চৌকিদার
চৌকিদার পুরনো আমলের গ্রাম পুলিশ। বর্তমানে গ্রামরক্ষী বা আনসার ভিডিপির (গ্রাম রক্ষিবাহিনীর) সঙ্গে চৌকিদার প্রতিষ্ঠানের তুলনা করা যায়। প্রাক্-ব্রিটিশ যুগেও এ প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান ছিল। তখন গ্রামের নিরাপত্তার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল গ্রাম পঞ্চায়েতের ওপর। চৌকিদার ছিল পঞ্চায়েত কর্তৃক নিয়োজিত কর্মচারী। তার ওপর একটি বা একগুচ্ছ গ্রামের পাহারার দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। আঠারো শতকের শেষের দিকে যখন পঞ্চায়েত প্রথার মর্যাদা হ্রাস করা হয় এবং জমিদারি নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ হয়, তখন চৌকিদার জমিদারের কর্মচারী হিসেবে পরিগণিত হয়। তার এলাকার নিরাপত্তা ও প্রহরা বিধানের বিনিময়ে চৌকিদারকে চাকরান জমি প্রদান করা হতো। সে জমিদারকে কোনোপ্রকার কর প্রদান ব্যতিরেকেই ওই জমি চাষাবাদ করতে পারত।
চাকরান ভূমির বিনিময়ে জমিদার কর্তৃক চৌকিদার পোষণ করার দায়িত্ব ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কর্নওয়ালিস কোড (১৭৯৩)-এর আওতায় বিলুপ্ত পঞ্চায়েত প্রথা ১৮৫৬ সালের স্থানীয় পুলিশ আইন অনুসরণে পুনর্জীবিত করার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পঞ্চায়েতের সদস্যদের মনোনয়ন দান এবং চৌকিদারদের নিয়োগ প্রদানের ক্ষমতা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের ওপর অর্পণ করা হয়। চৌকিদারদের ব্যয় নির্বাহের জন্য এ আইনের অধীনে কর আরোপ করার বিধান করা হয়েছিল। ১৮৭০ সাল পর্যন্ত চৌকিদারি প্রথা শহর এলাকা ও বড় বড় গ্রামে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৮৭০ সালের আইন ৬ (বিসি)-এর অধীনে চৌকিদারি প্রথা পুনর্গঠিত হয় এবং বাংলার সকল গ্রামে তা সম্প্রসারণ করা হয়। তারপর চৌকিদারের ওপর জমিদারদের নিয়ন্ত্রণ বিলুপ্ত হয়। তাকে আর জমিদারি চাকরান অনুদানে পোষণ করা হতো না। তখন থেকে চৌকিদার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট থেকে নিয়মিত বেতন পেতে শুরু করে এবং পালাক্রমে জেলা প্রশাসক গ্রাম পঞ্চায়েতের মাধ্যমে জনসাধারণের ওপর চৌকিদারি কর আরোপ করতে শুরু করে।
১৮৮০-এর দশকে পল্লী অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে শুরু করে। কৃষকদের মধ্যে উত্তেজনা ছাড়াও সাধারণ অপরাধও বাড়তে থাকে। বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য ১৮৯২ সালের আইন ১ (বিসি)-এর মাধ্যমে ১৮৭০ সালের চৌকিদারি আইন সংশোধন করা হয়। চৌকিদারদের সামাজিক মর্যাদা উন্নীত করাই ছিল এ আইনের লক্ষ্য। সমাজের নিম্নস্তরের লোকদের থেকে চৌকিদার নিয়োগ দেয়া হতো বলে সমাজে তার কোনো মর্যাদাও ছিল না। ফলে অপরাধকারীরা তার উপস্থিতির কোনো গুরুত্বই দিত না। প্রকৃতপক্ষে তখন তাকে জমিদার এবং পঞ্চায়েতের কায়িক শ্রমিক ও ব্যক্তিগত ভৃত্য হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এজন্য সমাজের মধ্যস্তর থেকে চৌকিদার নিয়োগের জন্য চৌকিদারি ট্যাক্স বৃদ্ধি করা হয় এবং তাদের বেতনও বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু এ কার্যক্রম চৌকিদারদের চিরাচরিত মর্যাদায় পরিবর্তন সাধনে কোনো ভূমিকা রাখে নি।
চৌকিদারি ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য অর্থসংস্থান এবং সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের চৌকিদারি কাজ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে চৌকিদারি গ্রাম তহবিল নামে একটি তহবিল গঠন করতে হতো। ১৮৯২ সালের আইনের অধীনে বিভাগীয় কমিশনারের অনুমোদন নিয়ে জেলা প্রশাসক তার সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষমতা মহকুমার দায়িত্বে নিয়োজিত তার অধীনস্থ কোনো প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট অথবা জেলা পুলিশ সুপারের নিকট হস্তান্তর করতে পারতেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত ভৃত্য হিসেবে চৌকিদারদের ব্যবহার করাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
গ্রাম পাহারা দেওয়ার কাজ ছাড়াও একজন চৌকিদারকে আরও কিছু কাজ করতে হতো। ১৮৭০-এর দশক থেকে বিভিন্ন ধরনের কয়েক দফা পরিসংখ্যান তৈরির প্রচলন করা হয়, যেমন, ফসলের পরিসংখ্যান, জন্ম ও মৃত্যুর হিসাব সংগ্রহ, অপরাধ প্রবণতা, জিনিসপত্রের বাজার দর পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি। একজন চৌকিদারকে তার দায়িত্বাধীন গ্রাম বা গ্রামসমূহের এসকল বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন পেশ করতে হতো। কিন্তু প্রতিবেদন প্রদানে কোনো সময়েই সে নির্ভরশীলতার পরিচয় দিতে পারে নি। কারণ, অনুমান ও শোনা কথাই ছিল তার তথ্য সংগ্রহের উৎস। ১৮৯২ সালে পুনর্গঠিত চৌকিদারি প্রতিষ্ঠান উপনিবেশিক শাসন আমলের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে।
পূর্ব পাকিস্তানে মুখ্যত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ইউনিয়ন কাউন্সিলকে সহায়তা করার জন্য চৌকিদারদের স্থানীয় সরকার সংস্থার অধীনে ন্যস্ত করা হয়। চৌকিদারি প্রথাকে পুনর্গঠিত করার উদ্দেশ্যে বহু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়; কিন্তু তাদের অধিকাংশই অকার্যকর প্রমাণিত হয়। কোনো সুপরিকল্পিত স্থানীয় সরকার পদ্ধতির সঙ্গে এ প্রথাকে একীভূত করা সম্ভব হয় নি। ১৯৭৬ সালে সরকার পরিকল্পিত গ্রাম সরকার পদ্ধতির অংশ হিসেবে পল্লী অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি বা গ্রাম রক্ষীদল গঠন করেন। গ্রাম সরকার পদ্ধতি কখনও প্রবর্তন করা সম্ভব হয় নি। এখনও চৌকিদারগণ ইউনিয়ন কাউন্সিলের অধীনে থেকে কাজ করে যাচ্ছে এবং তাদের মাসিক বেতন স্থানীয়ভাবে আদায়কৃত অর্থ থেকে পরিশোধ করা হচ্ছে। [এনামুল হক]