লাঠিয়াল
লাঠিয়াল (দন্ডধারী) প্রাক-ব্রিটিশ ও ব্রিটিশ আমলে বাংলার গ্রামীণ সমাজে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক সামাজিক শ্রেণিরূপে পরিগণিত। তখনকার দিনে একজন লাঠিয়াল বিশেষভাবে তৈরি বাঁশ (যা লাঠি নামে সমধিক পরিচিত) হাতে ধরে বিভিন্ন কায়দায় নিয়ন্ত্রণের কৌশল দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করত। লাঠি সাধারণত ঘন গিটযুক্ত বাঁশ দিয়ে তৈরি হত এবং সময়ে সময়ে লাঠিকে লোহার রিং দিয়ে ঘন করে মুড়িয়ে নেওয়া হতো। লাঠি প্রাকৃত শব্দ, এর সংস্কৃত রূপ যষ্ঠি (দন্ড)। বাংলাসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ভাষায় বহুল প্রচলিত প্রবচন হচ্ছে ‘লাঠি যার, ক্ষমতা তার’। লাঠি নিয়ন্ত্রণে পারদর্শিতা অর্জন করে যে ব্যক্তি মার্শাল আর্ট দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করত সে লাঠিয়াল নামে পরিচিত হতো।
উল্লেখ্য যে, বরকন্দাজ আর লাঠিয়াল এক নয়। বরকন্দাজ ছিল সরকারিভাবে স্বীকৃত স্থানীয় কর্তৃপক্ষের লাঠিয়াল। অন্যদিকে বেসরকারি লাঠিয়াল নগদ টাকা বা স্থাবর কিছুর বিনিময়ে জমিদার ও অন্যান্যদের নিকট তার দক্ষতা বিক্রি করত। আন্তঃ-জমিদার বিরোধ মিটাতে এবং অবাধ্য প্রজাদেরকে দমন করতে সতত লাঠিয়াল নিয়োজিত হতো। প্রত্যেক জমিদারি স্থাপনায় তিনটি শাখা ছিল: খাজনা নির্ধারণ ও আদায়ের দায়িত্বে ছিল তহসিল নায়েব ও গোমস্তা, কলহ-বিবাদে যুদ্ধ করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল জমাদার ও মৃধা এবং আইনি যুদ্ধ চালানোর জন্য ছিল উকিল। ভূমি-মালিক ও ভূ-সংশ্লিষ্ট লোকজনের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসার জন্য সালিশি ব্যবস্থা চালু ছিল। একমাত্র সালিশ ব্যর্থ হলেই লাঠিয়াল পাঠানো হতো। বিরোধ মীমাংসার সর্বপ্রকার চেষ্টা ব্যর্থ হলেই আইনি লড়াই চলত এবং ফলপ্রসূভাবে শক্তি প্রয়োগ না করা গেলে তখনই একমাত্র আইনের আশ্রয় নেওয়া হতো।
প্রয়োজনের তাগিদে প্রত্যেক জমিদার ও তালুকদার লাঠিয়াল বাহিনী পুষত। এই বাহিনী ক্রমোচ্চভাবে জমাদার, মৃধা এবং সর্দারগণ পরিচালনা করত। যুদ্ধরত সেনাপতির মতো জমাদার ও মৃধা যুদ্ধ করার চাইতে কৌশল নির্ধারণ ও পরামর্শদানে বেশি ব্যস্ত থাকত। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ও সাহসী লোক হিসেবে লাঠিয়ালরা জমিদার এবং কাচারির নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ করত। সরকারি কোষাগারে টাকা বহন করে নেওয়ার সময় লাঠিয়াল গোমস্তাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যেত। এই কাজের বিনিময়ে জমাদার ও মৃধাগণ সাধারণত ‘চাকরাণ’ বা কাজের পরিবর্তে জমি ভোগদখল করত।
অবশ্য ভূমালিকরা আরও অতিরিক্ত অ-বৈতনিক সাধারণ লাঠিয়াল বাহিনী রাখত। জমিদারদের মধ্যে সময়ে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি যেমন নতুন জেগে ওঠা চর দখল অথবা অন্যকোন ব্যাপার, যেখানে কারও অধিকার প্রতিষ্ঠা বা অধিকার হরণ বিষয়টি জড়িত হয়ে পড়ত, সেখানে লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়ার জন্য জমাদার ও মৃধাদের ডাক আসত। অপরাধমূলক কর্মকান্ডের জন্য প্রতিপক্ষ কর্তৃক মামলা-মকদ্দমায় জড়ানো হলে নিয়োগকর্তারা সাধারণত তাদেরকে আর্থিক সহায়তা দিত।
ব্রিটিশ শাসনের প্রথম পর্যায়ে যখন উপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করেনি এবং সরকার যখন জমিদারদের পৃষ্ঠপোষক ছিল, তখন লাঠিয়াল বাহিনী প্রলয়ঙ্করী পঙ্গপালের মতো যত্রতত্র ঘুরে বেড়াত। অসহায় নিরীহ গ্রাম্য জনগোষ্ঠীকে নিপীড়ন করে তারা জীবিকা নির্বাহ করত, এমনকি সম্পদশালী হতো। জমিদারদের ন্যায় নীলকর সাহেবেরাও অবাধ্য রায়তদের দমন করার জন্য লাঠিয়াল বাহিনী রাখত। লাঠিয়ালরা ছিল বেশ গতিময় এবং বাংলার যেকোন এলাকায় ভাড়া খাটতে তারা সদা প্রস্ত্তত থাকত। ভাড়ায় খাটানোর জন্য বাকেরগঞ্জ ও ফরিদপুরের লাঠিয়ালগণ সর্বাধিক কাম্য ছিল ফলে তাদের দামও ছিল বেশ চড়া।
১৮৬০-এর দশক থেকে পুলিশ প্রশাসনের পুনর্বিন্যাসের ফলে বিরোধ মীমাংসার জন্য লাঠিয়ালদের ব্যবহার কমতে থাকে। উন্নত শাসনের জন্য বড় বড় জেলাগুলিকে ‘মহকুমা’ নামে ছোট ছোট প্রশাসনিক বিভাগে ভাগ করা হয়। ১৮৭০-এর দশকে চালু হয় চৌকিদারি বা গ্রাম্য পুলিশ ব্যবস্থা। অনেক সাবেক লাঠিয়াল সর্দার চৌকিদার নিযুক্ত হয় এবং সাফল্যের স্বাক্ষর রাখে। বিশ শতকের শুরুতে জেলা প্রশাসন সুনিয়ন্ত্রিত হওয়ায় এবং ভূমি মালিকদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার লাভ করায় লাঠিয়াল ব্যবস্থা দ্রুত বিলীন হয়ে যায়। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের ফলে শ্রেণিগতভাবে লাঠিয়ালরা বেকার হয়ে পড়ে এবং এক সময় এ দেশে বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু দূরবর্তী দুর্গম অঞ্চলে গ্রামীণ সমাজের উচ্চ শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন প্রক্রিয়ায় লাঠিয়ালদের ব্যবহার এখনও দেখা যায়।
দলগতভাবে বিনোদনমূলক লাঠিখেলা প্রদর্শন করে লাঠিয়ালরা বাংলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কিছুটা অবদান রাখে। পুণ্যাহ বা এ ধরনের সামাজিক উৎসব উপলক্ষে জমিদারের দরবারে নৈপুণ্য প্রদর্শনের জন্য তাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। ধনী কৃষকরা তাদের প্রাচুর্য ও প্রভাব প্রদর্শনের প্রয়াসে স্ব স্ব বাড়ির প্রাঙ্গণে খেলা দেখানোর জন্য লাঠিয়ালদের ডাকত। এভাবে ঊনিশ শতকে বাংলায় লাঠিখেলা এক অতি জনপ্রিয় গ্রামীণ খেলারূপে প্রতিষ্ঠা পায়। পেশাদার লাঠিয়ালদের বিলুপ্তির পর লোক-উৎসব হিসেবে লাঠিখেলাও কমেছে, কিন্তু এটা এখনও সম্পূর্ণ বিলীন হয়নি। [সিরাজুল ইসলাম]