লোকউৎসব

লোকউৎসব  গ্রামবাংলার জনগণের প্রিয়  উৎসব। এর প্রচলন হয়েছে মূলত ভোজ-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। প্রাচীনকালে শিকারকৃত পশুর মাংস একত্রে বসে ভোজন করা এবং নৃত্যগীতের মাধ্যমে আনন্দ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠান পালিত হতো। পরবর্তীকালে কৃষি ও পশুপালন  স্তরে এসে এ উৎসব নতুন মাত্রা লাভ করে এবং বিভিন্ন সময়ে যুগের দাবি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের লোকউৎসবের সৃষ্টি হয়।

আদিম স্তরে প্রকৃতি ও সূর্যদেবকে তুষ্ট করতে নরবলিসহ যেসব উৎসব অনুষ্ঠিত হতো, সেগুলি এখন বিলুপ্ত। আবার কোনো কোনো উৎসব ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে এখনও টিকে আছে। এসব উৎসবের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কার, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, আচার-আচরণ, এমনকি অর্থনৈতিক বিষয়ও যুক্ত হয়ে গেছে। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিসংশ্লিষ্ট অনেকগুলি উৎসব আছে, যেগুলি প্রকৃতিনির্ভর কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত কৃষকদের নিকট বিশেষ গুরুত্ববহ। নিম্নে কয়েকটি লোকউৎসবের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো:

অম্বুবাচী  হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত একটি বিশেষ লোকউৎসব। আষাঢ় মাসের সাত তারিখ থেকে তিনদিন এটি পালিত হয়। এসময় হিন্দু মহিলারা নানা ধরনের ক্রিয়াচার পালন করে। তাদের বিশ্বাস, এ তিনদিন আকাশ ও পৃথিবীর মিলন হয় এবং এতে ধরিত্রী সিক্ত হয়ে কৃষিকাজের উপযোগী হয়। এসময় মাটি খোঁড়া, হাল চালনা ইত্যাদি নিষিদ্ধ। হিন্দু বিধবা মহিলারা এসময় কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলে। এ উপলক্ষে পিঠা-পুলি ইত্যাদি বিশেষ ধরনের খাবারের আয়োজন করা হয়।

কারাম ওরাওঁ উপজাতীয়দের একটি উৎসব। এটি উদ্যাপিত হয় ভাদ্র-সংক্রান্তিতে। কারাম এক ধরনের গাছ। এর পূজা উপলক্ষেই এ উৎসব করা হয়। উত্তরাঞ্চলে একে ভাদইপর্ব, বর্ষাপর্ব ইত্যাদিও বলা হয়। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে ওরাওঁ সমাজের কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতীরা হয়ে ওঠে নৃত্যচঞ্চল, সঙ্গীতমুখর এবং পানাহারমত্ত। এ পর্ব কেবল কারাম বৃক্ষের আবাহন নয়, প্রকৃতপক্ষে ওরাওঁ তরুণ-তরুণীদের মন দেওয়া-নেওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কামনা-বাসনা প্রকাশেরও উৎসব। ভাদ্র-সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হলেও তার প্রস্ত্ততি চলে পূর্বরাত্রির শেষ প্রহর থেকে। তরুণ-তরুণীরা একে পূত-পবিত্র করার উদ্দেশ্যে তখন থেকেই উপবাস শুরু করে।

সংক্রান্তির দিন সন্ধ্যাবেলা ওরাওঁ নরনারীরা কারাম বৃক্ষের পাদমূলে পূজা দেয়। এ সময় মেয়েরা সমবেত কণ্ঠে গান গায় এবং নারী-পুরুষ দলবদ্ধভাবে নৃত্য-গীত করে। এভাবে তিন পর্যায়ে কারাম বৃক্ষের পূজার মাধ্যমে তারা স্রষ্টার প্রতি নিজেদের ভক্তি নিবেদন করে।

কুলানামানো  বৃষ্টিআবাহনের একটি উৎসব। এ উপলক্ষে মহিলারা কুলা সাজিয়ে বাড়ি বাড়ি যায় এবং বৃষ্টির আবাহন জানিয়ে গান গায়।

গম্ভীরা গান পরিবেশনা

গাস্বি উৎসব  হৈমন্তিক ধানের শীষে দুধ সঞ্চয়নমূলক একটি অনুষ্ঠান। আশ্বিনের শেষ রাত থেকে এ অনুষ্ঠান শুরু হয়। ফসল যাতে ভাল হয় সে উদ্দেশ্যে পরের দিন পয়লা কার্তিক প্রত্যূষে কাঁচা হলুদ এবং শুন্দি একত্রে বেটে সরিষার তেলসহ ধানগাছে মাখিয়ে দেওয়া হয়। এই ধারণাটি সম্ভবত সংস্কৃত সাহিত্য থেকে এসেছে। সংস্কৃত সাহিত্যে অফলা গাছে ফল ধরানোর উদ্দেশ্যে এরকম একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করার উলে­খ পাওয়া যায়, যাকে বলে ‘দোহদ দান’। অফলা গাছে ফল ফলানোর উদ্দেশ্যে গাছের ডালে শামুকের মালা ঝুলিয়ে দেওয়া বা গাছটি কেটে ফেলার অভিনয়ও করা হয়। এসময় মশা-মাছি ও পোকা-মাকড়ের প্রাদুর্ভাব রোধ করার জন্য পূর্বরাতে প্যাকাটি জ্বালিয়ে ছেলেরা ছড়া কাটে। নীরোগ স্বাস্থ্যের জন্য লোকেরা এ রাতে তেলাকুচার পাতা, আমগুরুজের লতা, হলদি, পান ইত্যাদি বেটে গায়ে মেখে স্নান করে। এ অনুষ্ঠানে তারা আশ্বিনের শেষদিন রান্না করে এবং পরের দিন খায়। তাই জনশ্রুতি আছে, ‘আশ্বিনে রান্ধে-বাড়ে, কার্তিকে খায়/ যে যেই বর মাগে সেই বর পায়।’  প্রাকৃতিক পরিবর্তনের কারণে বর্তমানে অবশ্য এ উৎসবের প্রচলন নেই।

চড়কপূজা  হিন্দুদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। চৈত্রের শেষ এবং বৈশাখের প্রথম দু’তিন দিন ব্যাপী এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানত ফরিদপুর, বরিশাল ইত্যাদি হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে এ সব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে দু’তিন দিন ব্যাপী মেলা বসে।

নবান্ন  একটি বিশেষ লোকউৎসব। নতুন ফসল ওঠার পর অগ্রহায়ণ মাসে এ উৎসবটি এক সময় হিন্দুদের মধ্যে ধুমধামের সঙ্গে পালিত হতো। উৎসবের দিন ভোর না হতেই ছেলেমেয়েরা ঘরের বাইরে এসে ছড়া কেটে দাঁড়কাকদের নেমন্তন্ন করতো: ‘কো কো কো, আমাগো বাড়ি শুভ নবান্ন/ শুভ নবান্ন খাবা কাকবলি লবা/ পাতি কাউয়া লাথি খায়/ দাঁড় কাউয়া কলা খায়/ কো কো কো, মোরগো বাড়ি শুভ নবান্ন।’

এদিন নতুন চাল ঢেঁকিতে কোটা হয়। বেলা দশটার দিকে বাড়ির প্রবীণগণ পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করেন এবং ছেলেমেয়েরা নতুন জামা-কাপড় পরে।

এরপর বাড়ির উঠোনে গর্ত করে জ্যান্ত কৈ মাছ ও কিছু দুধ দিয়ে একটি বাঁশ পোতা হয়। একে বলে ‘বীর বাঁশ’। বীর বাঁশের চারপাশে চালের গুঁড়ো দিয়ে  আলপনা অাঁকা হয়। বীর বাঁশের প্রতিটি কঞ্চিতে নতুন ধানের ছড়া বাঁধা হয়। বীর বাঁশ পোঁতার পরে একটি কলার খোলে চালমাখা কলা ও নারকেল নাড়ু কাককে খেতে দেয়া হয়। কলাটি মুখে নিয়ে কাক কোন দিকে যায় তা লক্ষ করা হয়; কারণ তাদের বিশ্বাস, বছরের শুভাশুভ অনেকটা এর ওপর নির্ভর করে। কাককে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত এই পর্বটির নাম ‘কাকবলি’। এই অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ আহার করে না। শস্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীকে পূজা এবং নবান্ন দিয়ে পরে সকলে আহার গ্রহণ করে। এদিন প্রত্যেক পরিবারেই উন্নত মানের খাবার তৈরি হয়। দিনের বেলা অন্যের বাড়িতে নবান্ন গ্রহণ করলেও রাতে নিজ বাড়িতেই খেতে হয়। নবান্নের শেষ হয় পরের দিন ‘বাসি নবান্ন’ দিয়ে।

মুসলিম পরিবারেও নবান্নের প্রচলন ছিল। সংস্কারবশত তারাও লক্ষ্মীর শির্নী দিত। একে তারা বলত ‘নয়াখাওয়া’। উৎসবের আমেজ এদের মধ্যে থাকলেও হিন্দুদের মতো এত আনুষ্ঠানিকতা ছিল না।

পুণ্যাহ রাজস্ব আদায় সংত্রান্ত একটি উৎসব। নববর্ষের প্রারম্ভে প্রজারা জমিদারকে এবং জমিদাররা সরকারকে খাজনা দিত এবং সে উপলক্ষে এ উৎসবটি অনুষ্ঠিত হতো। এ উপলক্ষে প্রজারা নতুন পোশাক পরে কাচারিতে যেত এবং সেখানে মেলা, নাচ-গান,  যাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হতো। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকে এর গুরুত্ব কমতে থাকে এবং উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তা বাংলা নববর্ষের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়।

পৌষপার্বণ বা পোষলা  একটি শস্যউৎসব। এ উপলক্ষে মুসলিম রাখাল ছেলেরা মানিক পীরের গান গেয়ে, আর হিন্দু রাখালেরা লক্ষ্মীর নামে ছড়া কেটে সারা পৌষ মাস সন্ধ্যার পর বাড়ি বাড়ি মাগন করত। মাগনশেষে তারা পৌষ সংক্রান্তির সকালে মাঠ বা বনের ধারে রান্না করত; পিঠা বা শির্নী বানিয়ে পীর বা দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করত এবং পরে নিজেরা খেত। একে পিঠাপর্বও বলা হতো। বর্তমানে পৌষপার্বণ উৎসবটি গ্রামবাংলার পরিবর্তে জেলা শহরগুলিতে লোকসংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে পালিত হয়।

পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা

বাংলা নববর্ষ  এখন জাতীয় উৎসব হিসেবে উদ্যাপিত হয়। এ উপলক্ষে গ্রামবাংলার কৃষক পরিবারে চৈত্রসংক্রান্তির রাতে গৃহিণীরা ‘আমানি’ প্রস্ত্তত করে। একটি বড় হাঁড়িতে অনেকটা পানির মধ্যে আম আর কিছু চাল ভেজানো হয়। আর ওই হাঁড়ির ভেতর রাখা হয় একটি সপত্র আমের ডাল। ভোরবেলা বাড়ির সবাইকে জাগিয়ে গৃহিণী তাদের ওই ভেজানো চাল খেতে দেয়, আর আমের ডাল দিয়ে গায়ে জল ছিটিয়ে দেয়। এতে শরীর ঠান্ডা থাকে বলে তাদের বিশ্বাস। এদিন সবাই সাধ্যমত উন্নত ভোজের আয়োজন করে। এর মূলে তাদের এই বিশ্বাস কাজ করে যে, বছরের প্রথম দিন ভাল  ভোজ হলে সারা বছরই ভাল ভোজ হবে। এ উৎসবকে উপলক্ষ করে বিভিন্ন শহরে, নগরে ও গ্রামাঞ্চলে মেলা বসে।

বৃষ্টিআবাহন  কৃষিসংক্রান্ত একটি বিশেষ লোকউৎসব। যথাসময়ে বৃষ্টি না হলে কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে সমাজে বিপর্যয় দেখা দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য নানা ধরনের ক্রিয়াচার পালন করা হয়। সেসবের মধ্যে ব্যাঙবিয়ে, বদনাবিয়ে, মেঘারানী, হুদমাদেও সম্পর্কিত বৃষ্টিআবাহন অনুষ্ঠান এবং পুণ্যিপুকুর ব্রত ও বসুধারা ব্রত উল্লেখযোগ্য। আদিবাসী মেয়েরা বৃষ্টিকামনায় রাতের অন্ধকারে বিবস্ত্র হয়ে দল বেঁধে হুদমাদেও-এর গান গায়। প্রাচীনকালে আজটেকদের মধ্যে বৃষ্টিদেবতাকে তুষ্ট করার জন্য একটি সুন্দরী কুমারী মেয়েকে নানা অর্ঘ্যসহ উৎসর্গ করার প্রথা ছিল। এতে সমাজের সকল মানুষ দলবদ্ধ হয়ে বাদ্য-বাজনা বাজিয়ে সারা গ্রাম ঘুরত এবং শেষে মেয়েটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিত একটি কুয়োর মধ্যে। বৃষ্টিআবাহনের ক্ষেত্রে কাদামাটি অনুষ্ঠানটিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এতে মেয়েরা কলসিতে জল ভরে বাড়ি বাড়ি ঘোরে এবং মাটিতে জল ঢেলে একজন আরেকজনকে মাখিয়ে দেয়।

বেরাভাসান  উৎসবটি নদ-নদী ও হাওর-বাঁওড় অঞ্চলে জলের সব রকম অকল্যাণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে পালিত হয়। ভাদ্র মাসের শেষ বৃহস্পতিবার খোয়াজ-খিজিরের (জলের দেবতা বরুণের স্থলাভিষিক্ত) উদ্দেশে উৎসবটি নিবেদিত হয়। সামাজিক, পারিবারিক বা ফকির সম্প্রদায়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়। মুগল আমলে মুর্শিদাবাদ, রাজমহল ও ঢাকায় নবাব-নায়েবে নাজিমদের উদ্যোগে মহা সমারোহে এ উৎসব পালিত হতো। এর পৃষ্ঠপোষকতায় মুকাররম খান, নবাব  সিরাজউদ্দৌলা এবং মীর কাসিম উলে­খযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। এই লৌকিক উৎসবটি তখন তাঁদের কল্যাণে জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছিল। লোক-জীবনে এর প্রভাব এত গভীর যে, স্থানীয় ক্রিয়াচার এবং লৌকিক সংস্কারকে ভর করে এটা এখনও নদীবহুল অঞ্চলে টিকে আছে। এ উৎসবে এক নিঃশ্বাসে কলাগাছ কেটে ভেলা বানানো হয় এবং তাতে নানা রকমের শির্নী সাজিয়ে গান গাইতে গাইতে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

ভাদু  পশ্চিমবঙ্গের একটি কৃষিভিত্তিক উৎসব। বহুকাল আগে থেকেই এটি চলে আসছে এবং এখনও বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে উদ্যাপিত হয়। পুরো ভাদ্রমাস ব্যাপী পুরুলিয়া জেলার হিন্দু মেয়েরা ভাদুর পূজা করে। জনশ্রুতি আছে যে, কাশীপুররাজের অবিবাহিতা কন্যার ভাদ্র মাসে মূত্যু হওয়ায় তাকে স্মরণ করার জন্য এই উৎসবের আয়োজন করা হয়। একজন বর্ষীয়ান মহিলা ‘ভাদ্রেশ্বর্যৈ নমঃ’ বলে ভাদুমূর্তির দিকে ফুল ছুঁড়ে দেয়। এ সময় ভাদুর গান গাওয়া হয়। শেষ দিনে তারা সাশ্রুনয়নে ভাদুকে বিসর্জন দেয়।

সূর্যব্রত  হিন্দু কুমারী মেয়েদের একটি উৎসববিশেষ। একে লালঠাকুরের ব্রত, সিঁড়িপূজা ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়। উৎসবটি এক সময় বহুল প্রচলিত ছিল। সারা মাঘমাস জুড়ে কুমারী মেয়েরা আনন্দ, নিষ্ঠা ও ভক্তির সঙ্গে এ ব্রত পালন করত। পৌষ মাসের সংক্রান্তির দিন ব্রতচারিণী মেয়েরা সংযম পালন করত। পরদিন পয়লা মাঘ পাড়ার সকল মেয়ে খুব ভোরে দলবদ্ধভাবে চলে যেত নদী বা পুকুরঘাটে। জলে নামার আগে তারা একটি ছড়ামন্ত্র তিনবার আবৃত্তি করত। স্নানশেষে প্রত্যেকে অঞ্জলি ভরে জল নিয়ে মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক খড়ে আগুন ধরিয়ে সূর্যদেবকে প্রণাম জানাত। এর পরের কাজ বাড়ি ফিরে তুলসীতলায় নির্মিত সিঁড়ির পূজা করা। পূজাশেষে সূর্যদেবের নিকট তারা বর চায়। প্রতিদিন একই নিয়মে এক মাস সিঁড়ি পূজা হয়। মাঘমাসের প্রতি রবিবার ব্রতচারিণীরা নিরামিষ আহার করে এবং দুপুর বেলা ভেলা (ভেউরা) ভাসায়। কলার ভেলা তৈরি করে তাতে আতপ চাল, চিনি, বাতাসা, ঘি, মধু, কলা, প্রদীপ প্রভৃতি সাজিয়ে মাথায় করে নদী বা পুকুর ঘাটে যায়। তাদের পেছনে একদল স্ত্রীলোক গান গাইতে গাইতে অগ্রসর হয়। সুপতি, সাংসারিক মঙ্গল আর আর্থিক সচ্ছলতা কামনা করে তারা ভেলা ভাসায়। পুরো মাঘ মাস কুমারী মেয়েদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দের ভেতর দিয়ে এ উৎসবটি উদ্যাপিত হয়।

আদিবাসীদের সাগ্রাই উৎসব

সাগ্রাই  নববর্ষে উদ্যাপিত আদিবাসীদের একটি উৎসব। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা পুরাতন বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর উদ্দেশ্যে জাঁকজমকের সঙ্গে এটি পালন করে। উৎসবটি হয় চার দিন ব্যাপী পুরাতন বছরের শেষ তিনদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন। উৎসবের প্রথম দিন  মারমা নারী-পুরুষ মিছিল করে সকল বৌদ্ধমূর্তিকে নদীর ঘাটে নিয়ে যায় এবং ভেলায় স্থাপন করে চন্দন-জল কিংবা দুধ-জলে স্নান করিয়ে মন্দিরে কিংবা বাড়িতে পুনঃস্থাপন করে। পুরাতন বছরের শেষ দুদিন তাদের জন্য খুবই আনন্দের। এ সময় পাড়ায় পাড়ায় চলে ‘পানিখেলা’ উৎসব। তারা একে অপরকে পানি ছিটিয়ে পুরাতন বছরের ব্যর্থতা, গ্লানি ও দুঃখকে ধুয়ে মুছে দিতে চায়। পরে নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে তারা আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেয়। এদিন রাখাইন সম্প্রদায় ’রঙপানি‘ খেলায় মেতে ওঠে। চৈত্রের শেষ দুদিন এবং পয়লা বৈশাখ এই তিনদিন ব্যাপী চাকমাদের ভেতর মহাসমারোহে পালিত হয় ‘বিঝু’ উৎসব। প্রথম দিন ‘ফুল বিঝু’, দ্বিতীয় দিন ’মূল বিঝু’ এবং পয়লা বৈশাখ ‘গোজ্যাই পোজ্যার দিন’। প্রথম দুদিন চাকমারা কোনো কাজকর্ম করে না, আনন্দ উৎসবে কাটিয়ে দেয়। ‘মূল বিঝু’ই হচ্ছে তাদের মূল উৎসব। সারাদিন তারা একে অপরের বাড়িতে খাওয়ার উৎসবে মেতে ওঠে। তরুণী মেয়েরা তাঁতে বোনা রাঙা খাদি পরিধান করে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং অপরাহ্ণে বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করে।

হালখাতা  প্রধানত ব্যবসায়ীদের একটি উৎসব। বাংলা নববর্ষের দিন ব্যবসায়ীরা নতুন হিসাব খোলে এবং তাদের ক্রেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করে। শহর ও গ্রামে হালখাতার প্রচলন রয়েছে।

এগুলি ছাড়া  কবিগানবিচার গানআলকাপ গান ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে যে বিপুল জনসমাবেশ ঘটে, তাও উৎসবের পর্যায়ভুক্ত। বর্তমানে বিভিন্ন উপলক্ষে এসব লোকসাংস্কৃতিক উৎসব শহরে-নগরে উদ্যাপিত হতে দেখা যায়। প্রতিবছর পয়লা কার্তিক কুষ্টিয়া জেলার ছেউড়িয়ায় লালন স্মরণোৎসব পালিত হয়। লালন অনুসারী ফকির ছাড়া অন্যান্য লোকধর্মের সাধকরাও এতে যোগদান করে। এ উপলক্ষে মেলা বসে। এতে লালনের অনুসারী এবং লোকসঙ্গীতশিল্পীরা লালনগীতি পরিবেশন করেন।

কোন কোন লোকক্রীড়াও লোকউৎসবের রূপ নেয়, যেমন  নৌকাবাইচ, ষাঁড়ের লড়াই ইত্যাদি। এ উপলক্ষে যে জনসমাগম হয় তাকে রীতিমত লোকউৎসব বলা যায়। নৌকাবাইচের সময় নদীর দুই তীরে সারিবদ্ধ মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে কোন নৌকা প্রথম হয় তা দেখার জন্য। নৌকাবাইচ আজও একটি উত্তেজনাপূর্ণ এবং আনন্দদায়ক খেলা হিসেবে প্রচলিত আছে। ষাঁড়ের লড়াইও কম উত্তেজনাকর খেলা নয়, যদিও খেলাটি বর্তমানে অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। চট্টগ্রামের জববারের বলীখেলাও একটি গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। বৈশাখ মাসে অনুষ্ঠিত এ খেলা উপলক্ষে সেখানে বিরাট মেলা বসে।

সামাজিক ও পারিবারিক উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিয়ে। বিয়ে একটি সামাজিক প্রথা, তবে তার সঙ্গে জড়িত আচার-অনুষ্ঠানসমূহ লোকজ উৎসবের অংশ। বিয়ের পাকা দেখার পর থেকেই শুরু হয় নিকট আত্মীয়দের মধ্যে যাতায়াতের পালা। বর-কনের বাড়িতে নানা ধরনের অনুষ্ঠান হতে থাকে। আইবুড়োভাত,  গায়ে হলুদ, অধিবাস ইত্যাদি আচার-অনুষ্ঠান বিয়ের আনন্দকে বাড়িয়ে দেয়। অতীতে কোথাও কোথাও দুপক্ষের লাঠিয়ালদের মধ্যে সংঘর্ষ হতো। বরপক্ষের লাঠিয়ালরা বিজয়ী হলে তবেই বর বিয়ের আসরে যেত। কখনও কখনও উভয় পক্ষের মধ্যে চলত ধাঁধার প্রশ্নোত্তরের পালা। আগের মতো এখনও বাড়ির ছেলেমেয়েরা বরকে বিয়ের আসরে যেতে বাধা দেয়, যতক্ষণ না বর তাদের পুরস্কৃত করে। উত্তরাঞ্চলে বরের সঙ্গে যেসব মহিলা আসে তাদের বলা হয় মওলানি। তাদের সামনে অনেকগুলি বালিশ পেতে দেওয়া হয়, যাতে তারা সেগুলি ডিঙিয়ে যেতে না পারে। এমনি সব ছোট ছোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ের মূল অনুষ্ঠানকে আনন্দময় করে তোলা হয়। বিয়ের অনুষ্ঠানকে আরও আনন্দঘন করে তোলে বিয়ের গান। বর্তমানে হলুদের অনুষ্ঠানটি বর-কনে উভয় পক্ষ থেকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়।

আকিকাঅন্নপ্রাশন, খতনা প্রভৃতি পারিবারিক উৎসব বিয়ের তুলনায় এতটা ব্যাপক না হলেও কোথাও কোথাও বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই পালিত হয়। টাঙ্গাইলে ছেলের খতনা উপলক্ষে তাকে গোসল করিয়ে নতুন জামা-কাপড় পরানো এবং পরে পালকিতে বা ঘোড়ায় চড়িয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করানো হয়। [মোমেন চৌধুরী]

গ্রন্থপঞ্জি  ওয়াকিল আহমদ, বাংলার লোক-সংস্কৃতি, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৪; আতোয়ার রহমান, উৎসব, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৬; জাফর আহমদ হানাফী, উপজাতীয় নন্দন সংস্কৃতি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৩; মুহম্মদ আব্দুল জলিল, লোকসংস্কৃতির নানা প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৫; মোমেন চৌধুরী, লোকসংস্কার ও বিবিধ প্রসঙ্গ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৭; শীলা বসাক, বাংলার ব্রতপার্বণ, কলকাতা, ১৯৯৮; আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলার লোকশ্রুতি, দ্বিতীয় প্রকাশ, কলকাতা, ১৯৯৯।