেলা প্রদর্শন করে। মুহরমের শোভাযাত্রার অগ্রভাগে থেকে খেলোয়াড়রা লাঠিখেলার কসরৎ দেখায়। এটা হচ্ছে যুদ্ধের কৃত্রিম মহড়া। অতীতে ধনিগৃহে বিবাহোপলক্ষে লাঠিখেলার আয়োজন হতো।
তিন-চার হাত লম্বা ও পরিমিত ব্যাসের তৈলাক্ত মসৃণ লাঠি এ খেলার উপকরণ। খেলোয়াড়রা কখনও এককভাবে, কখনও দ্বৈতভাবে সামনে, পেছনে, পাশে, মাথার ওপরে, দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে নানা কৌশলে ক্ষিপ্র গতিতে লাঠি ঘুরিয়ে এরূপ খেলা দেখায়। শক্তি ও শ্রমসাপেক্ষ এ খেলায় সুস্থ-সবল যুবকরা অংশগ্রহণ করে। উত্তরবঙ্গে ঈদ-পর্বের সময় গ্রামের যুবকরা ‘চামড়ি’ খেলা দেখায়। এতে পনেরো-বিশজন যুবক এক সঙ্গে লাঠি নিয়ে যুদ্ধের ভঙ্গিতে খেলা দেখায়; সঙ্গে থাকে বাদ্যযন্ত্র। এটি লাঠিখেলারই নামান্তর।
লুকোচুরি অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের একটি দলবদ্ধ খেলা। আট-দশজন মিলে এ খেলা খেলতে পারে। দলের একজন প্রধান হয়, তাকে বলা হয় ‘রাজা’। লটারির মাধ্যমে অপর একজনকে চোর সাব্যস্ত করা হয়। রাজা দুহাত দিয়ে চোরের চোখ বন্ধ করলে অন্যরা আড়ালে-আবডালে আত্মগোপন করে। রাজা তার চোখ খুলে দিলে সে তাদের খুঁজে বের করে। সবাই চেষ্টা করে চোরের ছোঁয়া বাঁচিয়ে আগেভাগে রাজাকে স্পর্শ করতে; কিন্তু চোর কোনো একজনকে ছুঁয়ে আগেই রাজাকে স্পর্শ করলে সে মুক্তি পায়, আর ওই খেলোয়াড় চোর হয়। এভাবে পালাক্রমে লুকোচুরি খেলা চলতে থাকে। যশোর, মাদারীপুর ইত্যাদি অঞ্চলে এর আঞ্চলিক নাম ‘পলাপলি’। কোনো কোনো অঞ্চলে বাসরঘরে নতুন বর-বধূকে নিয়ে লুকোচুরি খেলার নিয়ম আছে। খেলাটি বেশ প্রাচীন; রাজ অন্তঃপুরে এ খেলার রীতি ছিল। এ উদ্দেশ্যে হেরেম-মহলে বিশেষ ঘরের ব্যবস্থা ছিল। খেলাটি গ্রামে-গঞ্জে আজও প্রচলিত আছে।
সাতখোলা দুজনের প্রতিযোগিতামূলক খেলা। মাটির ওপর দু সারিতে সাতটি করে ছোট গর্ত করে দুজন দুপাশে বসে এবং নিজ নিজ গর্তগুলিতে সাতটি করে তেঁতুল বিচি বা কুঁচ জাতীয় গুটি রাখে। প্রথমে যেকানো একজন গুটি চালনা শুরু করে। সে নিজের যেকোনো একটি গর্ত থেকে গুটি তুলে একটা একটা করে প্রতি গর্তে বিতরণ করে। হাতের গুটি শেষ হয়ে গেলে অব্যবহিত পরের গর্ত থেকে গুটি তুলে নিয়ে অনুরূপভাবে বিতরণ করতে থাকে। যদি সেটি শূন্য থাকে তবে পরের গর্তের গুটিগুলি তুলে সে নিজের দখলে রাখে। যদি পরপর দুটি গর্ত খালি থাকে, তবে সে শূন্য হাতেই দান হারায়। প্রতিপক্ষ অনুরূপভাবে চাল শুরু করে গুটি দখলে নেওয়ার চেষ্টা করে। এটি অনেকটা জুয়াধর্মী এবং ভাগ্যনির্ভর খেলা, তবে এতে সম্পদ আহরণ ও অবসরযাপনের আনন্দ আছে।
সাতচাড়া দুই দলে বিভক্ত সমান সংখ্যক ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক একটি খেলা। এতে ভাঙা হাঁড়ি-কলসির সাত টুকরা চাড়া বা খোলামকুচি পরপর ওপরে-নিচে সাজানো হয়। যেদল দান পায় সেদলের একজন আট-দশ হাত দূর থেকে একটি রবার বা টেনিস বলদ্বারা আঘাত করে চাড়ার স্তম্ভটি ভাঙ্গার চেষ্টা করে। সে সফল হলে বিপক্ষ দলের প্রতিযোগীরা ত্বরিত গতিতে সেটি গড়ে তোলার চেষ্টা করে। সপক্ষের খেলোয়াড়রা বলটি কুড়িয়ে তাদের আঘাত করতে থাকে। আঘাত বাঁচিয়ে ভাঙা স্তম্ভ জোড়া দিতে পারলে তারা খেলার দান পায়, আর আঘাত করতে পারলে সে মারা পড়ে। এভাবে সবাই মারা পড়লে এক পয়েন্ট লাভ হয়।
চাড়ার স্তম্ভটি একটি গোষ্ঠীর দুর্গ বা আবাসভূমির প্রতীক; শত্রুপক্ষ তা আক্রমণ করে ভেঙ্গে দিতে চায়, আর আক্রান্ত দল তা প্রতিহত করার চেষ্টা করে; সফল হলে জয়ী, ব্যর্থ হলে পরাজিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এতে বিশেষজ্ঞগণ আর্যদের দ্বারা অনার্যদের সপ্তনগরী (সিন্ধু সভ্যতা) ধ্বংসের চিত্র কল্পনা করেন।
সোলঝাপ্টা মুর্শিদাবাদের একটি আঞ্চলিক খেলা। কয়েকজন রাখাল বা অন্য বালক একত্রে এ খেলা খেলে থাকে। আম-লিচুর বাগান এ খেলার উপযুক্ত স্থান। টসে যে ‘চোর’ হয় সে একখানা লাঠি মাটির ওপর রেখে তা স্পর্শ করে দাঁড়ায়; অন্যরা আশপাশের গাছের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। চোর নামের বালকটি তাদের কাউকে ছুঁয়ে এসে লাঠিখানা আগেভাগে চুম্বন করতে পরলে যাকে ছুঁয়েছে সে চোর হয়; তার অনুপস্থিতিতে আবার অন্যরা ছুটে এসে এটি চুম্বন করতে চেষ্টা করে।
এ খেলার অপর নাম ‘গাছ্ছুয়া গাছ্ছুয়া’ (ময়মনসিংহ), ‘ডগারে ডগা’ (বিক্রমপুর) ইত্যাদি। গাছ্ছুয়া গাছ্ছুয়া খেলায় লাঠির পরিবর্তে নির্ধারিত গাছ স্পর্শ করা হয়। এ খেলার একটি ছড়ায় অরণ্যজীবনের অভিজ্ঞতার ছায়াপাত ঘটেছে। ছড়াটি প্রশ্নোত্তরমূলক: ‘গাছ্ছুয়া রে গাছ্ছুয়া। গাছ ক্যারে? বাঘের ডরে।/ বাঘ কই? মাটির তলে।/ মাটি কই? এই তো।/ তোরা কয় ভাই? সাত ভাই।/ এক ভাই দিবে? ছুঁতে পারলে নিবে।’ এতে অভিনয়েরও প্রয়োগ আছে। মুক্তাঙ্গনের এ খেলায় বালকেরা শরীরচর্চা ও নির্মল আনন্দ উপভোগ করে থাকে।
হাডুডু বাংলার সর্বত্র প্রচলিত একটি জনপ্রিয় খেলা। বর্তমানে এটি জাতীয় খেলার মর্যাদা লাভ করেছে। শক্তি ও সাহসের খেলা বলে এতে তরুণ ও যুবকরা অংশ নিয়ে থাকে। হাডুডু দলীয় খেলা। নরম মাটির ওপর দাগ কেটে কোটের সীমানা নির্ধারণ করা হয়। কোটের পরিমাপ ২১১৪ বর্গহাত। সমবয়সের খেলোয়াড়রা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে মধ্য সীমারেখার দুপাশে অবস্থান নেয়। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে দলে দশ জন খেলোয়াড় থাকে; অন্যথায় এ সংখ্যা কমবেশি হতে পারে।
খেলা শুরু হলে এক পক্ষের যেকোনো একজন খেলোয়াড় মধ্যরেখা থেকে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ও মুখে শ্রবণযোগ্য কোনো ধ্বনি উচ্চারণ করে বা ছড়া কেটে প্রতিপক্ষের কোটে গিয়ে কাউকে ছুঁয়ে আসার চেষ্টা করে। সে সফল হলে ওই খেলোয়াড় মারা যায়। এভাবে পাল্টাপাল্টি পদ্ধতিতে খেলা চলতে থাকে। খেলার সময় অনেকে নিজেদের
সাহসী ও প্রতিপক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ছড়া কাটে, যাকে বলা হয় ‘বোল’। এভাবে কোন এক পক্ষের সকল খেলোয়াড় মারা গেলে তাদের এক পয়েন্টে হার হয়। প্রতিযোগিতার খেলায় বিজয়ী দলকে পুরস্কৃত করা হয়।
জলের খেলা ঝাপ্পুরি খেলা ছেলেদের দলবদ্ধ খেলা। এতে সাধারণত কোমর পানিতে সকলে গোল হয়ে দাঁড়ায়। একজনের হাতে একটা ভাসন্ত ফল থাকে। ফলটা ওপরের দিকে ছুঁড়ে দিলে তা ধরার জন্য সবাই কাড়াকাড়ি করে। এ সময় তারা ছড়া কাটে: ‘তই তই/ বগা মারিয়া থলিত থই।/ বগা আইল কুঁইয়া/ ভুঞায় খায় চুঁইয়া।’ এ থেকে খেলাটি স্থান-বিশেষে ‘তই তই খেলা’ নামেও পরিচিত।
নৌকা বাইচ একটি বহু প্রাচীন ও বহুল প্রচলিত লোকক্রীড়া। প্রতিযোগিতামূলক নৌকা বাইচ খুবই আকর্ষণীয় ও উত্তেজনাকর হয়। লোকমেলা, জাতীয় উৎসব, মনসার ভাসান ইত্যাদি উপলক্ষে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামের বলিষ্ঠ যুবকরা নৌকার দুপাশে জোড়ায় জোড়ায় বসে দাঁড় টানে; তাদের বলা হয় বাচেলদার। মাঝি হাল ধরে। গান-বাজনার মাধ্যমে উৎসাহ দেওয়ার জন্য কয়েকজন সারিদার থাকে। এরূপ বিশ-পঁচিশ জনের সমান সংখ্যক দুই দল মাঝিমাল্লা নিয়ে সজ্জিত নৌকার মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়।
বাইচের নৌকায় কোনো পাল-মাস্ত্তল থাকে না। দাঁড়ির ও মাঝির পেশীবল এবং ক্ষিপ্রতার ওপরই জয়-পরাজয় নির্ভর করে। নৌকা বাইচ দলীয় খেলা বলে এতে গোষ্ঠীমনোভাব ও গোষ্ঠীস্বার্থ প্রকাশ পায়। অনেকের মতে মুগল আমলের নৌবাহিনী থেকে এ খেলার উদ্ভব এবং যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা সাধারণের মধ্যে বিস্তার লাভ করে। দেওয়ানা মদিনা পালা থেকে জানা যায় যে, ময়মনসিংহে দুশ-আড়াইশ বছর আগে আড়ং (মেলা) উপলক্ষে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হতো।
পানিঝুপ্পা পাতলা চ্যাপ্টা মাটির টুকরা, ভাঙা হাঁড়ির চাড়া বা খোলামকুচি ডাঙা থেকে হাতের কৌশলে পানির ওপর ছুঁড়ে মারা হয়; চাড়াটি ব্যাঙের মতো কিছুদূর লাফাতে লাফাতে গিয়ে ডুবে যায়। এভাবে কে কতক্ষণ চাড়াটিকে লাফাতে ও কতদূরে পাঠাতে পারে তা নিয়ে হয় প্রতিযোগিতা। অঞ্চলবিশেষে এ খেলাকে বলা হয় ‘খোলামকুচি খেলা’। এটি নিছক অবসরযাপন ও নির্মল আনন্দের খেলা। চাড়া লাফানোর দৃশ্যটি বেশ উপভোগ্য হয়ে থাকে।
লাই খেলা বালকদের দলবদ্ধ খেলা। ‘লাই’ শব্দটি ‘নাভি’ শব্দজাত। একটি বালক বুক পানিতে দাঁড়িয়ে এক হাতে পানি নিয়ে অন্যদের উদ্দেশ্যে প্রশ্নোত্তরবাচক ছড়া বলে। যেমন, ‘আমার হাতে কি?/ জলই এক ডুবে তলই। তোরে যদি পাই/ এক গেরাসে খাই।’ এই শেষ বাক্যটি বলে সে নাভি-পানিতে ডুব দেয় এবং অন্যরা তাকে ধরার চেষ্টা করে। সে সফল হলে পয়েন্ট পায়, ব্যর্থ হলে যে ধরতে সক্ষম হয় সে দান পেয়ে অনুরূপভাবে খেলা শুরু করে। নাভি বা লাই থেকেই এ খেলার নাম হয়েছে ‘লাই খেলা’। এতে সাঁতার কাটার আনন্দ ও শরীরচর্চার উপকারিতা আছে।
সাঁতার এ শ্রেণির খেলার মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য খেলা। সাঁতার সারা বিশ্বে প্রচলিত একটি সাধারণ জলক্রীড়া। গ্রামের সকলেই সাঁতার জানে। এটি একটি ভাল ব্যায়াম হিসেবেও পরিগণিত হয়। নানা পদ্ধতির সাঁতার উদ্ভাবন করে সাঁতারে এখন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাঙালি সাঁতারু ব্রজেন দাস ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। এর বিভিন্ন প্রকার নাম হচ্ছে ডুব সাঁতার, চিৎ সাঁতার, বুক সাঁতার প্রভৃতি।
হোলডুগ নদী-নালায় গোসলের সময় ছেলেরা এ খেলা খেলে থাকে। টসে জিতে একজন দান পায়। খেলার শুরুতে সে হাতে পানি নিয়ে প্রশ্ন করে, অন্যরা উত্তর দেয়।
যেমন, ‘এটা কি? দুধ,/ এটা কি? ত্যাল,/ এটা কি? মরিচ/ বাপ বলে ধরিস।’ প্রশ্নকর্তা শেষ বাক্যটি বলেই ডুব দিয়ে পালিয়ে যায়, আর অন্যরা তাকে ধরার চেষ্টা করে। যে তাকে প্রথম স্পর্শ করে, পরবর্তী খেলায় সে প্রশ্ন করার সুযোগ পায়। এভাবে হোলডুগ খেলা চলতে থাকে। এটি ময়মনসিংহে ‘মলই’ এবং নোয়াখালীতে ‘হট্টিহট্টি’ নামে পরিচিত। ডুব-সাঁতারে যে অধিক দক্ষ সে বেশি কৃতিত্বের অধিকারী হয়। এতে সাঁতার কাটার আনন্দ ও শরীরচর্চার উপকারিতা পাওয়া যায়।
অন্তরীক্ষের খেলা এ প্রকার খেলার মধ্যে কবুতর ওড়ানো ও ঘুড়ি ওড়ানো প্রধান। কবুতর পোষা ও তা ওড়ানোর আনন্দ প্রায় সব অঞ্চলেই লক্ষ করা যায়। কবুতরের বিভিন্ন জাত আছে। গিরোবাজ জাতের কবুতর খেলার বেশি উপযোগী। এগুলি আকাশে অনেক ওপরে উঠে নানারকম ডিগবাজি খেয়ে কসরত দেখাতে পারে। কবুতর দিয়ে কবুতর শিকার করার একটি রীতিও প্রচলিত আছে। কবুতর প্রভুভক্ত প্রাণী; যত দূরেই যাক, সে আপন প্রভু ও নীড়ের কথা বিস্মৃত হয় না। দীর্ঘ দিনের ব্যবধানেও সে ফিরে আসতে সক্ষম হয়।
ঘুড়ি ওড়ানো গ্রাম ও শহরে প্রচলিত একটি জনপ্রিয় খেলা। আবহাওয়া শুষ্ক ও বাতাস অনুকূল থাকলে প্রধানত কিশোররা ঘুড়ি উড়িয়ে আনন্দ উপভোগ করে। প্রতিযোগিতার সময় অবশ্য যুবকরাও অংশ নেয়। সে ক্ষেত্রে ‘মাঞ্জা’ দিয়ে সূতায় ধার দেওয়া হয়; এতে প্যাঁচ দিয়ে প্রতিপক্ষের সূতা কাটতে সুবিধা হয়। সাদা-লাল-নীল-সবুজ-বেগুনি বিভিন্ন রঙের কাগজ দিয়ে ঘুড়ি তৈরি করা হয়।
নাটাইয়ের সূতার সঙ্গে ঘুড়ি বেঁধে ওড়ানো হয়। খেলোয়াড় সূতার টানে ডানে-বামে, ওপরে-নিচে ঘুরপাক খাইয়ে ঘুড়িকে ওড়ায়। শিশুরা ভারসাম্য রক্ষার জন্য ঘুড়ির নিচে কাগজের লেজ লাগায়। প্রতিযোগিতার ঘুড়িতে লেজ থাকে না। চৈত্র মাসে দিন ধার্য করে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। হিন্দু সমাজে মকর সংক্রান্তি ও বিশ্বকর্মার দিনটিকে ঘুড়ি-দিবস হিসেবে গণ্য করে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। পৃথিবীর নানা দেশে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রথা প্রচলিত আছে। চীন, জাপানসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে বিচিত্র ধরণের ঘুড়ি দেখা যায়। চীনারা ড্রাগনের বৃহৎ আকারবিশিষ্ট ঘুড়ি তৈরি করে উড়িয়ে থাকে। [ওয়াকিল আহমদ]
গ্রন্থপঞ্জি অসীম সাহা, বাংলার লৌকিক ক্রীড়ার সামাজিক উৎস, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৯১।