রাজবল্লভ

রাজবল্লভ, রাজা  বাংলার দীউয়ান ও মুঙ্গেরের ফৌজদার। জাতিতে একজন বৈদ্য। তিনি ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে কানুনগো বিভাগে একজন মুহাররির (কোষাধ্যক্ষ) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ঐ ক্ষুদ্র সরকারি অবস্থান থেকে তিনি মুগলদের অধীনে চাকরিতে দ্রুত উন্নতিসাধন করে মহারাজা খেতাব পেয়ে ঢাকার দীউয়ান হন (১৭৫৬-৫৭)। পরবর্তীকালে তিনি মুঙ্গের-এর ফৌজদারের পদ লাভ করেন। তাঁর পিতা কৃষ্ণজীবনও নওয়ারা মহলের (নৌ-বিভাগ) একজন মুহাররির এবং পরবর্তীকালে একজন মজুমদার ছিলেন।

একজন উচ্চাভিলাষী মানুষ মহারাজা রাজবল্লভ তাঁর সরকারি অবস্থান এবং সম্পদ ব্যবহার করে ভূ-সম্পত্তি অর্জন করেন। বিত্ত-বৈভবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা সমকালীন সমাজে শ্রদ্ধালাভের উপযুক্ততার সুউচ্চ প্রতীক বলে বিবেচিত হতো। ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল এবং ত্রিপুরা হতে ভূসম্পত্তি দখল করে তিনি রাজনগর নামে নতুন পরগনা গঠন করেন এবং ক্রমান্বয়ে সম্ভবত অবৈধ উপায়ে বিক্রমপুর জমিদারির বৃহদংশ সংযুক্ত করে তাঁর জমিদারির আয়তন বৃদ্ধি করেন। শীঘ্রই রাজবল্লভ ঢাকা, ফরিদপুর এবং বিশেষ করে বরিশাল অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ক্ষুদ্র তালকুদারের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

এরূপ সুউচ্চ অবস্থান থেকে ১৭৫৬-৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকালে রাজবল্লভ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হন। মীরজাফর আলী খান এবং ঘসেটি বেগমের একজন অনুষঙ্গী রাজবল্লভ ঢাকার দীউয়ান পদে নিয়োজিত থাকাকালে বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার মনে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর প্ররোচনায় পুত্র কৃষ্ণদাস আত্মসাৎকৃত অর্থসহ কলকাতায় পালিয়ে যায় এবং ইংরেজদের আশ্রয় গ্রহণ করে। বিষয়টি পরবর্তীকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সিরাজের সশস্ত্র সংঘর্ষের একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নওয়াব মীর কাসিম ইংরেজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সন্দেহ করে তাকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করেন (১৭৬৩)।

জমিদার হিসেবে রাজবল্লভের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত না হলেও রাজনগরকে প্রশাসনের কেন্দ্র করার তাঁর প্রয়াস প্রমাণ করে যে, তিনি সমকালীন বনেদি জমিদারদের বিলাসবহুল জীবনপ্রণালী থেকে পিছিয়ে ছিলেন না। রাজা রাজবল্লভের রাজনগর শুধু সমকালীন কারিগরদের স্থাপত্যশৈলীর দক্ষতাই প্রদর্শন করে না, এর পৃষ্ঠপোষকের রুচি এবং অর্থনৈতিক প্রাচুর্যও ফুটিয়ে তোলে।  [শিরিন আখতার]